আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর দুই জেনারেল ছাড়া সবাই বলেছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব তাদরেকে ছেড়ে দিতে হবে। না হলে আমরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেব। আর তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষনায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন পেছনে থাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি। কারণ ওই সময়ে আর এ নিয়ে কোনো সমঝোতায় যাওয়ার সুযোগ ছিল না। জেনারেলদের চাপ ছাড়াও দুই নেত্রীকে ছেড়ে দিতে দেশ বিদেশ থেকে চাপ আসতে থাকে। ওয়ান ইলেভেনের সময় বিদেশি যারা সমর্থন দিয়েছিলেন তারাও অবস্থান বদল করেন। তারা বুঝতে পারেন, যে লক্ষ্য নিয়ে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তা পূরণ হচ্ছে না। ফলে আস্তে আস্তে তারা সরে যেতে থাকেন। দেশের প্রেক্ষাপটও বদলে যায়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকেনি।
সূত্র জানায়, এসময় সব জেনারেলের একটি বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকে জেনারেলরা তাদের বড় স্যারকে বলেন, দুই নেত্রীকে ছেড়ে দিতে হবে। না হলে সমস্যা হবে। কারণ দুই নেত্রীকে মাইনাস করার ঘটনায় পুরো বাহিনী নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, যা আমাদের জন্য শুভ নয়। এখন তাদেরকে মাইনাস করার পরিবর্তে প্লাস করার চিন্তা করতে হবে। তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন দিতে হবে।
সূত্র জানায়, ওয়ান ইলেভেনের পেছনের শক্তির মধ্যে দূরত্ব বেড়ে বিভেদ চলতে থাকায় পরে আর সম্ভব ছিল না এক সঙ্গে কাজ করা। কারণ যারা এক সময়ে কোর কমিটিতে ছিলেন তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। দুইপক্ষে দুইজন নেতৃত্ব দেন। একজন চেষ্টা করেন যাতে শেষ পর্যন্ত সমাপ্তি টানতে পারেন। তার উদ্দেশ্য ছিল লক্ষ্যে পৌঁছুতে না পারলেও অন্তত নিরাপদে সম্মানজনকভাবে বেরিয়ে যাওয়া। ভবিষ্যতে যেন কোনো সমস্যা না হয়। অন্যদিকে আরেকটি গ্র“পের যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি চাইছিলেন তার স্বার্থ হাসিল করতে। যে কারণে অপর গ্র“পকে আর সগযোগিতা করছিলেন না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। তখন ইউটার্ন ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদেরকে ইউটার্ন নিতে হয়। আবার ফিরে আসতে হয় হাসিনা-খালেদার কাছেই। তখন চিন্তা করা হয় নিরাপদে বের হয়ে যেতে চাইলে হাসিনা-খালেদাকে মাইনাস নয়, প্লাস করেই এগুতে হবে। যিনি মাইনাস করার জন্য মূল ভূমিকা পালন করেন, ইউটার্নের পর তাদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য ওই একই কর্মকর্তাই দায়িত্ব পালন করেন। ওই কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় এই নির্দেশনা দিয়ে যে তাদেরকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। এই জন্য তাদেরকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। শর্ত দেওয়া হয়, ক্ষমতায় গেলে এই সরকারের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যাবে না। প্রয়োজন হলে তাদেরকে বিদেশে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই জন্য যাবতীয় খরচও সরকার থেকে দিতে হবে। সেই সঙ্গে যে দল সরকারে যাবে সেই দলের কোনো নেতাও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। কেউ যাতে মামলা করতে না পারেন সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। নির্বাচনে তাদের পছন্দমতো প্রার্থী দিতে হবে। এই জন্য তালিকাও দেওয়া হবে। নমিনেশন জমা পড়ার পর বিচার বিশ্লেষণ করে অপেক্ষাকৃত সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়া হবে। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন এমন কাউকে নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া চলবে না। দুর্নীতিবাজের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।
নির্বাচন নিয়ে দুই নেত্রীর সঙ্গেই চেষ্টা চলতে থাকে সমঝোতার। এরই অংশ হিসেবে ওই কর্মকর্তা পহেলা বৈশাখে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে দুই নেত্রীর জন্য মিষ্টি, ফুল, শাড়ি ও বাসায় রান্না করা খাবার নিয়ে যান। এক নেত্রী নববর্ষের শুভেচ্ছা গ্রহণ করে সব খাবার রাখেন। কিন্তু অন্য নেত্রী সব ফেরত দেন। তাকে বলে দেন তোমার কোনো কিছুই আমি রাখবো না, খাব না। সব ফেরত নিয়ে যাও। ওই নেত্রী কোনোভাবেই ওই কর্মকর্তার সমঝোতা প্রস্তাব মেনে নিচ্ছিলেন না। কারণ, তার পরিবারের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, যেভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এটা তিনি ভুলতে পারছেন না। তাদেরকে কোনো দিনই ক্ষমা করতে পারবেন না। কিন্তু ওই কর্মকর্তা চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। নেত্রী একদিন ওই কর্মকর্তার উপর ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে উত্তেজনাও প্রকাশ করেন। তিনি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন ওই নেত্রীর সঙ্গে সমঝোতা করতে কিন্তু পারেননি। তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
সূত্র জানায়, সমঝোতা অনুযায়ী অসৎ, দুর্নীতিবাজের তালিকায় নাম এসেছে এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না এমন সিদ্ধান্ত নিলেও পরে তাতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কেউই অটল থাকতে পারেনি। এলাকা, আসন ও রাজনৈতিক বিষয় বিবেচনা করে অনেককেই প্রার্থী করতে হয়েছে। ওই কর্মকর্তা নির্বাচনের আগে দুইবার সারাদেশ সফর করেন। সেখানে কোন কোন আসনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কী অবস্থা, কোন আসন কোন দল পেতে পারে, প্রশাসনের অবস্থা কী, প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর জন্য কী কী করতে হবে, এসব কিছু দেখাশোনা করেন এবং ঢাকায় ফিরে রিপোর্ট তৈরি করে উপরে পাঠান। সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় তিনি বাকি কাজ ঢাকায় বসেই করেন।
নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসে ততই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। দেশ যখন আবার দুই নেত্রীকেই চাইছে, তখন সিদ্ধান্ত হয় সেনাপ্রধানের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর। প্রথমে দুই বছর বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু একসঙ্গে দুইবছর বাড়ানোর নিয়ম না থাকায় এক বছর বাড়ানো হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে দিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর কাগজে স্বাক্ষর করানো হয়। পরে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় সেনাপ্রধানের মেয়াদবৃদ্ধি করা হয়েছে মর্মে। ওই মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সেখানে গিয়েছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা। সঙ্গে ছিলেন প্রতিরক্ষা সচিব এবং একজন যুগ্ম সচিব।
সূত্র জানায়, ওই সময়ে সেনাপ্রধানের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি মনে করেছিলেন চাকরির মেয়াদ না বাড়িয়ে ওই অবস্থায় চলে গেলে সমস্যা হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কাজ শেষ করাও কঠিন হবে। তারা নিরাপদে বের হতে পারবেন না। তবে তার মেয়াদ না বাড়ানো হলে আরো একজন দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেও পারেননি। তিনি নিজে ওই পদে বসার চেষ্টা করার বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যায়। এ কারণে তার চাকরি সেনাবাহিনী থেকে অন্যত্র নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত নানা বাধা পেরিয়ে একটি সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন