নির্বাচন কমিশন: বিতর্ক , পুনর্গঠন ও পরিচালিত কর্মকান্ড
ভোটার তালিকা মুদ্রণ বন্ধ না করেই নির্ভুল তালিকা তৈরির নির্দেশ
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নতুন ভোটার তালিকা মুদ্রণের কাজ যখন পুরোদমে চলে তখন নির্বাচন কমিশন সচিবকে বঙ্গভবনে তলব করা হয়। সচিবকে ভোটার তালিকা মুদ্রণ বন্ধ নয়, নির্ভুল তালিকা করার তাগিদ দেন রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। ৫ নভেম্বর ২০০৬ নির্বাচন কমিশন সচিব আব্দুর রশীদ সরকারকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে তার কাছ থেকে এ বিষয়ে খোঁজখবর নেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্ভুল ভোটার তালিকা কিভাবে করা যায় সে বিষয়ে তিনি কমিশনের মত জানতে চান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে ধারণা নেন। রাষ্ট্রপতিকে সচিব জানান, ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই হাতে যে সময় রয়েছে তার মধ্যে কোনোভাবেই চলমান তালিকা বাতিল করে নতুন করে তালিকা করা সম্ভব নয়। সচিব তালিকার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে আরো জানান, ভোটার তালিকা একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ তালিকায় সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ থাকে। তাই ২০০০ সালের মতো এবারও ভোটার তালিকা ‘আপগ্রেডিং’ করা হয়েছে। তালিকায় কারো নাম না উঠলে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ভুয়া নামের খবর পেলে তা বাদ দেয়া হবে। একইভাবে কোনো ভুলত্রুটি থাকলে তাও সংশোধন করা যাবে বলে সচিব জানান। ইসি সচিব রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ থেকে ফিরে সরাসরি সিইসির সঙ্গে দেখা করেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্কে তাকে জানান। এর আগে সকালে সিইসি অন্য কমিশনার ও ইসি সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এতে ভোটার তালিকা ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করার বিষয় সম্পর্কে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। বৈঠকে ইসি সচিবকে এ ব্যাপারে কমিশন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করে। নতুন করে তালিকা করা কি সম্ভব, না বিদ্যমান ভোটার তালিকাকে নির্ভুল করা সম্ভব- সে বিষয়ে কমিশনের মত জানতে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ইসি সচিবকে ডেকে পাঠান। সচিব বঙ্গভবনে গেলে তার কাছে ভোটার তালিকা নিয়ে ১৪ দলের দাবির প্রসঙ্গ তুলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না জানতে চান প্রধান উপদেষ্টা। সে অনুযায়ী কমিশনের বক্তব্য জানাতে সচিব আবারও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন।
পরে ইসি সচিব সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানান। তিনি বলেন, চলতি মাসের মধ্যেই ভোটার তালিকা মুদ্রণের কাজ শেষ হবে বলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন। তালিকা মুদ্রণের জন্য তখন কম্পোজের কাজ চলে। তিনি আরো বলেন, ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এর ৮-১০ দিন আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারলে ভালো। সময় স্বল্পতার জন্য তাই চলমান ভোটার তালিকার কাজ শেষ না করে বিকল্প কোনো পথ নেই। তবে তালিকায় অতিরিক্ত কারো নাম থাকলে অথবা দ্বৈত ভোটার থাকলে তাদের বাদ দেয়া এবং বাদ পড়ে যাওয়াদের নাম পাওয়া গেলে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে বলে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানকে জানিয়েছিলেন। উল্লেখিত বৈঠক চলাকালে রাষ্ট্রপতিকে ইসি সচিব আরো জানান, দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন সচিবকে ভোটার তালিকার ভুল সংশোধনে ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেন বলে সচিব সাংবাদিকদের জানিলেছিলেন। ব্রিফিংকালে সাংবাদিকরা কমিশন সচিবালয়ের সভাকক্ষে টাঙ্গানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছবির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সচিব এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে তাৎক্ষণিকভাবে ছবি নামিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করেন। সাংবাদিকদের উপস্থিতিতেই ওই ছবি নামিয়ে ফেলা হয়। এ সময় সচিব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে উঠেন, কমিশনের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন করতেই এটা নামনো হয়নি।
সাংবিধানিক কারণ দেখিয়ে নিজ পদে অনড় থাকেন সিইসি
৫ নভেম্বর পর্যন্ত সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো অনুরোধ যায়নি। অবশ্য অনানুষ্ঠানিক অনুরোধ এলেও সিইসি তাতে সাড়া দেননি। বরং তিনি সাংবিধানিক এই পদে থাকার ব্যাপারে থাকেন অনড় অবস্থানে। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যেও তা ফুটে উঠে। ৫ নভেম্বর ২০০৮ ইইউ-এর আট রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে তাদের বলেন, সংবিধানের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। ইসি সচিবের ব্রিফিংয়েও একই আভাস মেলে। সিইসি পদত্যাগ করছেন কি না অথবা তাকে কেউ পদত্যাগের অনুরোধ করেছেন কি না এ প্রশ্নের জবাব দেননি সচিব। ১৪ দল থেকে উত্থাপিত বিতর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিতর্ক তো অনেক কিছু নিয়েই থাকতে পারে। তবে সবাইকে সংবিধান মেনে চলতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী কমিশন কাজ করছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাহী বিভাগকে কমিশনকে সহায়তা দিতে হবে। আর নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন ভোটার তালিকা।
দিনভর পদত্যাগের গুজব
৫ নভেম্বর ২০০৬ দিনভর ছিল সিইসির পদত্যাগের গুজব। ইসি সচিব বঙ্গভবনে যাওয়ার পর এ গুজব আরো ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছ থেকে সিইসির কাছে আনুষ্ঠানিক পদত্যাগের অনুরোধ করা হবে। এক বা দুইজন উপদেষ্টাকে দিয়ে অনুরোধ জানানো হবে। তবে ৫নভেম্বর পর্যন্ত এ অনুরোধ যায়নি। অনানুষ্ঠানিক অনুরোধের জবাবে সিইসি তার অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানানোর চিন্তা বাদ দেয় বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে, ইসি সচিব বঙ্গভবন থেকে ফিরে এসে ব্রিফিং করলে সিইসি যে তার পদ থেকে সরছেন না তা সাংবাদিকদের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়।
সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা
সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজ ৫ নভেম্বর সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে অফিসে যান আগের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা নিয়ে তিনি সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। ১ নভেম্বর থেকেই তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়। সিইসি প্রবেশের পর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। সিইসির দেহরক্ষী গেটে কর্তব্যরত কর্মচারীকে সাংবাদিক প্রবেশে সিইসির নিষেধের কথা জানিয়ে দেন। বেলা ১১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা গেটের সামনে জড়ো হলেও তারা কেউ ভেতরে ঢুকতে পারেননি। এ সময় নির্বাচন কমিশনার স ম জাকারিয়া বাইরে সাংবাদিকদের অপেক্ষা করতে দেখে তাদের ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করেন। সিইসির নির্দেশে সাংবাদিকদের ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়া হলেও বিএনপির দুই সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেন বকুল ও মোশাররফ হোসেন মঙ্গু কমিশন সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। তারা নিজ এলাকার বিষয় নিয়ে কথা বলতে কমিশন সচিবালয়ে আসেন বলে জানানো হয়। এ ছাড়া এশিয়া ফাউন্ডেশনের তিন কর্মকর্তা সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এদিকে একই দিন অর্থাৎ ৫ নভেম্বর ২০০৬ ফরিদপুরের জেলা জজ আজিজুল হক নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যুগ্ম সচিব পদে যোগদান কনে।
বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু সিইসি
দেশের রাজনৈতিক বিতর্কে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি এম এ আজিজ। তার পদত্যাগ দাবি করে ১৪ দল এবং এর সহযোগী বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন। অন্যদিকে চারদলীয় ঐক্যজোট ও সহযোগী পেশাজীবী সংগঠনগুলো সিইসির পদত্যাগের বিরোধিতা করে বলে, সংবিধান অনুসারে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ জানানোর সুযোগই নেই। একসময় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বিচারপতি কে এম হাসান। বলা হয়েছিল তার জন্যই দেশে এত হানাহানি, অশান্তি। দায়িত্ব গ্রহণে বিচারপতি হাসান অপারগতা জ্ঞাপন করার পর সেই ইস্যুর সমাপ্তি ঘটে। এরপর রাজনৈতিক সঙ্কটের নতুন কেন্দ্রবিন্দু হন সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজ। একপর্যায়ে ১৪ দলের দাবি করা তুলনামূলকভাবে অনালোচিত আরেকটি ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব হস্তান্তর। সিইসির পদত্যাগ ইস্যু শেষ হলে রাষ্ট্রপতির প্রধান তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব হস্তান্তরের বিষয়টি নতুন ইস্যুতে পরিণত হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ড. কামাল হোসেন এ দাবি জানানোর পর ১৪ দল নেত্রী শেখ হাসিনা এটাকে গ্রহণ করে নেন।
সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজের পদত্যাগ দাবির পেছনে একটি প্রধান যুক্তি হলো¬ তিনি হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে নতুন ভোটার তালিকা তৈরি করেন। পরে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের এ আদেশ বহাল রাখেন। উচ্চতর আদালতের এই নির্দেশ অমান্য করায় তার এ পদে থাকার অধিকার নেই বলে দাবি করা হয়।
সিইসি আজিজের পক্ষে বলা হয়, ভোটার তালিকাসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি যে, নতুন ভোটার তালিকা করা যাবে না। অথবা নতুন ভোটার তালিকার চলমান কার্যক্রমে স্থগিতাদেশও দেয়া হয়নি। পরে আপিল বিভাগ সুনির্দিষ্টভাবে আদেশ দেয়ার পর নতুন ভোটার তালিকার কার্যক্রম বন্ধ করে হালনাগাদ ভোটার তালিকার কাজ শুরু হয়। এছাড়া সিইসির বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতের আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগ সঠিক নয় বলে বলা হয়।
সিইসির পদত্যাগের পক্ষে বলা হয়, গোটা জাতি বিচারপতি এম এ আজিজের মুহূর্তের মধ্যে পদত্যাগ চায়। চার দল ক্ষমতায় থাকাকালে কয়েকজন মন্ত্রীও সিইসির বিপক্ষে কথা বলেন। সুতরাং এই জাতীয় দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে তার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত।
এ বক্তব্যের বিপক্ষে বলা হয়, ১৪ দল এবং এর সহযোগী সংগঠন মানে গোটা জাতি নয়। বিগত সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের অধিকারী চারদলীয় জোট সিইসির পদত্যাগের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সিইসির পদত্যাগের দাবি বড়জোর জাতির একাংশের বক্তব্য হতে পারে। গোটা জাতির বক্তব্য কোনভাবেই নয়।
সিইসির পদত্যাগের পক্ষে আরো বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা তাকে পদত্যাগের অনুরোধ জানানোর কথা অঙ্গীকার করে বিচারপতি আজিজ অসত্য কথা বলেন। উপদেষ্টা হাসান মশহুদ বলেছিলেন, তিনি সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তিনি অসত্য বলেন না। বিচারপতি আজিজ মিথ্যা বলে অসদাচরণ করেছেন এবং সিইসি পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে সিইসির পদত্যাগের বিরোধীদের বক্তব্য হলো¬ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ পদত্যাগের অনুরোধ আসেনি বলে উল্লেখ করেছিলেন বিচারপতি আজিজ। উপদেষ্টার সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল গোপন ও অনানুষ্ঠানিক। আনুষ্ঠানিক অনুরোধ আর গোপন অনুরোধ এক নয়। বরং গোপনীয়তা ফাঁস করে সংশি¬ষ্ট উপদেষ্টাই অসদাচরণ করেছেন।
বিচারপতি আজিজের পদত্যাগের ব্যাপারে একজন উপদেষ্টা বলেন, খেলোয়াড়রা না চাইলে রেফারির থাকা উচিত নয়। যারা খেলবেন তারা না চাইলে রেফারি খেলা পরিচালনা করবেন কিভাবে?
সিইসির পক্ষের লোকজন বলেন, খেলা খেলোয়াড়ের ইচ্ছায় চলে না, চলে রেফারির ইচ্ছায়। খেলোয়াড়রা রেফারি নির্ধারণ করলে সে খেলা চালানো সম্ভব হবে কি না সন্দেহ রয়েছে।
দেশের শীর্ষ পর্যায়ের আইনজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন, সিইসির পদটি হলো একটি প্রশাসনিক পদ। সংবিধান অনুসারে কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর এ ধরনের লাভজনক পদে বসতে পারেন না। যেদিন বিচারপতি অবসর নিয়েছেন সেদিন থেকে তিনি সিইসি হিসেবে অবৈধ হয়ে গেছেন। এখন রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
এর বিপরীত পক্ষের মত হলো¬ নির্বাচন কমিশন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ দুটিই আধা বিচার বিভাগীয় এবং অলাভজনক পদ। সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদে কিছু পদাধিকারীর পারিশ্রমিক সম্পর্কে উলে¬খিত প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদের বাইরে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা, স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী বা উপদেষ্টা, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর বাইরে বিভিন্ন আইনে নির্বাচন কমিশনকে আধা বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে উলে¬খ করা হয়। ফলে সিইসির অবৈধ হয়ে যাবার যুক্তি ভিত্তিহীন।
১৪ দল ও সহযোগী সংগঠনের বক্তব্য অনুযায়ী তৎকালীন রাজনৈতিক সঙ্কটের একমাত্র সমাধান সিইসির পদ থেকে বিচারপতি আজিজের পদত্যাগ। তিনি পদত্যাগ করলে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একজন সিইসি নির্বাচন সম্ভব । এতে জনগণের ভোটাধিকার এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনও নিশ্চিত করা সম্ভব ।
চারদলীয় জোট এবং এর সমর্থকদের বক্তব্য অনুযায়ী সিইসির পদত্যাগে রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান তো হবেই না, বরং একটি জটিল রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হবে বলে মত দেন। বিচারপতি কে এম হাসান অপারগতা জানানোর পর সব দল গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত করতে পারেননি বলেই রাষ্ট্রপতিকে সর্বশেষ বিকল্প অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। সবার গ্রহণযোগ্য সিইসি নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তখন নির্বাচন অনুষ্ঠানই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে বলে তারা যুক্তি দেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দু পক্ষের কোনো পক্ষই অপর পক্ষের মত গ্রহণ বা ছাড় দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
তিন কমিশনারও সিইসির মতো পদত্যাগে অসম্মতি জ্ঞাপন
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি এম এ আজিজের মতো অন্য তিন কমিশনারও পদত্যাগে অসম্মতি জানান। তিন কমিশনার বিচারপতি মাহফুজুর রহমান, স ম জাকারিয়া ও মাহমুদ হাসান মনসুর ১৫ নভেম্বর এ কথাই জানান। কমিশনাররা সকালে ইসি সচিব আব্দুর রশীদ সরকারের কাছে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। কয়েকটি দৈনিক ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় ‘নির্বাচন কমিশনার ও সচিবরা তাদের দায়িত্ব পালনে আগ্রহী নন’ ¬এ ধরনের প্রকাশিত খবর প্রসঙ্গে কমিশনারদের এ মনোভাবের কথা ইসি সচিব সাংবাদিকদের কাছে জানান। কমিশনাররাও পৃথকভাবে সাংবাদিকদের কাছে একই অভিমত ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া কমিশন সচিবালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে দেয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সংবাদটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন করা হয়।
ইসি সচিবালয়ে বিকেলে ব্রিফিংকালে সচিব সাংবাদিকদের বলেন, তাকে উদ্ধৃত করে পদত্যাগ প্রসঙ্গে কোনো কোনো পত্রিকায় লেখা হয়েছে, আমি নিজেই নাকি ইসির সচিব পদে থাকতে রাজি নই। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এ পদে থাকতে আমার কোনো আপত্তিও নেই। সরকার বদলি করলে যেতে হবে। তবে তার মানে এই নয় যে, আমি সরকারকে বদলির জন্য বলছি। তাকে নিয়ে এলডিপির বক্তব্য সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, আমাকে সৎ লোক উল্লেখ করে যে প্রশংসা করা হয়েছে তার জন্য তাদের ধন্যবাদ। তবে একই সঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার, কেউ সৎ হলে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারেন না। বরং যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা যে আদেশ-নির্দেশ দেবে তা-ই মেনে চলতে হবে। তাই পদত্যাগ করার মতো কিছু ঘটেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আহ্বান
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা (এমইপিএস) রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের প্রতি নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠনের আহ্বান জানান, যাতে করে কমিশন সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। তারা বলেন,এমইপিএস ‘একটি শক্তিশালী ও কার্যকর তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ দেখতে আগ্রহী। ১৬ নভেম্বর ২০০৬ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্ট্রেট্রসবার্গে অনুষ্ঠিত এক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে গৃহীত এক প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়। এমইপিএস বলেন, সরকারের উচিত ‘এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা, যে পরিবেশে ভোটাররা সত্যিকার স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।’ তারা ‘নির্বাচনী প্রচারণাকালে গণমাধ্যমের ভারসাম্যপূর্ণ সংবাদ পরিবেশনের নিশ্চয়তাও’ চান।
তারা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও হয়রানি সৃষ্টিকারীদের বিচারের সম্মুখীন করার এবং অপরাধীদের অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।তারা দেশী ও বিদেশীদের সহায়তায় সঠিকভাবে ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্যও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানান।এমইপিএস রাজনৈতিক সহিংসতা পরিহার করার জন্য সব বিরোধপূর্ণ নির্বাচনী ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে সিইসির বাসভবনের সামনে শত শত মানুষ
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজের বাসভবনের সামনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে হাজির হন কয়েক শত মানুষ। যত দিন লাগে তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করে যাবেন বলে অঙ্গীকার করেন। ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের এই সিদ্ধান্ত নেয়।
এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজ তার পদ থেকে সরে না গেলে ১৯ নভেম্বর ২০০৬ থেকে কোনো দোকান মালিক এম এ আজিজের কাছে কোনো দ্রব্য বিক্রি করবে না। দোকান মালিক সমিতির এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঐদিন সকাল থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্য নিয়ে কাকরাইলস্থ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বাসভবনের সামনে হাজির হন শত শত মানুষ। তাদের কারো হাতে চাল, কারো হাতে ডাল, মাছ, গোশত, সবজি, কলা, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ বা অন্যকিছু। দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গে লিখে এনেছেন বিভিন্ন লেখা সংবলিত প্লাকার্ড। ঢাকা, বরিশাল, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন পেশার লোকজন এই দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে ঢাকায় আসেন। তারা জানান, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে কাউকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রি করতে হবে না। যত দিন লাগে বিনা পয়সায় তারাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করে যাবেন। শুধু নিত্যপ্রযোজনীয় দ্রব্যই নয়, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের যা কিছু প্রয়োজন হবে তার সব কিছুই তারা সরবরাহ করবেন বলে জানান। তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজের প্রতি অনুরোধ জানান, কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তিনি যেন পদত্যাগ না করেন।
বিকেলের দিকে এক মহিলা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বাসা থেকে বের হয়ে উপস্থিতি সবাইকে বলেন, তাদের এই কর্মকাণ্ডে প্রধান নির্বাচন কমিশনার খুশি, তবে বাসায় পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে বিধায় এ মুহূর্তে কোনো খাবারের প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পক্ষ থেকে ওই মহিলা উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানান এবং তাদের জন্য নিয়ে আসা খাদ্যসামগ্রী কোনো এতিমখানায় দান করার অনুরোধ জানান।
৯ উপদেষ্টা একমত হয়ে যান সুপ্রিম জুডিশিয়াল প্রস্তাবে কিন্তু...
বিরাজমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদ অনেক বিকল্পের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজকে অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউ›িসলে পাঠানোর প্রস্তাবও বিবেচনায় নেন। এক পর্যায়ে একমত হন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯ উপদেষ্টা। একজন শুধু এর সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেন।
১৪ দলের দাবি অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অপসারণ করতে সংবিধানে কী কী উপায় রয়েছে বিষয়টি উত্থাপিত হয় ১৮ নভেম্বর ২০০৬ উপদেষ্টা পরিষদের সভায়। এতে বলা হয়, সিইসি নিজে থেকে চলে যেতে রাজি না হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করাই একমাত্র উপায়। এতে বিষয়টি নিস্পত্তি করতে সময় লাগত ছয় মাস। ফলে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার কারনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ বাড়তে পারার বিষয়টিও তারা অনুধাবন করতে পারেন। বিষয়টি উত্থাপিত হওয়ার পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ব্যাপারে ৯ উপদেষ্টা ইতিবাচক মতামত দেন।
কিন্তু কিভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হবে এবং সাংবিধানিকভাবে সেটা সম্ভব কি না রাষ্ট্রপতি সে বিষয়ে জানতে চাইলে তখন উপদেষ্টাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। সংবিধান অনুসারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের মতো যথেষ্ট কারণ থাকা, উচ্চ আদালতের অনুমতির প্রয়োজন এবং তিনি এ নিয়ে আদালতে গেলে কী পরিস্থিতি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয় এবং সর্ব শেষ এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা সঠিক হবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশাবাদ ব্যক্ত করেন ইসি
ইউরোপীয় কমিশন নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক টিম পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের হবে এবং তা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে আরো সুসংহত করবে।’
ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) সদস্য বেনিটা ফেরেরো ওয়াল্ডনার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দীন আহমেদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয় এ চিঠিতে।
বেনিটা ফেরেরো ওয়াল্ডনার তার চিঠিতে নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণক্রমে সেপ্টেম্বর ২০০৬ এ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবেশ যাচাই মিশনের বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, মিশনের সুপারিশক্রমে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইইউর নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পর্যবেক্ষক মিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং একজন উচ্চ পর্যায়ের প্রধান পর্যবেক্ষকের নেতৃত্বে এ টিম পাঠানোর কথা বলা হয় । দু-এক সপ্তাহের মধ্যে পর্যবেক্ষক দলের নেতার মনোনয়ন ঘোষণা করার কথাও উল্লেখ করা হয়।
ইউরোপীয় কমিশনের সদস্য উল্লেখ করেন নির্বাচন পরিবেশ পর্যবেক্ষণ মিশন নির্বাচন সংক্রান্ত যেসব উদ্বেগজনক বিষয় চিহিপ্তত করে তাতে পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত খুব সহজ ছিল না। এসব উদ্বেগজনক বিষয়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার ঘাটতি, ভোটার তালিকার যথার্থতার ব্যাপারে প্রশ্ন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্বচ্ছতার অভাব (বিশেষত সব পর্যায়ে ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ) এবং অভিযোগ ও আপিল কাঠামোর প্রতি আস্থার অভাব উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রাক নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ঝুঁকির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হয়।
ইউরোপীয় কমিশন সদস্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের কাছে লেখা এ চিঠিতে বলেন,‘ আমরা নির্বাচনী সংস্কার ইস্যুতে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সীমিত ম্যান্ডেট সম্পর্কে সচেতন। আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করি, ওপরে যে উদ্বেগ ও ঝুঁকির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তা নিরসনে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান রাজনৈতিক পক্ষগুলো সচেষ্ট হবে। এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর পালন করার মতো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, সঙ্কটের সাধারণ সমাধান এবং একটি অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের উন্নত পরিবেশ সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট সবাই সম্মিলিতভাবে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে।’
বাংলাদেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তা প্রসঙ্গে ইসি সদস্য বলেন,‘ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক দল নির্বাচনে আস্থা সৃষ্টির ব্যাপারে ভালো ভূমিকা পালন করবে এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক মান অনুসারে নির্বাচন সম্পর্কে একটি বিস্তৃত, বিশ্বাসযোগ্য ও গঠনমূলক প্রতিবেদন দিতে পারবে। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী ইইউর নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে প্রাথমিক বিবৃতি প্রকাশ করবেন এবং পরে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন- যার মধ্যে ভবিষ্যতের জন্য বিস্তারিত সুপারিশও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’
নির্বাচন কমিশনে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ইসিতে যাবেন এই সংবাদ পেয়ে ১৯ নভেম্বর সকালে ইসিতে গিয়েই সাংবাদিকরা এই নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হন। এ কারণে সাংবাদিকরা দিনভর ইসি ভবনের গাড়ি বারান্দায় অবস্থান করে তাদের দায়িত¦ পালন করেন। কেন সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এ বিষয়ে ইসি থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া থেকে বিরত থাকা হয়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি এম এ আজিজ ও তিন কমিশনারের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য ইসি ভবনের প্রধান ফটকের দায়িত্বে নিয়োজিত ইসির নিজস্ব লোকদের সরিয়ে নেয়া হয়। তাদের স্থলে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুই কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
সেদিন সকাল ১০টায় বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও দৈনিকের সাংবাদিক ইসি ভবনে প্রবেশ করতে চাইলে ফটকের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুই কর্মকর্তা বাধা দেন। তারা জানান, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ সাংবাদিকদের ঢুকতে দেয়া যাবে না। তবে সারাদিনই ইসিতে আগত সাধারণ লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঢুকতে দেয়া হয়।
এর আগে ইসি সচিব আবদুর রশীদ সরকার সাংবাদিকদের জানান, সরকার ইসিতে নাশকতার আশঙ্কা করায় কারণে ইসি এবং সংশ্লিষ্ট চত্বর ও এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তিনি ইসিতে যেসব সাংবাদিক কাজ করেন তাদের জন্য প্রবেশপত্র সরবরাহের প্রস্তাব করেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে একাধিক সাংবাদিক ইসি কাভার করায় সাংবাদিকদের তরফ থেকে সচিবের প্রস্তাব নাকচ করা হয়। বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে সচিব বলেন, সেক্ষেত্রে সাংবাদিকদের দেহ তল্লাশি এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়া হবে। সচিবের এই প্রস্তাবের সঙ্গে সাংবাদিকরা একমত পোষণ করেন। কিন্তু ১৯ নভেম্বর সকালে কমিশনে গেলে সাংবাদিকরা বাধার মুখে পড়েন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিষেধ রয়েছে উল্লেখ করে তাদের সচিবালয়ের অভ্যন্তরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তবে বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সিইসির সঙ্গে দেখা করতে এলে সচিবালয় থেকে শুধু টিভি মিডিয়ার ক্যামেরা ক্রুদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। কমিশন সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে এসে জানান, সিইসি শুধু টিভি মিডিয়ার ক্যামেরা ক্রুদের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তারা সর্বোচ্চ ৫ মিনিট ভেতরে অবস্থান করতে পারবেন বলেও তিনি জানান। কিন্তু ক্যামেরা ক্রুরা অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বৈঠকের চিত্র গ্রহণ করতে ভেতরে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানান।
সিইসিকে ছুটি নেয়ার প্রস্তাব দেন উপদেষ্টা পরিষদ
সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। উপদেষ্টা পরিষদের আগের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০ নভেম্বর ২০০৬ তিন উপদেষ্টা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের সঙ্গে পৌনে ১ ঘন্টা ধরে বৈঠক করেন। উপদেষ্টারা সিইসির সঙ্গে আলোচনার ফলাফল অবহিত করতে ছুটে যান বঙ্গভবনে। সন্ধ্যায় তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক বসে। বৈঠকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
অন্যদিকে চারদলীয় জোট নির্বাচন কমিশন প্রশ্নে সংবিধানের বাইরে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৪ দল তৃতীয় দফা অবরোধের প্রথম দিন বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা আবারও জানিয়ে দিয়। তত্ত¦াবধায়ক সরকারের একাধিক উপদেষ্টা উভয় রাজনৈতিক পক্ষের অবস্থানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের আভাস দেন। এই সমন্বয়ের প্রস্তাবটি কী হবে সে সম্পর্কে উপদেষ্টারা স্পষ্টভাবে কিছু বলা থেকে বিরত থাকেন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নয়:
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের দাবি ছিল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে বিচারপতি এম এ আজিজ ইস্তফা না দিলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাকে অপসারণ করা। এ দাবি নিয়ে কয়েক দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে সিইসির দায়িত্ব পালন ও অব্যাহতিদানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এর বিভিন্ন দিক কমিশনারের ক্ষেত্রে না ঘটায় এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ না আসায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ব্যাপারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের কোনো সুযোগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়।
সংবিধানের ব্যবস্থা অনুসারে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের প্রবীণতম দুই বিচারপতিকে নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে পাঠালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়। সার্বিক বিবেচনায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ধারণা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি।
স্বেচ্ছায় ছুটি গ্রহণ
প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ছুটি গ্রহণ বা প্রদানের বিধিবিধান সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের মতো। বিচারপতিরা নিজেরা ছুটি গ্রহণ করতে পারেন কিন্তু তাদের বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়ার রেওয়াজ নেই। গত রোববার রাতে বঙ্গভবনে দীর্ঘ ২ ঘন্টা ধরে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টাদের বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। উপদেষ্টা পরিষদের সেই বৈঠকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে কয়েক মাস স্বেচ্ছায় ছুটিতে থাকার প্রস্তাব পেশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
নির্বাচন কমিশনে তিন উপদেষ্টা
এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম, আজিজুল হক ও সুলতানা কামাল তাদের প্রস্তাব পেশ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের কাছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে দেয়া এ প্রস্তাবটি বিবেচনার আশ্বাস দেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার আলোচনাও করেন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা স্বাস্থ্যগত চেকআপের লক্ষ্যে এ ধরনের ছুটি নিয়ে কয়েক মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মোশতাক আহমেদ চৌধুরী। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজ ওই দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে স্বেচ্ছায় কয়েক মাসের ছুটি নেয়ার বিষয় বিবেচনা করেন। অবশ্য তিনি এ ব্যাপারে আইনের খুঁটিনাটি বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখেন।
রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তিন উপদেষ্টা কথা বলতে যান বেলা পৌনে ১১টার দিকে। উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম, এম আজিজুল হক ও সুলতানা কামালের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের উচ্চতর এই প্রতিনিধি দল সিইসি প্রশ্নে ১৪ দলের দাবি নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রায় ১ ঘন্টার আলোচনা শেষে তথ্য, পানিসম্পদ ও ধর্ম মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম কমিশন সচিবালয়ের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, সঙ্কট নিরসনে যা যা করা দরকার তার সবই করার চেষ্টা চলছে। বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে আমরা বৈঠকে এসেছি। সিইসির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের ফলাফল আগে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হবে। আজই উপদেষ্টা কমিটি পুনরায় বৈঠকে বসবে। ওই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সব কিছু জানানো হবে।
সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম ও এম আজিজুল হক গাড়িতে সিইসিতে পৌঁছেন। অপর উপদেষ্টা সুলতানা কামালও একই সময় আসেন। তিন উপদেষ্টা সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজের সঙ্গে বৈঠক করেন বেলা পৌনে ১২টা পর্যন্ত। উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠককালে সিইসির সঙ্গে উপস্থিত থাকেন তিন নির্বাচন কমিশনার¬ বিচারপতি মাহফুজুর রহমান, স ম জাকারিয়া ও মাহমুদ হাসান মনসুর, নির্বাচন কমিশন সচিব আবদুর রশিদ সরকার ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ জকরিয়া। বৈঠকের এক পর্যায়ে তিন উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব নিয়ে সিইসির সঙ্গে একান্তে কথা বলেন।
উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম ব্রিফিংকালে জানান, সিইসি তাদের চা-পানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাই রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে তারা এসেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান সঙ্কটে দেশবাসীর মতো আমরাও উৎকণ্ঠিত। সাংবাদিকরা বৈঠকের বিষয়বস্তু ও ফলাফল সম্পর্কে জানতে তাকে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করলেও উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম কৌশলে পাশ কাটিয়ে যান। আলোচনার বিষয়বস্তু ও ফলাফল স¤পর্কে তিনি কিছুই বলেননি। তবে এসব প্রশ্নের জবাবে তিনি পরিস্কারভাবে বলেন, রাষ্ট্রপতি আমাদের পাঠিয়েছেন। তাই সিইসির কাছে কী প্রস্তাব দিয়েছি বা কী আলোচনা হয়েছে সে সব বিষয়ে আগে সাংবাদিকদের বললে রাষ্ট্রপতিকে আর কিছু বলার থাকে না। এজন্য রাষ্ট্রপতির কাছেই আগে রিপোর্ট পেশ করব। ‘আশাব্যঞ্জক কিছু হয়েছে কি-না’¬ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটা পদক্ষেপ একটা আশা নিয়েই হয়। আশা না থাকলে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয় না।’ উদ্যোগ ব্যর্থ হলে কী করা হবে¬ এ প্রশ্নের উত্তরে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘এটা হাইপোথেটিক্যাল।’ এর কোনো জবাব হয় না।
ওদিকে, তিন উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক সম্পর্কে নিরব থাকেন সিইসি। ২০ নভেম্বর বিকেল ৪টার দিকে অফিস শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সালামের উত্তর দেন তিনি। তবে বৈঠকের ফলাফল স¤পর্কে জানতে চাইলে কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়েন। এ সময় তাকে কিছুটা বিমর্ষ দেখায়
কূটনীতিকদের তৎপরতা ও সমঝোতায় ছুটি নেন সিইসি - দুই কমিশনার নিয়োগ
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের তীব্র আন্দোলন ও চরম বিশৃঙ্খলার মুখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের তিন মাসের ছুটি গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সঙ্কটের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে বিচারপতি আজিজ তিন মাস ছুটি গ্রহণের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নতুন দুজন কমিশনার নিয়োগ করেন। এর আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে সঙ্কটের অবসান ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ প্রশস্ত হওয়ার ব্যাপারে ঢাকার কূটনীতিকরা বিশেষ উদ্যোগ নেন। তারা দুপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানগত দূরত্ব কমানোর ব্যাপারে ভূমিকা রাখেন। রাষ্ট্রপতি সঙ্কট নিরসনের পদক্ষেপ নেয়ার আগে দুই রাজনৈতিক পক্ষের সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হলে চলমান সঙ্কটের অবসান ঘটবে না মর্মে কূটনীতিকরা অভিমত প্রকাশ করেন। তাদের অভিমতের সঙ্গে একমত হয়ে বঙ্গভবন থেকে উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। উভয় পক্ষের মতামত সম্পর্কে জানার পরই রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে পুরো প্যাকেজ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন।
রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের ব্যাপারে বঙ্গভবন ও উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে নানা তৎপরতা চালানো হয়। একই সঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠেন ঢাকার প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকরাও। তাদের তৎপরতার অংশ হিসেবে ২২ নভেম্বর ২০০৬ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের সঙ্গে চার কূটনীতিকের বৈঠক হয়। এ বৈঠকে চলমান সঙ্কট নিয়ে আওয়ামী লীগের সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা হয়। একই সঙ্গে বঙ্গভবন থেকেও উপদেষ্টা পরিষদের কোনো কোনো সদস্যের মাধ্যমে ১৪ দলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
অন্যদিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে থাকা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজ ২২ নভেম্বর ২০০৬ নির্বাচন কমিশনে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। বিকেলে নির্বাচন কমিশনের সচিব আবদুর রশীদ সরকার যান বঙ্গভবনে। সšধ্যায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের তিন মাসের ছুটি গ্রহণের বিষয়টি মৌখিকভাবে রাষ্ট্রপতি অবহিত করেন।
ভোটার তালিকা মুদ্রণ বন্ধ না করেই নির্ভুল তালিকা তৈরির নির্দেশ
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নতুন ভোটার তালিকা মুদ্রণের কাজ যখন পুরোদমে চলে তখন নির্বাচন কমিশন সচিবকে বঙ্গভবনে তলব করা হয়। সচিবকে ভোটার তালিকা মুদ্রণ বন্ধ নয়, নির্ভুল তালিকা করার তাগিদ দেন রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। ৫ নভেম্বর ২০০৬ নির্বাচন কমিশন সচিব আব্দুর রশীদ সরকারকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে তার কাছ থেকে এ বিষয়ে খোঁজখবর নেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্ভুল ভোটার তালিকা কিভাবে করা যায় সে বিষয়ে তিনি কমিশনের মত জানতে চান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে ধারণা নেন। রাষ্ট্রপতিকে সচিব জানান, ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই হাতে যে সময় রয়েছে তার মধ্যে কোনোভাবেই চলমান তালিকা বাতিল করে নতুন করে তালিকা করা সম্ভব নয়। সচিব তালিকার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে আরো জানান, ভোটার তালিকা একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ তালিকায় সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ থাকে। তাই ২০০০ সালের মতো এবারও ভোটার তালিকা ‘আপগ্রেডিং’ করা হয়েছে। তালিকায় কারো নাম না উঠলে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ভুয়া নামের খবর পেলে তা বাদ দেয়া হবে। একইভাবে কোনো ভুলত্রুটি থাকলে তাও সংশোধন করা যাবে বলে সচিব জানান। ইসি সচিব রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ থেকে ফিরে সরাসরি সিইসির সঙ্গে দেখা করেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্কে তাকে জানান। এর আগে সকালে সিইসি অন্য কমিশনার ও ইসি সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এতে ভোটার তালিকা ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করার বিষয় সম্পর্কে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। বৈঠকে ইসি সচিবকে এ ব্যাপারে কমিশন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করে। নতুন করে তালিকা করা কি সম্ভব, না বিদ্যমান ভোটার তালিকাকে নির্ভুল করা সম্ভব- সে বিষয়ে কমিশনের মত জানতে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ইসি সচিবকে ডেকে পাঠান। সচিব বঙ্গভবনে গেলে তার কাছে ভোটার তালিকা নিয়ে ১৪ দলের দাবির প্রসঙ্গ তুলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না জানতে চান প্রধান উপদেষ্টা। সে অনুযায়ী কমিশনের বক্তব্য জানাতে সচিব আবারও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন।
পরে ইসি সচিব সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানান। তিনি বলেন, চলতি মাসের মধ্যেই ভোটার তালিকা মুদ্রণের কাজ শেষ হবে বলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন। তালিকা মুদ্রণের জন্য তখন কম্পোজের কাজ চলে। তিনি আরো বলেন, ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এর ৮-১০ দিন আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারলে ভালো। সময় স্বল্পতার জন্য তাই চলমান ভোটার তালিকার কাজ শেষ না করে বিকল্প কোনো পথ নেই। তবে তালিকায় অতিরিক্ত কারো নাম থাকলে অথবা দ্বৈত ভোটার থাকলে তাদের বাদ দেয়া এবং বাদ পড়ে যাওয়াদের নাম পাওয়া গেলে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে বলে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানকে জানিয়েছিলেন। উল্লেখিত বৈঠক চলাকালে রাষ্ট্রপতিকে ইসি সচিব আরো জানান, দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন সচিবকে ভোটার তালিকার ভুল সংশোধনে ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেন বলে সচিব সাংবাদিকদের জানিলেছিলেন। ব্রিফিংকালে সাংবাদিকরা কমিশন সচিবালয়ের সভাকক্ষে টাঙ্গানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছবির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সচিব এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে তাৎক্ষণিকভাবে ছবি নামিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করেন। সাংবাদিকদের উপস্থিতিতেই ওই ছবি নামিয়ে ফেলা হয়। এ সময় সচিব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে উঠেন, কমিশনের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন করতেই এটা নামনো হয়নি।
সাংবিধানিক কারণ দেখিয়ে নিজ পদে অনড় থাকেন সিইসি
৫ নভেম্বর পর্যন্ত সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো অনুরোধ যায়নি। অবশ্য অনানুষ্ঠানিক অনুরোধ এলেও সিইসি তাতে সাড়া দেননি। বরং তিনি সাংবিধানিক এই পদে থাকার ব্যাপারে থাকেন অনড় অবস্থানে। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যেও তা ফুটে উঠে। ৫ নভেম্বর ২০০৮ ইইউ-এর আট রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে তাদের বলেন, সংবিধানের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। ইসি সচিবের ব্রিফিংয়েও একই আভাস মেলে। সিইসি পদত্যাগ করছেন কি না অথবা তাকে কেউ পদত্যাগের অনুরোধ করেছেন কি না এ প্রশ্নের জবাব দেননি সচিব। ১৪ দল থেকে উত্থাপিত বিতর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিতর্ক তো অনেক কিছু নিয়েই থাকতে পারে। তবে সবাইকে সংবিধান মেনে চলতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী কমিশন কাজ করছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাহী বিভাগকে কমিশনকে সহায়তা দিতে হবে। আর নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন ভোটার তালিকা।
দিনভর পদত্যাগের গুজব
৫ নভেম্বর ২০০৬ দিনভর ছিল সিইসির পদত্যাগের গুজব। ইসি সচিব বঙ্গভবনে যাওয়ার পর এ গুজব আরো ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছ থেকে সিইসির কাছে আনুষ্ঠানিক পদত্যাগের অনুরোধ করা হবে। এক বা দুইজন উপদেষ্টাকে দিয়ে অনুরোধ জানানো হবে। তবে ৫নভেম্বর পর্যন্ত এ অনুরোধ যায়নি। অনানুষ্ঠানিক অনুরোধের জবাবে সিইসি তার অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানানোর চিন্তা বাদ দেয় বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে, ইসি সচিব বঙ্গভবন থেকে ফিরে এসে ব্রিফিং করলে সিইসি যে তার পদ থেকে সরছেন না তা সাংবাদিকদের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়।
সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা
সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজ ৫ নভেম্বর সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে অফিসে যান আগের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা নিয়ে তিনি সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। ১ নভেম্বর থেকেই তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়। সিইসি প্রবেশের পর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। সিইসির দেহরক্ষী গেটে কর্তব্যরত কর্মচারীকে সাংবাদিক প্রবেশে সিইসির নিষেধের কথা জানিয়ে দেন। বেলা ১১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা গেটের সামনে জড়ো হলেও তারা কেউ ভেতরে ঢুকতে পারেননি। এ সময় নির্বাচন কমিশনার স ম জাকারিয়া বাইরে সাংবাদিকদের অপেক্ষা করতে দেখে তাদের ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করেন। সিইসির নির্দেশে সাংবাদিকদের ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়া হলেও বিএনপির দুই সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেন বকুল ও মোশাররফ হোসেন মঙ্গু কমিশন সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। তারা নিজ এলাকার বিষয় নিয়ে কথা বলতে কমিশন সচিবালয়ে আসেন বলে জানানো হয়। এ ছাড়া এশিয়া ফাউন্ডেশনের তিন কর্মকর্তা সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এদিকে একই দিন অর্থাৎ ৫ নভেম্বর ২০০৬ ফরিদপুরের জেলা জজ আজিজুল হক নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যুগ্ম সচিব পদে যোগদান কনে।
বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু সিইসি
দেশের রাজনৈতিক বিতর্কে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি এম এ আজিজ। তার পদত্যাগ দাবি করে ১৪ দল এবং এর সহযোগী বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন। অন্যদিকে চারদলীয় ঐক্যজোট ও সহযোগী পেশাজীবী সংগঠনগুলো সিইসির পদত্যাগের বিরোধিতা করে বলে, সংবিধান অনুসারে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ জানানোর সুযোগই নেই। একসময় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বিচারপতি কে এম হাসান। বলা হয়েছিল তার জন্যই দেশে এত হানাহানি, অশান্তি। দায়িত্ব গ্রহণে বিচারপতি হাসান অপারগতা জ্ঞাপন করার পর সেই ইস্যুর সমাপ্তি ঘটে। এরপর রাজনৈতিক সঙ্কটের নতুন কেন্দ্রবিন্দু হন সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজ। একপর্যায়ে ১৪ দলের দাবি করা তুলনামূলকভাবে অনালোচিত আরেকটি ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব হস্তান্তর। সিইসির পদত্যাগ ইস্যু শেষ হলে রাষ্ট্রপতির প্রধান তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব হস্তান্তরের বিষয়টি নতুন ইস্যুতে পরিণত হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ড. কামাল হোসেন এ দাবি জানানোর পর ১৪ দল নেত্রী শেখ হাসিনা এটাকে গ্রহণ করে নেন।
সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজের পদত্যাগ দাবির পেছনে একটি প্রধান যুক্তি হলো¬ তিনি হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে নতুন ভোটার তালিকা তৈরি করেন। পরে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের এ আদেশ বহাল রাখেন। উচ্চতর আদালতের এই নির্দেশ অমান্য করায় তার এ পদে থাকার অধিকার নেই বলে দাবি করা হয়।
সিইসি আজিজের পক্ষে বলা হয়, ভোটার তালিকাসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি যে, নতুন ভোটার তালিকা করা যাবে না। অথবা নতুন ভোটার তালিকার চলমান কার্যক্রমে স্থগিতাদেশও দেয়া হয়নি। পরে আপিল বিভাগ সুনির্দিষ্টভাবে আদেশ দেয়ার পর নতুন ভোটার তালিকার কার্যক্রম বন্ধ করে হালনাগাদ ভোটার তালিকার কাজ শুরু হয়। এছাড়া সিইসির বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতের আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগ সঠিক নয় বলে বলা হয়।
সিইসির পদত্যাগের পক্ষে বলা হয়, গোটা জাতি বিচারপতি এম এ আজিজের মুহূর্তের মধ্যে পদত্যাগ চায়। চার দল ক্ষমতায় থাকাকালে কয়েকজন মন্ত্রীও সিইসির বিপক্ষে কথা বলেন। সুতরাং এই জাতীয় দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে তার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত।
এ বক্তব্যের বিপক্ষে বলা হয়, ১৪ দল এবং এর সহযোগী সংগঠন মানে গোটা জাতি নয়। বিগত সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের অধিকারী চারদলীয় জোট সিইসির পদত্যাগের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সিইসির পদত্যাগের দাবি বড়জোর জাতির একাংশের বক্তব্য হতে পারে। গোটা জাতির বক্তব্য কোনভাবেই নয়।
সিইসির পদত্যাগের পক্ষে আরো বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা তাকে পদত্যাগের অনুরোধ জানানোর কথা অঙ্গীকার করে বিচারপতি আজিজ অসত্য কথা বলেন। উপদেষ্টা হাসান মশহুদ বলেছিলেন, তিনি সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তিনি অসত্য বলেন না। বিচারপতি আজিজ মিথ্যা বলে অসদাচরণ করেছেন এবং সিইসি পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে সিইসির পদত্যাগের বিরোধীদের বক্তব্য হলো¬ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ পদত্যাগের অনুরোধ আসেনি বলে উল্লেখ করেছিলেন বিচারপতি আজিজ। উপদেষ্টার সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল গোপন ও অনানুষ্ঠানিক। আনুষ্ঠানিক অনুরোধ আর গোপন অনুরোধ এক নয়। বরং গোপনীয়তা ফাঁস করে সংশি¬ষ্ট উপদেষ্টাই অসদাচরণ করেছেন।
বিচারপতি আজিজের পদত্যাগের ব্যাপারে একজন উপদেষ্টা বলেন, খেলোয়াড়রা না চাইলে রেফারির থাকা উচিত নয়। যারা খেলবেন তারা না চাইলে রেফারি খেলা পরিচালনা করবেন কিভাবে?
সিইসির পক্ষের লোকজন বলেন, খেলা খেলোয়াড়ের ইচ্ছায় চলে না, চলে রেফারির ইচ্ছায়। খেলোয়াড়রা রেফারি নির্ধারণ করলে সে খেলা চালানো সম্ভব হবে কি না সন্দেহ রয়েছে।
দেশের শীর্ষ পর্যায়ের আইনজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন, সিইসির পদটি হলো একটি প্রশাসনিক পদ। সংবিধান অনুসারে কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর এ ধরনের লাভজনক পদে বসতে পারেন না। যেদিন বিচারপতি অবসর নিয়েছেন সেদিন থেকে তিনি সিইসি হিসেবে অবৈধ হয়ে গেছেন। এখন রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
এর বিপরীত পক্ষের মত হলো¬ নির্বাচন কমিশন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ দুটিই আধা বিচার বিভাগীয় এবং অলাভজনক পদ। সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদে কিছু পদাধিকারীর পারিশ্রমিক সম্পর্কে উলে¬খিত প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদের বাইরে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা, স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী বা উপদেষ্টা, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর বাইরে বিভিন্ন আইনে নির্বাচন কমিশনকে আধা বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে উলে¬খ করা হয়। ফলে সিইসির অবৈধ হয়ে যাবার যুক্তি ভিত্তিহীন।
১৪ দল ও সহযোগী সংগঠনের বক্তব্য অনুযায়ী তৎকালীন রাজনৈতিক সঙ্কটের একমাত্র সমাধান সিইসির পদ থেকে বিচারপতি আজিজের পদত্যাগ। তিনি পদত্যাগ করলে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একজন সিইসি নির্বাচন সম্ভব । এতে জনগণের ভোটাধিকার এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনও নিশ্চিত করা সম্ভব ।
চারদলীয় জোট এবং এর সমর্থকদের বক্তব্য অনুযায়ী সিইসির পদত্যাগে রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান তো হবেই না, বরং একটি জটিল রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হবে বলে মত দেন। বিচারপতি কে এম হাসান অপারগতা জানানোর পর সব দল গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত করতে পারেননি বলেই রাষ্ট্রপতিকে সর্বশেষ বিকল্প অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। সবার গ্রহণযোগ্য সিইসি নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তখন নির্বাচন অনুষ্ঠানই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে বলে তারা যুক্তি দেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দু পক্ষের কোনো পক্ষই অপর পক্ষের মত গ্রহণ বা ছাড় দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
তিন কমিশনারও সিইসির মতো পদত্যাগে অসম্মতি জ্ঞাপন
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি এম এ আজিজের মতো অন্য তিন কমিশনারও পদত্যাগে অসম্মতি জানান। তিন কমিশনার বিচারপতি মাহফুজুর রহমান, স ম জাকারিয়া ও মাহমুদ হাসান মনসুর ১৫ নভেম্বর এ কথাই জানান। কমিশনাররা সকালে ইসি সচিব আব্দুর রশীদ সরকারের কাছে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। কয়েকটি দৈনিক ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় ‘নির্বাচন কমিশনার ও সচিবরা তাদের দায়িত্ব পালনে আগ্রহী নন’ ¬এ ধরনের প্রকাশিত খবর প্রসঙ্গে কমিশনারদের এ মনোভাবের কথা ইসি সচিব সাংবাদিকদের কাছে জানান। কমিশনাররাও পৃথকভাবে সাংবাদিকদের কাছে একই অভিমত ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া কমিশন সচিবালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে দেয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সংবাদটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন করা হয়।
ইসি সচিবালয়ে বিকেলে ব্রিফিংকালে সচিব সাংবাদিকদের বলেন, তাকে উদ্ধৃত করে পদত্যাগ প্রসঙ্গে কোনো কোনো পত্রিকায় লেখা হয়েছে, আমি নিজেই নাকি ইসির সচিব পদে থাকতে রাজি নই। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এ পদে থাকতে আমার কোনো আপত্তিও নেই। সরকার বদলি করলে যেতে হবে। তবে তার মানে এই নয় যে, আমি সরকারকে বদলির জন্য বলছি। তাকে নিয়ে এলডিপির বক্তব্য সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, আমাকে সৎ লোক উল্লেখ করে যে প্রশংসা করা হয়েছে তার জন্য তাদের ধন্যবাদ। তবে একই সঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার, কেউ সৎ হলে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারেন না। বরং যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা যে আদেশ-নির্দেশ দেবে তা-ই মেনে চলতে হবে। তাই পদত্যাগ করার মতো কিছু ঘটেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আহ্বান
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা (এমইপিএস) রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের প্রতি নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠনের আহ্বান জানান, যাতে করে কমিশন সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। তারা বলেন,এমইপিএস ‘একটি শক্তিশালী ও কার্যকর তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ দেখতে আগ্রহী। ১৬ নভেম্বর ২০০৬ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্ট্রেট্রসবার্গে অনুষ্ঠিত এক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে গৃহীত এক প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়। এমইপিএস বলেন, সরকারের উচিত ‘এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা, যে পরিবেশে ভোটাররা সত্যিকার স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।’ তারা ‘নির্বাচনী প্রচারণাকালে গণমাধ্যমের ভারসাম্যপূর্ণ সংবাদ পরিবেশনের নিশ্চয়তাও’ চান।
তারা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও হয়রানি সৃষ্টিকারীদের বিচারের সম্মুখীন করার এবং অপরাধীদের অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।তারা দেশী ও বিদেশীদের সহায়তায় সঠিকভাবে ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্যও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানান।এমইপিএস রাজনৈতিক সহিংসতা পরিহার করার জন্য সব বিরোধপূর্ণ নির্বাচনী ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে সিইসির বাসভবনের সামনে শত শত মানুষ
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজের বাসভবনের সামনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে হাজির হন কয়েক শত মানুষ। যত দিন লাগে তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করে যাবেন বলে অঙ্গীকার করেন। ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের এই সিদ্ধান্ত নেয়।
এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজ তার পদ থেকে সরে না গেলে ১৯ নভেম্বর ২০০৬ থেকে কোনো দোকান মালিক এম এ আজিজের কাছে কোনো দ্রব্য বিক্রি করবে না। দোকান মালিক সমিতির এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঐদিন সকাল থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্য নিয়ে কাকরাইলস্থ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বাসভবনের সামনে হাজির হন শত শত মানুষ। তাদের কারো হাতে চাল, কারো হাতে ডাল, মাছ, গোশত, সবজি, কলা, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ বা অন্যকিছু। দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গে লিখে এনেছেন বিভিন্ন লেখা সংবলিত প্লাকার্ড। ঢাকা, বরিশাল, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন পেশার লোকজন এই দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে ঢাকায় আসেন। তারা জানান, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে কাউকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রি করতে হবে না। যত দিন লাগে বিনা পয়সায় তারাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করে যাবেন। শুধু নিত্যপ্রযোজনীয় দ্রব্যই নয়, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের যা কিছু প্রয়োজন হবে তার সব কিছুই তারা সরবরাহ করবেন বলে জানান। তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজের প্রতি অনুরোধ জানান, কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তিনি যেন পদত্যাগ না করেন।
বিকেলের দিকে এক মহিলা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বাসা থেকে বের হয়ে উপস্থিতি সবাইকে বলেন, তাদের এই কর্মকাণ্ডে প্রধান নির্বাচন কমিশনার খুশি, তবে বাসায় পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে বিধায় এ মুহূর্তে কোনো খাবারের প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পক্ষ থেকে ওই মহিলা উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানান এবং তাদের জন্য নিয়ে আসা খাদ্যসামগ্রী কোনো এতিমখানায় দান করার অনুরোধ জানান।
৯ উপদেষ্টা একমত হয়ে যান সুপ্রিম জুডিশিয়াল প্রস্তাবে কিন্তু...
বিরাজমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদ অনেক বিকল্পের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজকে অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউ›িসলে পাঠানোর প্রস্তাবও বিবেচনায় নেন। এক পর্যায়ে একমত হন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯ উপদেষ্টা। একজন শুধু এর সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেন।
১৪ দলের দাবি অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অপসারণ করতে সংবিধানে কী কী উপায় রয়েছে বিষয়টি উত্থাপিত হয় ১৮ নভেম্বর ২০০৬ উপদেষ্টা পরিষদের সভায়। এতে বলা হয়, সিইসি নিজে থেকে চলে যেতে রাজি না হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করাই একমাত্র উপায়। এতে বিষয়টি নিস্পত্তি করতে সময় লাগত ছয় মাস। ফলে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার কারনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ বাড়তে পারার বিষয়টিও তারা অনুধাবন করতে পারেন। বিষয়টি উত্থাপিত হওয়ার পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ব্যাপারে ৯ উপদেষ্টা ইতিবাচক মতামত দেন।
কিন্তু কিভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হবে এবং সাংবিধানিকভাবে সেটা সম্ভব কি না রাষ্ট্রপতি সে বিষয়ে জানতে চাইলে তখন উপদেষ্টাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। সংবিধান অনুসারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের মতো যথেষ্ট কারণ থাকা, উচ্চ আদালতের অনুমতির প্রয়োজন এবং তিনি এ নিয়ে আদালতে গেলে কী পরিস্থিতি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয় এবং সর্ব শেষ এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা সঠিক হবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশাবাদ ব্যক্ত করেন ইসি
ইউরোপীয় কমিশন নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক টিম পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের হবে এবং তা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে আরো সুসংহত করবে।’
ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) সদস্য বেনিটা ফেরেরো ওয়াল্ডনার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দীন আহমেদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয় এ চিঠিতে।
বেনিটা ফেরেরো ওয়াল্ডনার তার চিঠিতে নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণক্রমে সেপ্টেম্বর ২০০৬ এ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবেশ যাচাই মিশনের বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, মিশনের সুপারিশক্রমে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইইউর নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পর্যবেক্ষক মিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং একজন উচ্চ পর্যায়ের প্রধান পর্যবেক্ষকের নেতৃত্বে এ টিম পাঠানোর কথা বলা হয় । দু-এক সপ্তাহের মধ্যে পর্যবেক্ষক দলের নেতার মনোনয়ন ঘোষণা করার কথাও উল্লেখ করা হয়।
ইউরোপীয় কমিশনের সদস্য উল্লেখ করেন নির্বাচন পরিবেশ পর্যবেক্ষণ মিশন নির্বাচন সংক্রান্ত যেসব উদ্বেগজনক বিষয় চিহিপ্তত করে তাতে পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত খুব সহজ ছিল না। এসব উদ্বেগজনক বিষয়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার ঘাটতি, ভোটার তালিকার যথার্থতার ব্যাপারে প্রশ্ন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্বচ্ছতার অভাব (বিশেষত সব পর্যায়ে ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ) এবং অভিযোগ ও আপিল কাঠামোর প্রতি আস্থার অভাব উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রাক নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ঝুঁকির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হয়।
ইউরোপীয় কমিশন সদস্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের কাছে লেখা এ চিঠিতে বলেন,‘ আমরা নির্বাচনী সংস্কার ইস্যুতে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সীমিত ম্যান্ডেট সম্পর্কে সচেতন। আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করি, ওপরে যে উদ্বেগ ও ঝুঁকির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তা নিরসনে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান রাজনৈতিক পক্ষগুলো সচেষ্ট হবে। এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর পালন করার মতো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, সঙ্কটের সাধারণ সমাধান এবং একটি অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের উন্নত পরিবেশ সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট সবাই সম্মিলিতভাবে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে।’
বাংলাদেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তা প্রসঙ্গে ইসি সদস্য বলেন,‘ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক দল নির্বাচনে আস্থা সৃষ্টির ব্যাপারে ভালো ভূমিকা পালন করবে এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক মান অনুসারে নির্বাচন সম্পর্কে একটি বিস্তৃত, বিশ্বাসযোগ্য ও গঠনমূলক প্রতিবেদন দিতে পারবে। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী ইইউর নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে প্রাথমিক বিবৃতি প্রকাশ করবেন এবং পরে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন- যার মধ্যে ভবিষ্যতের জন্য বিস্তারিত সুপারিশও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’
নির্বাচন কমিশনে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ইসিতে যাবেন এই সংবাদ পেয়ে ১৯ নভেম্বর সকালে ইসিতে গিয়েই সাংবাদিকরা এই নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হন। এ কারণে সাংবাদিকরা দিনভর ইসি ভবনের গাড়ি বারান্দায় অবস্থান করে তাদের দায়িত¦ পালন করেন। কেন সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এ বিষয়ে ইসি থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া থেকে বিরত থাকা হয়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি এম এ আজিজ ও তিন কমিশনারের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য ইসি ভবনের প্রধান ফটকের দায়িত্বে নিয়োজিত ইসির নিজস্ব লোকদের সরিয়ে নেয়া হয়। তাদের স্থলে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুই কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
সেদিন সকাল ১০টায় বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও দৈনিকের সাংবাদিক ইসি ভবনে প্রবেশ করতে চাইলে ফটকের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুই কর্মকর্তা বাধা দেন। তারা জানান, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ সাংবাদিকদের ঢুকতে দেয়া যাবে না। তবে সারাদিনই ইসিতে আগত সাধারণ লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঢুকতে দেয়া হয়।
এর আগে ইসি সচিব আবদুর রশীদ সরকার সাংবাদিকদের জানান, সরকার ইসিতে নাশকতার আশঙ্কা করায় কারণে ইসি এবং সংশ্লিষ্ট চত্বর ও এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তিনি ইসিতে যেসব সাংবাদিক কাজ করেন তাদের জন্য প্রবেশপত্র সরবরাহের প্রস্তাব করেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে একাধিক সাংবাদিক ইসি কাভার করায় সাংবাদিকদের তরফ থেকে সচিবের প্রস্তাব নাকচ করা হয়। বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে সচিব বলেন, সেক্ষেত্রে সাংবাদিকদের দেহ তল্লাশি এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়া হবে। সচিবের এই প্রস্তাবের সঙ্গে সাংবাদিকরা একমত পোষণ করেন। কিন্তু ১৯ নভেম্বর সকালে কমিশনে গেলে সাংবাদিকরা বাধার মুখে পড়েন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিষেধ রয়েছে উল্লেখ করে তাদের সচিবালয়ের অভ্যন্তরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তবে বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সিইসির সঙ্গে দেখা করতে এলে সচিবালয় থেকে শুধু টিভি মিডিয়ার ক্যামেরা ক্রুদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। কমিশন সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে এসে জানান, সিইসি শুধু টিভি মিডিয়ার ক্যামেরা ক্রুদের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তারা সর্বোচ্চ ৫ মিনিট ভেতরে অবস্থান করতে পারবেন বলেও তিনি জানান। কিন্তু ক্যামেরা ক্রুরা অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বৈঠকের চিত্র গ্রহণ করতে ভেতরে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানান।
সিইসিকে ছুটি নেয়ার প্রস্তাব দেন উপদেষ্টা পরিষদ
সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। উপদেষ্টা পরিষদের আগের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০ নভেম্বর ২০০৬ তিন উপদেষ্টা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের সঙ্গে পৌনে ১ ঘন্টা ধরে বৈঠক করেন। উপদেষ্টারা সিইসির সঙ্গে আলোচনার ফলাফল অবহিত করতে ছুটে যান বঙ্গভবনে। সন্ধ্যায় তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক বসে। বৈঠকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
অন্যদিকে চারদলীয় জোট নির্বাচন কমিশন প্রশ্নে সংবিধানের বাইরে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৪ দল তৃতীয় দফা অবরোধের প্রথম দিন বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা আবারও জানিয়ে দিয়। তত্ত¦াবধায়ক সরকারের একাধিক উপদেষ্টা উভয় রাজনৈতিক পক্ষের অবস্থানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের আভাস দেন। এই সমন্বয়ের প্রস্তাবটি কী হবে সে সম্পর্কে উপদেষ্টারা স্পষ্টভাবে কিছু বলা থেকে বিরত থাকেন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নয়:
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের দাবি ছিল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে বিচারপতি এম এ আজিজ ইস্তফা না দিলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাকে অপসারণ করা। এ দাবি নিয়ে কয়েক দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে সিইসির দায়িত্ব পালন ও অব্যাহতিদানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এর বিভিন্ন দিক কমিশনারের ক্ষেত্রে না ঘটায় এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ না আসায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ব্যাপারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের কোনো সুযোগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়।
সংবিধানের ব্যবস্থা অনুসারে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের প্রবীণতম দুই বিচারপতিকে নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে পাঠালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়। সার্বিক বিবেচনায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ধারণা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি।
স্বেচ্ছায় ছুটি গ্রহণ
প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ছুটি গ্রহণ বা প্রদানের বিধিবিধান সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের মতো। বিচারপতিরা নিজেরা ছুটি গ্রহণ করতে পারেন কিন্তু তাদের বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়ার রেওয়াজ নেই। গত রোববার রাতে বঙ্গভবনে দীর্ঘ ২ ঘন্টা ধরে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টাদের বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। উপদেষ্টা পরিষদের সেই বৈঠকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে কয়েক মাস স্বেচ্ছায় ছুটিতে থাকার প্রস্তাব পেশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
নির্বাচন কমিশনে তিন উপদেষ্টা
এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম, আজিজুল হক ও সুলতানা কামাল তাদের প্রস্তাব পেশ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের কাছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে দেয়া এ প্রস্তাবটি বিবেচনার আশ্বাস দেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার আলোচনাও করেন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা স্বাস্থ্যগত চেকআপের লক্ষ্যে এ ধরনের ছুটি নিয়ে কয়েক মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মোশতাক আহমেদ চৌধুরী। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজ ওই দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে স্বেচ্ছায় কয়েক মাসের ছুটি নেয়ার বিষয় বিবেচনা করেন। অবশ্য তিনি এ ব্যাপারে আইনের খুঁটিনাটি বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখেন।
রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তিন উপদেষ্টা কথা বলতে যান বেলা পৌনে ১১টার দিকে। উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম, এম আজিজুল হক ও সুলতানা কামালের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের উচ্চতর এই প্রতিনিধি দল সিইসি প্রশ্নে ১৪ দলের দাবি নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রায় ১ ঘন্টার আলোচনা শেষে তথ্য, পানিসম্পদ ও ধর্ম মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম কমিশন সচিবালয়ের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, সঙ্কট নিরসনে যা যা করা দরকার তার সবই করার চেষ্টা চলছে। বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে আমরা বৈঠকে এসেছি। সিইসির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের ফলাফল আগে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হবে। আজই উপদেষ্টা কমিটি পুনরায় বৈঠকে বসবে। ওই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সব কিছু জানানো হবে।
সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম ও এম আজিজুল হক গাড়িতে সিইসিতে পৌঁছেন। অপর উপদেষ্টা সুলতানা কামালও একই সময় আসেন। তিন উপদেষ্টা সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজের সঙ্গে বৈঠক করেন বেলা পৌনে ১২টা পর্যন্ত। উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠককালে সিইসির সঙ্গে উপস্থিত থাকেন তিন নির্বাচন কমিশনার¬ বিচারপতি মাহফুজুর রহমান, স ম জাকারিয়া ও মাহমুদ হাসান মনসুর, নির্বাচন কমিশন সচিব আবদুর রশিদ সরকার ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ জকরিয়া। বৈঠকের এক পর্যায়ে তিন উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব নিয়ে সিইসির সঙ্গে একান্তে কথা বলেন।
উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম ব্রিফিংকালে জানান, সিইসি তাদের চা-পানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাই রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে তারা এসেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান সঙ্কটে দেশবাসীর মতো আমরাও উৎকণ্ঠিত। সাংবাদিকরা বৈঠকের বিষয়বস্তু ও ফলাফল সম্পর্কে জানতে তাকে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করলেও উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম কৌশলে পাশ কাটিয়ে যান। আলোচনার বিষয়বস্তু ও ফলাফল স¤পর্কে তিনি কিছুই বলেননি। তবে এসব প্রশ্নের জবাবে তিনি পরিস্কারভাবে বলেন, রাষ্ট্রপতি আমাদের পাঠিয়েছেন। তাই সিইসির কাছে কী প্রস্তাব দিয়েছি বা কী আলোচনা হয়েছে সে সব বিষয়ে আগে সাংবাদিকদের বললে রাষ্ট্রপতিকে আর কিছু বলার থাকে না। এজন্য রাষ্ট্রপতির কাছেই আগে রিপোর্ট পেশ করব। ‘আশাব্যঞ্জক কিছু হয়েছে কি-না’¬ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটা পদক্ষেপ একটা আশা নিয়েই হয়। আশা না থাকলে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয় না।’ উদ্যোগ ব্যর্থ হলে কী করা হবে¬ এ প্রশ্নের উত্তরে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘এটা হাইপোথেটিক্যাল।’ এর কোনো জবাব হয় না।
ওদিকে, তিন উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক সম্পর্কে নিরব থাকেন সিইসি। ২০ নভেম্বর বিকেল ৪টার দিকে অফিস শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সালামের উত্তর দেন তিনি। তবে বৈঠকের ফলাফল স¤পর্কে জানতে চাইলে কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়েন। এ সময় তাকে কিছুটা বিমর্ষ দেখায়
কূটনীতিকদের তৎপরতা ও সমঝোতায় ছুটি নেন সিইসি - দুই কমিশনার নিয়োগ
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের তীব্র আন্দোলন ও চরম বিশৃঙ্খলার মুখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের তিন মাসের ছুটি গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সঙ্কটের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে বিচারপতি আজিজ তিন মাস ছুটি গ্রহণের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নতুন দুজন কমিশনার নিয়োগ করেন। এর আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে সঙ্কটের অবসান ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ প্রশস্ত হওয়ার ব্যাপারে ঢাকার কূটনীতিকরা বিশেষ উদ্যোগ নেন। তারা দুপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানগত দূরত্ব কমানোর ব্যাপারে ভূমিকা রাখেন। রাষ্ট্রপতি সঙ্কট নিরসনের পদক্ষেপ নেয়ার আগে দুই রাজনৈতিক পক্ষের সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হলে চলমান সঙ্কটের অবসান ঘটবে না মর্মে কূটনীতিকরা অভিমত প্রকাশ করেন। তাদের অভিমতের সঙ্গে একমত হয়ে বঙ্গভবন থেকে উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। উভয় পক্ষের মতামত সম্পর্কে জানার পরই রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে পুরো প্যাকেজ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন।
রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের ব্যাপারে বঙ্গভবন ও উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে নানা তৎপরতা চালানো হয়। একই সঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠেন ঢাকার প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকরাও। তাদের তৎপরতার অংশ হিসেবে ২২ নভেম্বর ২০০৬ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের সঙ্গে চার কূটনীতিকের বৈঠক হয়। এ বৈঠকে চলমান সঙ্কট নিয়ে আওয়ামী লীগের সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা হয়। একই সঙ্গে বঙ্গভবন থেকেও উপদেষ্টা পরিষদের কোনো কোনো সদস্যের মাধ্যমে ১৪ দলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
অন্যদিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে থাকা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজ ২২ নভেম্বর ২০০৬ নির্বাচন কমিশনে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। বিকেলে নির্বাচন কমিশনের সচিব আবদুর রশীদ সরকার যান বঙ্গভবনে। সšধ্যায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের তিন মাসের ছুটি গ্রহণের বিষয়টি মৌখিকভাবে রাষ্ট্রপতি অবহিত করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন