পৃথিবীর বুকে প্রকৃতির সবুজ আর রক্তের লালে যে স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে আত্মপ্রকাশ করল, সে বাংলাদেশের জন্মের সাথে যে দুটি নাম সবচেয়ে বেশি জড়িত তারা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।কিন্তু কেনই বা তারা নিহত হলেন, কিভাবে হলেন, বাংলাদেশ কে আবদ্ধ করলেন রক্তের ঋণে- তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় পৃথিবীর বিখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনি মাস্কারনহাসের বিখ্যাত বই “ Bangladesh : Legacy of blood” যার শাব্দিক অর্থ হতে পারে “বাংলাদেশঃ রক্তের ঋণ”। এ ব্যাপারে এ্যান্থনি মাস্কারনহাস বলেন- “এই বইটি বাংলাদেশের প্রথম দশ বছরের দুঃখজনক ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে লিখিত। ঘটনার প্রধান নায়কদের সাথে আমার ব্যাক্তিগত জানাশুনা, নাটকীয় ঘটনা প্রবাহের সাথে জড়িতদের সাথে ১২০টি সাক্ষাৎকার এবং সরকারি দলিল-নথিপত্র সাপেক্ষে এর ভিত রচিত হয়েছে। মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ শেখ মুজিবকে কেন এবং কিভাবে হত্যা করেছেন, ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যা রহস্য অভিযুক্তরা নিজেরাই বর্ণনা করেছেন। জেনারেল জিয়া সম্পর্কে বলেছেন তার বন্ধু-বান্ধব ও সমালোচকগন। শহিদদের ঢেলে দেওয়া রক্তের কাহিনীতে একটি কথায় বেরিয়ে এসেছে , যখন প্রত্যাশার দ্বীপ শিখা নির্বাপিত হয়, বাধ্যবাধকতা দায়িত্ব যখন অস্বীকৃত হয়, জনগণের হারানোর যখন আর কিছুই বাকি থাকে না, তখন তারা ভুল সংশোধনের জন্য আক্রমণের পন্থা বেছে নেয়। শেক্সপিয়ার বলেছেন- মানুষ যে অনিষ্ট সাধন করে তা তার মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকে। আর সাধিত মঙ্গল প্রায়শইঃ তাদের অস্থি মজ্জা কবরস্থ হয়ে যায়। শেখ মুজিব এবং আর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এমতাবস্থায়, বইটি অনিবার্য কারণেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে নেতাদের ভুলের দিকে। আমি সেজন্য কোন ক্ষমা প্রার্থনা করছি না। জনগণের অবশ্যই অধিকার রয়েছে নেতাদের ভুল সম্পর্কে জানার। আর আমরাও তাদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।”
বইটির বাংলা অনুবাদের অংশ তুলে ধরে অগণিত পাঠককে এই দুজন মহান নেতার হত্যা সম্পর্কে অজানা তথ্য জানাতে। কোন মন্তব্য বা উক্তির সাথে আমার কোন সম্পর্ক বা দায় নেই। ধারাবাহিক ভাবে বইটির অনুবাদ প্রকাশ করবো। অনুবাদ করেছেন তারেক রাজীব।

অধ্যায়-১
দেশের জন্য আমি যা করেছি কেউ তা অনুধাবন করল না।
--শেখ মুজিবর রহমান
আমি ১৫ তারিখে তা ঘটাতে যাচ্ছি;
মুজিবকে আমি চিরতরে সরিয়ে দিচ্ছি।
--মেজর ফারুক রহমান।
১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট । রাত হয়ে এসেছে। মেজর ফারুক বেঙ্গল ল্যান্সারস এর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক। মেজর ফারুক এবং তার সুন্দরী স্ত্রী ফরিদার তৃতীয় বিয়ে বার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা গলফ ক্লাবে চলছে জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন প্রায় শ'খানেক অতিথি।
ফারুক-ফরিদা একটি অতি জনপ্রিয় তরুণ দম্পতি। দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত, বিত্তশালী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারবর্গের সাথে রয়ছে তাদের নিবিড় বন্ধন। ঐ সকল পরিবারের সদসসরাই দেশের সরকারি আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আর উচ্চ আদালতের বিচারক। সুতারং, এ পার্টি ছিল সামাজিক ঘটনা প্রবাহের একটা বিশেষ অংশ। আয়োজনে ছিল জৌলুশ।
ফারুকের পূর্ব পুরুষও সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তাই পার্টিটি ছিল সামরিক ঐতিহ্যে বলীয়ান। সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে ব্যান্ড সঙ্গীতের মূর্ছনায় আকাশ-বাতাস মুখরিত। ক্লাব ঘরের টেবিলগুলোতে সাজানো ছিল খাসীর মাংসের বিরিয়ানী, কাবাব, মাংসের রেজালা ও পরিমাণমত ফলের সালাদ।
ফারুকের মামা জেনারেল স্টাফ প্রধান ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আরও ছিলেন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমানের মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক। ফারুকের জোয়ানেরা দম্পতির জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে আসে বেডরুমের জন্য পাটের এক চমৎকার গালিচা। বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনেরা আনে নগরীর অভিজাত কেন্দ্রগুলো থেকে উপহার সামগ্রী। ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক এসেছিলেন শেষের দিকে কিন্তু উপহারে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন। তিনি নিয়ে এসেছিলেন গণভবন অর্থাৎ প্রেসিডেন্টের সরকারী বাসভবনের প্রধান মালীর তৈরী মৌসুমি ফুলের এক বিরাট তোড়া। তিনি ফূলের তোড়াটি ফরিদাকে উপহার দিয়ে বাজীমাত করে দেন। তিনদিন পর সকলেই হয়তো রাতের ঘটনা প্রবাহ থেকে কোন সূত্র খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পেলেন না কিছুই। এদিকে ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক নীরবে হয়তো তার ভাগ্যকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন। সেদিন ফরিদার জন্য আনীত ফুলের তোড়াটি হয়তো তার জীবন বাঁচিয়ে ছিল।
ঐ রাতে কেউই ভাবতে পারেনি, কি ছিল ফারুকের মনে। উৎসবে তিনি ছিলেন অস্বাভাবিক রকমের প্রাণখোলা। তিনি যে কাজে মনস্থির করে ফেলেছিলেন তাতে হয় তিনি ফায়ারিং স্কোয়াডে যাবেন না হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে তার নাম অমোচনীয়ভাবে অক্ষয় করে রাখবেন। তার ভাষায় ‘আমি অনুষ্ঠান উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঐটিই হতে পারত আমার জীবনের শেষ অনুষ্ঠান।‘
অতিথিদের সবাই চলে গেলে পারিবারিক আলাপচারিতায় ফারুকের বাবা-মা, চট্টগ্রাম থেকে আগত ফরিদার মা,ফরিদার বড় বোন জোবাইদা, তার স্বামী মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ ঢাকায় অবস্থিত ২য় আর্টিলারির অধিনায়ক কফি ও সামান্য নাস্তা নিয়ে মগ্ন হন।
হটাৎই ফারুক তার ভায়রা মেজর রশিদকে একদিকে সরিয়ে আনেন। তিনি রশিদকে জানান, ‘আমি ১৫ই তারিখে তাই ঘটাতে যাচ্ছি, আমি শুক্রবার সকালে জীবনেরতরে মুজিবকে সরিয়ে দিচ্ছি।’
রশিদ চমকে উঠলেন। সচকিত রশিদ খুব দ্রুত চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কেউতো আবার ফারুকের কথা শুনে ফেলে নি! হটাৎ যেন গোপন ষড়যন্তের মাসগুলো শুরু হল বাংলাদেশে। কিন্তু রশিদ প্রস্তুত ছিলেন না। অনেকক্ষণ চুপ থেকে খুব আস্তে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন, ‘তুমি পাগল হয়েছে?’ ‘আমাদের তো কোন সাথী অফিসার নেই, নেই অস্ত্রশস্ত্র, আমরা কিভাবে তাহলে সফল হব?’
তেজদ্দীপ্ত শানিত চোখে ফারুক অন্য মেজরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটাই আমার সিদ্ধান্ত। পরিকল্পনা আমার তৈরিই আছে, কেউ না এলেউ আমি একাই এগিয়ে যাবো। তুমি ইচ্ছে করলে সরে দাড়াতে পারো। তবে জেনে রাখো, আমি ব্যর্থ হলে শাসক চক্র তোমাকেও ফাঁসিতে লটকাবে।
এবারো রশিদ অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। মনে হচ্ছিল তিনি ফারুকের কথাগুলো হজম করছিলেন। অবশেষে হালকা পাতলা গড়নের দিরঘাদেহী আর্টিলারির অধিনায়ক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে যদি করতে হয় তবে করো কিন্তু এ নিয়ে আমাদের আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে।
শহরের অন্যপ্রান্তে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ীটি তখনো দেশবাসীর চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। এটিই শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যিনি স্থপতি। এ বাড়ির কেউই জানে না মেজর ফারুকের পরিকল্পনা সম্পর্কে। শেখ মুজিবর রহমানের ছোট বোনের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে ৩২নম্বরের বাড়িতে দুই দিন আগে থেকেই আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত হয়েছিলেন। বিয়ে শেষ হলে বেগম মুজিব ভদ্রভাবে সবাইকে বিদায় দেন। তবুও কিছু আত্মীয়-স্বজন রয়ে গিয়ে ছিলেন। তাদের মাঝে মুজিবের প্রিয় বোনের স্বামী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত উপস্থিত ছিলেন। তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রন,পানি সম্পদ,পশু সম্পদ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন মন্ত্রনালয়ের দ্বায়িত্তে ছিলেন। আরও একজন সেখানে ছিলেন, তিনি হলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে আবুল হাসানাৎ আব্দুল্লাহ। তিনি তিন দিন পরে অলৌকিকভাবে পারিবারিক ধ্বংসযজ্ঞ হতে বেচে গিয়েছিলেন।
ঐ রাতে পারিবারিক বিষয়াদির সাথে তিনি রাষ্ট্রীয় কাজ নিয়েও ভাবছিলেন। তিনি তার প্রানপ্রিয় বাংলাদেশ নিয়ে যে কোন কিছু ভাবার সময় পরিবারের সবাইকে কাছে ডেকে নিতেন। সেদিনের আলোচ্য বিষয় ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রন।
আবুল হাসানাৎ আব্দুল্লাহ সেদিনের স্মৄতিচারন করতে গিয়ে বলেন, মামা সেদিন শরৎকালীন বন্যার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তামাকের পাইপ থেকে আসা ধোঁয়ায় পুরো ঘর মুখরিত হয়ে উঠেছিল। তিনি বলতে লাগলেন, আমি তখন বেশ ছোট। ড্রেজার কোম্পানির বিদেশীদের সাথে নদীর পাড়ে ফুটবল খেলতাম। হটাতই এসব ড্রেজার বার্জ বানিয়ে বার্মায় সরিয়ে নেয়া হল। আর সেগুলো ফিরে এলো না। আমরা যেখানে খেলতাম সেখানে এখন আর কোন নদী নেই- এখন শুধু চর আর চর। আর এ কারণেই প্রতি বছর আমরা বন্যার শিকার।
পরিবারের সবাইকে উদ্দেশ্যে তিনি বলে উঠলেন, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই কিন্তু ড্রেজারগুলো আমরা হাতে পাচ্ছি। তোমরা দেখো আমি ঠিকই নদীগুলো আঁচড়িয়ে ঠিক করে দিবো। আমার বাকশাল ঠিকই তা পারবে।তারপর হঠাৎই এক অসাড় মানসিকতায় তিনি বলে উথলেন, দেশের জন্য আমি যা করেছি তা কেউই বুঝতে পারল না।
ঐটি ছিল শেখ মুজিবর রহমানের অমিয় বাণী। কিন্তু ততক্ষণে তিনি তার প্রিয় বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার তলিনীতে চলে এসেছেন। এটা ছিল এক অতিমাত্রায় প্রেম-বিদ্বষ সম্পর্ক যা কেবল এক অতিমাত্রায় আবেগী ও উদ্বেলিত জাতির পক্ষেই সম্ভব। তারা তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়ে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। দেবতুল্য মানব শেখ মুজিব তার জাতির সাথে একাত্ম হতে গিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, জনগণকে ভালবাসার মাঝেই আমার শক্তি নিহিত। আর দুর্বলতা হচ্ছে আমি তোমাদেরকে অতিমাত্রায় ভালবাসি।
সাড়ে তিন বছর আগেই বাংলাদেশের জন্ম থেকেই তিনি তদেরকে গুরুর মতো শাসন করতেন। তিনি অদম্য উৎসাহে কাজ শুরু করলেন আর মঙ্গল চিন্তায় সদিচ্ছায় তার সচিবালয় তৈরি করলেন। তিনি সত্যের সাথে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেললেন। তার সরলতার আশ্রয় নিয়ে চারিপাশে জমতে লাগলো চাটুকারদের তোষামোদ। অনিবার্য কারণেই জনগনের জাদুরমত আসক্তির ভালবাসা ম্লান হয়ে এলো আর তোষামোদ পরিনত হল ভীষণ তিক্ততায়। তবে এসব সত্ত্বেও, শেখ মুজিব সব ঠিক করতে পারবেন বলে আশাবাদ করেছিলেন। বাংলদেশিদের কাছে তার অক্ষমতা ধারণাতীত বিষয় ছিল। কিন্তু আগস্টের ১৫ সব অসম্ভবকে সম্ভবের ইতিহাস সৃষ্টি করলো। আর্মির সাঁজোয়া বাহিনীর গাড়ি সামনে অগ্রসর হতে শুরু করলো। মেজররা দিপ্তপদে এগিয়ে চললো।
চলবে .....
বইটার বাংলা version কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। Please mail me the বাংলা version at navid.kaisar@yahoo.com if you have it. I'll be grateful to you. Thanks in advance.
উত্তরমুছুন