জাসদ-গণবাহিনী সৈনিক সংস্থার বিপ্লবের চালচিত্র ৪

জেনারেল জিয়ার মতো একজন দৃঢ়চেতা ও উঁচুমাপের সেনানায়কের হাতে যদি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব না থাকতো, তাহলে জাসদ-গণবাহিনী-সৈনিক সংস্থার রক্তাক্ত বিপ্লবের তোড়ে শুধু সেনাবাহিনীই ভেসে যেতো না। জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও বিপন্ন হতো।বিশেষ করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার হাতে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি তুলে দেবার ফলে দেশে যে গৃহযুদ্ধের দাবানল জ্বলে উঠতে যাচ্ছিল,

তার সুযোগে বিদেশী আগ্রাসনের পথ উন্মুক্ত হতো। সৈনিকদের ক্ষোভ প্রশমন বা তাদের দাবি দাওয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে সেনা অফিসারদের যেখানে পাওয়া যায়, সেখানেই হত্যা করার কর্মসূচি কোন বিপ্লবের শর্ত হতে পারে না। সেনাবাহিনীর চরিত্রকাঠামো বদলে শ্রেণীহীন-অফিসারদের পদ-পদবীহীন পিপলস আর্মিতে রূপান্তর করতে হলে নিরপরাধ সেনা অফিসারদের হত্যা করতে হবে কেন? প্রচলিত পদ্ধতির ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীতে অফিসাররা কর্মরত ছিলেন। তারা কী দোষ করেছেন? অকারণ ও উন্মত্ত হত্যা-রক্তপাত কোন বিপ্লব হতে পারে না। বরং বিপ্লবের নামে আমাদের সেনাবাহিনীর মেরুদন্ড ধ্বংস করে দেশকে ভিন্ দেশী আগ্রাসী শক্তির হাতে তুলে দেবার পথে সেনাবাহিনী অন্তরায় বলেই সেনা অফিসার নিধনের বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয় ক্যান্টনমেন্টকে। জিয়া যদি জাসদ-গণবাহিনী-সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি মেনে না নিয়ে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকেন, তাহলে জাসদ মহাজোটের অংশীদার হিসেবে এ ১২ দফা দাবি নতুন করে উপস্থাপন করে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিচ্ছে না কেন? তাছাড়া জাসদ-গণবাহিনী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের দলীয় ও সরকারি অবস্থান কি, তাও জনগণকে জানানো উচিৎ। আওয়ামী লীগও কি জাসদ-এর পিপলস আর্মীর কনসেপশন সমর্থন করে?

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৭ই নভেম্বর ৭৫ সময়কালে ঢাকা সেনা নিবাসের স্টেশন কমান্ডার হিসেবে কর্মরত হিসেবে সরেজমীন প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা নিয়ে লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম এ হামিদ পিএসসি ‘‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’’ শীর্ষক একটি তথ্যবহুল বই লিখেছেন। ৩২/২-ক বাংলাবাজার, ঢাকার ‘‘মোহনা প্রকাশনী এটি প্রকাশ করেছে। কর্নেল হামিদের বর্ণনায় দেখা যায় যে, তাহেরের সৈনিক সংস্থার সদস্যরা খালেদ মোশারেরফের ক্যুর সাথে জড়িত হিসেবে সনাক্ত মেজর নাসের ও মেজর গাফফারকে তাদের হাতে তুলে দেবার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল আমিন ও মেজর মুনির অফিসারদেরকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত ট্যাংকাররা ফিরে যেতে বাধ্য হয়।’’

কর্নেল হামিদ লিখেছেনঃ ‘‘আমার নিচতলায় থাকতেন সিগন্যাল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল সামস। হঠাৎ গেইটে তুমুল চিৎকার, হট্টগোল। গেইট ঠেলে ভেঙ্গে ১০/১২ জন সেপাই ঢুকে পড়ল চত্বরে। তারা নিচতলায় কর্নেল সামসের বাসা আক্রমণ করে বসলো। অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিয়ে তাকে দরজা খুলতে বলে চিৎকার দিতে লাগল। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। সেপাইরা ক্রমাগত লাথি মেরে মেইন দরজা ভেঙে ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ল। ততক্ষণে সামসরা সবাই পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছেন। ঘরে কাউকে না পেয়ে প্রবল আক্রোশে তারা খালি ঘরে গুলি চালাতে লাগল। দুটো গুলি উপরের তলায় একেবারে আমার পায়ের তলায় এসে লাগল। ভাবলাম সাম্স শেষ। কিন্তু তিনি পালিয়ে বেঁচে গেলেন। ভয়ে আমার বাচ্চারা কাঁদতে লাগল।’’[উদ্ধৃত বই ঃ পৃ- ১১৬]

এরপর সোপাইরা নিচতলায় শিকার বধ করতে না পেরে সিঁড়ি বেয়ে উপরতলায় কর্নেল হামিদের বাসায় ধাওয়া করে। তারা ব্যাটম্যান ও অন্য চার রক্ষী সেপাইদের বাধা অতিক্রম করে দরজা খোলার জন্য হাঁক-ডাক দিতে থাকে। তিনি লিখেছেন] ‘‘আমি দেখলাম, দরজা না খুললে বিপ্লবীরা দরজা ভেঙেই ভেতরে ঢুকে পড়বে। অতএব, আমি দরজা খুলে বেরুতে গেলাম। আমার স্ত্রী আমাকে থামিয়ে বললো, দাঁড়াও আমিই যাবো, বলেই সে দরজা খুলে একেবারে আক্রমণকারীদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।’’ তারা বললো, ‘‘আপনি সরুন। আমরা আপনাকে চাই না, অফিসারকে চাই। রক্তপাগল সৈনিকরা আমার স্ত্রীকে গুলি করতে পারে ভেবে আমি নিজেই তাড়াতড়ি দরজার পেছন থেকে বেড়িয়ে এলাম। বললাম, আমি কর্নেল হামিদ। তোমরা কি চাও? একজন বিপ্লবী গুলী করার জন্য রাইফেল তুলতেই সবুজ আলী (ব্যাটম্যান) ও অনুগত সেপাইরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে জাপটে ধরলো। সবুজ আলী বললো, খবরদার বলছি, ভাল হবে না। তারা বিপ্লবীকে প্রবলভাবে ঠেলে পেছনে নিয়ে গেল।’’ ঐ

ব্যাটাই ছিল লিডার। মনে হলো এরা ভিনগ্রহের বিপ্লবী সেপাই। বাকিদের দুতিন জনকে সামসের সিগন্যাল ইউনিটের মনে হলো। আমার সেপাইদের দৃঢ়তা দেখে তারা পিছপা হলো। রাগে গর গর করতে করতে তারা ফিরে চলল। একজন বলল, দাবি না মানলে আমরা কোন অফিসারকে জিন্দা রাখবো না। যা হোক, আমরা কোনক্রমে এ যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেলাম। সারারাত আমরা ঘরের আলো নিভিয়ে জেগেই রইলাম। আমার সেপাইরাও জেগে রইলো।’’ [প্রাগুক্ত : পৃ ১২০]

কর্নেল হামিদ লিখেছেন : ‘‘৭/৮ নবেম্বরের ঐ বিভীষিকাময় রাতের গভীর অন্ধকারে উন্মাদ সৈনিকরা অফিসারদের রক্তের নেশায় পাগল হয়ে উঠল। ঘটে গেল বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড। বহু বাসায় হামলা হল। অনেকে বাসায় ছিলেন না। অনেকে পালিয়ে বাঁচলো। সৈনিকরা মেজর করিম, মিসেস মুজিব, মিসেস ওসমানকে গুলী করে হত্যা করল, মেজর অজিম ও মুজিব চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। বিপ্লবী সৈনিকরা তাদের এয়ারপোর্টে পাকড়াও করে। আজিমকে গুলী করে হত্যা করে। মেজর মুজিব প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। অর্ডিন্যান্স অফিসার মেসে সৈনিকরা হামলা করে তিনজন তরুণ অফিসারকে গুলী করে হত্যা করে। এদের মধ্যে ছিলেন মেজর মহিউদ্দীন, যিনি শেখ সাহেবের লাশ টুঙ্গীপাড়ায় নিয়ে দাফন করেন। সৈনিকরা বনানীতে কর্নেল ওসমানের বাসায় আক্রমণ করে। ওসমান পালিয়ে যান। তারা মিসেস ওসমানকে গুলী করে হত্যা করে। হকি খেলতে এসেছিল দুজন তরুণ লেফটেন্যান্ট। তাদের স্টেডিয়ামের পাশে গুরী করে হত্যা করা হয়। অর্ডিন্যান্সে দুশজন অফিসারকে এক লাইনে দাঁড় করানো হয় মারার জন্য। প্রথমজন এক তরুণ ই এম ই ক্যাপটেন। তার পেটে গুলী করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। বাকিরা অনুনয় বিনয় করলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। বেঁচে গেল তারা অপ্রত্যাশিতভাবে। একজন টেলিভিশনের অফিসার মুনিরুজ্জামান। বঙ্গভবনে খালেদের সময় খুবই অ্যাকটিভ ছিলেন। তাকে ধরে গুলী করা হয়। তিনদিন পর তার লাশ পাওয়া যায় মতিঝিল কলোনীর ডোবায়। সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের ডাইরেক্টর কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার) খুরশিদ। বিপ্লবীরা তার বাসা আক্রমণ করে কয়েক ঝাঁক গুলীবর্ষণ করে। তিনি পালিয়ে যান। কিন্তু পরে আবার সেপাইদের হাতে ধরা পড়েন। বিপ্লবীরা তাঁর দুই হাত বেঁধে যখন গুলী করতে উদ্যত, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। হঠাৎ আসুরিক শক্তিতে বনবাদাড় ভেঙ্গে তিনি দেন ছুট। তারা পিছনে গুলী ছুঁড়লেও আর তাকে ধরতে পারেননি।

রাস্তার ওপারে অর্ডিন্যান্স স্টেটের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। উচ্ছৃ´খল সৈনিকরা দল বেঁধে প্রায় প্রতিটি অফিসার্স কোয়ার্টারে হামলা চালায়। ভীতসন্ত্রস্ত অফিসাররা বাসা ছেড়ে অন্ধকারে পেছনের পানির ডোবায়, ঝোপে জঙ্গলে আত্মগোপন করে সারারাত কাটায়। এই সময় -এর কমান্ডিং অফিসার কর্নেল বারী সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। হত্যাকান্ডের সময় তিনি জীপে চড়ে ভেতরে যাচ্ছিলেন। গোলাগুলীর খবর শুনে তার বিশ্বস্ত ড্রাইভার গেইট থেকেই সজোরে মোড় ঘুরিয়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে যায়।

১২ জন অফিসার মারা পড়েন ঐ রাতে। আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান বেশ কজন অফিসার। নিহত কজন অফিসার হলেন : মেজর আনোয়ার আজিম, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন আনোয়ার, লে. সিকান্দার, লে. মুস্তাফিজ, বেগম ওসমান ও অন্যান্য।

... বিপ্লবী সৈনিকরা সত্যি সত্যিই অফিসারদের রক্ত-নেশায় পাগল হয়ে উঠলো। ভাগ্যিস, অধিকাংশ অফিসার ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে সন্ধ্যার আগেই শহরে তাদের নাগালের বাইরে চলে যান। সেপাইগণ কর্তৃক আপন অফিসারদের ওপর হামলা কস্মিনকালেও ঘটেনি এর আগে। বস্তুত এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা।’’

৮ নবেম্বর

... আপন সেপাইদের কাছ থেকে অফিসাররা ছুটে পালাতে লাগল। কোনো ইউনিটে, হেড কোয়ার্টারে, অফিসে অফিসার নাই। সবাই ছুটে পালাচ্ছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে। ... বেশিরভাগ অফিসার নিজের জন্য নয়,বরং তাদের পরিবারের নিরাপত্তার চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। ঐ দিন সকাল ৮টার সময়ও কয়েকজন অফিসারের ওপর গুলীবর্ষণ করা হল। বহু অফিসারকে সৈনিকরা নাম ধরে খুঁজতে লাগল।

... কেউ কেউ শহরে আত্মীয়-স্বজন না থাকায় অখ্যাত হোটেলে উঠে আত্মগোপন করলেন। অনেকে স্টেশন হেডকোয়ার্টারে নাম্বার দিয়ে গেলেন পরিবেশ স্বাভাবিক হলেই তাদের খবর দিয়ে আনার জন্য। ... অফিসার দেখলেই সেপাইরা তাড়া করছে। সেপাইরা বাধ্য করলো তাঁদের কাঁধের র‌্যাং ক নামিয়ে ফেলতে। কেউ র‌্যাং ক পরতে পারবে না। আমি যথারীতি অফিসে গেলাম। আমার ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসে আমাকে নিতে। অফিসে আমার সুবেদার সাহেব বললেন : স্যার, আপনাকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি। কিন্তু দয়া করে অফিসের বাইরে গেলে কাঁধে আপনার কর্নেলের রযাং কটা নামিয়ে যাবেন। ... সব অফিসার তাই করছে। অফিসে আমি র‌্যাং ক পরেই থাকলাম। কিন্তু জীপ নিয়ে বেরুবার সময় র‌্যাং ক নামিয়েই বেরুলাম।

আমি জিয়াকে [জেনারেল জিয়া লেখকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু] খুঁজছিলাম। সে পাগলের মত এখানে ওখানে ঘুরছিল। চতুন্দিকে গন্ডগোল থামাতে ক্যান্টনমেন্টের সবখানে ছুটে গিয়ে সেপাইদের এসব কান্ড বন্ধ করতে বললো। তারা বিভিন্ন দাবি পেশ করলো। জিয়া বলল, আগে তোমরা অস্ত্র জমা দাও। আমি সব দাবি মানবো।’’

‘‘কর্নেল তাহেরের ইঙ্গিতে বিপ্লবী সৈনিকরা এখন একেবারে উল্টে গেছে। বিপ্লবীরা জিয়াকেও হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে। জিয়া সৈনিকদের ১২ দফা দাবি মানতে অস্বীকার করেছে। সৈনিকদের কাছে দেয়া প্রতিশ্র”তির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যে ১২ দফা দাবির ভিত্তিতে কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে জিয়াকে মুক্ত করেছে। সেই দাবিগুলো মানতে প্রতিশ্র”তি দিয়ে জিয়া এখন পিছিয়ে গেছে। এখন তারা জিয়াকে হত্যা করবে। সব অফিসারদের হত্যা করবে বিপ্লবীদের আস্ফালন। সৈনিকদের বিপ্লব এখন নতুন মোড় নিল। অফিসারদের রক্ত চাই রক্ত চাই’’

৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের এক সমাবেশে জিয়া তাঁর ভাষণে বলেন : ‘‘আপনারাই দেখুন, ডিসিপ্লিন না থাকলে কি অবস্থা হয়। আপনারা হাতিয়ার জমা শৃ´খলার মধ্যে আসুন। ব্যারাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যান। অযথা রক্তপাত করবেন না। আপনারা ক্যান্টনমেন্টে শান্তি-শৃ´খলা ফিরিয়ে আনুন।’’

ঐ মিটিং-এ প্রায় সবাই ছিল সশস্ত্র। একজনের স্বযংক্রিয় রাইফেল থেকে আপনা আপনি গুলী বেরিয়ে যাওয়ায় ঐ সভাতেই দুজনের মৃত্যু ঘটে। ‘‘সৈনিক সমাবেশে জিয়ার আকুল আহবান তারা আমলে নিলেন না। হিংসাত্মক পরিবেশের কোন উন্নতি হলো না। বরং জাসদ তাদের ১২ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত অস্ত্র জমা না দেয়ার জন্য সৈনিকদের নির্দেশ দিলো। বহু লিফলেট বিতরণ করা হল। ওগুলোতে জিয়া এবং অফিসার শ্রেণীতে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা হলো।’’ [প্রাগুক্ত-পৃ-১২২]

‘‘সৈনিকদের ভয়ে অফিসারদের ক্যান্টনমেন্টে ছেড়ে পলায়ন- এরকম ঘটনা কোনদিন কোথাও ঘটেছে বলে মনে হয় না।’’ [প্রাগুক্ত] কর্নেল হামিদ লিখেছেন : ১২ দফার দাবিগুলো বাস্তবায়ন হলে- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি শ্রেণীহীন বাহিনীতে পরিণত হতো। ‘বিপ্লবী কাউন্সিল গঠিত হলে সেনাপ্রধানের কমান্ড থাকে না। ৯ নবেম্বর ও হত্যা, অরাজকতা চলছিল। সবখানে অচলাবস্থা, আতঙ্ক। অফিস, ব্যারাক সিপাইদের দখলে। বিপ্লবীরা সর্বত্র ঘুরে ফিরে-সৈনিকদের উত্তোজিত করছিল। দাবি-দাওয়া সম্বলিত প্রচুর লিফলেট সর্বত্র বিতরণ করছিল। এ দিন বিকালে (নয় নবেম্বর) জাসদের একটি বিজয় মিছিল ও মিটিং অনুষ্ঠিত হল বায়তুল মোকাররমে। জিয়ার নির্দেশে পুলিশ গুলী চালিয়ে তা ভেংগে দিল। বিভ্রান্ত জনগণ। একবার শোনে সিপাই বিপ্লব, জাসদের বিপ্লব। আবার দেখে জাসদের মিটিংয়ে গুলী। আসল ব্যাপার কি?’’ [প্রগুক্ত-পৃ-১২৫]

দুদিন ধরে খালেদ মোশাররফের লাশ পড়ে ছিল। তার পরিবার পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ৯ নবেম্বর/৭৫ খালেদের এক চাচা লাশ নেবার জন্য স্টেশন কমান্ডার কর্নেল হামিদকে টেলিফোন করেন। তাকে লাশ নিতে আসতে বললেও ভয়ে তিনি ক্যান্টনমেন্টে আসতে রাজি হলেন না। অগত্যা বনানী স্টেশনের কাছে নিয়ে লাশ হস্তান্তর করা হলো। সেনানিবাস গোরস্থানে খালেদকে দাফনের অনুমতি দিলেন কর্নেল হামিদ। খালেদের আত্মীয়রা লাশ দাফনে ভয় পাচ্ছিলেন। কর্নেল হামিদ তাদের অভয় দিয়ে বললেন, সন্ধ্যায় লাশ যখন দাফন হবে, তখন তিনি নিজে সেখানে উপস্থিত থাকবেন। অন্ধকার সন্ধ্যা। গুঁড়ি, গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তার লাইটের স্তিমিত আলোতে ক্যান্টনেমেন্ট গোরস্থানে তড়িঘড়ি করে খালেদের দাফন কার্য সমাধা হল। উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৪/৫ জন অতি নিকটাত্মীয় ও চাচা। আর শুধু কর্নেল হামিদ ও তার ড্রাইভার ল্যান্সনায়েক মনোয়ার। কর্নেল হামিদ তাঁর বইয়ে এসব কথা লিখেছেন। খালেদকে হত্যার পরও তার বাসা লুটপাটের আয়োজন দেখেন কর্নেল হামিদ। তিনি লিখেছেন : ‘‘আমি আর্মি হেড কোয়ার্টারে গেলাম। সেখানে গিয়ে হেড কোয়ার্টার উইং-এর সুবেদার মেজরকে খোঁজা-খুঁজি করে বের করলাম। তাকে বললাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদের বাসায় লুটপাট হচ্ছে। কিছু গার্ডের ব্যবস্থা করুন। তিনি আকাশ থেকে পড়লেন, বললেন, স্যার গার্ড কোথা থেকে দেবো? সেপাইরা তো এখন আমাদের কমান্ড করছে। সবকিছু তো এখন তাদের দয়ার ওপর।....

সন্ধ্যার এই সময় ক্যান্টনমেন্টে আমি ঘোরাফেরা করছি দেখে তিনি খুবই আতঙ্কিত হলেন। বললেন : স্যার, আপনি তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান। সিপাইদের মতিগতি ভাল না। আপনার বিশেষ ক্ষতি হতে পারে। তার কথায় আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমি জীপ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি বাসার পথ ধরলাম।’’ [প্রাগুক্ত-পৃ-১২৬]

জেনারেল জিয়ার দৃঢ়তা এবং তাঁর কতিপয় বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ক্যান্টনেমেন্ট শান্ত হয়ে এলো। সৈনিকরা অনেক বোঝাপাড়ার পর তাদের অস্ত্র জমা দিয়ে শৃ´খলায় ফিরে আসতে থাকে। কর্নেল হামিদের মতে ১৪/১৫ নবেম্বরের (১৯৭৫) ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তিনি লিখেছেন : ‘‘সৈনিকগণ তাদের অফিসারদের আবার যথাযথ সম্মান দেখানো শুরু করলো। তাদের পূর্ব ব্যবহারের জন্য সবাই দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। প্রায় প্রতিটি ইউনিটে এখন সৈনিকগণের সাথে অফিসারদের প্রীতিভোজ অনুষ্ঠান করে পুনর্মিলনী পালন করা হলো। রক্তাক্ত যুদ্ধের পর এসেছে শান্তি। এবার ‘সেপাই অফিসার ভাই-ভাই। করমন্দন, গলাগলি, কোলাকুলি, হাসি-মশকরা- সর্বত্র আনন্দমুখর দৃশ্য। এসব দৃশ্য এখন মনে হলে রীতিমতো হাসির উদ্রেক হয়। [প্রাগুক্ত-পৃ-১৩০]

এরশাদের ভূমিকা

কর্নেল হামিদের বর্ণনায় দেখা যায়, ভারতের নয়াদিল্লীতে একটি কোর্সে থাকা এরশাদকে তার কোর্স অসমাপ্ত রেখেই তার বন্ধু জেনারেল শওকত ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। তিনি আরও লিখেছেন, জেনারেল তখন ব্রিগেডিয়ার ও শওকত যশোর থেকে খালেদ মোশাররফকে সহায়তার জন্য ঢাকায় এসে পটপরিবর্তনে জেনারেল জিয়ার পক্ষে ভিড়ে যান। জেনারেল শওকত মৃত্যুর আগে বিএনপির রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারস ফোরাম গঠন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইন্ডিয়ান এজেন্ডা বাস্তবায়নে তিনি সোচ্চার ছিলেন। তাছাড়া নবম ডিভিশনের জিওসি থেকেও তিনি জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে এরশাদ-মঞ্জুর অভ্যুত্থান থেকে তাকে রক্ষা করতে পারেননি। কর্নেল হামিদ লিখেছেন : ‘‘আমাকে ডেকে জিয়া বললেন, হামিদ তুমি এরশাদকে সাথে নিয়ে তোমার ইউনিটগুলোর সৈনিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দাও। ওর ব্যাপারে জওয়ানরা কিছু প্রশ্ন তুলেছে। বেচারা ‘সাদাসিধে নম্র মানুষ। কিন্তু দেখো, ব্যাটারা কি সব প্রশ্ন তুলেছে। তার কথা শুনে আমার ফিক করে হাসি উঠল। জিয়া বলল: কেন, তোমার তক্লিফটা কি? বললাম, কিছু না। এমনিতেই হাসলাম। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে একটি ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হলে তার ঐ কথাটি তখন আমার বার বার মনে পড়ছিল।’’

‘‘একদিন সেনা সদর থেকে এরশাদ ফোন করে বললেন, ৩রা নবেম্বর অভ্যুত্থানকারী বিদ্রোহী অফিসারদের ট্রায়াল শুরু করা হবে। লগ এরিয়া হেড কোয়ার্টারের তত্ত্বাবধানে ট্রায়াল হবে। চীফ বলেছেন, আপনাকে সব অভিযুক্ত অফিসারদের চার্জশীটগুলো সাইন করে বাকি ব্যবস্থা নিতে। আমি বললাম, দয়া করে এসব ট্রায়ালের ঝামেলায় আমাকে ফেলবেন না।

কিছুক্ষণ পরেই জিয়ার ফোন এলো, হামিদ, তোমরা কেন এরশাদের সাথে সহযোগিতা করো না? -দের চার্জশীট তোমাকেই সাইন করতে হবে। ট্রায়াল পরে দেখা যাবে। জিয়া ফোন করার পর দিনই লেঃ কর্নেল (অবঃ) আজিজ একগাদা ‘তৈরি চার্জশীট বগলদাবা করে আমার অফিসে এলেন এবং পাঁচ মিনিটেই সবগুলো সাইন করিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। পরবর্তীতে এ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার রউফ, শাফায়েত জামিলরা আমার ওপর নাখোশ ছিল। তারা ভেবেছিল, আমিই বুঝি সব চার্জশীট তৈরি করেছি। যদিও আসলে এগুলো তৈরি করা হয়েছিল সেনা সদরে ব্রাঞ্চে এরশাদেরই তত্ত্বাবধানে।’’ [প্রাগুক্ত পৃ-১৩২]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন