শেখ মজিবুর রহমান যেভাবে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এবং ডঃ ওয়াজেদ মিয়া সুধাসদন এর মালিক হলেন-২
১৯৫৮ সালে সরকারী বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরই বেগম মুজিব বুঝেছিলেন, যে কোনভাবেই হোক মাথা গোঁজার একটি ঠাঁই করতে হবে। ১৯৬০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি তাঁকে বরাদ্দ পাওয়া প্লট এ বাড়ি নির্মাণের কথা জানালেন। হাত দিলেন বাড়ি নির্মাণের কাজে। ১৯৬০-৬১ সাল থেকেই ৩২ নম্বরের বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়। এ সময় হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে ঋণ নেয়া হয়েছিল। পিডব্লিউডি'র তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (পরবর্তী সময়ে পূর্ত সচিব ও ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক) মাইনুল ইসলাম এ বাড়ির নির্মাণ কাজ তদারকীও করেছেন। বাড়ি নির্মাণের কাজে নানাভাবে সহকর্মীদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এঁদের একজন নুরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী। বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন নূরুল ইসলামের বাড়ি ছিল চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে। আওয়ামী লীগের প্রচার কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। সবাই তাঁকে একডাকে 'পোস্টার নুরুল ইসলাম' নামে জানতেন। তিনিও চাকরি করতেন আলফা ইন্সু্রেন্স কোম্পানিতে। ১৯৬০ বা ১৯৬১ সালে নুরুল ইসলাম যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। প্রতি রবিবার সময় করে বঙ্গবন্ধু তাঁর এই প্রিয় কর্মীকে হাসপাতালে দেখতে যেতেন। তখন দীর্ঘ সময় তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। ৩২ নম্বরের বাড়ি তৈরির কাজে নুরুল ইসলামও অনেক সহযোগিতা করেছেন। হাসপাতালে থাকার সময় নূরুল ইসলাম 'ক্রস ওয়ার্ড' লটারি খেলতেন। লটারিতে নাম-ঠিকানা দেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। একদিন তিনি লটারিতে ব্যবহার করেছিলেন শেখ রেহানার নাম। সেই দিনই তিনি পেয়ে যান ছয় হাজার টাকা। এই টাকা বেগম মুজিবের কাছে গচ্ছিত ছিল। বাড়ি নির্মাণের সময় টাকার সঙ্কট দেখা দিলে নূরুল ইসলাম এই টাকা ব্যবহার করতে বলেন। তাঁর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সেই টাকা ঋণ হিসেবে নেয়া হয়। পরে সেই টাকা পরিশোধও করা হয়। নূরুল ইসলাম আজও জীবিত। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কার্যকরী কমিটির সদস্য। তিনি ৩২ নম্বরের বাড়ি তৈরির সাক্ষী। বাড়ির নির্মাণ কাজ দেখাশোনার জন্য কেয়ারটেকার হিসেবে নিয়ে আসা হয় আরজ আলী নামে একজনকে। আরজ আলী ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার পাশের গ্রাম পাঁচকহনিয়ার বাসিন্দা। ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনের ঝাউ গাছের চারা এনে দিয়েছিলেন বদরুন্নেসা আহমেদের স্বামী নূরুদ্দিন আহমেদ। এই বাড়ির জানালার লোহার গ্রিল সরবরাহ করেছিলেন রংপুরের মতিউর রহমান। তিনি ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। 'রংপুরের মতিউর রহমান' নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। ঢাকার তেজগাঁওতে তাঁর একটি লোহার ইন্ডাস্ট্রি ছিল। বঙ্গবন্ধু পরিবার-পরিজন নিয়ে এই বাড়িতে ওঠেন ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর। একতলা বাড়িটিতে তখন বেডরুম ছিল মাত্র দুটো। এক রুমে থাকতেন বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব। অন্যকক্ষে থাকতেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সেই কক্ষটি রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই কক্ষেরই একপাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল ছোট একটি কক্ষ। এই কক্ষটি ড্রইং রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কক্ষে ছিল কম দামের এক সেট বেতের সোফা। বঙ্গবন্ধুর নবনির্মিত এই বাড়িতে প্রথম যে টেলিফোন সংযোগ দেয়া হয়, সেই টেলিফোনের নম্বর ছিল ২৫৬১। উল্লেখ্য, ১৯৬২ সাল থেকে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুর বাড়ির টেলিফোনে আড়িপাতা শুররু করে। এ সময় ছাত্রনেতারা বঙ্গবন্ধুকে ফোন করার সময় ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। যেমন_ শেখ ফজলুল হক মণি ফোন করে নিজেকে 'বালিঅলা' বলে পরিচয় দিতেন। সিরাজুল আলম খান ফোন করে নিজের পরিচয় দিতেন 'ইটাঅলা' বলে। এভাবে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি। এটি কারও দয়ার দানে পাওয়া বাড়ি নয়। যে বাড়িটি আজ ইতিহাসের সাক্ষী। বাড়িটি আজ ইতিহাসের বাড়ি। বাঙালীর তীর্থ আজ ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন।
৩২ নম্বরের এই বাড়িটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর শেখ হাসিনা বাড়িটি বুঝে পান। ঐ বছরের শেষের দিকে একবার খবরের কাগজে একটি নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে তাঁর চোখ আটকে যায়। হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের সে নিলাম বিজ্ঞাপ্তির তালিকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিও ছিল। শেখ হাসিনা ছুটে যান হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের অফিসে। ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বকেয়া পরিশোধের পর বাড়ির দলিল শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে বাড়ি বুঝে পাওয়ার পর তিনি ঘোষণা করেছিলেন ইতিহাসের এই বাড়িটি হবে জনগণের। এরপর ৩২ নম্বরের বাড়ি ও টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি দেখাশোনা করার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ৩২ নম্বরের বাড়িটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে শুভ উদ্বোধন করা হয়। সে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল।
অথচ কুচক্রী মহল এই বাড়িটিকে নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। অন্যের দয়ার দানে যাদের সম্পদ হয়েছে, যাদের সন্তানরা জবরদখল করতে জানে; তাদের দ্বারাই সম্ভব এমন অবাস্তব কল্পনা। কারণ তাদের মাইন্ড-সেটের মধ্যে তো জবরদখল ছাড়া আর কিছু নেই। বিএনপি মহাসচিব শেখ রেহানার লন্ডনের বাড়ি নিয়েও অবাস্তব কল্পকাহিনী ফেঁদেছেন। এই কাহিনী যে কতটা তাঁর নিরেট মস্তিষ্কপ্রসূত, সেটা প্রমাণ তিনি নিজেই করতে পারেন। লন্ডনে তাঁর দলের নেতাকর্মীদের যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবেন লন্ডনে শেখ রেহানা কেমন সাধারণ জীবন যাপন করেন।হ্যাঁ, সাধারণ জীবন যাপন করেও তিনি তাঁর সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তাঁর পুত্র দেলোয়ারপুত্রদের মতো দখলবাজ-মাস্তান, সন্ত্রাসী, বোমাবাজ হয়নি। উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে এখন ব্রাসেলসে কর্মরত। মেয়ে টিউলিপ লন্ডনে কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত। এখানেই খোন্দকার দেলোয়ারের সঙ্গে শেখ পরিবারের পার্থক্য। শেখ পরিবারে বিদ্যার চর্চা আছে, দেলোয়ারের উত্তরসূরিদের তা নেই। খোন্দকার দেলোয়ারের নেত্রীর পরিবারের দিকে তাকালেও একই দৈন্য চোখে পড়ে। কাজেই তাঁদের ঈর্ষার কারণ কেবল বাড়ি নয়, যোগ্যতাও।
চলবে............
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন