মারা যান।’
এরশাদের এক সহকর্মী মোস্তফা—লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামাল ২০১৩ সালে আদালতে বলেছিলেন, ‘কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে মঞ্জুরকে নেওয়ার পথে তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময় হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুরের গায়ে বুলেট বিঁধে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।’
এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা যে গল্প ফেঁদেছেন এবং ৩০ বছর ধরে ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজিয়ে চলেছেন, তার প্রধান দুর্বলতা হলো বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। সে সময় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন বা এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা কেউই কখনো বলেননি যে তাঁরা ‘বিক্ষুব্ধ মানুষ’ বা ‘বিক্ষুব্ধ অস্ত্রধারী’ ব্যক্তিদের দেখেছেন, যাঁরা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে গোলাগুলি হয়; আর মঞ্জুর এই ‘টানাহ্যাঁচড়া’র কারণে গুলিবিদ্ধ হন। কেউ কেউ বলেছেন, মঞ্জুরের ‘নিরাপত্তারক্ষীরা’ গুলি করেছিল; আর কেউ বলেছেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার পথে মঞ্জুর মারা যান।’ কিন্তু কোনো হাসপাতালেই মঞ্জুরকে সেদিন জীবিত বা মৃত বা আহত অবস্থায় দেখা যায়নি। কেবল একজন সেনা চিকিৎসক তাঁকে দেখেছেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের ব্রিগেডিয়ার আজিজ, ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে তখন ছিলেন তিনি, দাফনের জন্য মরদেহ প্রস্তুত করাতে তাঁকে মঞ্জুরের ‘ক্ষত ব্যান্ডেজ’ করে দিতে বলেন।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর বইয়ে ফটিকছড়িতে মঞ্জুরের শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং তাঁর গতিবিধির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর বিবরণ বা চট্টগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের কারও কথার সঙ্গেই এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের গল্পের ন্যূনতম কোনো মিল নেই। চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক হিসেবে জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ১ জুন মঞ্জুরের গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে হাটহাজারী থানায় সেনাবাহিনীর হাতে তাঁকে সোপর্দ করা পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এমনকি মঞ্জুর নিরাপদে ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছালেন কি না, সেটিও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ারের কাছ থেকে তিনি শুনে নিশ্চিত হয়েছেন।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরীর ভাষ্যের সঙ্গে এরশাদের ভাষ্যের তুলনা করা যাক:
‘মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পরদিন সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মঞ্জুর মৃত্যুবরণ করেছেন। এই প্রতিবেদন ছিল একটি ডাহা মিথ্যা।
‘ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়নি। ব্রিগেডিয়ার আজিজ পুলিশের ডিআইজিকে বলেছিলেন, ২ জুন সকালবেলা মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। আজিজ এ কথা বলেননি যে মঞ্জুর বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের হাতে মারা পড়েছেন...
‘চিকিৎসককে যখন মঞ্জুরের “ক্ষত ব্যান্ডেজ” করতে বলা হয়, তখন তিনি দেখতে পেলেন, একটিমাত্র গুলির আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। গুলিটি তাঁর মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর জন্য একঝাঁক বুলেট দরকার হয়নি...ঢাকা থেকে আসা এক সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুুরকে হত্যা করেন, বিক্ষুব্ধ সৈন্যরা নয়। তাঁকে কেন হত্যা করা হবে? কেন বিচারের মুখোমুখি করা হবে না? তিনি কি এমন কিছু জানতেন, সেনাবাহিনী যা প্রকাশিত হতে দিতে চায়নি?’
এ ধরনের মিথ্যা ও প্রচ্ছদকাহিনির সমস্যা হচ্ছে, এর প্রণেতারা অনেক সময় নিজেদের লেখা চিত্রনাট্য নিজেরাই ভুলে যান। নিজেদের গা বাঁচাতে ‘বিক্ষুব্ধ সৈন্য’দের হাতে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের যেসব গল্প এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা ফেঁদেছেন, তার প্রতিটিতে বলা হয়েছে যে পুলিশ তাঁকে সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করার পর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ‘নেওয়ার পথে’ তাঁকে হত্যা করা হয়।
তার পরও, সিআইডির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে পুলিশের আইজি এ বি এম জি কিবরিয়া জানিয়েছেন, তিনি এরশাদকে সরাসরি প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আনার পরই মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়।’
কিবরিয়া এর আগের দিনই মঞ্জুরকে পুলিশের কাছ থেকে সেনা হেফাজতে আনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এরশাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়?
সাক্ষ্যে কিবরিয়া বলেন, ‘২ জুন বিকেলবেলা বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আমি চিফ অব আর্মি স্টাফের কাছে জানতে চাই, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে? আদতে তো তাঁর প্ররোচনায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশ দেন, যাঁদের হাতে—এক অর্থে তাঁরই হেফাজতে—মঞ্জুরের মৃত্যু হলো। এরশাদের জবাব ছিল, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পরপরই বিক্ষুব্ধ সেনাদের গুলিবর্ষণে মঞ্জুর নিহত হন। এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো কিবরিয়াও এরশাদের ‘বিক্ষুব্ধ সেনা’দের হাতে মঞ্জুর হত্যার গল্প বিশ্বাস করেননি।
কিবরিয়া তাঁর সাক্ষ্যে এরশাদের নিজের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই বলেছেন যে মঞ্জুরকে ‘ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পথে’ হত্যা করা হয়নি। এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। এরশাদের স্বীকারোক্তির পর কিবরিয়া কীভাবে ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা-ও তিনি বলেছেন। প্রথমে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি চট্টগ্রামে পাঠান। পরে নিজেই সেখানে যান। চট্টগ্রামে অবস্থিত তাঁর সহকর্মীদের তিনি বঙ্গভবনের বৈঠকের কথা জানিয়ে পুলিশ হেফাজতে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে এই শঙ্কা প্রকাশ করেন যে সেনাবাহিনী হয়তো এদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারে।
কিবরিয়া ব্যাখ্যা করেন, মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পর ‘বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এরশাদের দাবি অগ্রাহ্য করে’ তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে তিনি কীভাবে প্রভাবিত করেন। স্পষ্টভাবেই তাঁর মনে ভয় ছিল, সেনা হেফাজতে নিয়ে গেলে এদেরও মঞ্জুরের ভাগ্য বরণ করতে হবে।
সত্যিই তাই। পরের কয়েক মাসে বহু সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে এনে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অনুষ্ঠিত ফিল্ড কোর্ট মার্শালে তাঁদের বিচার করা হয়। ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৩ জনকে। তৎকালীন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর ভাষ্যমতে, এই হতভাগারা নিরপেক্ষ বিচার ও যথাযথ আইনি সুরক্ষা পাননি, যা ছিল তাঁদের মৌলিক অধিকার। আগেই বলেছি, জুলফিকার আলী মানিক তাঁর সেই সাহসী বইয়ে এসব কথা লিপিবদ্ধ করেছেন।
নোংরা সত্যটি হচ্ছে এই যে ওই মানুষগুলোকে এমন এক ‘অভ্যুত্থানের’ অভিযোগে বিচার করা হয়, যেটি আদতে কোনো ‘অভ্যুত্থান’ ছিল না বা সেই বিদ্রোহ কোনো দিন সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু জিয়া আবুল মঞ্জুরের হাতে নিহত হননি; কিংবা যাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, তাঁদের হাতেও নন।
সেনাবাহিনীতে এরশাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার অভিপ্রায়ে তাঁদের ভিত্তিহীন ও নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হয়। বলির পাঁঠা বানানোর জন্য এরশাদের দরকার ছিল একটি ‘অপরাধী চক্র’।
জেনারেল মইন ও জুলফিকার আলী মানিক তাঁদের বইয়ে জানিয়েছেন, এরশাদ নির্যাতন করে ‘স্বীকারোক্তি আদায় করেছেন, কিন্তু তথাকথিত বিচারটি চলেছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, কোনো তদন্ত ছাড়াই। মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর নির্দেশে বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়।
খালেদা জিয়া কি সত্যি সত্যিই এরশাদকে তাঁর স্বামী হত্যার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন? প্রকৃত ‘অভ্যুত্থান’ তাহলে ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয়।
লেখাটি ছাপাখানায় যাওয়ার পর প্রথম আলোর হাতে থাকা কিছু দলিল আমার হাতে এসেছে। দলিলগুলো হচ্ছে ১৯৮১ সালের মে-জুন মাসের সেই নিয়তি-নির্ধারক দিনগুলোতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য চট্টগ্রামে ছিলেন, সিআইডির কাছে দেওয়া তাঁদের সাক্ষ্য। এসব সাক্ষ্য আমাদের সামনে কিছু নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এই লেখা শেষ হওয়ার পর একটি উপসংহার পর্বে সেগুলো নিয়ে আমি আলোচনা করব।
এরশাদের এক সহকর্মী মোস্তফা—লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামাল ২০১৩ সালে আদালতে বলেছিলেন, ‘কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে মঞ্জুরকে নেওয়ার পথে তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময় হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুরের গায়ে বুলেট বিঁধে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।’
এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা যে গল্প ফেঁদেছেন এবং ৩০ বছর ধরে ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজিয়ে চলেছেন, তার প্রধান দুর্বলতা হলো বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। সে সময় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন বা এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা কেউই কখনো বলেননি যে তাঁরা ‘বিক্ষুব্ধ মানুষ’ বা ‘বিক্ষুব্ধ অস্ত্রধারী’ ব্যক্তিদের দেখেছেন, যাঁরা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে গোলাগুলি হয়; আর মঞ্জুর এই ‘টানাহ্যাঁচড়া’র কারণে গুলিবিদ্ধ হন। কেউ কেউ বলেছেন, মঞ্জুরের ‘নিরাপত্তারক্ষীরা’ গুলি করেছিল; আর কেউ বলেছেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার পথে মঞ্জুর মারা যান।’ কিন্তু কোনো হাসপাতালেই মঞ্জুরকে সেদিন জীবিত বা মৃত বা আহত অবস্থায় দেখা যায়নি। কেবল একজন সেনা চিকিৎসক তাঁকে দেখেছেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের ব্রিগেডিয়ার আজিজ, ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে তখন ছিলেন তিনি, দাফনের জন্য মরদেহ প্রস্তুত করাতে তাঁকে মঞ্জুরের ‘ক্ষত ব্যান্ডেজ’ করে দিতে বলেন।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর বইয়ে ফটিকছড়িতে মঞ্জুরের শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং তাঁর গতিবিধির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর বিবরণ বা চট্টগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের কারও কথার সঙ্গেই এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের গল্পের ন্যূনতম কোনো মিল নেই। চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক হিসেবে জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ১ জুন মঞ্জুরের গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে হাটহাজারী থানায় সেনাবাহিনীর হাতে তাঁকে সোপর্দ করা পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এমনকি মঞ্জুর নিরাপদে ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছালেন কি না, সেটিও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ারের কাছ থেকে তিনি শুনে নিশ্চিত হয়েছেন।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরীর ভাষ্যের সঙ্গে এরশাদের ভাষ্যের তুলনা করা যাক:
‘মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পরদিন সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মঞ্জুর মৃত্যুবরণ করেছেন। এই প্রতিবেদন ছিল একটি ডাহা মিথ্যা।
‘ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়নি। ব্রিগেডিয়ার আজিজ পুলিশের ডিআইজিকে বলেছিলেন, ২ জুন সকালবেলা মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। আজিজ এ কথা বলেননি যে মঞ্জুর বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের হাতে মারা পড়েছেন...
‘চিকিৎসককে যখন মঞ্জুরের “ক্ষত ব্যান্ডেজ” করতে বলা হয়, তখন তিনি দেখতে পেলেন, একটিমাত্র গুলির আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। গুলিটি তাঁর মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর জন্য একঝাঁক বুলেট দরকার হয়নি...ঢাকা থেকে আসা এক সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুুরকে হত্যা করেন, বিক্ষুব্ধ সৈন্যরা নয়। তাঁকে কেন হত্যা করা হবে? কেন বিচারের মুখোমুখি করা হবে না? তিনি কি এমন কিছু জানতেন, সেনাবাহিনী যা প্রকাশিত হতে দিতে চায়নি?’
এ ধরনের মিথ্যা ও প্রচ্ছদকাহিনির সমস্যা হচ্ছে, এর প্রণেতারা অনেক সময় নিজেদের লেখা চিত্রনাট্য নিজেরাই ভুলে যান। নিজেদের গা বাঁচাতে ‘বিক্ষুব্ধ সৈন্য’দের হাতে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের যেসব গল্প এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা ফেঁদেছেন, তার প্রতিটিতে বলা হয়েছে যে পুলিশ তাঁকে সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করার পর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ‘নেওয়ার পথে’ তাঁকে হত্যা করা হয়।
তার পরও, সিআইডির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে পুলিশের আইজি এ বি এম জি কিবরিয়া জানিয়েছেন, তিনি এরশাদকে সরাসরি প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আনার পরই মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়।’
কিবরিয়া এর আগের দিনই মঞ্জুরকে পুলিশের কাছ থেকে সেনা হেফাজতে আনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এরশাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়?
সাক্ষ্যে কিবরিয়া বলেন, ‘২ জুন বিকেলবেলা বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আমি চিফ অব আর্মি স্টাফের কাছে জানতে চাই, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে? আদতে তো তাঁর প্ররোচনায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশ দেন, যাঁদের হাতে—এক অর্থে তাঁরই হেফাজতে—মঞ্জুরের মৃত্যু হলো। এরশাদের জবাব ছিল, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পরপরই বিক্ষুব্ধ সেনাদের গুলিবর্ষণে মঞ্জুর নিহত হন। এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো কিবরিয়াও এরশাদের ‘বিক্ষুব্ধ সেনা’দের হাতে মঞ্জুর হত্যার গল্প বিশ্বাস করেননি।
কিবরিয়া তাঁর সাক্ষ্যে এরশাদের নিজের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই বলেছেন যে মঞ্জুরকে ‘ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পথে’ হত্যা করা হয়নি। এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। এরশাদের স্বীকারোক্তির পর কিবরিয়া কীভাবে ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা-ও তিনি বলেছেন। প্রথমে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি চট্টগ্রামে পাঠান। পরে নিজেই সেখানে যান। চট্টগ্রামে অবস্থিত তাঁর সহকর্মীদের তিনি বঙ্গভবনের বৈঠকের কথা জানিয়ে পুলিশ হেফাজতে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে এই শঙ্কা প্রকাশ করেন যে সেনাবাহিনী হয়তো এদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারে।
কিবরিয়া ব্যাখ্যা করেন, মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পর ‘বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এরশাদের দাবি অগ্রাহ্য করে’ তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে তিনি কীভাবে প্রভাবিত করেন। স্পষ্টভাবেই তাঁর মনে ভয় ছিল, সেনা হেফাজতে নিয়ে গেলে এদেরও মঞ্জুরের ভাগ্য বরণ করতে হবে।
সত্যিই তাই। পরের কয়েক মাসে বহু সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে এনে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অনুষ্ঠিত ফিল্ড কোর্ট মার্শালে তাঁদের বিচার করা হয়। ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৩ জনকে। তৎকালীন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর ভাষ্যমতে, এই হতভাগারা নিরপেক্ষ বিচার ও যথাযথ আইনি সুরক্ষা পাননি, যা ছিল তাঁদের মৌলিক অধিকার। আগেই বলেছি, জুলফিকার আলী মানিক তাঁর সেই সাহসী বইয়ে এসব কথা লিপিবদ্ধ করেছেন।
নোংরা সত্যটি হচ্ছে এই যে ওই মানুষগুলোকে এমন এক ‘অভ্যুত্থানের’ অভিযোগে বিচার করা হয়, যেটি আদতে কোনো ‘অভ্যুত্থান’ ছিল না বা সেই বিদ্রোহ কোনো দিন সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু জিয়া আবুল মঞ্জুরের হাতে নিহত হননি; কিংবা যাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, তাঁদের হাতেও নন।
সেনাবাহিনীতে এরশাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার অভিপ্রায়ে তাঁদের ভিত্তিহীন ও নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হয়। বলির পাঁঠা বানানোর জন্য এরশাদের দরকার ছিল একটি ‘অপরাধী চক্র’।
জেনারেল মইন ও জুলফিকার আলী মানিক তাঁদের বইয়ে জানিয়েছেন, এরশাদ নির্যাতন করে ‘স্বীকারোক্তি আদায় করেছেন, কিন্তু তথাকথিত বিচারটি চলেছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, কোনো তদন্ত ছাড়াই। মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর নির্দেশে বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়।
খালেদা জিয়া কি সত্যি সত্যিই এরশাদকে তাঁর স্বামী হত্যার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন? প্রকৃত ‘অভ্যুত্থান’ তাহলে ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয়।
লেখাটি ছাপাখানায় যাওয়ার পর প্রথম আলোর হাতে থাকা কিছু দলিল আমার হাতে এসেছে। দলিলগুলো হচ্ছে ১৯৮১ সালের মে-জুন মাসের সেই নিয়তি-নির্ধারক দিনগুলোতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য চট্টগ্রামে ছিলেন, সিআইডির কাছে দেওয়া তাঁদের সাক্ষ্য। এসব সাক্ষ্য আমাদের সামনে কিছু নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এই লেখা শেষ হওয়ার পর একটি উপসংহার পর্বে সেগুলো নিয়ে আমি আলোচনা করব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন