১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছিলো ইয়াহিয়া খানের জন্য একটি বিশেষ দিন। এদিন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দু’বছর পুরো হয় তার। সেদিনের রাতটা তিনি উদযাপন করেছিলেন বাঙালীদের উপর তার খুনে বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে।১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ছিলো ভুট্টোর জন্য তেমনি এক বিশেষ দিন, পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধন করার পর সেদিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দুবছর পূর্তি। সে রাতটা কিভাবে উদযাপন করেছেন তার বর্ণনা আমরা পাবো পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোডের তারবার্তায়।
তার আগে চলুন আরেকটু এগিয়ে যাওয়া যাক। সময়কাল ১৯৭৬ সালের ৯ আগস্ট। লাহোরের গভর্ণর হাউজ। পাকিস্তানে এক সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছেন মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার। দ্বিপাক্ষিক এ আলোচনায় আরো অনেকেই উপস্থিত। উপমহাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বয়ান দিচ্ছেন ভুট্টো। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দুজনের কথোপকথনের ভাবানুবাদটা তুলে দিচ্ছি :
ভুট্টো :…বাংলাদেশের কথা যদি বলি, আমরা আবার আগের মতো হয়ে গেছি। আমাদের সম্পর্ক এখন চমৎকার। তারা আমাদের এখানে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে আর প্রায় সব খাতেই আমাদের সহায়তা চাইছে। আমাদের কাছে সামরিক সহায়তাও চেয়েছে। আমরা বলেছি, আমাদের নিজেদের সামর্থ্যই তো যথেষ্ট নয়, দ্বিতীয়ত তাদের চিন্তামুক্ত করার মতো যথেষ্ট সাহায্য আমরা কিভাবে পাঠাবো? ওরা খুবই স্পর্শকাতর ধরণের মানুষ, ভারতের সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। যদি ওখানে সত্যিই একটা স্থিতিশীল অবস্থা ওদের কাম্য হয় আর ওরা যদি সত্যিই পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চায় তাহলে আমাদের একটা প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আমি বলছি না যে আমাদের অতীতের মতো হয়ে যেতে হবে।
কিসিঞ্জার : তেমন কিছু যদি করতে চান, তাহলে ’৮১ সালের পর করবেন, আবারও ওই চাপ সওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
ভুট্টো : আমরা তো ফেডারেশন বা কনফেডারেশনের কথা ভাবছি না। কিন্তু ওরা যদি আমাদের সঙ্গে কোনো বিশেষ সম্পর্ক চায় তাহলে তারজন্য একটা রূপরেখাতো লাগবে। অনেকটা ফ্রান্স-জার্মানির মতো, ছয় মাস পরপর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে। এতে ওদের জন্য আমাদের কিছু করতে চাওয়াটা একটা নায্যতা পাবে।
বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে চরম ঘৃণা করে। এনিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে ভারত তাদের লাঞ্ছিত করেই যাচ্ছে। রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থা- অপপ্রচারের শেষ নেই কোনো।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অভ্যুথান-পাল্টা অভ্যুথান লেগেই আছে। যখনই ভারতপন্থী কোনো সরকার আসে একটা অভ্যুথান হয়। আবার জনগনের মনমতো কেউ সরকার গঠন করলে,তখন ভারত আগবাড়িয়ে ঝামেলা পাকানো শুরু করে দেয়। ভারতের উচিত হবে এই দাদাগিরিসূলভ আচরণ বন্ধ করা। এমনকি নেপালের সঙ্গেও তারা বড় ভাই সাজার চেষ্টা করছে যাতে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা যায়। সিকিমকে তো পকেটেই পুরে ফেলেছে।
তো বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। অপ্রত্যাশিত কোনো পরিবর্তন আসতেই পারে। তারপরও যতদিন সেখানকার জনগণ পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে, আমাদের সম্পর্ক খুব বেশী খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই।
কিসিঞ্জার:আপনি কি চাচ্ছেন?
ভুট্টো : কাল রাতেই তো আপনাকে বললাম। কিছু সাবেক কর্ণেলকে যেভাবেই হোক দেশে ফিরতে দেওয়ার অনুরোধ এসেছে। আমরা প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করেছি। কিন্তু তারপরও অভ্যুথানের খবর শোনা যাচ্ছে।
কিসিঞ্জার :আমরা শুনেছি।
ভুট্টো: জেএসডি (জাসদ), একটা জাতীয় সমাজন্ত্রিক মার্কবাদী দল সেনাবাহিনীর বেশ কিছু পদে ঢুকে পড়েছে। তারা অনেক সমস্যা তৈরি করছে। জাসদের একজন নেতাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে (কর্ণেল তাহের)। এটা এখন একটা সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে প্রচুর রাজনীতি। এদের মধ্যে কিছূ মার্ক্সবাদীও আছে। আবার এদিকে পুরানো রাজনীতিবিদরাও মাঠে নামতে চাইছে। প্রেসিডেন্ট (সায়েম) ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিতে চাইছেন, কিন্তু তারপরও বর্তমান সরকার শঙ্কিত যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের ঘুরে দাড়ানোটা থমকে যেতে পারে। আর সেটা এখন মোটামুটি প্রকট হয়েই ফুটে উঠেছে।
কিসিঞ্জার: আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে আগ্রহী। আপনার মতোই আমাদেরও ধারণা যে এটা শুধু অস্ত্র সরবরাহ করে নিশ্চিত করা যাবে না। কারণ অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আমাদের ওই পরিমাণ অস্ত্র পাঠাতে হবে। তার চেয়ে অন্য জায়গায় রেখে সময়মতো সেখানে পৌছে দেওয়াটাই ভালো।
ভুট্টো: আমরা মনে করি এই বিশেষ সম্পর্কটা একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে যাতে আমরা আরো বেশী করে সাহায্য দেওয়ার একটা যৌক্তিকতা খুজে পাই। এটা তো সমর্থন দেওয়া যায়। (পড়ুন, এটাকে তো আপনারা সমর্থন দিতে পারেন)
কিসিঞ্জার: পরিকল্পনাটার মূল নীতি ঠিক আছে, কিন্তু এটা প্রকাশ হয়ে গেলে প্রশ্ন উঠবে। আপনারা যদি নিয়মিত বৈঠক করে ব্যাপারটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন সেটা তো ভালোই। এটা আমরা দুজনেই সেই ১৯৭১ সালেই টের পেয়েছি। ব্যাপারটা আনুষ্ঠানিক চুক্তি হিসেবে ঘোষণা দিতে চাইলে একজন বন্ধু হিসেবে আমি কিছু প্রশ্ন তুলতে পারি।
ভুট্টো : আমরা তাদের প্রস্তাবটা দিয়েছি যাতে আমাদের সর্বাত্মক সহায়তার ব্যাপারটাকে একটা ভিত্তি দেওয়া যায়, যাতে এটাকে কেউ সন্দেহের চোখে না দেখে।তারা যদি আপত্তি করে, তাতে আমাদের ঘুম হারাম হয়ে যাবে না।
কিসিঞ্জার : আমরাও তাদের সাহায্য করতে পারি। তাদের নৌবাহিনী প্রধান ওয়াশিংটন এসেছিলো। এমনিতে কোনো নৌ-প্রধানের ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু এই লোকের সঙ্গে আমি গুরুত্ব দিয়েই দেখা করেছি। তাদের সার্বভৌমত্বে আমরা আগ্রহী যা ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ভুট্টো: চীনারাও সাধ্যমতো সাহায্য করছে। আমরা মে মাসে পিকিং গিয়েছিলাম, আমরা প্রস্তাবটা দিয়েছি, তারাও বলেছে যে তাদের সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখতে সাহায্য করবে। রুশ রাষ্ট্রদূতকে আমি বলেছি যে বাংলাদেশে ভারতের সঙ্গে মিলেঝুলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো উপকার হয়নি, কারণ বাংলাদেশের মানুষের ঘৃণা খুব বেশী। বলেছি: ভারত যাই করে তাতেই তোমরা তাল দাও কেনো? ওরা তো বাংলাদেশকে একটা পুতুল রাষ্ট্র বানাতে চায় যারা ওদের কথা মতো নাচবে।
কিসিঞ্জার: ওটা ’৭১ সালে ওদের লক্ষ্য ছিলো।
ভুট্টো: ওরা (বাঙালীরা)’৭১সালে ভাবতো যে পশ্চিম পাকিস্তান ওদের শোষন করছে। এখন পাকিস্তান আমলকে তাদের স্বর্নযুগ বলে মনে হয়। শেখ মুজিব যখন মারা গেলো তখন চোখের পানিও ফেলেনি কেউ।
কিসিঞ্জার: আমরা প্রচুর খাদ্য সাহায্য দিয়েছি,ওরা ওই খাতে আমাদের সবচেয়ে বড় গ্রাহকদের মধ্যে পড়ে।
ভুট্টো: বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মনোভাব আগের চেয়ে অনেক ইতিবাচক হয়েছে। তবে এভাবে যদি সরকার বদলাতে থাকে তাহলে তো ওদের ভবিষ্যত অন্ধকার। এই একটা ভারতপন্থী আসে তো তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়, আবার জনগনের পছন্দের সরকার আসে তো তাদের উৎখাত করা হয়। আমাদের উচিত হবে বাংলাদেশের মানুষের মনোবল চাঙা রাখার জন্য খাদ্য এবং নানা ধরণের সাহায্য অব্যহত রাখা। অস্ত্রশস্ত্র আসলে ঠিক উপায় না।
কিসিঞ্জার: এটা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী
ভুট্টো: চীনারা অবশ্য তাদের এভাবেই সাহায্য করছে
কিসিঞ্জার: অস্ত্র দিয়ে?
ভুট্টো: হালকা অস্ত্র….
আলোচনাটুকু পড়ার পর পাঠকের মনে নানা ধরণের প্রশ্ন জাগতেই পারে। যেমন ভুট্টো কি চাইছেন সেটা আলোচনাতেই পরিষ্কার। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে, সেখানে জাসদের অনুপ্রবেশ নিয়ে এমন দায়িত্ব নিয়ে কথা বলার মানে কি? তিনি তো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তাহলে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান কি তার কাছে অভিযোগ অনুযোগ জানাচ্ছেন? সাবেক কর্নেল কারা? ফারুক-রশীদ তো! তাদের দেশে ফেরা না ফেরায় ভেটো দেওয়ার ভুট্টো কে? বাংলাদেশের নৌবাহিনী প্রধানইবা কি আবদার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন? ভুট্টো যেখানে বারবার বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের অংশ বানানোর প্রস্তাব দিচ্ছে সেখানে কিসিঞ্জার কেনো ভেটো দিচ্ছেন বারবার? বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে তার এত দরদের হেতু কি!
(চলবে--------)
ছবি: '৭৪সালে ঢাকায় ভুট্টো, সেবারই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে।
নেট থেকে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন