ভাষা আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেন , তাদের কারো মনে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র করার কোন চিন্তা ছিল না । এ ব্যাপারে ভাষা সৈনিক জনাব মোহাম্মদ তোয়াহা বলেন , তাদের মনে কোন স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার কোন চিন্তা ছিল না । (ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ হতে বায়ান্ন , ৮১ পৃষ্ঠা , ১ম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি,১৯৮৭, মোস্তফা কামাল ) । “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের ” আহ্বায়ক এবং ভাষা সৈনিক জনাব কাজী গোলাম মাহবুব বলেন “ অবশ্যই (ভাষা সমস্যার সমাধান) তা পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতর থেকে । কারণ পাকিস্তান আন্দোলন ছিল আমাদের গভীর বিশ্বাস এবং একাগ্র সংগ্রামের ফলশ্রুতি ।” (ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ হতে বায়ান্ন , ১৯৫ পৃষ্ঠা , মোস্তফা কামাল ) । শুধু তাই নয় জনাব গোলাম আজম , মৌলবী ফরিদ আহমদ সহ অনেকেই যারা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন তারা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভবের বিরোধীতা করেছিলেন । মূল কথা হল আজ ভাষা আন্দোলনকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হউক না কেন সে সময় ভাষা আন্দোলন ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া । ভাষা আন্দোলন করেছিল ছাত্ররা এবং এর সুবিধা নিয়েছিল রাজনীতিবিদরা । কিছু সুবিধার কথা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে । ২১শে ফেব্রুয়ারি ঘটনার কারণে ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রণ্টের নিকট ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় । আওয়ামিলীগ , কৃষক-শ্রমিক পার্টি , পাকিস্তান নেজামে ইসলামী , খেলাফতে রাব্বানী , পাকিস্তান গণতন্ত্রী দলসমূহকে নিয়ে যুক্তফ্রণ্ট গঠিত হয় । যুক্তফ্রণ্টের ২১ দফার মূল নীতি ছিল , “কোরান ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিক জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা হইবে ।” (জাতীয় রাজনীতি , ১৮২ পৃষ্ঠা , অলি আহাদ , একশ বছরের রাজনীতি , পৃষ্ঠা , ২৮৪ , আবুল আসাদ ) । আজ বলা হয় আমাদের স্বাধীনতার একটি মাইলফলক হল ৫৪ এর নির্বাচন এবং যুক্তফণ্টের ২১ দফা । তাই যদি হয় তবে ২১ দফার মূল নীতি বলে দেয় বাংলাদেশ কখনও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে পারে না । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ৫৪ এর নির্বাচনকে বিবেচনা করতে হবে ৫৪ সালের রাজনীতিবিদদের চিন্তার আলোকে । সে সময় রাজনীতিবিদদের মধ্যে পূর্ব বাংলাকে আলাদা রাষ্ট্র করার কোন চিন্তাই ছিল না । তাদের চিন্তার মধ্যে ছিল ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করে শাসন ক্ষমতায় যাওয়া এবং তাদের ওয়াদা ছিল পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্ব শাসন প্রতিষ্ঠা করা যা ২১ দফার মধ্যে ১৯নং দফায় উল্লেখ ছিল । অর্থাৎ স্বায়ত্ব শাসনের বিষয়টি প্রথম তিনটি দফার মধ্যে আসতে পারেনি , এসেছে শেষের দিকে । তাছাড়া যুক্তফ্রণ্টের মধ্যে নেজামে ইসলামী দল ছিল , যারা পরবর্তীতে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভবের বিরোধীতা করেছিল । বর্তমানে আরও একটি ধারণা দেয়া হয় , যুক্তফ্রণ্টের ব্যর্থতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা দায়ী । প্রকৃতপক্ষে এটি ইতিহাসের চরম বিকৃতি । প্রকৃতপক্ষে যুক্তফ্রণ্টের ব্যর্থতার জন্য দায়ী আওয়ামিলীগের প্রধান দুই নেতা সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর বিরোধ এবং একপর্যায়ে ভাসানীর আওয়ামিলীগ হতে বেরিয়ে ন্যাপ গঠন করা এবং সোহরাওয়ার্দীর সাথে কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা শেরেবাংলার রাজনৈতিক বিরোধ । এসমস্থ কারণে যুক্তফ্রণ্টের পতন ঘটেছিল । এব্যাপারে নতুন প্রজন্মের জন্য একটু বেশি আলোচনা করতে হচ্ছে । যুক্তফ্রণ্টের মৃত্যু ঘণ্টা বাজে নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার গঠন নিয়ে । এ ব্যাপারে আবুল মনসুর আহমদ “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” পঞ্চম সংস্করণ ২য় খন্ড ৫৭ পৃষ্ঠায় বলেছেন , “মন্ত্রিসভা গঠন লইয়া হক সাহেবের সাথে শহীদ সাহেব (সোহরাওয়ার্দী ) ও ভাসানী সাহেবের মতান্তর হইল । ----- সে মতভেদ ছিল দুই দলের দুইজন তরুণের মন্ত্রিত্ব লইয়া । ----- একজন হক সাহেবের (শেরেবাংলা) প্রিয়পাত্র এবং অপরজন শহীদ সাহেবের ।” এক্ষেত্রে জনাব আবুল মনসুর শহীদ সাহেবের প্রিয় পাত্রের নাম উল্লেখ করেন নি । জনাব অলি আহাদের “জাতীয় রাজনীতি ” ১৮৯ পৃষ্ঠায় , সরকার শাহাবুদ্দিন আহমদের “আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল” বইয়ের ১১৯ পৃষ্ঠায় এ প্রিয় পাত্রটির নাম উল্লেখ আছে । তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান । শেখ মুজিবুর রহমান তাকে মন্ত্রি করার জন্য আওয়ামিলীগের বেশকিছু কর্মীদের সংঘটিত করেছিলেন । তাই হোসেন সোহরাওয়ার্দী শেরে বাংলাকে অনুরোধ করেন শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রি সভায় নেয়ার জন্য । কিন্তু ‘ বদমেজাজী ও অপরিণত বুদ্ধি বলে শেরো বাংলা শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিসভায় নিতে অস্বীকৃতি জানালেন ।'' (“আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল” পৃষ্ঠা ১১৯ , ১২০ ) । ফলে আওয়ামিলীগের কোন সদস্য ছাড়াই শেরে বাংলা যুক্তফণ্টের মন্ত্রিসভা গঠন করেন । এভাবে সরকার গঠনের সূচনা থেকেই যুক্তফ্রণ্ট ভেঙ্গে পড়ে , তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভাঙ্গেনি । এদিকে মন্ত্রিসভায় কোন সদস্য না থাকায় আওয়ামিলীগ শেরে বাংলার সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা করতে থাকে । এর মধ্যে শেরে বাংলা কলকাতা সফরে যে বক্তব্য রেখেছিলেন , আওয়ামিলীগ সে বক্তব্যগুলোর কদর্য অর্থ করে । (জাতীয় রাজনীতি , পৃষ্ঠা ১৮৯ ) । কলকাতার এ বক্তব্য এবং শিল্পগুলোতে বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী শ্রমিকদের দাঙ্গার কারণে ৩০শে মে ’ ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় ৯২-ক এর মাধ্যমে গভর্ণরে শাসন প্রতিষ্ঠত হয় এবং শেরে বাংলার সরকার বহিস্কৃত হয় । অবশ্য এর পূর্বে ২রা মে একটি ঘটনার সুযোগ নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে যুক্তফ্রণ্টের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করে নেন । ঘটনাটি হল “চকবাজারের এক পানের দোকানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কারারক্ষী মকবুল হোসেন বাকী খরিদ বাবদ পঁচাত্তর পয়সা ঋণী ছিল । মকবুল হোসেন পুনরায় বাকী খরিদ করিতে চাহিলে দোকানদার বাকী বিক্রি করিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পূর্বেকার বাকী পঁচাত্তর পয়সা পরিশোধ করিতে বলে । ----এই তুচ্ছ ঘটনাই অচিরে জনতা ও কারারক্ষির মধ্যে সংঘর্ষের কারণ হইয়া দাঁড়ায় । রাজনৈতিক ফায়দা লুটার মতলবে খবর পাওয়ামাত্র পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামিলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদ্য নির্বাচিত সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান এক উচ্ছৃঙ্খল জনতার কাফেলাকে নের্তৃত্ব দিয়া জেল গেট আক্রমণ করেন । উচ্ছৃঙ্খল জনতা জেল গেট সন্নিকটবর্তী সশস্ত্র পুলিশদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠণে অগ্রসর হইলে আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার অপরিহার্য হিসেবে জেল গেটে প্রহারত সশস্ত্র পুলিশ গুলী বর্ষণ করিতে বাধ্য হয় । আই , জি , পি শামসুদ্দোহা সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ও আক্রমণকারী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করিবার প্রচেষ্টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেন এবং এবং পর মুহুর্তেই তাকে আবার মুক্তি দেয়া হয় । ঘটনা অতি সামান্য , অতি তুচ্ছ এবং অনুল্লেখযোগ্য অথচ ইহার ফলশ্রুতিতে একটি নির্দোষ নিষ্পাপ কিশোরকে পুলিশের গুলিতে আত্মাহুতি দিতে হইল ।” ((জাতীয় রাজনীতি , পৃষ্ঠা ১৮৯ ) । একই ঘটনার বিবরণ আপনরা পাবেন সরকার শাহাবুদ্দিন আহমদের “আত্মঘাতী রাজনীতি তিনকাল” বইয়ের ২য় খন্ডে । এক্ষেত্রে ঘটনাটি এজন্যই উল্লেখ করেছি যে , নেতারা বিভিন্ন মুখোরোচক দফা দেয় জনগণের ভোট নেয়ার জন্য কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য হল ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করা । আর আন্দোলনের মাধ্যমে যদি কোন লাশ পাওয়া যায় , তা হল নেতাদের কাংক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার মাধ্যম । ৫২ সালে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের গুলিতে মারা গিয়েছিল নিরীহ জনগণ । এতে লাভবান হয়েছিল মুসলিম লীগ বিরোধী দলগুলো , যারা পরবর্তীতে যুক্তফ্রণ্ট গঠন করেছিল । আবার ৫৪ সালে যুক্তফ্রণ্টের শেরে বাংলা সরকারের গুলীতে মারা গিয়েছিল এক কিশোর এবং লাভবান হয়েছিল যুক্তফ্রণ্টের অপর শরীকদল আওয়ামিলীগ । তাই ঘটনার ১৩ দিন পর ১৫ই মে আওয়ামিলীগ হতে আতাউর রহমান , আবুল মনসুর আহমদ , আব্দুস সালাম খান , হাশিমুদ্দিন আহমদ , শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রণ্ট মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন এবং পিছনে পড়ে থাকল এক কিশোরের লাশ । ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে পূর্ব বাংলায় শিল্পসমূহে বাঙ্গালী -অবাঙ্গালী দাঙ্গা এবং কলকাতায় শেরেবাংলার আবেগময়ী বক্তব্যের কারণে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রি বগুড়ার মোহাম্মদ আলী (বগুড়ার অধিবাসী) পূর্ব বাংলায় ৯২-ক ধারা প্রয়োগ করে ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে যুক্তফ্রণ্ট সরকারকে বহিস্কৃত করে এবং গভর্ণরের শাসন প্রতিষ্ঠিত করে । পরবর্তীতে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পূর্ব বাংলা সফরে আসেন । সবাই মনে করলেন ৯২-ক ধারা উঠে যাবে এবং পার্লামেণ্টারি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে । তাই ক্ষমতা লাভের আশায় যুক্তফ্রণ্টের দুই শরীক দল আওয়ামিলীগ এবং কৃষকশ্রমিক পার্টির মধ্যে প্রতিদন্দ্বিতা শুরু হল কে আগে গভর্ণরের গলায় মালা পরাবেন । শেষ পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে আওয়ামিলীগের পক্ষে আতাউর রহমান খান এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির পক্ষে শেরেবাংলা গভর্ণরের গলায় মালা পরালেন । ১৯৫৫ সালের ৩ জুন পূর্ব বাংলা হতে গভর্ণরের শাসন উঠে গেল এবং আওয়ামিলীগ হতে দলছুট কিছু অংশের সমর্থন এবং নেজামে ইসলামীকে নিয়ে শেরে বাংলা ৬ জুন পূর্ব বাংলায় নতুন সরকার গঠন করলেন । এক্ষেত্রে শেরেবাংলা নতুন সরকারের মূখ্যমন্ত্রি না হয়ে তার দলের আবু হোসেন সরকারকে মূখ্যমন্ত্রি করেন এবং নিজে পরে পূর্ব বাংলার গভর্ণর হন । (তথ্য সূত্রঃ আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল , জাতীয় রাজনীতি , আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর , ২য় খন্ড , স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামিলীগের ভূমিকা ) । আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় আসতে না পারায় তারা অন্ধভাবে শেরেবাংলার বিরোধীতা করা শুরু করল এবং প্রয়োজন দেখা দিল নিরীহ এবং বোকা জনগণের লাশ । এ ব্যবস্থাটি খুবই সুন্দরভাবে সমাধান করলেন আওয়ামিলীগের জনাব শেখ মুজিবুর রহমান । এ ব্যাপারে ১৯৯৬ সালে আওয়ামি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রি মেজর রফিকুল ইসলামের “স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামিলীগের ভূমিকা” বই হতে কিছু বক্তব্য তুলে ধরব । যদিও বইটি আওয়ামিলীগের গুণ-কীর্তনের জন্য লেখা হয়েছে , তথাপি সতর্ক এবং অনুসন্ধানী পাঠকের কাছে এখানে বেশ কিছু খোরাক রয়েছে । এ বইয়ের ৭৯ পৃষ্ঠায় আছে , “এ সময় কিছু তরুণকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আপোসহীনভাবে শেরেবাংলার বিরোধীতা করে যাচ্ছিলেন । ------ তাকে বলা হল মন্ত্রিসভায় তিনি যে পদ চাইবেন সে পদ দেয়া হবে তাঁকে । কয়েক দফা বৈঠক করে সৈয়দ আজিজুল হককে দায়িত্ব দেয়া হয় শেখ মুজিব যেন শেরে বাংলা বিরোধী কার্যক্রম হতে বিরত থাকেন । কিন্তু কোন প্রলোভন বা অনুরোধে শেখ মুজিব দমে যাননি ।” ৮৪ পৃষ্ঠায় আছে “১৯৫৬ সালের ৪ অগাস্ট তারিখে খ্যাদ্যের দাবীতে ঢাকাতে নিরন্ন মানুষের মিছিল হয় । -------সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে । এতদসত্ত্বেও শেখ মুজিবের নের্তৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জনগণ মিছিল করে । --------৩ জন বুভুক্ষু গ্রামবাসী নিহত হয় । শেখ মুজিব ১ জনের মৃতদেহ তুলে নিয়ে মিছিল সহকারে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করেন ।” ৮৬ পৃষ্ঠায় আছে “ ৪ সেপ্টেম্বর খাদ্যের দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল চলছিল । ঢাকার জেলা প্রশাসক ১৪৪ ধারা জারি করলে বিক্ষোভকারীরা তা মানলো না । ------ ৪নিহত ও শত শত লোক আহত হয় । ” ১ মাসের ভিতরে ৭ জনের লাশ । ফলে পূর্ব বাংলার গভর্ণর শেরেবাংলা বাধ্য হলেন নিজ দলের মন্ত্রিসভা বাতিল করতে এবং ১৯৫৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানকে মূখ্যমন্ত্রি করে আওয়ামিলীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয় । ৬ দিন পর ১২ই সেপ্টেম্বর কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি হন । ফলে কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামলিীগ এর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় । ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামিলীগ প্রধান সোহরাওয়ার্দি ১৯৫৭ সালের ১৪ই জুন ঢাকার পল্টনের জনসভায় বলে দেন ৫৬ এর সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানে ৯৮% ভাগ স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয়েছে । (জাতীয় রাজনীতি , পৃষ্ঠা ২০১ , আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল , ২য় খন্ড , পৃষ্ঠা ১৫৩) । যতীন সরকার “ পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু - দর্শন” বইয়ের ২২৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন , “ অধিবেশনের পরে আওয়ামিলীগে সোহরাওয়ার্দি সাহেবের প্রভাব প্রবল হতে থাকে । পাশ্চাত্যপন্থী পররাষ্ট্রনীতি ও পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসন বিরোধী অবস্থান নিয়েই বরং তিনি আওয়ামিলীগে তার নের্তৃত্বকে দৃঢ় করে তোলেন । ” সুতরাং বলা যায় যে , স্বায়ত্বশাসনের ধারণা আওয়ামিলীগ প্রদান করেছিল এজন্য যে , বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে নিজেদের জন সমর্থন বৃদ্ধি করা । ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামিলীগ স্বায়ত্বশাসনের ধারণা ভুলে গেল এবং ক্ষমতা হতে বিতাড়িত হওয়ার পর আবার একই ধারণা ৬ দফার মাধ্যমে জনগণের কাছে প্রকাশ করে , স্রেফ জন সমর্থন পাওয়ার জন্য । কিন্তু দেখা গেল ৬ দফার ভিত্তিতে ক্ষমতায় গিয়ে ১৯৭২ সালে আওয়ামিলীগ অনানুষ্ঠানিকভাবে একদলীয় শাসন এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাস হতে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত করে । কেন্দ্রে আওয়ামিলীগের শরীক দল রিপাবলিকান পার্টি আওয়ামিলীগের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করায় ১৯৫৭ সালের ১১ই অক্টোবর সোহরাওয়ার্দি প্রধানমন্ত্রির পদ হতে পদত্যাগ করেন । আওয়ামিলীগের হাত হতে কেন্দ্রের ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর শেরেবাংলার দল কৃষক শ্রমিক পার্টি সুযোগ খুজঁতে থাকে পূর্ব বাংলায় কীভাবে আওয়ামিলীগ সরকারের পতন ঘটানো যায় । ৫ মাসের ভিতরেই ১৯৫৮ সালের ৩১শে মার্চ শেরেবাংলা আওয়ামিলীগ সরকারকে বরখাস্ত করে তার দলকেই আবার ক্ষমতায় বসান । কিন্তু কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের সপ্তম প্রধানমন্ত্রি ফিরোজ খাঁন নুনকে বলে দেন , শেরেবাংলাকে গভর্ণর পদ হতে বরখাস্ত না করলে তিনি নুনের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহার করবেন । ফলে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর ভয়ে ফিরোজ খাঁন নুন ৪ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব বাংলার গভর্ণর শেরেবাংলাকে বরখাস্ত করেন এবং তার দলের মূখ্যমন্ত্রি আবু হোসেন সরকার ১২ ঘণ্টা রাজত্ব করে বরখাস্ত হন এবং পুনরায় আতাউর রহমানের নের্তৃত্বে আওয়ামিলীগ সরকার গঠন করে । কিন্তু শেরেবংলার কৃষক শ্রমিক পার্টি নাছোড় বান্দা । ১৯৫৮ সালের ১৮ই জুন আওয়ামিলীগ প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠা হারালে পুনরায় শেরেবাংলার দল আবু হোসেনের নের্তৃত্বে সরকার গঠন করে । কিন্তু এ সরকার মাত্র তিন দিন ছিল । এভাবে পূর্ব বাংলা প্রদেশে বারবার সরকার পরিবর্তন হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ইসকান্দর মীর্জা পূর্ব বাংলায় প্রেসিডেণ্টের শাসন চালু করেন । কিন্তু দু মাস পর ইসকান্দর মীর্জা বাধ্য হন প্রেসিডেণ্ট শাসন তুলে নিতে এবং পুনরায় ১৯৫৮ সালের ২৫শে অগাস্ট আতাউর রহমানের নের্তৃত্বে আওয়ামিলীগ সরকার গঠন করে । (জাতীয় রাজনীতি , স্বাধীনতার সংগ্রামে আওয়ামিলীগের ভূমিকা ) । ১৯৫৮ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর পূর্ব বাংলার ইতিহাসে এক কলংকময় দিন । এ দিন আওয়ামিলীগ তাদের অপছন্দের স্পীকার আব্দুল হাকিমের প্রতি অনাস্থা আনে এবং তাকে পাগল ঘোষণা করে । এ সময় স্পীকারের আসনে ছিলেন ডেপুটি স্পীকার জনাব শাহেদ আলী এবং সরকার দল আওয়ামিলীগ স্পীকার আব্দুল হাকিম যাতে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করতে না পারেন , সে ব্যবস্থা করে । ফলে সরকার দল এবং বিরোধী দলের প্রচন্ড হট্টগোলের মধ্যে জনাব শাহেদ আলী আহত হন এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর মারা যান । (আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল , ২য় খন্ড , জাতীয় রাজনীতি , আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর , ২য় খন্ড ) । এভাবে ক্ষমতার স্বার্থে আওয়ামিলীগ সংসদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ স্পীকারকে পাগল ঘোষণা করল এবং তাদেরই তান্ডবে শাহেদ আলীকে জীবন দিতে হল । চলবে ..... সুত্রঃ আবু নিশাত(সোনার বাংলাদেশ ব্লগ) |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন