বিগ গেম: বাংলাদেশ নিয়ে ৬ শক্তির লড়াই!


জমে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। জমে উঠেছে খেলা। বিশ্ব রাজনীতির খেলোয়াড়রা তৎপর। ভিতরে ভিতরে তৎপরতা চলছে। রাজনীতির গোপন খেলা সব জনসমক্ষে আসে না। কিছু লুক্কায়িতই থাকে। আর কিছু প্রকাশ্য। বাহ্যত এই খেলার একদিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। অন্যদিকে ভারত ও রাশিয়া। মধ্যখানে চীন।

[ক] ভারতের অবস্থান খুব স্পষ্ট। তারা নিজ স্বার্থেই বাংলাদেশে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় রাখতে চায়, সেটা যে কোনো মূল্যে হোক।
নির্বাচন, গণতন্ত্র এখানো কোনো ইস্যু না। নিজেদের অস্তিত্ব ও অখন্ডতার জন্য ভারত মনে করে বাংলাদেশের শাসকদের নিরঙ্কুশ সমর্থন ও সহযোগিতা অপরিহার্য। পূর্ব-উত্তরের ৭টি রাজ্যের স্বাধীনতার সংগ্রাম দমাতে হলে বাংলাদেশের সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া ভারত সফল হবে না। বাংলাদেশের বুক চিড়ে ট্রানজিট/করিডোর না পেলে ভারতের সেভেন সিষ্টার্স হয়ত হারাতে হবে, এমন ভয় তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। তাছাড়া ঐ এলাকাগুলিকে ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে মালামাল ও অস্ত্র পৌছাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর ও আশুগঞ্জ পোর্ট ব্যবহার করা ভারতের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক। এই সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে ভারত চায় আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় রাখতে, সাথে রয়েছে কম খরচে বাংলাদেশে ভারতের বৃহত্তম বাজার। তাই বাংলাদেশকে কব্জায় রাখতে রাশিয়াকে সাথে নিয়েছে ভারত। শেখ হাসিনাকে রাশিয়া থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র ক্রয়, পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্র ও নানাবিধ সহায়তা দেয়া হয়েছে এ উদ্দেশ্যেই। ৫ জানুয়ারী তামাশার অবৈধ নির্বাচনের উপর ভর করে হাসিনা ক্ষমতায় বসার পরে ভারত-রাশিয়া একযোগে হাসিনাকে সমর্থনের কথা বলেছে, এবং তারাই উদ্যোগী হয়ে সাবেক কমিউনিষ্ট ব্লকের দেশগুলো থেকে অভিনন্দন বার্তা জোগাড় করে দিচ্ছে। 


[খ] অন্যদিকে নানাবিধ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে। আমেরিকা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতু বলে মনে করে। যার ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। আমেরিকার বাংলাদেশকে বেছে নেয়ার আর একটি লক্ষ্য হলো, চীনকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করতে হলে পরে মার্কিন নৌবহরকে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত টহল দিতে হবে। আর সে জন্যই বাংলাদেশের নৌবন্দরগুলো আমেরিকার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ন। কারণ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌঘাঁটি গঠন সংক্রান্ত খবরে পেন্টাগণের ওই অঞ্চলে কর্তৃত্ব হারানোর আশঙ্খা বাড়ছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সমুদ্র সংযোগ রুটের খুব কাছাকাছি ঘাঁটি বসাতে অনেকদিন থেকেই তৎপর যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি চীনের কাছে স্পর্শকাতর। রাখাইন রাজ্যে চীন নির্মাণ করেছে কিইয়াউকপিউ বন্দর, একটি বিশাল তেল ও গ্যাস পাইপলাইন। এ পাইপলাইনের মধ্যে কিউকপুর সঙ্গে ইউনানকে সংযুক্ত করা হয়েছে। পরিবহন খাতে বিপুল পরিমাণ খরচ কমাতে চীনের বানিজ্য জাহাজগুলি মালাক্কা প্রণালী এড়িয়ে তারা এই প্রণালী ব্যবহার করা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। অন্যদিকে এই অঞ্চলে চীনকে রুখতে যুক্তরাষ্ট্র এর কাছাকাছি সামরিক শক্তি মজুদ রাখতে চায়। এই লক্ষ নিয়ে দক্ষিণ ভারতে একটি নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় যুক্তরাষ্ট্র, যাতে ভারত রাজী হয়নি। ভারত মনে করছে,“এরপরে বিকল্প হিসাবে বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য খালেদা জিয়ার সাথে ওয়াশিংটনের সমঝোতা হয়েছে। আর সে কারনেই যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বিএনপিকে এত দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।” শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিরোধ রয়েছে, চীনা নেতারা নিশ্চিত এর ফলে ওয়াশিংটন যদি বাংলাদেশে একটি ঘাঁটি স্থাপন করতে চায় তাতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে সায় দেবেন না। ফলে বিএনপির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা এশীয় অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধি করার নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। গেলো সপ্তাহে হাওয়াইতে প্যাসিফিক কমান্ডের সাথে ড্যান মজেনার বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনা বিষয়টিকে আরো জোরালো করছে। 


[গ] বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের নাজুক পরিস্থিতির পূর্ন সুযোগ নিতে তৎপর চীন। হাসিনাকে সরকারকে অভিনন্দন জানানোর বিনিময়ে চীনকে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু এবং যোগাযোগ ইত্যাদি খাতে বৃহদায়তন অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। চীন ভারতকে এই ধারনা দিয়েছে যে, সোনাদিয়ায় বন্দর হলে তা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের যোগাযোগে সহায়ক হবে। এটা নিঃসন্দেহে চীনের নীতিতে মারাত্মক বিচ্যুতি। এ ছাড়া বাংলাদেশে চীনের সামরিক ও ভোগ্যপন্যের ব্যবসা তো রইলোই। দীর্ঘদিন থেকে ভারত ও হাসিনা সরকার খুব জোরালো চেষ্টা চালাচ্ছে চীন-মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে করিডোর গঠন করতে। ভারত চায় চীনের কুনমিং থেকে ভারতের কলকাতা পর্যন্ত আন্তঃমহাদেশীয় সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করতে। তাহলে এ পথ ব্যবহার করে সেভেন সিষ্টার্সকে নিয়ন্ত্রণ রাখা খুব সহজসাধ্য হবে। আর চীনের পক্ষেও এ অঞ্চলে ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাবকে ঠেকানোর জন্য চীন ভারতের যৌথচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র যারপরনাই বিরক্ত ও হতচকিত। সে কারণে ওয়াশিংটন চেষ্টা করছে ভারতের প্রভাবের বাইরে কাউকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আনতে। এটা এমন এক সময়ে ঘটছে যখন ভারতীয় কূটনীতিক দেবযানী খোবরাগাড়ে ঘটনায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। বুশ প্রশাসনের “ভারতের চোখে বাংলাদেশ দেখার” নীতির বেশ ভালো খেসারত দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। (উল্লেখ্য গতবার ভারত-মার্কিন সহায়তায় বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে হাসিনা। মঈন উ আহামেদকে ব্যবহার করে)। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ওয়াশিংটন খুব কার্যকর চেষ্টা করছে। ভারতের অনাকাঙ্খিত বৈরীতার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয় সংক্রান্ত মার্কিন নীীততে গুরুত্বপূর্ন পরিবর্তনে সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে হাসিনা সরকারের বৈধতার প্রশ্নটি যুক্তরাষ্ট্রকে চমৎকার একটি সুযোগ করে সৃষ্টি করে দিয়েছে। সাংবিধানিক বা অসাংবিধানিক যে কোনো পন্থায় এর অবসান হলে নতুন প্রশাসনের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পর্যাপ্ত সুবিধা লাভ করবে, এমনই ধারনা। এ উদ্দেশ্য সাধনে যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘ দিনের পরিক্ষীত বন্ধু যুক্তরাজ্য ও কানাডার সার্বিক সহযোগিতা পাচ্ছে। কমনওয়েলথের ‍মুরব্বী যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের ওপর বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। অন্যদিকে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়েনের সাথে যদিও বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত বানিজ্যকেন্দ্রীক, তথাপি গণতন্ত্র এবং শান্তির প্রশ্নে তাদের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের হাতকেই শক্তিশালি করছে।

সব মিলিয়ে সামনে দিনে বাংলাদেশকে নিয়ে অপেক্ষা করছে বিগ গেম। একদিকে ভারত রাশিয়া, মাঝখানে চীন; অন্যপক্ষে আমেরিকা, বৃটেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন।

সার্বিক অবস্থায় খালেদা জিয়ার "এই দেশকে যে-কোনো উপায়ে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতেই হবে" এমন বক্তব্য নিয়ে শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ! 

(সংগৃহীত ও সম্পাদিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন