ফিরে দেখা ...১/১১; ইয়াজউদ্দিনকে ব্ল্যাকমেইল করে কাজ করানো হত


সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমদকে বারবার ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছিল। কোনো কাজ না করতে চাইলে স্ত্রী ও ছেলের দুর্নীতির কথা বলে ব্ল্যাকমেইল করা হতো। ওয়ান ইলেভেনের সময়ে তিনি প্রথমে জরুরি অবস্থা জারি করতে চাননি। জরুরি অবস্থা জারির আগে তিন বাহিনী প্রধানদের বসিয়ে রেখেই একটু সময় চেয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু সে সময় তাকে দেওয়া হয়নি। যারা জরুরি অবস্থা জারি করানোর জন্য বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন তারা এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করতে চাননি। জানতেন, সময় নষ্ট করলে তাদের জন্যও ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এ কারণে তারা বঙ্গভবনে যাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব ইয়াজউদ্দিনকে জরুরি অবস্থা জারি করাতে বাধ্য করেন। একপর্যায়ে তাকে ভয়ও দেখানো হয়।
ওই ভয়ে পরে তিনি জরুরি অবস্থা জারি করা, জাতির উদ্দেশে তাদের তৈরি করে আনা ভাষণ দেওয়া, প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করাসহ সব কাজ করেছিলেন। মূলত তার দুর্বলতা, সাহসের অভাবে আর নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদে টিকিয়ে রাখার লোভেই তাদের সব কথা ওইদিন মেনে নেন। কোনো জোরালো আপত্তি তার তরফ থেকে ছিল না। তিনি সেদিন বেঁকে বসলে অন্য ঘটনা ঘটতে পারত, এটা তিনি নিজেও জানেন। অন্যরা জানেন। কিন্তু কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি ইয়াজউদ্দিন। এরপরও তিনি দু-একবার মাঝেমধ্যে নিজেকে সাহসী হিসেবে দেখানোর বৃথা চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি।

সূত্র জানায়, ইয়াজউদ্দিন আহমেদের কাছে কোনো কাগজ স্বাক্ষর করাতে নিয়ে গেলে তিনি প্রথমে করতে চাইতেন না। এরপর বাধ্য হয়ে রাজি হতেন। কারণ, তার কাছে যারা ফাইল ও কেনো অর্ডার স্বাক্ষর করাতে নিয়ে যেতেন, সেটা তৈরি করে নিয়ে যাওয়া হতো এজন্য রুটিন কাজের বাইরে তার দপ্তরে তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। ক্ষমতাশালী কর্মকর্তারা তার কাছে যেতেন। বলতেন, স্যার সাইন করে দিন। আর তাকে দিয়ে যেসব কাগজ সাইন করানো হতো এর বেশির ভাগই তিনি আগে জানতেন না। উপস্থিত মতো স্বাক্ষর করানো হতো।

সূত্র জানায়, ইয়াজউদ্দিন কোনো কাগজে স্বাক্ষর করতে না চাইলে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হতো। বলা হতো, স্যার আপনার স্ত্রী ও ছেলের দুর্নীতি প্রকাশ করে দেব। আপনার স্ত্রী ও ছেলে যে দুর্নীতি করেছে তাতে স্যার, তাদের কয়েক বছর করে শাস্তি হবে। তখন আপনার খুব কষ্ট হবে। আপনার কষ্ট হোক তা চাই না। আপনার স্ত্রী ও ছেলে জমি দখল থেকে শুরু করে আপনার নাম ভাঙিয়ে অনেক কিছুই করেছেন। এখন যদি আপনি কথামতো কাজ না করেন তাহলে দুদকও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। সেটা কি আপনার জন্য ভালো হবে। ইয়াজউদ্দিন তাদের কথা শুনে ভয় পেতেন। স্ত্রী, ছেলে কারাগারে যাবে এটা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ইয়াজউদ্দিন নিজে তেমন কোনো বড় ধরনের দুর্নীতি না করলেও তার স্ত্রী ও ছেলের বড় বড় দুর্নীতির নথিপত্র সব জোগাড় করা হয়েছিল ওয়ান ইলেভেনের আগেই। কারণ, ওটা ছিল অস্ত্র, ইয়াজউদ্দিনকে ভয় দেখানোর জন্য। কারণ, কোনো কারণে ইয়াজউদ্দিন রাজি না হলে তার স্ত্রী, ছেলেকেও গ্রেপ্তার করা হতো। 

এক কর্মকর্তা বঙ্গভবনের একজন কর্মকর্তার মারফত খবর পাঠাতেন, স্যার, আপনার ছেলে রাতেরবেলা বঙ্গভবনে ঢুলতে ঢুলতে ঢোকেÑ এটা সবাই জানে। এর ছবিও তাদের কাছে আছে। আপনি প্রেসিডেন্ট আর আপনার ছেলে ওই অবস্থায় বঙ্গভবনে হেঁটে হেঁটে ঢুকবেÑ এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। এটা ওয়ান ইলেভেনের নায়করা কেউ ভালোভাবে নেয়নি। ছেলের কারণে ইয়াজউদ্দিন খুব ভয় পেতেন। তিনি চাইতেন না ছেলে ও স্ত্রীর কোনো গোপন খবর প্রকাশ পাক। সূত্র জানায়, তার স্ত্রী ও পুত্রের নামে প্রচুর ধনসম্পদ ও টাকা-পয়সা রয়েছে। অবৈধ ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদও রয়েছে। এসব কারণে ইয়াজউদ্দিনকে যখন ওইসব কথা বলতেন তিনি বিচলিত হয়ে যেতেন। তাই তারা যা বলতেন মেনে নিতেন। 

সূত্র জানায়, দুই নেত্রীকে মাইনাস করা, গ্রেপ্তার করার ব্যাপারে তার কাছে কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। এমনকি দুই বছর পর্যন্ত ওই সরকারের মেয়াদ করা হবে তার জন্যও অনুমতি নেওয়া হয়নি। এছাড়া অনেক কিছ্ইু তার নির্দেশে হতো না। বেশির ভাগই জানা সম্ভব ছিল না। 

সূত্র জানায়, ওয়ান ইলেভেনের পর ইয়াজউদ্দিনের দিনগুলো কেটেছে ভীষণ বিভীষিকার মধ্যে। তিনি প্রতিরাতে একাকী যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। ভয় পেতেন। ভয়ের কারণে কয়েকবার অসুস্থ হয়ে যান। তবে ভয় পেলেও তিনি একবারের জন্যও ক্ষমতা ছাড়তে চাননি। তিনি চেয়েছেন, যেকোনোভাবেই হোক ক্ষমতা ছাড়বেন না। তাকে ক্ষমতায় থাকেতেই হবে। এ কারণে প্রয়োজনে হাতে-পায়ে ধরে হলেও থাবেন। এ ব্যাপারে তিনি তার ঘনিষ্ঠ একজনকে বলেন, এখন সব মেনে নিচ্ছি, না নিয়ে উপায় নেই। তবে আমি এখন অত কিছু চাই না। আমি একটাই চাই, তা হচ্ছেÑ মরতে চাই না। না মরলে ক্ষমতায় থাকতে পারব। প্রেসিডেন্টও থাকতে পারব। তবে তিনি এও জানতেন, তাকে পদ ছাড়তে হতে পারে। সারাদেশে যখন খবর ছড়িয়ে যায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নতুন একজনের নাম। তিনি প্রেসিডেন্ট হতে চান। এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। তখন ইয়াজউদ্দিন বোঝেন, এবার বোধ হয় তাকে পদ ছাড়তেই হবে। মানসিকভাবে প্রস্তুতিও নেন। 

সূত্র জানায়, ওয়ান ইলেভেনের পেছনের একজনের নাম যখন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে সামনে চলে আসে, কীভাবে প্রেসিডেন্ট হবেন, কী করা হবে। তখন ইয়াজউদ্দিনকে একজন বলেন, স্যার আপনাকে পদ ছাড়তে হবে। ইয়াজউদ্দিন তাকে বলেন, আমি তা ছাড়তে চাই না। আমার অপরাধ কী। তোমরা যা বলছ। আমি তো তাই করে দিচ্ছি। তাহলে আমাকে সরাবে কেন। আমাকে না সরিয়ে তোমরা কাজ করো। সমস্যা হবে না। 

ক্ষমতায় থাকার জন্য আশ্বাস দিলেও তার পদে থাকা কঠিন হয়ে যায়। তাকে সরানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সিদ্ধান্ত হয় ওই পদ থেকে তাকে জোরপূর্বক নয়, জেন্টেলমেন্ট এগ্রিমেন্টে পদত্যাগ করানো হবে। কাগজে-কলমে দেখানো হবে তিনি অসুস্থ, এ কারণে তার পক্ষে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। দায়িত্ব দেবেন ওয়ান ইলেভেনের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। 

সূত্র জানায়, ইয়াজউদ্দিন এসব কথার কিছু কিছু জানার পর তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পরেন। তাকে হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়। অসুস্থ হলেও ক্ষমতা ছাড়তে চাননি। তার ইচ্ছে ছিল, বেগম খালেদা জিয়ার দয়ায় ও বদান্যতায় তিনি ওই পদে বসেছেন, তার জন্য কিছুই করতে পারবেন না, এটা হয় না। তার ধারণা ছিল বেগম খালেদা জিয়াই আবার ক্ষমতায় আসবেন। আর তিনি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের শপথ পড়াবেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। তিনি তার ঘনিষ্ঠ একজনকে বলেছেন, ম্যাডাম খালেদা জিয়া আমার জন্য এত কিছু করেছেন। তার জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না। এ আফসোসটাই আমাকে তাড়া করে বেড়াত। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। ইয়াজউদ্দিন বেগম খালেদা জিয়ার জন্য কাজ করবেন এমন আশা করেই যখন বিচারপতি কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজি হলেন না তখন সামনে অন্য আরও চারটি অপশন থাকার পরও শেষ অপশনটি বেছে নেওয়া হলো। প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। তার ওই পদে আসীন হওয়াটা বিএনপি ছাড়া আর কেউ মানতে পারেননি। বেগম খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন তিনি ক্ষমতায় আসার সব পরিকল্পনা সফল করে ফেলেছেন। তখনও তিন জানতেন না তার জন্য কত বড় বিপদ ও ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে। তিনি যাদেন জন্য করেছেন, তাদের সবাই তার সঙ্গে প্রতারণা করবেন। তাকে কারাগারে নিয়ে যাবেন। তার ছেলেদের ওপর অমানসিক নির্যাতন করবে। নির্বাচনেও পরাজিত হবেন। 

ইয়াজউদ্দিন মেয়াদ শেষে যখন নতুন প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নেন এরপর গুলশানের বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে একাকী জীবন যাপন করতে হয়েছে। বারবার চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন । ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া তার খবরও নেননি। এছাড়া কেউ তার খবর রাখে না অনেকটাই একাকী জীবন পার করছেন। অনুশোচনা তাকে তাড়া করে বেড়ায়।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন