ফিরে দেখা ...১/১১; ম্যাডাম বিদেশ যাওয়ার ৬ মাসের মধ্যে তারেককেও পাঠানো হবে



ওয়ান ইলেভেনপরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মাইনাস টু ফর্মুলা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়াকে দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘ম্যাডাম আগে বিদেশে যাবেন, ছয় মাসের মধ্যে মেডিকেল গ্রাউন্ডে তারেক রহমানকে কারাগার থেকে বিদেশে পাঠানো হবে। কোকোকে পাঠানো হবে আরো পরে। আপনার পরিবারের কারো কোনো সমস্যা হবে না। আপনি আপনার সঙ্গে যাদেরকে নিতে চান নিতে পারবেন। এমনকি তারেক রহমানের স্ত্রী, কন্যা, কোকোর স্ত্রী কন্যাকেও নিয়ে যেতে পারেন।’ তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের নির্দেশে ওই সময়ে ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমি খালেদা জিয়ার বাসায় এই প্রস্তাব নিয়ে যান। এ নিয়ে তিনি বার বার তার সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। 


মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমি যে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছেন এবং বেগম খালেদা জিয়ার কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেছেন, সেই কথা তিনি নিজেই গত রোববার আদালতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাক্ষ্য দেওয়ার সময় স্বীকার করেছেন। তিনি নিজেই কোর্টের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, ওই সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের নির্দেশে তিনি সেখানে যান। 

বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, ওয়ান ইলেভেনের ঘটার আগেই পরিকল্পনাকারী পরিকল্পনা করেন, জরুরি অবস্থা জারি করে ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙ্গে দিয়ে নতুন সরকার গঠন করতে পারলেই তারা দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের জন্য কাজ করবেন। এই জন্য দুই নেত্রীকে তারা বাধা মনে করেছিলেন। এই কারণে কীভাবে তাদের মাইনাস করা যায় সেই ছকও আঁকা হয়। এরই অংশ হিসেবে ওয়ান ইলেভেনের মূল পরিকল্পনাকারী ও কোর কমিটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে কৌশলে রাজনীতি থেকে মাইনাস করবেন। তারা নতুন কাউকে ক্ষমতায় আনবেন। ওয়ান ইলেভেনের ঘটনার পর কোর কমিটির সদস্যরা উদ্যোগ নেন দুই নেত্রীকে মাইনাস করার জন্য। তাদের সামনে দুটি পয়েন্ট ছিল। একটি হচ্ছেÑ তাদের দুজনকে স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসরে পাঠানো। আর তারা রাজি না হলে তাদেরকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানো। তারা যতদিন ক্ষমতার পেছনে থাকবেন ততদিন আর দেশে ফিরে আসতে পারবেন না। ক্ষমতায় নতুন সরকার বসানোর পরপরই কোর কমিটি তাদের সেই সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীনকে দিয়ে বাস্তবায়ন করাতেন। ওই কমিটির সদস্যরা বুঝে যান কোনোভাবেই দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করা সম্ভব নয়। তারা পদত্যাগও করবেন না। কোনোভাবেই তাদের অবসরে পাঠানো সম্ভব নয়। যে কারণে তারা দ্বিতীয় অপশনটি বেছে নেন। এরই অংশ হিসেবে তারা দুই নেত্রীকে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। 

সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়ার কাছে প্রস্তাব নিয়ে কাকে পাঠানো হবে এ নিয়ে বেশ দোটানায় পড়তে হয় জেনারেল মইনসহ অন্যদের। কারণ ওই সময়ে যারা ঊর্ধ্বতন ও শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন সবাই বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই সেখানে বসেছেন। এ কারণে কেউ প্রকাশ্যে তার সঙ্গে বেঈমানি করার সাহস দেখাতে পারেননি। বেগম খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ট কর্মকর্তা ছিলেন জেনারেল রুমি। তিনি ছিলেন ডিজিএফআইয়ের প্রধান। তিনি বেগম খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত ছিলেন। এই কারণে তাকে পছন্দ করেন জেনারেল মইনসহ কোর কমিটির সদস্যরা। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করেই তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর অপারেশন সফল করার জন্য। প্রথমে মেজর জেনারেল রুমি বেগম খালেদা জিয়ার কাছে ওই প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্ধে ছিলেন। কিন্তু তার সামনে কোনো সুযোগ ছিল না বেগম খালেদা জিয়ার কাছে না যাওয়ার। কারণ তার চাকরি বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাকে যেতেই হবে। এর কারণ হচ্ছে সেনাবাহিনীর প্রধান যা বলবেন তার অধস্তন কর্মকর্তাকে সেই নির্দেশ পালন করতেই হবে। 

সূত্র জানায়, মেজর জেনারেল রুমিকে পাঠানোর পেছনের কারণ ছিল তিনি গেলে বেগম খালেদা জিয়া তাকে বের করে দেবেন না। তিনি কেন গেছেন সেটা শুনবেন এবং তার দেওয়া প্রস্তাবের সবদিক বিবেচনা করবেন। এই কারণেই তাকে ব্যবহার করা হয়। সূত্র জানায়, রুমি বেগম খালেদা জিয়ার কাছে যাওয়া নিয়ে ইতস্তত করলেও তার সামনে কোনো উপায় ছিল না। তাই তিনি একবার নয়, বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার জন্য বেশ কয়েকবার তার ক্যান্টনমেন্টে মইনুল রোডের বাড়িতে যান। সেখানে তার সঙ্গে বৈঠক করেন। বেগম খালেদা জিয়া প্রথমেই তার মুখ থেকে বিদেশ যাওয়ার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন। পরে মেজর জেনারেল রুমি তাকে সব ঘটনা খুলে বলেন। তিনি দেশে থাকলে সমস্যা হবে, বিদেশে চলে যাওয়াই ভাল বলে তাকে জানান। এর ইতিবাচক নেতিবাচক সব দিকও বলেন। বেগম খালেদা জিয়া তার কাছে জানতে চান, তার দোষ কোথায়, তাকে কেন বিদেশে পাঠানো হবে, এর জবাবে বেগম খালেদা জিয়াকে জানানো হয়েছে, তিনি দেশে থাকেন এটা কেউ চাইছেন না। তারা চাইছেন তিনি বিদেশ চলে যাবেন। বিদেশে যেতে রাজি হলে সব ব্যবস্থাই তারা করবেন। এই জন্য ডিজিএফআইর পক্ষ থেকে বিদেশে ভিসার জন্য সব ব্যবস্থা করা হবে। তিনি কেবল ভিসার আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করে দিলেই হবে। বিদেশ তিনি কোথায় থাকবেন, ওই সময়ে তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও তারা নিশ্চত করবেন। তিনি বিদেশে গেলে তার কোনো সমস্যা হবে না। আর না গেলে অনেক রকম সমস্যা হবে। 

বেগম খালেদা জিয়া প্রথম দিনে তার কথা কেবল শুনেছেন। কোনো মতামত দেননি। রুমি প্রথম দফায় তাকে বিদেশ যেতে রাজি করাতে ফেল করেন। তাকে আবারও পাঠানো হয় বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। তিনি তাকে রাজি করানোর জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও রাজি হননি খালেদা। সূত্র জানায়, মেজর জেনারেল রুমীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যে কোনো শর্তেই তিনি যাতে বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে রাজি করাতে সক্ষম হন। তিনি চেষ্টা অব্যাহতও রাখেন। কয়েকদফা আলোচনার পর বেগম খালেদা জিয়া তার কাছে জানতে চান, তারা তাকে কোন দেশে পাঠাতে চান। রুমি তাকে কয়েকটি দেশের নাম বলেন। তাকে ওইসব দেশ থেকে তার পছন্দের দেশ বেছে নিতে বলেন। তাকে বলা হয়, ম্যাডাম আপনি যে দেশে যেতে চাইবেন, সেখানেই পাঠানো হবে।

সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়া তার কাছে জানতে চেয়েছেন তাকে কত দিনের জন্য বিদেশে যেতে হবে। নির্দিষ্ট কোনো সময় জানাননি রুমী। কেবল বলেছেন সময়টি দীর্ঘই হবে। তিনি বিদেশে গেলে তার ছেলেদের কি হবে, জানতে চাইলে তাকে জানানো হয়, তারেক রহমানকে ছয়মাস পর বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে। এ ব্যাপারে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা তারা করে দিবেন। সূত্র জানায়, তাদের আশঙ্কা ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন বিদেশে গেলেও তারেক রহমানকে দেশে রাখা তাদের জন্য বিপদ হতে পারে। এই চিন্তা করে তারা তাকেও বিদেশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। ওয়ান ইলভেনের নায়করা পরিকল্পনার সময়ই ঠিক করেন তারা কমপক্ষে দুই বছর ক্ষমতায় থাকবেন। তা আরো বেশিও হতে পারে। তাদের পরিকল্পনা ছিল, বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বিদেশে পাঠাতে পারলে তারা ক্ষমতাও নিতে পারবেন। এই জন্য তারা বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। তিনি আলোচনা করতে থাকেন। 

সূত্র জানায়, ওয়ান ইলেভেনের নায়করা দুই নেত্রীকে বিদেশে পাঠানোর মাধ্যমে সেইফ সাইডে থাকার জন্যই এই উদ্যোগ নেন। এ কারণে তারা তাদের কাছে এমন কোনো প্রস্তাব প্রথমে দেননি যে তাদেরকে দেশ থেকে বিদেশে চলে যাওয়ার সময় দলের প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে কিংবা অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে যেতে হবে। সংশ্লিষ্টরা জানতেন দল থেকে পদত্যাগ করতে তারা কোনোভাবেই রাজি হবেন না। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছিল ততই পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। প্রথমে বিষয়টি অনেক গোপনেই নাড়াচাড়া হতো। পরে আর তা গোপন থাকেনি। একইসঙ্গে রাজনীতি থেকে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার ফর্মুলা কার্যকর করার বিরোধিতা করে আসছিল কয়েকটি দেশ। দেশের একটি গ্র“পও এই ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠে। তারাও চায়নি বেগম খালেদা জিয়া বিদেশ যান। যে কারণে তারাও খালেদার কাছে দেওয়া প্রস্তাবিত দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন