প্রশ্নগুলোর উত্তর খোজার আগে এটা বোঝা জরুরী, ভুট্টো মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রে কতখানি জড়িত। তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন কি ছিলো এতে, নাকি স্রেফ পরিস্থিতির ফায়দা ওঠাতে চাইছিলেন তিনি। বাংলাদেশে তার মিত্র ছিলো কারা, কারা তার মতো ভারত বিদ্বেষী মতবাদটা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে একটি যুদ্ধাঞ্চল বানাতে চাইছিলো?
মার্কিন ন্যাশনাল আর্কাইভে চিলি, কিউবা, ল্যাটিন আমেরিকা বা আফ্রিকায় সিআইএর জঘন্য কীর্তিকলাপের অনেক দলিলই মেলে। সেগুলো নিয়ে অনেক গবেষকই কাজ করেন। আমাদের দূর্ভাগ্য আমাদের যোগ্য গবেষকরা তেমন কোনো প্রয়াসই নেননি। বরং বাংলাদেশ এবং ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে অনেক ডকুমেন্টই এখনও রেস্ট্রিকটেড, ক্লাসিফাইড এবং ডিলিটেড যেগুলো প্রকাশ পেলে অনেক রহস্য হয়তো পরিষ্কার হয়ে যেতো। আমাদের অনুমানের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হতো না।
তেমন দুটো নমুনার স্ক্রিনশট আমি তুলে দিচ্ছি। ’৭৫ সালের ৩ ডিসেম্বর ইসলামাবাদ থেকে রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোড একটি তারবার্তা পাঠান তার পররাষ্ট্র দপ্তরে। তারবার্তাটি মুছে ফেলা হয়েছে, কিন্তু তার শিরোনাম ও ট্যাগ রয়ে গেছে। শিরোনাম বলছে বিডি অফিসারস ক্লেইম দ্যাট দে ওয়ার্কড টু রিইউনাইট পাকিস্তান (বাংলাদেশী সেনাকর্তাদের দাবি তারা পাকিস্তানের একত্রিকরণের জন্য কাজ করেছে)। অফিসারের অনুবাদে আমি সেনা কর্তা লেখলাম কেনো? ট্যাগ দেখুন, ফারুক রহমান এবং খন্দকার আবদুর রশীদ। দুজনের পরিচয় এবং কীর্তি নিয়ে নিশ্চয়ই নতুন কিছু বলবার নেই।
এখন পর্যন্ত অনেককেই দেখেছি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিশ্লেষণ করেন। তাদের বেশীরভাগের চোখেই ফারুক-রশীদদের কাজটা হুইমজিকাল, হঠাৎ ঘটিয়ে ফেলা। তাদের পেছনে কোনো ব্যাকিং ছিলো না, কোনো তৃতীয় রাষ্ট্রের সমর্থন ছিলো না। এটা অন্তত আমি বিশ্বাস করি না। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ কর্ণেল তাহের এবং জাসদের বিপ্লব নিয়ে বই লিখেছেন (দ্য আনফিনিশড রেভ্যুলেশন)। মুজিব হত্যা নিয়েও তার একটা অসম্পূর্ণ কাজ আছে, এনাটমি অব আ ক্যু। এটি বাংলাদেশের দ্য ডেইলি স্টারে কয়েক পর্বে ছাপা হয়েছে। লিফশুলজ সেখানে রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টারকে ক্লিনচিট দিয়েছেন, তাকে স্বাক্ষী মেনেছেন। দোষ দিয়েছেন ঢাকায় তখনকার সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরিকে। ’৭৬ সালের এপ্রিলে ফারুক-রশীদ এন্থনী ম্যাসকারেনহাসকে দেওয়া সাক্ষাতকারে জিয়াকে জানিয়ে সব কিছু করার কথা বলেছেন। তার প্রবন্ধে এটি হাইলাইট করেছেন লিফশুলজ, লিখেছেন :
Among the many things that he talked about my source described how both Mustaque and General Ziaur Rahman had been in contact and discussions with the Majors for more than six months prior to the actual coup. This individual had personally attended numerous meetings that Major Rashid had held separately with Zia and Mustaque. In his television interview with Anthony Mascarenhas, Rashid described a meeting with General Zia on March 20, 1975, in which a coup was discussed in detail. This meeting took place five months before the coup. My source attended this meeting with General Zia but claimed it was not the first in which plans for a coup were discussed.
১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ জিয়া সব জেনেছেন (আরটিভির একটা ফুটেজ পাওয়া যায় যেটাতে মাসকারেনহাসের নেওয়া সাক্ষাতকারটার অনুবাদ সাবটাইটেল করা হয়েছে, সেখানে ফারুকের বলা টুয়েন্টিয়েথ অফ মার্চকে টুয়েন্টিএইট অফ মার্চ ভেবে সাবটাইটেলে ২৮ মার্চ লেখা হয়েছে)। এবং তিনি সেটা শেখ মুজিবকে জানাননি। কাউকেই কি জানাননি? হয়তো না। তবে আমরা উপরের মতো একটা ডিলিটেড মেসেজ পাই ২০ মার্চ ১৯৭৫ সালের। সেটা পাঠানো হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর (স্টেট) থেকে, ঢাকা, নয়াদিল্লী দুতাবাস এবং মিশরের আসওয়ানে সফররত হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্দেশ্যে। তারবার্তার শিরোনাম ক্যু রিউমার্স বা অভ্যুথানের গুজব। সেটার ট্যাগে বিজি ইনিশিয়ালে বাংলাদেশের নাম ছিলো। ব্যক্তির নাম ছিলো না, ছিলো জবাবে। ২১ মার্চ নয়াদিল্লী থেকে ঢাকায় এবং ২২ মার্চ ঢাকা থেকে পাঠানো তারবার্তার জবাবে মুজিবুর রহমান নামটা আছে। এটার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে দুতাবাসের অগোচরে ঢাকা থেকে খবর পাঠানো হয় যে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একটা অভ্যুথানের চক্রান্ত হয়েছে, সেটা নিশ্চিত হতেই পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে তারবার্তা আসে। কাকতালীয় এই ব্যাপারটা থেকে এটা অনুমান করা উচিত হবে না যে জিয়া ফিলিপ চেরিকে বলেছেন ফারুক-রশীদের পরিকল্পনা। সেটা সে দেশে জানিয়েছে, তারা খোজ নিয়েছে। তবে মার্কিনিরা খবরটা মুজিবকে ঠিকই দিয়েছিলো। চক্রান্তকারীদের নাম না বললেও তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এটা মুজিবকে জানানো হয়, তিনি পাত্তা দেননি।
তবে জিয়া মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ রেখেছেন এটা লিফশুলজ উল্লেখ করেছেন তার লেখায় :
My unusual source made a rather interesting comment when he noted that he had been present during two different meetings- one with Zia and a separate one on a different day with Mustaque-in which Major Rashid independently raised a question concerning what the attitude of the United States would be to the planned coup. "Both Zia and Mustaque independently told us that they had checked with the Americans," said this military officer. "Their answers were the Americans. I then realized that Zia and Mustaque had their separate channels to the Americans. After that the subject didn't come up again."
এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয় লিফশুলজের সেই সোর্স ছিলেন মহিউদ্দিন। বেঙ্গল ল্যান্সারের এই মেজর ছিলেন ফারুকের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। এই মহিউদ্দিন শেখ রাসেলকে নিজের হাতে গুলি করে মারেন। হেগে তাকে রাষ্ট্রদূত বানান জিয়া, পরে তিনি হল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে ব্রেডায় একটি রেস্তোরা খোলেন, যেখানে প্রায় নিয়মিতই বৈঠকে বসতো মুজিব হত্যায় জড়িত সামরিক কর্মকর্তারা। মহিউদ্দিন্ আরেকজন ছিলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে বদলির আদেশ স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে এই মহিউদ্দিনকেই আগস্টের শুরুতে মুজিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন জিয়া। ২০ আগস্ট মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর তৎপরতার খবরে ভীত হয়ে সস্ত্রীক মার্কিন দুতাবাসে আশ্রয় নেন । খালেদের অভ্যুথানের পর অন্যদের সঙ্গে দেশ ছেড়ে পালাননি। এবং ৭ নভেম্বর জিয়াকে মুক্ত করার সময় তিনি ছিলেন সেখানে উপস্থিত।
যাহোক লিফশুলজকে দেওয়া সাক্ষাতকারে চেরি অস্বীকার করেছেন অভ্যুথানে কোনো ধরণের সংশ্লিষ্টতার। আর ধোয়া তুলসীপাতা সাজা বোস্টারকে দেখা যায় ৯ আগস্ট (‘৭৫) যুক্তরাষ্ট্রে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এমআর সিদ্দিকীর বাসায় ডিনার খেতে , যেখানে হাতে গোনা অতিথিদের একজন ছিলেন খন্দকার মোশতাক। তার বাসায় জিয়ার মতো সামরিক আইন প্রশাসকদের সঙ্গী হয়ে সেনা কর্মকর্তারা দল বেঁধে সিনেমা দেখতে আসেন (প্যাটন), আর ফাঁকে ফাঁকে রাষ্ট্রনীতি এবং ভারতের আগ্রাসন ঠেকাতে অস্ত্রসস্ত্র কিভাবে পাওয়া যায় তা নিয়ে আলাপ করেন। যে খালেদকে ভারতপন্থী বানাতে জাসদ লিফলেট ছেড়েছে বলে অভিযোগ, তাহের গ্রেফতারের পর যাকে ছাড়াতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরণ করতে গিয়ে তার ভাইসহ চারজন জাসদ সদস্যের মৃত্যু, সেই জাসদ যে আসলে ভারতের টাকায় চলে এমন কানপড়া মার্কিনিদের দিতে একটুও বাধেনি জিয়ার । এমনকি লিফলেটে বিসমিল্লাহ, আসসালামু আলাইকুম, খোদা হাফেজ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ লাগিয়েও নিস্তার মেলে না তাদের, রেডিওতে তাদের মীরজাফর বলে ঘোষণা দেন জিয়া । ভারতজুজু, মার্কিন রাষ্ট্রনীতি, জাসদ এবং খালেদকে নিয়ে আগামী পর্বগুলোতে বিস্তারিত লেখা হবে, তাই এখানে আলোচনা আর বাড়াচ্ছি না।
এখানে একটা চমকপ্রদ ব্যাপার পাঠকদের জানানো যায়। মুজিবের বিরুদ্ধে দূর্নীতির পাশাপাশি স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনেছে তার হত্যাকারীরা, যে কারণে লাশ হতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি এবং ভগ্নিপতি সেরনিয়াবাতকেও। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যেও আত্মীয়তার ছড়াছড়ি। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মতো রশীদও খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে লাগেন। রাষ্ট্রদূত এমআর সিদ্দিকির দুইবোন ফারুক এবং রশীদের ঘরণী। আবার মোশতাককে উৎখাতে ব্রতী খালেদ মোশাররফ হচ্ছেন ফারুকের দূরসম্পর্কের মামা !
মোশতাক যে এক পাকিস্তানে ফিরতে আগ্রহী এবং জিয়া যে ভুট্টোর বিশেষ পছন্দ সেটা আগের পোস্টেই প্রমাণ মিলেছে , সামনের পর্বগুলোতে আরো মিলবে। ফেরা যাক একদম শুরুতে বলা ’৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ভুট্টো কি করছিলেন সেই কাহিনীতে। ১৮ আগস্ট পাঠানো বাইরোডের তারবার্তা বলছে ভুট্টো আগের রাতে তাকে ফোন করে বলেছেন, আমি জানি আপনারা খারাপ লোক না, বাংলাদেশে অভ্যুথানে আপনাদের হাত নেই। তবে রাশানরা তো ঠিক উল্টোটা ভাবছে।এরপর আমরা জানতে পারি যে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে সন্ধ্যায় ভুট্টোর ওখানে স্বস্ত্রীক দাওয়াত ছিলো বাইরোডের। মূলত আলোচনাটা কাবুল কেন্দ্রিক হলেও সেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিলো। ভুট্টো এটাকে বলেছেন বাংলাদেশের আভ্যন্তরিন ঝামেলা, কিন্তু সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত আজিমভ তা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন যে তাদের কাছে প্রমাণ আছে যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনায় ভালোমতোই জড়িত। বাইরোড রসিকতা করে ভুট্টোকে বলেছেন যে আপনি যেরকম সবার আগে তাদের স্বীকৃতি দিলেন তাতে সন্দেহ তো আপনাকেও করতে পারে। ভুট্টোর জবাব তার নাকি বাংলাদেশে এমন কেউ নেই যাতে এই সন্দেহ কারো মধ্যে জাগবে। অন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর (সৌদি আরব ও লিবিয়া) আগেই পাকিস্তান কাজটা করতে চেয়েছে কারণ দুদেশের মধ্যে একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। ভুট্টো বলেছেন তিনি নতুন রাষ্ট্রপতিকে (মোশতাক) বেশ ভালোমতোই চেনেন, এবং আশা করছেন সম্পর্কটা এবার ভালো হবে।
’৭৬ সালের আগস্টে এসে ভুট্টো কর্নেলদের (ফারুক-রশীদ) ফিরতে বাধা দিচ্ছেন বাংলাদেশে, অস্ত্র চাইছেন ভারত থেকে দেশকে বাঁচাতে, চীনারা এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে এমন তথ্য দিচ্ছেন কিসিঞ্জারকে। কিন্তু জিয়ার প্রতি তার মনোভাবটা কি তখনও শুরুর মতোই, নাকি ভাঙ্গন ধরেছে? কিসিঞ্জার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ-পাকিস্তান এক জোটে তার আপত্তির কথা। ওদিকে ফারুক-রশীদও জিয়ার ওপর দারুণ খ্যাপা। এক মাস আগে (৮ জুলাই ’৭৬) ফারুক ফিনানশিয়াল টাইমসে ছয় পাতার চিঠি পাঠিয়েছেন । সেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি আহবান জানানো হয়েছে জিয়াকে যে কোনোভাবে উৎখাতের, কারণ তিনি নাকি ইসলাম এবং বাংলাদেশের জনগনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন! (চলবে)
ছবি : '৭৪ সালে ঢাকায় ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় মুজিব। বন্দি বিনিময়, সম্পদ বন্টন ইত্যাদি নানা ইস্যুতে তখন অচলাবস্থায় দুদেশের আলোচনা। নেট থেকে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন