ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নং বাড়িটি পুরোটা বোধ হয় জাদুঘর করা হয় নি। পেছনের অংশটা এখনো হাসিনা/রেহানা বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহার করেন।
এই প্লটটি ১ বিঘা দেখানো হলেও পরে শেখ সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের বাড়িতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পেছনের [স্কয়ারের] তপন চৌধুরীর প্লটের থেকে বেশ কয়েক কাঠা এর সঙ্গে যোগ করা হয়।
পূর্বের বাড়িটি প্রিয় প্রতিবেশিনী বদরুন্নেসা আহমদের সচিব স্বামীর ছিল (বদরুন্নেসা অকালে মারা গেলে বখশীবাজারের গভর্মেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজটির [ যেখানে মতিয়া এবং হাসিনা এক কালে লেখাপড়া এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন ) নাম বদরুন্নেসার নামে করা হয়। এই বসত বাড়িটিও এখন আসলে দুই বোন কিনে নিয়েছেন।
*******************
এবার আসা যাক সুধা সদন নামের বাড়িটি প্রসঙ্গে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনে যোগ দেন ১৯৬৩ সালের ৮ এপ্রিল। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন আণবিক শক্তি কমিশনের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ১৯৬৭ সালে। ঢাকাতে তাঁর কোন বাড়ি ছিল না। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ড. ওয়াজেদ মিয়া ধানমণ্ডির ১৫ নম্বর সড়কের ১৭৭ নম্বর বাড়ির নিচতলা ভাড়া নেন। ঐ সময় বাড়িটির ভাড়া ছিল ৯০০ টাকা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে নিয়ে ঐ বাড়িতে চলে যান। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তিনি তাঁদের নিয়ে খিলগাঁওতে তাঁর বন্ধু ড. মোজাম্মেলের বাসায় ওঠেন। একাত্তরের ১ এপ্রিল তিনি খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ায় একটি বাসা ভাড়া নেন। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে নতুন ভাড়াবাসায় ওঠেন। কিন্তু এপ্রিলের ৫ তারিখেই বাড়িঅলা ভাড়ার টাকা ফেরত দিয়ে তাঁকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেন। কারণ, ঐ চারদিনেই এলাকায় জানাজানি হয়ে যায় যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবার ঐ বাড়িতে আছে। বাড়ি ওয়ালা নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাঁদের বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেন। বাধ্য হয়েই পরদিন ৬ এপ্রিল ঐ বাড়ি ছেড়ে তাঁদের চলে আসতে হয়। তাঁরা চলে আসেন মগবাজার চৌরাস্তার কাছে নূরুদ্দিন আহমদের বাসায়। একাত্তরের ১২ মে মগবাজারের ঐ বাসা থেকেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রোডের ২৬ নম্বর বাড়িতে নিয়ে আসে, অন্তরীণ রাখে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতেই উঠেছিলেন। স্বাধীন দেশে তিনি নিজের বাড়িতে ওঠেন ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষার্ধে। ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর সড়কের এই ২৬ নম্বর বাড়ি থেকেই শেখ হাসিনাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ১৯৭১ সালের ১৫ জুলাই।
ওই আন্তর্জাতিক ও সার্বজনীন বিধি বিধানের অধীনে '৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধে অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করা বাঙালী জাতি ও বিশ্ব মানবজাতির বর্তমান ভবিষ্যত শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করণের স্বার্থে একান্তভাবে অপরিহার্য। কারণ, যুদ্ধাপরাধী যেই হোক, যে দেশের হোক, যে ধর্ম বা বর্ণ বা গোত্রের হোক_সে বিশ্ব মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্ব মানবজাতির শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। সেই নিরিখে '৭১ সালে বাংলাদেশের সব যুদ্ধাপরাধী বাঙালী জাতি ও মানবজাতির জন্য হুমকি ও বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি। এই হুমকির অবসান ঘটানো বাঙালী জাতি ও বিশ্ব মানবজাতির পরম কর্তব্য একাত্তরের ২৭ জুলাই রাত আটটায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জয়ের জন্ম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১ মার্চ ড. ওয়াজেদ মিয়া স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর বাড়ির একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে ওঠেন। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী সোহরাব হোসেন বরাবর একটি প্লটের জন্য আবেদন করেন তিনি। ১৯৭৪ সালের প্রথমদিকে ধানমন্ডির এই প্লটটি ড. ওয়াজেদ মিয়ার নামে বরাদ্দ দেয়া হয়। ১৪ কাঠার প্লটটির মূল্য তখন ছিল ৭০ হাজার টাকা। এই টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করা হয়।
১৯৭৫ সালে ড. ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন জার্মানিতে। তিনি একটি বৃত্তি নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। ঐ বছর ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেখানে যান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘটে যায় মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। ঐ বছর ২৫ আগস্ট ড. ওয়াজেদ মিয়া স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভারতের দিল্লী আসেন। সেখানে তাঁরা রাজনৈতিক আশ্রয় পান। দিল্লীতে পান্ডারা রোডে একটি ছোট বাড়িতে সাড়ে ছয় বছর কাটে তাঁদের। শেখ হাসিনা দিল্লী থেকে দেশে ফিরে আসেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। দেশে ফিরে তিনি প্রথমে উঠেছিলেন তাঁর ছোট ফুফু খাদিজা খানমের লালমাটিয়ার বাসায়। ড. ওয়াজেদ মিয়া দিল্লী থেকে ঢাকায় আসেন ১৯৮২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় ফিরে তিনি ওঠেন তাঁর ভাগ্নিজামাই সিদ্দিক হোসেন চৌধুরীর মোহাম্মদপুরের ১১/১২ ইকবাল রোডের বাসায়। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তিনি মহাখালীতে আণবিক শক্তি কলোনিতে একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পান। ১৯৮২ সালেই ধানমন্ডিতে সুধা সদনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বাড়ির আর্কিটেক্ট ছিলেন আলমগীর কবির। বাড়ি নির্মাণের সময় হাউস বিল্ডিং কর্পোরেশন থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ নেয়া হয়। পরে ঋণ নেয়া হয় আরব বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। পরে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ৩৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আরব বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা হয়। এতেও বাড়ি নির্মাণের ব্যয় সংকুলান না হওয়ায় একই ব্যাংক থেকে আরও পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নেয়া হয়। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে মোট ঋণের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকা। বাড়ি নির্মাণ শেষে এটি ভাড়া দেয়া হয়। ড. ওয়াজেদ মিয়া সপরিবারে এই বাড়িতে ওঠেন ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে। এই বাড়িতে যাঁরা গেছেন, তাঁরা জানেন বাড়ির আসবাবপত্র কত সাধারণ। বাড়িটিও একটি সাধারণ বাড়ি। অথচ এই বাড়িটিও এখন খোন্দকার দেলোয়ারদের ঈর্ষার কারণ।
খোন্দকার দেলোয়াররা এ রকমই। লন্ডনে তারেকের বাড়ি কিংবা মালয়েশিয়ায় তারেক-কোকোর সেকেন্ড হোম তাঁদের চোখে পড়ে না। কিংবা ইচ্ছা করেই তাঁরা সেগুলো দৃষ্টির আড়ালে রাখতে চান। খুঁজে বের করেন লন্ডনে শেখ রেহানার কাল্পনিক বাড়ি। সাধারণত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ও ড. ওয়াজেদ মিয়াকে নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বলতেও তাঁদের বাধে না। শেখ মুজিবুর রহমানকে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বলার আগে তাঁর খেয়াল রাখা উচিত ছিল যে, যথেষ্ট সম্পদশালী পরিবারের সন্তান না হলেও শেখ মুজিবুর রহমান সভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। সেই সময়ে তাঁর পিতা তাঁকে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বেকার হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। ঐ সময় পারিবারিক সঙ্গতি ছিল বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। অন্যদিকে ড. ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন একজন খ্যাতিমান পরমাণু বিজ্ঞানী। বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ পড়ানো হয়। ভাঙা সু্টকেসের ম্যাজিক তত্ত্ব যে সব পরিবারের জন্য খাটে না, সেটা খোন্দকার সাহেবরা অনুধাবন করতে পারেন না।
তথ্যসূত্র
"যে ইতিহাস সবার জানা দরকার"
লেখক : এম নজরুল ইসলাম
অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও সাংবাদিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন