ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া নানা জানা-অজানা ও এক্সক্লুসিভ বিষয়ের বর্ণনা -১৫তম পর্ব

নির্বাচন কমিশন: বিতর্ক , পুনর্গঠন ও পরিচালিত কর্মকান্ড 


রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন নিয়ে তথ্য উপদেষ্টার ব্রিফিং 
রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা কাটাতে ২২ নভেম্বর ২০০৬ রাতে উপদেষ্টা পরিষদের এক জরুরি বৈঠক বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে দেশের বিদ্যমান সঙ্কট ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অভিযান পরিচালনার বিষয় নিয়েও উপদেষ্টাদের বৈঠকে আলোচনা হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত সোয়া ৮টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে বঙ্গভবনের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের তথ্য উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় আলোচনার জন্য আমরা বৈঠকে মিলিত হয়েছিলাম। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা করণীয় তা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে মৌখিকভাবে ছুটির কথা জানিয়েছেন। এ ছাড়া আরো দুজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়েও আমরা কথা বলেছি। রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এসব বিষয়ে সবিস্তার অবহিত করবেন। তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী, সঙ্কট খুব শিগগির কেটে যাবে। কাদের নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়া হবে জানতে চাইলে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, এ ব্যাপারে আমি অবহিত নই। তিনি সবাইকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের জন্য ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দেন।
মাহবুবুল আলম বলেন, প্রত্যেকটি বিষয়ের একেকটি স্তর আছে। স্টেপ বাই স্টেপ এগোতে হয়। কখনো কাজে গতিহীনতা মনে হলেও দেখা যায়, এরপর দ্রুত একের পর এক সমাধান হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রেও তেমন হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ সময় উপদেষ্টা আজিজুল হক ও সুলতানা কামাল চক্রবর্তীও উপস্থিত ছিলেন।


বিচারপতি মাহফুজের ভারপ্রাপ্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ
ভারপ্রাপ্ত সিইসির দায়িত্ব নেন নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মাহফুজুর রহমান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজ তিন মাসের ছুটিতে যাওয়ায় তিনি ২৩ নভেম্বর ২০০৬ এ দায়িত্ব নেন। নির্বাচন কমিশনের এক বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে এক ব্রিফিংয়ে ভারপ্রাপ্ত সিইসি বলেন, পুরো কমিশন গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করবে। নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্নের লক্ষ্যে তিনি সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা চান। একই সঙ্গে নভেম্বর ২০০৬ এর মধ্যেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে তিনি জানান।
আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের অবরোধ কর্মসূচির মুখে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজ ২২ নভেম্বর ২০০৬ ছুটিতে যান। এ জন্য ওই দিন সকালে অফিসে না গিয়ে সারাদিন বাসায় অবস্থান করেন তিনি। বিকেলে ইসি সচিব আবদুর রশীদ সরকার রাষ্ট্রপতির কাছে তার ছুটির দরখাস্ত পৌঁছে দেন। সিইসি ছুটিতে যাচ্ছেন¬ এমন গুঞ্জন দিনভর থাকলেও ওই দিন মধ্যরাতে রাষ্ট্রপতির ভাষণে বিষয়টি পরিস্কার হয়। এক দিন সিইসি ছাড়াই ছিল নির্বাচন কমিশন। এ কারণে ২৩ নভেম্বর ২০০৬ বেলা ১১টার দিকে তিন কমিশনার¬ বিচারপতি মাহফুজুর রহমান, স ম জাকারিয়া ও মাহমুদ হাসান মনসুর বৈঠকে বসেন। ভারপ্রাপ্ত সিইসি ঠিক করতে আয়োজিত ওই বৈঠকে অন্যদের মধ্যে ইসি সচিব আবদুর রশীদ সরকার ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ জকরিয়া অংশ নেন। কমিশন সূত্র জানায়, বৈঠকে একজন নির্বাচন কমিশনার ভারপ্রাপ্ত সিইসি হিসেবে বিচারপতি মাহফুজুর রহমানের নাম প্রস্তাব করেন। অন্য কমিশনার তাতে সমর্থন করলে বিচারপতি মাহফুজুর রহমান দায়িত্ব গ্রহণে সম্মতি দেন। জ্যেষ্ঠতার বিবেচনায় কমিশন এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বলে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান। তিনি আরো জানান, বিচারপতি এম এ আজিজের ছুটিকালীন ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অর্ডারের (আরপিও) ৪ ধারা’ অনুযায়ী বিচারপতি মাহফুজুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আরপিওর সেকশন ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন তার চেয়ারম্যান অথবা কোনো সদস্য অথবা কোনো কর্মকর্তাকে’ এ আইনের অধীনে সকল বা কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ বা কার্যসম্পাদনের দায়িত্ব অর্পণ করতে পারে। বৈঠকে এ বিষয় ছাড়াও নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়ও স্থান পায়।
২৩ নভেম্বর বেলা ১২টা ২০ মিনিটের সময় ইসি সচিবালয়ে নিজ কক্ষে ভারপ্রাপ্ত সিইসি ব্রিফিংকালে বলেন, রাষ্ট্রপতির ভাষণের পরই সিইসির ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি জানতে পারি। এর পরিপ্রেক্ষিতেই বৈঠকটি বসে। কমিশনের আইনানুযায়ী বয়োজ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তারা (অন্য কমিশনাররা) আমাকে ভারপ্রাপ্ত সিইসি করার প্রস্তাব করলেন। আমি তাতে সম্মতি দিই। এখন আমার কাজ ভারপ্রাপ্ত সিইসি হিসেবে কমিশনের কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া।
আপনার সামনে চ্যালেঞ্জ কী? সাংবাদিকদের এরকম প্রশ্নে বিচারপতি মাহফুজ বলেন, আসন্ন নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। সবাই সহযোগিতা করলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় আছে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, কোনো অন্তরায় নেই। সব প্রস্তুতিই আমাদের রয়েছে। চলতি মাসেই তফসিল ঘোষণা করা হবে। ১৪ দল আপনাকে ভারপ্রাপ্ত সিইসি হিসেবে মানবে কি না? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কেউ মানতে পারে, আবার কেউ নাও মানতে পারে। এটা তাদের বিষয়, আমার নয়। তবে নির্বাচন কমিশনের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবেন কি না? জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত সিইসি বলেন, এটা ভবিষ্যতের বিষয়। তবে এখন এমন একটা সময় এসে দাঁড়িয়েছে যে, এগুলোর সময় নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, এর আগে ভোটার তালিকার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন বসেছিল। ছোট দলগুলো তাতে সাড়া দিলেও বড় সব দলের কাছ থেকে তেমন সাড়া মেলেনি। রাষ্ট্রপতি যে দুজন নতুন কমিশনার নিয়োগ করবেন তাদের মধ্য থেকে কাউকে ভারপ্রাপ্ত সিইসি করার প্রস্তাব এলে মেনে নেবেন কি না? সাংবাদিকদের এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে বিচারপতি মাহফুজুর রহমান বলেন, না, অন্তত আমি মেনে নেব না। বিচারপতি হিসেবে ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ অনুযায়ী আমার অবস্থান অনেক ওপরে। তা ছাড়া ‘সিনিয়র মোস্ট’ আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ভোটার তালিকার ভুল সংশোধন করতে কী পদক্ষেপ নেবেন জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত সিইসি বলেন, ‘ভোটার তালিকায় কোথায় ভুল আছে আপনারা দেখান। তালিকা ঠিকই আছে। তবে কিছুটা এদিক-ওদিক হতে পারে। তাই ওই ভুলভ্রান্তি চিণ্হিত করতে সবার সহযোগিতা চাচ্ছি। তালিকা সংশোধন চলমান প্রক্রিয়া। দেশের থানা পর্যায় পর্যন্ত যেহেতু নির্বাচন অফিস আছে সেহেতু তালিকা সংশোধন করা সহজেই সম্ভব হবে।
সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজের কাছে টেলিফোনে ‘কার্টিসি কল’ করবেন বলে তিনি জানান। তবে বিতর্ক এড়াতে তার বাসায় যাবেন না বলে জানান তিনি।

ভারপ্রাপ্ত সিইসি নিয়ে আইনজ্ঞদের অভিমত
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অনুপস্থিতিতে তার দায়িত্ব পালনের জন্য অন্য কোনো কমিশনারকে দায়িত্ব প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের কোনো প্রয়োজন নেই। তাই সিইসি ছুটিতে যাওয়ায় কমিশনার বিচারপতি মাহফুজুর রহমানের সিইসির দায়িত্ব গ্রহণ আইনের বিরোধী হয়নি। অন্যদিকে বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়া তার দায়িত্ব গ্রহণ করাটা ঠিক হয়নি। যেহেতু প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদটি সর্বোচ্চ পদ সেহেতু তার অনুপস্থিতিতে সেখানকার দু-তিনজন বসেই তার দায়িত্ব পালন কে করবে ঠিক করে ফেলাটা ঠিক হয়নি। আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে ভারপ্রাপ্ত সিইসি হওয়া উচিত ছিল।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সংবিধান এবং ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধত্ব আদেশ অনুযায়ী সিইসির অনুপস্থিতিতে তার দায়িত্ব অন্য কাউকে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের দরকার নেই। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বর্তমান তিনজন কমিশনার তাদের মধ্য থেকে একজনকে সিইসির দায়িত্ব পালনের জন্য নির্ধারণ করতে পারেন। ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, সিইসি ছুটিতে যাওয়ার পর কাউকে না কাউকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। না হয় তার কাজ কে করবে? এ দায়িত্ব প্রদান বা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। কারণ যিনি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি তো সিইসির অনুপস্থিতিতে মাত্র তার দায়িত্ব পালন করবেন, সিইসি নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন না। আর এ ক্ষেত্রে অন্য ১০ জন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা বা তাদের জানিয়ে করারও কোনো ব্যাপার নেই। কারণ সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা রয়েছে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ প্রদান পর্যন্তই। কমিশনের ভেতরের সব কিছু নির্বাচন কমিশনই করবে। ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত সিইসি। ভারপ্রাপ্ত সিইসির বিধানও আইনের কোথাও নেই। আইনে আছে সিইসির কার্যনির্বাহের কথা। সুতরাং কাউকে ভারপ্রাপ্ত সিইসি হিসেবে নিয়োগ প্রদানেরও কোনো সুযোগ নেই।
ড. শাহদীন মালিক বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী তো নির্বাচন কমিশনের একজন সহকারী সচিবকেও প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেয়া অবৈধ হবে না। তার মানে একজন সহকারী সচিবকে সিইসির দায়িত্ব পালন করার সিদ্ধান্ত দেয়া হবে? এখানে নীতির প্রশ্ন রয়েছে। শুধু আইনের ব্যাখ্যা হলেই হবে না। সেই ব্যাখা অস্বাভাবিক হলে তো হবে না। আমরা একটি গাড়িতে চারজন চড়লাম। এক পর্যায়ে ড্রাইভার ছুটিতে গেল। আর আমরা বাকি তিনজন মিলে আমাদের মধ্য থেকে একজনকে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে দিলাম। এখন বিষয়টা এমন দাঁড়াল। আমি মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত সিইসির বিষয়টি আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে হওয়া উচিত ছিল। এটাই সবচেয়ে ভালো ও সুন্দর হতো।

সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা
তফসিল ঘোষণা হয় ২১ জানুয়ারি ২০০৭ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ১০ ডিসেম্বর ২০০৬। মনোনয়নপত্র বাছাই ১১ ডিসেম্বর ২০০৬। আর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৯ ডিসেম্বর ২০০৬। ২৭ নভেম্বর ২০০৬ তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন এসব তারিখ ঠিক করে। সকাল ১০টার দিকে এ ব্যাপারে জারি করা হয় এক প্রজ্ঞাপন। এর আগে সোয়া ৯টার দিকে কমিশন বৈঠকে বসে। দুপুরে নির্বাচন কমিশন সচিব আব্দুর রশীদ সরকার প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তফসিল ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর দিন সকালেই এ তফসিল ঘোষণা করা হয়। ইসি সচিব বঙ্গভবনে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ প্রস্তুতি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন। তফসিল ঘোষণা নিয়ে প্রধান দুটি রাজনৈতিক পক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মুখে এ সম্পর্কে কমিশন সচিবালয়ে বলা হয়, সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসায় কয়েক দিন হাতে রেখেই তফসিল ঘোষণা করতে হয়। তা ছাড়া এবার ভোটার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তা-ই ভোট গ্রহণে এবার কমিশনকে গতবারের তুলনায় অনেক বেশি ব্যালট পেপার ছাপতে হবে। কোনো প্রকার চাপের মুখে কমিশন তফসিল ঘোষণা করেনি বলেন ইসি সচিব।
ঘোষিত তফসিলের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের দফা (১)-এর বিধান অনুসারে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে এবং সংবিধানের ১২৩-এর দফা (৩)-এর বিধানমতে মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রয়োজন, সেহেতু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ১১ অনুচ্ছেদের দফা (১) অনুসারে ইসি জাতীয় সংসদ গঠন করার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন সদস্য নির্বাচনের জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এ তফসিল ঘোষণা করেছে।’
বেলা ২টায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব তফসিল ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে দেশবাসীর প্রতি আগামী ২১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি পুনঃ তফসিল ঘোষণার সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, আশা করি সব রাজনৈতিক দল ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নেবে।
তফসিল ঘোষণা করতে তড়িঘড়ি করা হয়েছে এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, তফসিল ঘোষণা করতে কমিশন কোনোরকম তড়িঘড়ি করেনি। শুরু থেকেই কমিশন বলে আসছিল ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই কমিশনকে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। কারণ ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে কমিশনের হাতে খুব বেশি সময় নেই। সময় অত্যন্ত কম। তা ছাড়া ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে সাপ্তাহিক ছুটির বাইরেও ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস, ২৫ ডিসেম্বর বড় দিন এবং জানুয়ারিতে ঈদুল আজহার জন্য চার-পাঁচ দিন ছুটিসহ বেশ কয়েকটা দিন সরকারি ছুটি থাকবে। তা ছাড়া ভোট গ্রহণে এবার কমিশনকে গতবারের তুলনায় অনেক বেশি ব্যালট পেপার ছাপতে হবে। কারণ এবার ভোটার সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। ব্যালট পেপার ছাপতে বিজি প্রেস এবার কমিশনের কাছে এক মাসের সময় চেয়েছে।
তফসিল ঘোষণা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিনের মধ্যে অন্যবার সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের ফারাক থাকে। এবার তা ৫৪ দিন হলো কেন? এ মর্মে সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবেও তিনি একই কথা বলেন। ভোটার তালিকা প্রকাশ করার আগেই কেন তফসিল ঘোষণা, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভোটার তালিকা চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। আপনাদের মনে রাখতে হবে হালনাগাদ ভোটার তালিকা কোনো নতুন তালিকা নয়। ২০০০ সালের বিদ্যমান তালিকাকে মূল ধরে এবার হালনাগাদ ভোটার তালিকা করা হয়েছে। তা ছাড়া ভোটার তালিকা একটি চলমান প্রক্রিয়া হওয়ায় ভোটারযোগ্য যেকোনো নাগরিক নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত কমিশনে যোগাযোগ করে ভোটার হতে পারবেন।
সাংবাদিকরা আব্দুর রশীদ সরকারকে প্রশ্ন করেন¬ অন্যান্য বছর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তফসিল ঘোষণা করা হতো, এবার অন্যথা হলো কেন? জবাবে বলেন, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অথবা তাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তফসিল ঘোষণা করতে হবে¬ এমন কোনো কথা নেই। তা ছাড়া সময় স্বল্পতার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা যায়নি। তবে পরে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি ভেবে দেখা হবে। ঘোষিত তফসিল ১৪ দল মেনে না নিলে কমিশন কী পদক্ষেপ নেবে। এ প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, রাজনৈতিক দল না মানলে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে ১৪ দলের পক্ষ থেকে তফসিল প্রত্যাখ্যান করার প্রসঙ্গ তুলে ধরে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ দলকে কি পুনরায় রাস্তায় ঠেলে দেয়া হলো কি না এবং রাজনৈতিক ময়দানে সংঘাত-সংঘর্ষ হলে তার দায়-দায়িত্ব কি কমিশনের কাঁধে বর্তাবে? উত্তরে তিনি বলেন, দেখা যাক কী হয়। আমি মনে করি না তাদের রাস্তায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। কমিশনের হাতে পুনঃ তফসিল ঘোষণা করার সুযোগ আছে কি না¬ এ মর্মে আরেক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, পুনঃ তফসিল ঘোষণার সুযোগ কমিশনের হাতে আছে। আমাদের কাছে বিষয়টি এলে তখন দেখা যাবে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবি করে আসছিলো। এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণা করায় এখানে একটা সন্দেহের সৃষ্টি হয় না? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখানে সন্দেহের কোনো বিষয় নেই। নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধনের বিষয়টি সব সময় বলে আসছে। আমরা আগেও বলেছি, নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগের দিন পর্যন্ত ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ করা যায়। ভোটার তালিকায় ১ কোটি ৪০ লাখ ভুয়া ভোটার রয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠছে তার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পক্ষের কাছ কমিশনের কাছে ভুয়া ভোটারের তালিকা আসেনি বলে তিনি জানান।
ভোটার তালিকা সংশোধনের আগে যেন কমিশন তফসিল ঘোষণা না করে এ বিষয়ে হাইকোর্ট একটি রিট হয়েছে। শুনানি চলা অবস্থায় কমিশন কোনো রকম অপেক্ষা না করেই কেন তফসিল ঘোষণা করল? প্রশাসনে রদবদলের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে কি না? এমন সব প্রশ্নের উত্তর দেন ইসি সচিব। তিনি বলেন, মামলা ভিন্ন জিনিস। আদালত থেকে যেভাবে রায় আসবে সেভাবে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর সঙ্গে শিডিউল ঘোষণার কোনো সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া শিডিউল ঘোষণার সঙ্গে প্রশাসনে রদবদলের কোনো সম্পর্কও নেই।
বঙ্গভবনে যাওয়ায় কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনী প্রস্ত–তি বিষয়ে অবহিত করা এবং দুজন নতুন কমিশনার বিষয়ে সবিনয় অনুরোধ করার প্রয়োজন ছিল। তাই গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে যাইনি। মোট তিনবার রাষ্ট্রপতিকে কমিশনের প্রস্তুতি বিষয়ে অবহিত করেছেন বলে তিনি জানান। অন্যান্যবার তফসিল ঘোষণা করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এবার ব্যতিক্রম কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, সব সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভাষণ দেন না। একবার দিয়েছেন। সেটা গতবার। সাংবাদিকরা সচিবের কাছে জানতে চান, উপদেষ্টারা বলে আসছিলেন একটা লেভেল ফিল্ড না হওয়া পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা করা ঠিক হবে না। তাহলে কেন তফসিল হলো¬ এ প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, শিডিউল ঘোষণার সঙ্গে উপদেষ্টাদের অবশ্যই সম্পর্ক আছে। কিন্ত– শিডিউল ঘোষণার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। কমিশন সেটিই করেছে। একই সঙ্গে তফসিল মেনে নিয়ে সব নির্বাচনে অংশ নেবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সম্প্রতি গুলশানে ইসি সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে কোন কর্মকর্তা ওই বৈঠকে গিয়েছেন তার নাম পেলে তদন্ত করে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সচিব সবাইকে আশ্বস্ত করেন।
উল্লেখ্য, তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন পর্যন্ত ৫৪ দিন সময় হাতে রাখা হয়। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ১৯ আগস্ট ২০০১, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল ২৯ আগস্ট, বাছাই ৩০ আগস্ট, প্রত্যাহার ৬ নভেম্বর এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১ অক্টোবর। সেবার তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন পর্যন্ত সময় ছিল ৪১ দিন। এবার ভোটার সংখ্যা বেশি বলে ভোটার তালিকা ছাপতে সময়ও বেশি লাগবে। তাই বেশি সময় হাতে রেখে তফসিল ঘোষণা করা হয় বলে কমিশনের বক্তব্য।


তথ্য সূত্র: তৎকালীন জাতীয় দৈনিক সমূহ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন