অতএব আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি , ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট পাকিস্তান অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছিল পশ্চিম পান্জাব , সিন্ধু , বেলুচিস্তান , উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং হাজার মাইল দূরের পূর্ববাংলার জনগণ । একই ভাবে ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট পশ্চিম বাংলার জনগণ স্বাধীন হয়েছিল ভারতের সাথে অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে । পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীন হওয়ার পিছনে অবদান ছিল নবাব সলিমুল্লাহ , নবাব আলী , হোসেন শহীদ সোহরোয়ার্দী , শেরে বাংলা ফজলুল হক , খাঁজা নাজিম উদ্দিন , মওলানা আকরম খাঁ এবং নের্তৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ । এখানে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবে দেখা দেয় , তাহলে ১৯৭১ সাল পূর্ব বাংলার জন্য কী ছিল ? ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলা (৫৬ এর সংবিধান অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তান হতে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয় । সোজাকথা পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট এবং পূর্ব বাংলা এলাকা ঐ সময় ছিল পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত একটি প্রদেশ এবং ১৯৭১ সালে এ প্রদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । কথাগুলো লিখতে হচ্ছে এ কারণে যে , ইতিহাসের এত বিকৃতি হয়েছে যে , তরুণ প্রজন্ম মনে করে যে , ১৯৪৭ হতে ১৯৭১ এ ২৪ বছর পূর্ব বাংলা ছিল পরাধীন । কিন্তু আমরা যে ইতিহাস দেখেছি , সে ইতিহাস বলে দেয় পাকিস্তান প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল বাংলার জনগণের । বাংলার জনগণের রক্তের উপরই পাকিস্তান হয়েছিল । ৪৬ এর কলকাতার দাঙ্গা , যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে , তা ভারত বিভক্তিকে নিশ্চিত করে দেয় । রাজনৈতিক মত পার্থক্যের কারণে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভুল পদক্ষেপের জন্য পূর্ব বাংলা নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিণত হয় । ৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক রাষ্ট্র ছিল এবং পরে বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয় । কিন্তু তার জনগণ সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় স্বাধীন ছিল এবং আলাদা হওয়ার পরও স্বাধীন ছিল । আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানী পূর্ব ও পশ্চিম দুটি অংশে বিভক্ত হয় । তাহলে কি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানীর জনগণ দেশ বিভিক্তির মাধ্যমে নতুন করে স্বাধীন হয়েছে ? পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানী আবারও একত্রিত হল । তখন জনগণের স্বাধীনতার অবস্থাটি কী হবে ? মূল কথা হল রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে । যদি কোন ভূখন্ডের নাগরিক স্বাধীন থাকে , তবে ঐ ভূখন্ড একাধিক অংশে বিভক্ত হয়ে নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করলে বা পুনরায় একত্রিত হলে জনগণের স্বাধীনতার কোন পরিবর্তন হবে না । বাংলার মুসলমানরা ২০০ বছর বৃটিশদের সাথে সংগ্রাম করে তাদের হাত হতে ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট স্বাধীনতা লাভ করে । পূর্বের আলোচনায় দেখেছি সোহরাওয়ার্দী , শেরেবাংলা , আবুল হাশিম অখন্ড বাংলা চেয়েছিলেন । এ প্রস্তাবে মুসলীগ সভাপতি জিন্নাহ রাজী হলেও কংগ্রেস রাজী হয় নি । আবার স্বাধীন পূর্ব বাংলার দাবী তখন কেউ করেননি । কারণ পূর্ব বাংলার ৮০% জনগণ মুসলমান হওয়ায় এবং এর চারধারে হিন্দু ভারত থাকায় পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন হবে বলে তৎকালীন বাংলার নের্তৃবন্দ এ দাবী তুলেননি । তাই অখন্ড বাংলা না পাওয়ার কারণে পূর্ব বাংলার জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে এবং সিলেট অঞ্চল গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানে যোগ দেয় । ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাষ্ট পূর্ব বাংলার জনগণ কী পরিমাণ আনন্দো করেছিল , তা জানার জন্য আওয়ামিলীগ নেতা এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রি জনাব আবুল মনসুর আহমদের “আমার দেখা পঞ্চাশ বছর” ২য় খন্ড অধ্যয়ন করলে জানা যাবে । পূর্ব বাংলা ২৪ বছর পাকিস্তানের সাথে ছিল । এই ২৪ বছরে মধ্যে প্রথম ১১ বছর ছিল বেসামরিক শাসন ১৩ বছর ছিল সামরিক শাসন । এ সময়কালে পূর্ব বাংলার খাঁজা নাজিমউদ্দিন , বগুড়ার মোহাম্মদ আলী , হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন । ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে মুসলিম লীগ , কৃষক-শ্রমিক লীগ এবং আওয়ামিলীগ ছিল । এর মধ্যে মুসলিম লীগ ছিল সারা পাকিস্তান ব্যাপী একটি দল এবং কৃষক-শ্রমিক লীগ ও আওয়ামিলীগ হল পূর্ব বাংলা ভিত্তিক আঞ্চলিক দল । আবার পূর্ব বাংলা প্রদেশ শাসিত হয়েছিল যুক্তফ্রণ্ট এবং আওয়ামিলীগের মাধ্যমে । আইউবের সামরিক শাসনের সময় পূর্ব বাংলার গভর্ণর ছিলেন মোনায়েম খান , তিনি এ দেশেরই মানুষ ছিলেন ।
এখন আলোচনা করব পূর্ব বাংলা কেন পাকিস্তান হতে বেরিয়ে গেল ? এর উত্তর অনেকগুলো । প্রথম কারণটা হল পূর্ব বাংলার সাথে পাকিস্তানের বাকী অংশের দূরত্ব হল ১০০০ মাইল এবং কোন সরাসরি যোগাযোগ ছিল না । দ্বিতীয় কারণ হল ভাষাগত পার্থক্য এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রকাশ । তৃতীয় কারণ হল নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী যারা আরও বেশি ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছিল । এ সমস্ত কারণের সাথে যুক্ত ছিল পাকিস্তানকে বিভক্ত করার জন্য ভারতের চেষ্টা । ভারত তার অনুচরদের মাধ্যমে সবসময় চেষ্টা করেছে পাকিস্তানে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা । তবে এটা ঠিক পাকিস্তানের নের্তৃবৃন্দ সে সুযোগ ভারতকে তৈরি করে দিয়েছিলেন ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম সমস্যা দেখা দেয় ভাষা নিয়ে । পরবর্তীতে যারা ভাষা আন্দোলন দেখে নাই , তাদেরকে দেয়া হয়েছে এর বিকৃত ব্যাখ্যা । আজও বলা হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল । ১৯৪৮ সালে রেসকোর্সের ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে ভাষণ দিয়েছিলেন , সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে বলে ছিলেন “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কোন অঞ্চলের ভাষা হওয়া উচিত হবে না । তাই উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা । কিন্তু প্রদেশের ভাষা কী হবে তা নির্ধারণ করবে ঐ প্রদেশের জনগণ ।” এখন প্রদেশের ভাষা বাংলা হলে আমাদের মুখের ভাষা কীভাকে কেড়ে নেয়া হল ? বর্তমান পশ্চিম বাংলায় প্রদেশের ভাষা বাংলা কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হিন্দি ও ইংরেজি । তাহলে কী আমরা বলব ভারত সরকার পশ্চিম বঙ্গের মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়েছে ? ভাষা সৈনিক জনাব অলি আহাদের “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫হতে ৭৫” বই এ জনাব জিন্নাহর পুরো ভাষণটি দেয়া আছে । প্রকৃতপক্ষে উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের ভাষা ছিল না । যেমন পান্জাবের ভাষা হচ্ছে পান্জাবি , সীমান্ত প্রদেশের ভাষা পশতু , বেলুচিস্তানের ভাষা বালুচ , সিন্ধু প্রদেশের ভাষা সিন্ধি এবং পূর্ব বাংলার ভাষা হচ্ছে বাংলা । যেহেতু উর্দু কোন অঞ্চলের ভাষা ছিল না এবং এটি ছিল শিক্ষিত মুসলমানদের ভাষা (ঢাকার নবাব পরিবার যাদের অবদানে এবং জমির উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে , তাদের ভাষা ছিল উর্দু) সেহেতু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল , যাতে কোন অঞ্চল দাবী করতে না পারে অমুক অঞ্চলের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছে । এখানে জেনে রাখাটা ভাল হবে যে , মোগল আমলে হিন্দি ভাষার সংস্কৃত শব্দগুলো বাদ দিয়ে ফার্সী শব্দের আধিক্যের মাধ্যমে উর্দু ভাষার সৃষ্টি হয় , যা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য ভাষায় পরিণত হয় । মোঘল আমল হতে উর্দু ভাষার বিকাশ ঘটে । কিন্তু সাধারণ মানুষ যাতে নিজ মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে , সে জন্য বলা হয়েছিল প্রদেশের ভাষা কী হবে তা প্রাদেশিক পরিষদ নির্ধারণ করবে । ফলে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক সরকার ১৯৪৮ সালের ৮ই এপ্রিল প্রদেশের সরকারি ভাষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাষা বাংলা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । (জাতীয় রাজনীতি , অলি আহাদ) এই সিদ্ধান্তই বলে দেয় পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা বাংলা হবে এবং বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেয়া হবে । বর্তমান প্রজন্মের কাছে মনে হতে পরে , সে সময় পূর্ব বাংলার সবাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন । বাস্তবে সে সময় পূর্ব বাংলার সবাই বাংলা ভাষার পক্ষে ছিলেন না । তবে যারা বাংলার বিপক্ষে ছিলেন , তারা কিন্তু প্রাদেশিক ভাষা বাংলা হবে , এ ব্যাপারে একমত ছিলেন । মতবিরোধ হচ্ছে কেন্দ্রে ভাষা বাংলা না উর্দু হবে । ভাষা সৈনিক অলি আহাদের “জাতীয় রাজনীতি” বইয়ের ৫২ পৃষ্ঠায় বলেন “ঢাকা শহরের আদিবাসীরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঘোরবিরোধী ছিল । তাহাদের দৃষ্টিতে আমাদের আন্দোলন ছিল মুসলিম ঐক্য বিনষ্টকারী ও হিন্দুদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ।” ভাষা আন্দোলনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বই জনাব মোস্তফা কামালের “ভাষা আন্দোলনঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন” বইয়ে ৩৫ জন ভাষা সৈনিকের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে । এ বই হতে কিছু বিষয় আমি তুলে ধরব । ৬৮ পৃষ্ঠায় ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ তোয়াহা বলেছেন ,“রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে ইশতেহার বিলি করতে গিয়ে ছাত্ররা একদিন চকবাজারে জনতা কর্তৃক ঘেরাও হয় । তখন পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল ছিল । ছাত্ররা উত্তেজিত জনতার সামনে অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হয় । ” ৪৩ পৃষ্ঠায় ভাষা আন্দোলনের অগ্রপথিক , তমুদ্দিন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল জনাব আবুল কাসেম বলেছেন , “সত্যিকার বলতে কী এ বইটি (রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ) কেনার মত ৫ জন লোকও প্রথমে ক্যাম্পাসে পাওয়া যায় নি । ------ ক্যম্পাসে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্র মুসলিম হল ও ফজলুল হক হলেও আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে বৈঠক করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি ।” ৫৫ পৃষ্ঠা আছে “স্বনামখ্যাত মৌলানা দীন মোহাম্মদ সাহেব প্রমুখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল্লায় ও মফস্বলের বহু স্থানে উর্দুকে সমর্থন করে বহু সভা করা হয় । এরা কয়েক লাখ দস্তখত যোগাড় করে কেন্দ্রীয় সরকারে কাছে এক মেমোরেন্ডাম পেশ করেন । ” ৫৭ পৃষ্ঠায় আছে “অন্যান্য স্থানেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে । কিন্তু কোথাও সামগ্রীকভাবে জনসাধারণের তেমন সক্রিয় সমর্থন পায়নি । কর্মী ও ছাত্রদের মধ্যেই বিশেষ করে এ আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল ।” ৬৩ পৃষ্ঠায় আছে “নির্বিচারে গুলী করে (২১শে ফেব্রুয়ারি) সরকার তাকে আগুনের মত চারিদিকে ছড়িয়ে দেয় । ----যে ঢাকার জনসাধারণ ১৯৪৮ সালে উর্দুর পক্ষে থেকে সরকারকে সবরকমের সাহায্য করেছে , তারাও সরকারের উপর ক্ষেপে যায় ।” উপরের প্রতিটি বক্তব্য ভাষা আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের । এখন সঠিক ইতিহাস কোনটি ? ভাষা আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের না বর্তমান কালের পল্টন ময়দানের বক্তব্য ? এ ব্যাপারে পাঠকরাই সিদ্ধান্ত নিবেন । ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর নীতিগতভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করাটা মেনে নেয়া হয় এবং ৫৬ এর সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় । তমুদ্দিন মজলিসের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যাচ্ছিল । কিন্তু এ আন্দেলনের ভিতরে ঢুকে ভারতীয় হিন্দুরা পাকিস্তানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পায়তারা করেছিল । এ হিন্দু ভাইয়েরা কাজ করছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির ব্যানারে । এ ব্যাপরে বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক এবং বামধারার রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত জনাব গাজীউল হক বলেছেন “এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব কোন কর্ম পদ্ধতি ছিল না । প্রকৃতপক্ষে এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির লেজুড় বিশেষ । ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কমরেডরা তো ছিলেন প্রায় সবাই হিন্দু । তারা আদর্শের দিক থেকে যতটুকু কমিউনিস্ট ছিলেন , তার চেয়ে বেশি ছিলেন হিন্দু ।” (একই বইয়ের ১৮৮ , ১৮৯ পৃষ্ঠা) । এই কমিউনিস্টরা পরবর্তীতে আওয়ামিলীগের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে পাকিস্তানের বিভক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনও আওয়ামিলীগের ঘাড় হতে এই কমিউনিস্ট ভূতরা দূরীভূত না হওয়ার কারণে আওয়ামিলীগের অনেক কাজ এ দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত করছে । আওয়ামিলীগ তার ঘাড় হতে এ কমিউনিস্ট ভূতগুলো দূর করতে পারলে , তারা এ দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের আরো কাছের দলে পরিণত হতে পারত । ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে কেউ কেউ মন্ত্রিত্ব ও রাষ্ট্রদুতের পদ বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন । জনাব আবুল কাসেম বলেছেন , “ অনেক এম ,এল,এ (আইনসভার সদস্য) বড় বড় কথা বলে যান , আর আন্দোলনের সুযোগে রাষ্ট্রদূতের পদ বা মন্ত্রিত্ব লাভ করেন ।”(একই বইয়ের ৫৪ পৃষ্ঠা) । এ ব্যাপারে ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ তোয়াহা বলেন “একদিন আমি ও তাজউদ্দিন (প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রি) আইন পরিষদের সদস্য মোঃ তোফাজ্জল আলীর বাড়ীতে যাই । তিনি আমাদের দেখেই দূর থেকে চীৎকার করে বলে উঠলেন আরে এসো এসো তোমাদের খবর আছে । ----- তোমরা দুটি মন্ত্রিত্ব ও একটি রাষ্ট্রদূতের পদ পাচ্ছ । মুজিব (বঙ্গবন্ধু ) তোমাদের কিছু বলেনি । ---- শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের প্রাণশক্তিকে ------ ক্ষমতার লোভে ব্যবহার করলেন ।” (একই বইয়ের ৭১ পৃষ্ঠা ) । ভাষা সৈনিক জনাব অলি আহাদ লিখেছেন , “সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের কার্যত ত্রিনেতা মোহাম্মদ আলী চৌধূরীকে ব্রক্ষদেশে (বার্মা) রাষ্ট্রদূত করা হইল এবং তোফাজ্জল আলী ও ডাঃ আব্দুল মোত্তালেব মালেক নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলেন ।” (জাতীয় রাজনীতি , ৭৩ পৃষ্ঠা ) ।
বর্তমান প্রজন্ম এমন একটি ধারণা পেয়েছে যে , ভাষা আন্দোলন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে । প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলন ছিল তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে । কারণ সে সময় কেন্দ্রে ও প্রদেশে মুসলিম লীগ সরকার ছিল । ভাষা আন্দোলনের মূল ধাক্কাটি গিয়েছিল পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগ সরকারের উপর । ২১ শে ফেব্রুয়ারির পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যে মিছিল হয়েছিল , সে মিছিলের শ্লোগান ছিল -
“নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
উর্দু-বাংলায় বিরোধ নেই
খুনী নূরুল আমীনের বিচার চাই
খুনের বদলা খুন চাই ।”
(জাতীয় রাজনীতি , ১৪৩ পৃষ্ঠা)
উপরের এই শ্লোগান স্পষ্ট বলে দেয় , বিভোক্ষকারীদের আক্রোশ ছিল পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের নুরুল আমীন সরকারের উপর। ২১শে ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণের কারণেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রণ্টের নিকট পরাজিত হয় । ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুযারি পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সরকার জনতার উপর যে গুলি চালিয়েছিল , সে গুলি চালানো আজ কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে ? আজ গণতন্ত্রের জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল সে আন্দোলনে এরশাদ সরকার গুলি চালায় নি ? হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার সরকার বিভিন্ন সময়ে গুলি চালায় নি ? ৭২-৭৫এর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গুলি চালায় নি ? গুলি চালিয়ে সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হয় নি ? প্রতিটি সরকার গুলি চালানোর একটিই ব্যাখ্যা দেয় । “সরকারি সম্পদ ও আইন শৃংখলা রক্ষার জন্য মারমুখী জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার বাধ্য হয়ে গুলি চালিয়েছে ।” গুলিতে মারা যায় সাধারণ জনগণ এবং লাভবান হন নের্তৃবৃন্দ । ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা পায় এবং ৫৬ সালে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পায় । তবে আজ কেন পূর্ব বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার পর আমরা আমাদের সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠাই ? প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম কেন ইংরেজি ? অফিস - আদালতে কেন বাংলার পুরোপুরি প্রচলন হল না ? এর উত্তরটি রয়েছে ভাষা সৈনিক জনাব অলি আহাদের “জাতীয় রাজনীতি” বইয়ের ১৩৪ পৃষ্ঠায় । আমি জানি না ভাষা সৈনিক অলি আহাদ এ বিষয়ের প্রতি চিন্তা করেছেন কিনা ? সেখানে বলা হয়েছে “ রাত প্রায় ১,৩০ মিনিটে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামিলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক সংগ্রাম পরিষদের এই সভায় বিবেচনার জন্য নিম্নোক্ত প্রস্তাব পেশ করেন -
'' Resolved that in vew of the promulgation of the section 144 -------- the committee will ipso facto stand dissolved . ''
অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম পরিষদের সভায় আন্দোলনকারী জনাব শামসুল হক প্রস্তাবটি বাংলায় না দিয়ে ইংরেজি ভাষায় দিলেন , আর দাবী করছেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই !
প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল উর্দু বা পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে নয় বরং উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার জন্য । এ আন্দোলনের পিছনে ছিল ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ , মওলানা আকরম খাঁ , কবি ফররুখ আহমদ , জনাব আব্দুল গফুর , প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম প্রমুখের মহৎ উদ্যোগ । কিন্তু এ আন্দোলন হতে পূর্ব বাংলার নের্তৃবৃন্দ ফায়দা লাভ করার চেষ্টা করেছেন , কেউ হয়েছেন রাষ্ট্রদূত এবং কেউ কেউ হয়েছেন মন্ত্রি এবং এটাকে ইস্যু করে নিজ দলকে করেছেন শক্তিশালী । তবে এটা ঠিক ভাষা আন্দোলন পরবর্তিতে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । চলবে ... ।
সুত্রঃ আবু নিশাত(সোনার বাংলাদেশ ব্লগ)
এখন আলোচনা করব পূর্ব বাংলা কেন পাকিস্তান হতে বেরিয়ে গেল ? এর উত্তর অনেকগুলো । প্রথম কারণটা হল পূর্ব বাংলার সাথে পাকিস্তানের বাকী অংশের দূরত্ব হল ১০০০ মাইল এবং কোন সরাসরি যোগাযোগ ছিল না । দ্বিতীয় কারণ হল ভাষাগত পার্থক্য এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রকাশ । তৃতীয় কারণ হল নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী যারা আরও বেশি ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছিল । এ সমস্ত কারণের সাথে যুক্ত ছিল পাকিস্তানকে বিভক্ত করার জন্য ভারতের চেষ্টা । ভারত তার অনুচরদের মাধ্যমে সবসময় চেষ্টা করেছে পাকিস্তানে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা । তবে এটা ঠিক পাকিস্তানের নের্তৃবৃন্দ সে সুযোগ ভারতকে তৈরি করে দিয়েছিলেন ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম সমস্যা দেখা দেয় ভাষা নিয়ে । পরবর্তীতে যারা ভাষা আন্দোলন দেখে নাই , তাদেরকে দেয়া হয়েছে এর বিকৃত ব্যাখ্যা । আজও বলা হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল । ১৯৪৮ সালে রেসকোর্সের ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে ভাষণ দিয়েছিলেন , সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে বলে ছিলেন “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কোন অঞ্চলের ভাষা হওয়া উচিত হবে না । তাই উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা । কিন্তু প্রদেশের ভাষা কী হবে তা নির্ধারণ করবে ঐ প্রদেশের জনগণ ।” এখন প্রদেশের ভাষা বাংলা হলে আমাদের মুখের ভাষা কীভাকে কেড়ে নেয়া হল ? বর্তমান পশ্চিম বাংলায় প্রদেশের ভাষা বাংলা কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হিন্দি ও ইংরেজি । তাহলে কী আমরা বলব ভারত সরকার পশ্চিম বঙ্গের মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়েছে ? ভাষা সৈনিক জনাব অলি আহাদের “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫হতে ৭৫” বই এ জনাব জিন্নাহর পুরো ভাষণটি দেয়া আছে । প্রকৃতপক্ষে উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের ভাষা ছিল না । যেমন পান্জাবের ভাষা হচ্ছে পান্জাবি , সীমান্ত প্রদেশের ভাষা পশতু , বেলুচিস্তানের ভাষা বালুচ , সিন্ধু প্রদেশের ভাষা সিন্ধি এবং পূর্ব বাংলার ভাষা হচ্ছে বাংলা । যেহেতু উর্দু কোন অঞ্চলের ভাষা ছিল না এবং এটি ছিল শিক্ষিত মুসলমানদের ভাষা (ঢাকার নবাব পরিবার যাদের অবদানে এবং জমির উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে , তাদের ভাষা ছিল উর্দু) সেহেতু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল , যাতে কোন অঞ্চল দাবী করতে না পারে অমুক অঞ্চলের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছে । এখানে জেনে রাখাটা ভাল হবে যে , মোগল আমলে হিন্দি ভাষার সংস্কৃত শব্দগুলো বাদ দিয়ে ফার্সী শব্দের আধিক্যের মাধ্যমে উর্দু ভাষার সৃষ্টি হয় , যা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য ভাষায় পরিণত হয় । মোঘল আমল হতে উর্দু ভাষার বিকাশ ঘটে । কিন্তু সাধারণ মানুষ যাতে নিজ মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে , সে জন্য বলা হয়েছিল প্রদেশের ভাষা কী হবে তা প্রাদেশিক পরিষদ নির্ধারণ করবে । ফলে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক সরকার ১৯৪৮ সালের ৮ই এপ্রিল প্রদেশের সরকারি ভাষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাষা বাংলা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । (জাতীয় রাজনীতি , অলি আহাদ) এই সিদ্ধান্তই বলে দেয় পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা বাংলা হবে এবং বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেয়া হবে । বর্তমান প্রজন্মের কাছে মনে হতে পরে , সে সময় পূর্ব বাংলার সবাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন । বাস্তবে সে সময় পূর্ব বাংলার সবাই বাংলা ভাষার পক্ষে ছিলেন না । তবে যারা বাংলার বিপক্ষে ছিলেন , তারা কিন্তু প্রাদেশিক ভাষা বাংলা হবে , এ ব্যাপারে একমত ছিলেন । মতবিরোধ হচ্ছে কেন্দ্রে ভাষা বাংলা না উর্দু হবে । ভাষা সৈনিক অলি আহাদের “জাতীয় রাজনীতি” বইয়ের ৫২ পৃষ্ঠায় বলেন “ঢাকা শহরের আদিবাসীরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঘোরবিরোধী ছিল । তাহাদের দৃষ্টিতে আমাদের আন্দোলন ছিল মুসলিম ঐক্য বিনষ্টকারী ও হিন্দুদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ।” ভাষা আন্দোলনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বই জনাব মোস্তফা কামালের “ভাষা আন্দোলনঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন” বইয়ে ৩৫ জন ভাষা সৈনিকের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে । এ বই হতে কিছু বিষয় আমি তুলে ধরব । ৬৮ পৃষ্ঠায় ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ তোয়াহা বলেছেন ,“রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে ইশতেহার বিলি করতে গিয়ে ছাত্ররা একদিন চকবাজারে জনতা কর্তৃক ঘেরাও হয় । তখন পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল ছিল । ছাত্ররা উত্তেজিত জনতার সামনে অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হয় । ” ৪৩ পৃষ্ঠায় ভাষা আন্দোলনের অগ্রপথিক , তমুদ্দিন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল জনাব আবুল কাসেম বলেছেন , “সত্যিকার বলতে কী এ বইটি (রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ) কেনার মত ৫ জন লোকও প্রথমে ক্যাম্পাসে পাওয়া যায় নি । ------ ক্যম্পাসে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্র মুসলিম হল ও ফজলুল হক হলেও আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে বৈঠক করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি ।” ৫৫ পৃষ্ঠা আছে “স্বনামখ্যাত মৌলানা দীন মোহাম্মদ সাহেব প্রমুখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল্লায় ও মফস্বলের বহু স্থানে উর্দুকে সমর্থন করে বহু সভা করা হয় । এরা কয়েক লাখ দস্তখত যোগাড় করে কেন্দ্রীয় সরকারে কাছে এক মেমোরেন্ডাম পেশ করেন । ” ৫৭ পৃষ্ঠায় আছে “অন্যান্য স্থানেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে । কিন্তু কোথাও সামগ্রীকভাবে জনসাধারণের তেমন সক্রিয় সমর্থন পায়নি । কর্মী ও ছাত্রদের মধ্যেই বিশেষ করে এ আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল ।” ৬৩ পৃষ্ঠায় আছে “নির্বিচারে গুলী করে (২১শে ফেব্রুয়ারি) সরকার তাকে আগুনের মত চারিদিকে ছড়িয়ে দেয় । ----যে ঢাকার জনসাধারণ ১৯৪৮ সালে উর্দুর পক্ষে থেকে সরকারকে সবরকমের সাহায্য করেছে , তারাও সরকারের উপর ক্ষেপে যায় ।” উপরের প্রতিটি বক্তব্য ভাষা আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের । এখন সঠিক ইতিহাস কোনটি ? ভাষা আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের না বর্তমান কালের পল্টন ময়দানের বক্তব্য ? এ ব্যাপারে পাঠকরাই সিদ্ধান্ত নিবেন । ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর নীতিগতভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করাটা মেনে নেয়া হয় এবং ৫৬ এর সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় । তমুদ্দিন মজলিসের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যাচ্ছিল । কিন্তু এ আন্দেলনের ভিতরে ঢুকে ভারতীয় হিন্দুরা পাকিস্তানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পায়তারা করেছিল । এ হিন্দু ভাইয়েরা কাজ করছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির ব্যানারে । এ ব্যাপরে বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক এবং বামধারার রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত জনাব গাজীউল হক বলেছেন “এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব কোন কর্ম পদ্ধতি ছিল না । প্রকৃতপক্ষে এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির লেজুড় বিশেষ । ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কমরেডরা তো ছিলেন প্রায় সবাই হিন্দু । তারা আদর্শের দিক থেকে যতটুকু কমিউনিস্ট ছিলেন , তার চেয়ে বেশি ছিলেন হিন্দু ।” (একই বইয়ের ১৮৮ , ১৮৯ পৃষ্ঠা) । এই কমিউনিস্টরা পরবর্তীতে আওয়ামিলীগের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে পাকিস্তানের বিভক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনও আওয়ামিলীগের ঘাড় হতে এই কমিউনিস্ট ভূতরা দূরীভূত না হওয়ার কারণে আওয়ামিলীগের অনেক কাজ এ দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত করছে । আওয়ামিলীগ তার ঘাড় হতে এ কমিউনিস্ট ভূতগুলো দূর করতে পারলে , তারা এ দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের আরো কাছের দলে পরিণত হতে পারত । ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে কেউ কেউ মন্ত্রিত্ব ও রাষ্ট্রদুতের পদ বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন । জনাব আবুল কাসেম বলেছেন , “ অনেক এম ,এল,এ (আইনসভার সদস্য) বড় বড় কথা বলে যান , আর আন্দোলনের সুযোগে রাষ্ট্রদূতের পদ বা মন্ত্রিত্ব লাভ করেন ।”(একই বইয়ের ৫৪ পৃষ্ঠা) । এ ব্যাপারে ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ তোয়াহা বলেন “একদিন আমি ও তাজউদ্দিন (প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রি) আইন পরিষদের সদস্য মোঃ তোফাজ্জল আলীর বাড়ীতে যাই । তিনি আমাদের দেখেই দূর থেকে চীৎকার করে বলে উঠলেন আরে এসো এসো তোমাদের খবর আছে । ----- তোমরা দুটি মন্ত্রিত্ব ও একটি রাষ্ট্রদূতের পদ পাচ্ছ । মুজিব (বঙ্গবন্ধু ) তোমাদের কিছু বলেনি । ---- শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের প্রাণশক্তিকে ------ ক্ষমতার লোভে ব্যবহার করলেন ।” (একই বইয়ের ৭১ পৃষ্ঠা ) । ভাষা সৈনিক জনাব অলি আহাদ লিখেছেন , “সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের কার্যত ত্রিনেতা মোহাম্মদ আলী চৌধূরীকে ব্রক্ষদেশে (বার্মা) রাষ্ট্রদূত করা হইল এবং তোফাজ্জল আলী ও ডাঃ আব্দুল মোত্তালেব মালেক নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলেন ।” (জাতীয় রাজনীতি , ৭৩ পৃষ্ঠা ) ।
বর্তমান প্রজন্ম এমন একটি ধারণা পেয়েছে যে , ভাষা আন্দোলন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে । প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলন ছিল তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে । কারণ সে সময় কেন্দ্রে ও প্রদেশে মুসলিম লীগ সরকার ছিল । ভাষা আন্দোলনের মূল ধাক্কাটি গিয়েছিল পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগ সরকারের উপর । ২১ শে ফেব্রুয়ারির পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যে মিছিল হয়েছিল , সে মিছিলের শ্লোগান ছিল -
“নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
উর্দু-বাংলায় বিরোধ নেই
খুনী নূরুল আমীনের বিচার চাই
খুনের বদলা খুন চাই ।”
(জাতীয় রাজনীতি , ১৪৩ পৃষ্ঠা)
উপরের এই শ্লোগান স্পষ্ট বলে দেয় , বিভোক্ষকারীদের আক্রোশ ছিল পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের নুরুল আমীন সরকারের উপর। ২১শে ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণের কারণেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রণ্টের নিকট পরাজিত হয় । ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুযারি পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সরকার জনতার উপর যে গুলি চালিয়েছিল , সে গুলি চালানো আজ কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে ? আজ গণতন্ত্রের জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল সে আন্দোলনে এরশাদ সরকার গুলি চালায় নি ? হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার সরকার বিভিন্ন সময়ে গুলি চালায় নি ? ৭২-৭৫এর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গুলি চালায় নি ? গুলি চালিয়ে সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হয় নি ? প্রতিটি সরকার গুলি চালানোর একটিই ব্যাখ্যা দেয় । “সরকারি সম্পদ ও আইন শৃংখলা রক্ষার জন্য মারমুখী জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার বাধ্য হয়ে গুলি চালিয়েছে ।” গুলিতে মারা যায় সাধারণ জনগণ এবং লাভবান হন নের্তৃবৃন্দ । ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা পায় এবং ৫৬ সালে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পায় । তবে আজ কেন পূর্ব বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার পর আমরা আমাদের সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠাই ? প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম কেন ইংরেজি ? অফিস - আদালতে কেন বাংলার পুরোপুরি প্রচলন হল না ? এর উত্তরটি রয়েছে ভাষা সৈনিক জনাব অলি আহাদের “জাতীয় রাজনীতি” বইয়ের ১৩৪ পৃষ্ঠায় । আমি জানি না ভাষা সৈনিক অলি আহাদ এ বিষয়ের প্রতি চিন্তা করেছেন কিনা ? সেখানে বলা হয়েছে “ রাত প্রায় ১,৩০ মিনিটে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামিলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক সংগ্রাম পরিষদের এই সভায় বিবেচনার জন্য নিম্নোক্ত প্রস্তাব পেশ করেন -
'' Resolved that in vew of the promulgation of the section 144 -------- the committee will ipso facto stand dissolved . ''
অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম পরিষদের সভায় আন্দোলনকারী জনাব শামসুল হক প্রস্তাবটি বাংলায় না দিয়ে ইংরেজি ভাষায় দিলেন , আর দাবী করছেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই !
প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল উর্দু বা পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে নয় বরং উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার জন্য । এ আন্দোলনের পিছনে ছিল ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ , মওলানা আকরম খাঁ , কবি ফররুখ আহমদ , জনাব আব্দুল গফুর , প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম প্রমুখের মহৎ উদ্যোগ । কিন্তু এ আন্দোলন হতে পূর্ব বাংলার নের্তৃবৃন্দ ফায়দা লাভ করার চেষ্টা করেছেন , কেউ হয়েছেন রাষ্ট্রদূত এবং কেউ কেউ হয়েছেন মন্ত্রি এবং এটাকে ইস্যু করে নিজ দলকে করেছেন শক্তিশালী । তবে এটা ঠিক ভাষা আন্দোলন পরবর্তিতে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । চলবে ... ।
সুত্রঃ আবু নিশাত(সোনার বাংলাদেশ ব্লগ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন