শেখ মজিবুর রহমান যেভাবে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এবং ডঃ ওয়াজেদ মিয়া সুধাসদন এর মালিক হলেন-১

ক্যান্টনমেন্টের খালেদা জিয়ার দীর্ঘদিনের স্মৃতি। একাত্তরে যখন মানুষ প্রাণের ভয়ে ঢাকা ত্যাগে ব্যস্ত তখন চট্টগ্রাম থেকে বেগম জিয়া সড়কপথে ঢাকা এসেছিলেন। উঠেছিলেন এই ক্যান্টনমেন্টেই। সেখানে কিভাবে তিনি একাত্তরে ন'টি মাস কাটিয়েছেন সে বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। কাজেই ওটা তোলা থাক। আপাতত এই বাড়ি নিয়ে বলা যাক। হাইকোর্টের নির্দেশে বাড়ী হাতছাড়া হবার পর বি.এন.পি'র হুমকি নেতা খ্যাত বেসামাল মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার একটি বেসামাল উক্তি করে বসেন। আইএসপিআরকে উপদেশ দিতে গিয়ে তিনি অনাবশ্যকভাবে টেনে এনেছেন আরো দু'টি বাড়ির প্রসঙ্গ। এর একটি হচ্ছে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন। অন্যটি বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী মরহুম ওয়াজেদ মিয়ার বাড়ি সুধা সদন। 

এই দুই বাড়ি সম্পর্কে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর প্রশ্ন হচ্ছে, 'মরহুম শেখ মজিবুর রহমান তো নিন্মমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান ছিলেন, তিনি কীভাবে ৩২ নম্বরের বাড়িটি বানালেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী হলেও তিনিও নিন্মমধ্যবিত্তের সন্তান ছিলেন। তিনি কীভাবে ধানমন্ডিতে বাড়ি বানালেন ? এটা অনাবশ্যক বেসামাল উক্তি, সন্দেহ নেই। বক্তৃতার মঞ্চে উঠে যিনি নিজের পরিধেয় সামাল দিতে পারেন না, তিনি বোধহয় এমন বেসামাল উক্তি করতেই পারেন। হয়ত এটা অস্বাভাবিক নয়। খোন্দকার দেলোয়ার অনেকদিন বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয় কোন কথা উচ্চারণ করেনি। বিএনপিও তাদের মহাসচিবের এই উক্তিকে ক্যাশ করতে চায়নি। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, তাঁর এই কথার কোন সারবস্তু নেই। কিন্তু সম্প্রতি আবার বিএনপি মহাসচিব এই বাড়িটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কাজেই প্রশ্ন যখন উঠেছে, তখন দু'টি বাড়িরই ইতিহাস সবার জানা দরকার। 

বেগম জিয়া কেমন করে দুই-দু'টি বাড়ির মালিক হয়েছেন সেটা সবার জানা। কিন্তু ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি সাধারণ কোন বাড়ি নয়। এ বাড়িটি দেশের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। অর্থাৎ বাড়িটি ইতিহাসের বাড়ি। যেমন ইতিহাসের বাড়ি, তেমনি বাড়িটির একটি ইতিহাসও আছে। সে ইতিহাস তো সবার জানা দরকার। ৩২ নম্বরের বাড়িটির প্রসঙ্গেই আগে আসা যাক। 

সবাই জানেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির জন্য বাড়িঘর-সংসারের খবর খুব একটা রাখতেন না। সংসার সামলাতেন যে মহীয়সী নারী, তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। ৩২ নম্বরের এই বাড়িটির ইতিহাস নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে একটু পেছনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হন। কিন্তু সে সরকার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এরপর ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ, কংগ্রেস, তফসিলি ফেডারেশন ও গণতন্ত্রী পার্টি_ এই চার দল মিলে যে সরকার গঠন করে, সে সরকারের চীফ মিনিস্টার ছিলেন আতাউর রহমান খান। আর, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই মন্ত্রিসভার বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প এবং দুর্নীতিদমনমন্ত্রী। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পিতা কফিলউদ্দিন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মনোরঞ্জন ধর, গৌরচন্দ্র বালা , মসিউর রহমান, দিলদার আহমদ, মাহমুদ আলী প্রমুখ ছিলেন ঐ মন্ত্রিসভার সদস্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হিসেবে সপরিবারে থাকতেন আবদুল গণি রোডের ১৫ নম্বর বাড়িতে। ঐ সময় বঙ্গবন্ধুর পিএস ছিলেন জনৈক নূরুজ্জামান। ঐ সময়ে ধানমণ্ডিতে প্লট বরাদ্দ দেয়া হচ্ছিল পিডব্লিউডি থেকে। নূরুজ্জামান পিডব্লিউডি থেকে একটি আবেদন ফরম নিয়ে আসেন। ফরমটি বেগম মুজিবের নামে পূরণ করে জমা দেয়া হয়। ১৯৫৭ সালের প্রথমদিকে বেগম মুজিবের নামে এক বিঘার এই প্লটটি বরাদ্দ দেয়া হয়। সে সময়ে প্লটটির দাম ধরা হয়েছিল ৬ হাজার টাকা। এককালীন জমা দিতে হয়েছিল ২ হাজার টাকা। বাকি ৪ হাজার টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করা হয়। ১৯৫৭ সালেই শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেন। দলের সাংগঠনিক কাজ করার জন্য ঐ সময় তাঁকে একটি জীপ দেয়া হয়। লাল রঙের এই উইলিজ জীপটির নম্বর ছিল ইবিডি-১১১ (ঊইউ-১১১). ১৯৫৮ সালে টি-বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে থাকতেন সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে। বাড়িটি ছিল টি-বোর্ডের চেয়ারম্যানের নামে বরাদ্দ করা। আইয়ুবের সামরিক শাসন জারির পর এ বাড়ি থেকেই ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে তিনদিনের মধ্যে বাসা ছেড়ে দেয়ার জন্য বলা হয়। ১৫ অক্টোবর মুজিব পরিবারকে বাসা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। বাসা ছাড়ার সময় সরকারের লোকজন ঐ জীপটি নিয়ে যায়। নিয়ে যায় জমির কিস্তির টাকা দেয়ার জন্য বাসায় রাখা ২০০০ টাকা ও ঘরের কিছু মাল। তখন এমন অবস্থা যে, কেউ আর বঙ্গবন্ধু পরিবারকে বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। অনেক কষ্টে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি বাসা ভাড়া নেন। সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের মাঠের পাশের সেই বাড়িটির ভাড়া ছিল ২০০ টাকা। বাড়িটির মালিক ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। অল্পদিনের মধ্যেই বেগম মুজিবের বাসা ভাড়া নেয়ার বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেল। বাড়ির মালিক তাঁকে বাসা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানালেন। সিদ্ধেশ্বরী ছেড়ে বেগম মুজিব সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন সেগুনবাগিচা এলাকায়। ওঠেন ৭৬ সেগুনবাগিচার দোতলায়। এ বাড়িটির মাসিক ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা। 

১৯৬০ সালের ১ অক্টোবর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বঙ্গবন্ধু আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কন্ট্রোলার অব এজেন্সিস পদে চাকরি নেন। পদটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষ পদ। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এই কোম্পানির অফিস ছিল। পাকিস্তানের এই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ঢাকা অফিস ছিল তৎকালীন ১৪ জিন্নাহ এ্যাভিনিউতে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ)। আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিস বাড়িটি ছিল চারতলা। অফিস বাড়িটির মালিক ছিলেন বলাকা সিনেমা হলের মালিক এম হাসান। আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মালিক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের ইউসুফ হারুন। এই ভবনের তিনতলায় বসতেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর মাসিক সম্মানী ভাতা ছিল তিন হাজার টাকা। এছাড়াও তিনি প্রিমিয়াম থেকে কমিশন পেতেন। নিজের ব্যবহারের জন্য অফিস থেকে একটি প্রিফেক্ট প্রাইভেট কার দেয়া হয়েছিল তাঁকে। প্রাইভেট কারটির নম্বর ছিল ইবিডি-৭১৭১ (ঊইউ-৭১৭১). গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন মঈন নামের এক অবাঙালী। উল্লেখ করা যেতে পারে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই ইউসুফ হারুন ১৯৬৯ সালের ১৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর মনোনীত হন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন