হত্যা মামলার একজন সন্দেহভাজন আসামিকে মামলা চলাকালে রাষ্ট্রের অপরিহার্য ও অনিবার্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিভাত করার সরকারের নীতিই বা কি? প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত নিয়োগের পর গত ২৩শে জানুয়ারি এরশাদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা মুছে ফেলে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর একটি গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন।’ কোন তিক্ত
অভিজ্ঞতা মুছে ফেলার জন্য এরশাদ আহ্বান জানিয়েছেন? যিনি রাজনীতিকে নৈতিকতাহীন আবর্জনায় রূপান্তর করেছেন তার ওপর প্রধানমন্ত্রী কি-ই বা গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন?
এইচএম এরশাদেরও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পরিপূর্ণ অধিকার রয়েছে। তবে তা যেন ক্ষমতার অন্যায় প্রভাবে নিম্ন আদালতকে প্রভাবিত করার সুযোগের বিনিময়ে না হয়। এ-ও তো সত্য রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন- ‘আমি যখন হতাশ হয়ে পড়ি, তখন আমি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই এবং সেখানে দেখি, সত্য ও ভালবাসার জয় সব সময়ই হয়েছে। স্বৈরাচার থাকবে, হত্যাকারী থাকবে এবং এক সময় মনে হবে তারা বোধহয় অপরাজেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের পতন হতে বাধ্য।’
একজন বীর যিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে জীবন-মৃত্যুকে তুচ্ছ করে ভয়ঙ্কর বিপদকে আলিঙ্গন করে দেশমাতৃকার টানে কয়েক হাজার মাইল দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই অসম সাহসী গর্বিত সন্তানের পরম গৌরবোজ্জ্বল ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য রাষ্ট্র বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করেছিল। সেই বীর মেজর জেনারেল এমএ মঞ্জুর। সেই মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার উপেক্ষিত হবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে?
১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা শুরু করে তখন পাকিস্তান সেনানিবাস থেকে কয়েকবার পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ২৫শে জুলাই ১৯৭১ কর্নেল আবু তাহের, জেনারেল এমএ মঞ্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন পাকিস্তানের এবোটাবাদ দিয়ে ভারতের দেবীগড় সীমান্ত অতিক্রম করে দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানের সৈন্যরা যখন বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের ওপর বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ ঘোষণা করে নজিরবিহীন নির্যাতন ও গণহত্যার অপরাধ সংঘটিত করছে তখন পাকিস্তান সেনানিবাসে এইচএম এরশাদ নিশ্চিত সুখী জীবনের প্রলোভনে দিন যাপন করছেন।
অন্যদিকে পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু ও নৃশংসতাকে উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাহের আর মঞ্জুর বাঙালির আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানকে পূর্ণিমার আলোয় জ্যোতির্ময় করেছেন। সেই তাহের আর মঞ্জুর স্বাধীন দেশে অপরাজনীতির শিকার হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আর এরশাদ এখনও নিশ্চিত জীবনের প্রত্যাশায় মঞ্জুর হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য রাজনৈতিক খেলা খেলছেন।
সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অপসারিত করার অভিপ্রায়ে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মম নির্যাতনের পর ফাঁসিতে হত্যা করা হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে আবুল মঞ্জুর-এর হাতে নিহত হননি কিংবা যাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে তাদের হাতেও নন, এসব সত্য আজ প্রকাশিত। অথচ চক্রান্তকারীরা আজ রাষ্ট্রে সমাদৃত ও সংবর্ধিত। জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে- তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশে ১৯৮১ সালে ১লা জুন মধ্যরাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। ১৯৯৫ সালের ২৭শে জুন এরশাদসহ ৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ সরকার এরশাদকে প্রাথমিকভাবে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দাখিল করার পর এরশাদকে অপরাধী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য আদালতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সরকার এরশাদকে কি করে মন্ত্রীর মর্যাদায় বিশেষ দূত করে জাতীয় পতাকা বহন করা বা পুলিশি প্রটোকল ব্যবহার করার সুযোগ দিতে পারে? একদিকে সরকার সরকারি কর্মচারী অর্থাৎ পুলিশ বিভাগসহ সরকারি আইনজীবী নিয়োগ করে প্রজাতন্ত্রের অর্থ ও সময় ব্যয় করে এরশাদকে অপরাধী বা খুনি হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছেন আবার সেই সরকার সরকারি অর্থ-পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় প্রটোকল দিয়ে এরশাদকে রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য করে তুলছেন-অতিরিক্ত নিরাপত্তার সুরক্ষা দিচ্ছেন।
একই সঙ্গে খুনি- একই সঙ্গে ফুলের মালায় স্বাগত। একই সঙ্গে অভিযুক্ত- একই সঙ্গে খালাস। একই সঙ্গে সততা- একই সঙ্গে প্রবঞ্চনা। এটা কোন রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামীদের রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে চাকরি বা সুযোগ সুবিধা বা আনুকুল্য প্রদানের অন্যায় আচরণের কারণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়াসহ এরশাদকেও অভিযুক্ত করেন। একই কারণে এক বীরউত্তম বা বহু বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা মামলার আসামিকে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে এবং জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে বিচারকে প্রভাবিত করার অভিযোগ নিশ্চয়ই একদিন উত্থাপিত হবে। ভবিষ্যতে কোন আদালত কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ডের মতো জাতীয় বীর জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত আসামিকে মামলা চলাকালে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করার প্রশ্নটি রাজনৈতিক অবিচার হিসেবে রায় বা পর্যবেক্ষণ দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ মুক্তিযুদ্ধের অসম সাহসী বীর সেনানি জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীরউত্তমের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কাহিনী নিয়ে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করে বলেছেন-
১. এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা ‘বিক্ষুব্ধ, সেনা, ‘উত্তেজিত জনতা’ এবং ‘বিক্ষুব্ধ মানুষের’ হাতে মঞ্জুর হত্যার অনেক কাহিনী ফেঁদেছেন
২. এরশাদ শুধু হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজনই নন, সেনাপ্রধান হিসেবে বহু সেনা কর্মকর্তাকে নির্যাতন করে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের ঘটনায়ও তিনি একজন হুকুমের আসামি। এ ধরনের কাজ একদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের খেলাপ, অন্যদিকে নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক ও অবমাননামূলক আচরণ আন্তর্জাতিক রীতি-নীতিরও পরিপন্থি
৩. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি তাঁর সদ্য নিযুক্ত বিশেষ দূত জেনারেল এরশাদ যিনি এ মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন, তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক সমীকরণের স্বার্থে আপসরফা চালিয়ে যাবেন?
৪. মঞ্জুর-এর পরিবারও সেই জবাবদিহি দেখতে চায়- যা প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতা-মাতা-ভাই-বোনদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দাবি করেছিলেন। নতুন তথ্যের আলোকে আমরা এই প্রত্যাশা করি যে, শেখ হাসিনা তাঁর ‘বিশেষ দূত’-এর কাছ থেকে সরে এসে মঞ্জুরের সন্তানদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। তাদের বলবেন- তোমাদের ন্যায়বিচারের দাবিতে আমি বিপক্ষে নই বরং পাশে আছি
৫. মৃত্যুর মামলা ও সংশ্লিষ্ট সেই পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাকে কারও রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়- এটা বিবেচনাবোধহীন একটি ব্যাপার ৬. এই মামলাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এই মামলার মধ্যে বাংলাদেশের এক দশকের সামরিক শাসনের বীজ নিহিত রয়েছে। মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড সেই বীজের প্রাণকেন্দ্র।
লরেন্স লিফশুলৎজ সর্বশেষ বলেছেন মঞ্জুর হত্যা মামলা বাংলাদেশের বিবেককে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এটা কিভাবে মোকাবিলা করা হবে তাই এখন দেখার বিষয়। এ দেশের মুক্তিকামী মানুষও অপেক্ষা করবে মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার সরকার কি ভূমিকা গ্রহণ করে। রাষ্ট্রকেই বার বার প্রমাণ করতে হয় রাষ্ট্র জনগণের।
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন