তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া নানা জানা-অজানা ও এক্সক্লুসিভ বিষয়ের বর্ণনা - ১২ম পর্ব

নির্বাচন কমিশন: বিতর্ক , পুনর্গঠন ও পরিচালিত কর্মকান্ড-১

প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে বিতর্ক ও বাস্তবতা


রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নির্বাচন কেন্দ্রীক অনেক বিষয়ে বিতর্ক উঠে। তার মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আজিজও ছিলেন এ বিতর্কের একটি অংশ জুড়ে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি এম এ আজিজকে নিয়ে বিতর্ক বাংলাদেশকে এক সংঘাতময় সাংবিধানিক সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেয়। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক থাকার সময়ে তিনি সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান। সে সময় বিরোধী দল তার নিয়োগের বিরোধিতা করে। কোনোরূপ বিতর্ক এবং কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাকে বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করা হয়। দুজন নির্বাচন কমিশনারের মতামত না নিয়ে ভোটার তালিকা গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। তাদের আনীত অভিযোগের সত্যতা যথেষ্ট প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। প্রকৃত সত্য হলো, ২০০১ সালে প্রণীত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ১ কোটি অবৈধ ভোটার বাতিল করার জন্য নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অপর দুজন কমিশনারের স¤মতিক্রমেই এ নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন করেন। অবশ্য পরে অপর দুজন কমিশনার এ নতুন তালিকা প্রণয়নের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। পরে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এ সংক্রান্ত এক রিট পিটিশনের জবাবে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ নতুন প্রণীত ভোটার তালিকার বিপক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়। ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সিইসি এম এ আজিজ আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেন। আপিল বিভাগ ২০০১ সালে প্রণীত ভোটার তালিকাকে মূল হিসেবে ধরে হালনাগাদ করার সিদ্ধান্ত দেয়। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকাকে হালনাগাদ করে। সর্বোচ্চ আদালতের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সিইসি এম এ আজিজ ও অন্য কমিশনাররা তাদের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত¦ যথাযথভাবে পালন করেন। কিন্ত– আওয়ামী লীগের নেতুত্বাধীন জোটের আন্দোলন ও কিছু সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন সিইসি এম এ আজিজ ও নির্বাচন কমিশনের মান-মর্যাদাকে টেনেহিঁচড়ে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। কিছু পত্রপত্রিকার বিকৃত তথ্য পরিবেশনের কারণ হিসেবে যে বিষয়টি জানা যায়, তা হলো বিচারক হিসেবে দায়িত¦ পালনকালে সিইসি এম এ আজিজ মানহানিকর সংবাদ পরিবেশনের জন্য চারটি প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকার স¤পাদকের বিরুদ্ধে মামলার বিচার করেন। ওই সব সম্পাদক ও তাদের মিত্র স¤পাদকদের পত্রিকায় বিচারপতি এম এ আজিজকে হেয় ও কটাক্ষ করে ধারাবাহিকভাবে নানা প্রচারনা চালানো হয়।
দেশের সর্বোচ্চ আইন হচ্ছে সংবিধান। আর এ সংবিধানকে সর্বতোভাবে সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা চালানো দেশের সব নাগরিকের নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব। সংবিধানকে অবজ্ঞা করে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া কিংবা সংবিধানকে উপেক্ষা করে কিছু করার প্রবণতা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। বিচারপতি এম এ আজিজ সব সাংবিধানিক নিয়মকানুন মেনেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হন। কিন্ত– সেই পবিত্র সংবিধানকে অবজ্ঞা করে পেশিশক্তির জোরে এম এ আজিজকে সিইসির পদ থেকে হটিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে। সিইসির পদত্যাগের দাবি নিয়ে লাঠি-লগি-বৈঠা নিয়ে প্রকাশ্য রাজপথে নেমে আসে চৌদ্দ দলীয় জোট সমর্থকরা। সিইসির গ্রহণযোগ্যতা ও তাকে নিয়ে বিতর্কে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ সমর্থক কিছু আইনজীবী । তারা সিইসির অপসারনের পক্ষে নানা সাংবিধানিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। অনেক চিন্তাশীল লেখক এ নিয়ে কলম ধরেন যাদের অনেকের কলমের খোঁচাই ছিল সিইসিকে নিয়ে অত্যন্ত তাচ্ছিল্লকর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দীন খান বলেন, ‘সাংবিধানিকভাবেই সিইসির অপসারণ সম্ভব’ শিরোনামে এক লেখায় সংবিধানের ৯৯, ১১৯ অনুচ্ছেদ ও ১৯৭২ সালের জনপ্রতিনিধিত¦ আদেশের বরাত দিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ‘নির্বাচন কমিশন কোনো আধাবিচারিক প্রতিষ্ঠান নয়, নির্বাচন কমিশনারদের পদগুলো আধাবিচারিক পদ নয় বরং নির্বাচন কমিশন প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান এবং কমিশনারদের পদগুলো প্রশাসনিক পদ। এ অবস্থায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ এমএ আজিজের বিচারপতি হিসেবে অবসরের দিন থেকে শূন্য হয়েছে ধরে নিয়ে রাষ্ট্রপতি গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করার মাধ্যমে ওই দিন থেকে এম এ আজিজ আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে বহাল নেই বলে ঘোষণা দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তার পদত্যাগ বা অপসারণ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ থাকবে না।’ কিন্তু এম এ আজিজ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত¦ গ্রহণ করেন, নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন করেন, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে আবার হালনাগাদ করেন, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সম্বোধন করা হয়, কাল্পনিক বিতর্কিত হলেও যাকে সারাদেশের জনগণ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে জেনেছিলো, মিডিয়ার কল্যাণে সারাবিশ্ব যখন তাকে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে চিনেছিলো আর তখন কি না তিনি যেদিন বিচারপতি পদ থেকে অবসর নিলেন সেদিন থেকেই আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার নেই মর্মে ঘোষণা শুধু হাস্যকরই নয়, আত্মঘাতীও বটে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. অবঃ হাসান মশহুদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয় অস্বীকার করে সিইসি মিথ্যা বলেছেন এবং অসদাচরণ করেন। সুতরাং অসদাচরণের অভিযোগে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করানো হোক। উপদেষ্টা পরিষদের কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই এ ধরনের একটি গোপন বিষয় প্রকাশ করে লে. জে. হাসান মশহুদ চৌধুরী প্রকারান্তরে সংবিধান লঙ্ঘন করেন। সংবিধানের তৃতীয় তফসিলের ১৪৮ (২ক) (খ) অনুচ্ছেদে উপদেষ্টাদের জন্য গোপনীয়তার শপথে বলা হয়েছে, ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কিংবা উপদেষ্টারূপে যে সকল বিষয় আমার বিবেচনার জন্য আনীত হইবে বা যে সকল বিষয় আমি অবগত হইব, তাহা প্রধান উপদেষ্টা কিংবা উপদেষ্টারূপে যথাযথভাবে আমার কর্তব্য পালনের প্রয়োজন ব্যতীত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ব্যক্তির নিকট গোপন করিব না বা কোনো ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করিব না।’ প্রকৃত অর্থে উপদেষ্টা লে. জে. হাসান মশহুদ চৌধুরী সিইসিকে পদত্যাগের অনুরোধ করতে গিয়ে কার্যত সততার নামে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য বুদ্ধিকে লেজেগোবরে করে ফেলেন। তিনি বলেননি, পদত্যাগের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকে তিনি সিইসিকে অনুরোধ করেন কি না। আর সেটি করে থাকলে তার ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্বের বরখেলাপ হতো, শপথ ভঙ্গ হতো। আর সে ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজই অন্যায় বলেন নি যে, তার সঙ্গে পদত্যাগের বিষয়ে কোনো উপদেষ্টার কথা হয়নি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন