ব্যবসা-বাণিজ্য সরকারি দল আওয়ামী লীগের পকেটে


দেশের সব ব্যবসা বাণিজ্য এখন সরকারি দলের পকেটে। গত ৪ বছরে সরকারের মন্ত্রী-এমপি, শাসক দলের নেতা ও তাদের আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিবারের সদস্যরা বড় বড় ব্যবসায় নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা বেসরকারি ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় ও টেলিভিশন, বিদ্যুত্ ও টেলিকম খাত, জাহাজ নির্মাণ থেকে শুরু করে নতুন ব্যবসা ও একচেটিয়া লাইসেন্স ও অনুমতি নিয়েছেন। ক্ষমতাসীন জোটের শরিকদের কেউ কেউ

 
অধিক পুঁজির ও লাভজনক এসব ব্যবসার সুবিধা নিয়েছেন। আর এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ। বিদ্যুত্ ও টেলিকমসহ গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক একাধিক সেক্টর এ প্রতিষ্ঠানটির একচেটিয়া দখলে চলে গেছে। পিছিয়ে নেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরও। তিনি বেসরকারি ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়, শিপিং ব্যবসাসহ বেশ কিছু ব্যবসার সুবিধা নিয়েছেন।
বর্তমান মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত দেয়া বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসা বাণিজ্যের অনুমতি পাওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারদলীয় লোকজনকে এসব সুযোগ-সুবিধা দিতে গিয়ে অনেক শর্তও মানা হয়নি। এর বাইরে সরকারদলীয় লোকজন বিশেষ সুবিধা কিংবা জোর জবরদস্তি করে সব ধরনের টেন্ডারও ভাগিয়ে নিয়েছেন। প্রভাব খাটিয়ে অনেকে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বও নিয়েছেন ।
বেসরকারি সব বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ পেয়েছে সরকারের লোকজন : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত বিদ্যুত্ উত্পাদনের নামে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সরকার এ পর্যন্ত ৫৬টি বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করেছে। বেসরকারি খাতের ভাড়াভিত্তিক এসব বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজ দেয়া হয় সম্পূর্ণ বিনা টেন্ডারে। প্রায় সবক’টি বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের দায়িত্ব পান সরকারদলীয় লোকজন কিংবা সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুত্ সেক্টরের দুর্নীতির বিচার যাতে না হয় সে জন্য সরকারের তরফ থেকে ইনডেমনিটি বিলও পাস করা হয়েছে।
বিদ্যুত্ সেক্টরে এগিয়ে রয়েছে সামিট গ্রুপ। ছোট বড় মিলিয়ে মোট ৬টি বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ পেয়েছে বিমানমন্ত্রী ফারুক খানের পারিবারিক এ প্রতিষ্ঠানটি। এ প্রতিষ্ঠানটি গত ৪ বছরে বিদ্যুত্ সেক্টরের মহাজন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজ পেয়েছে এ গ্রুপ। এর মধ্যে প্রতিটি ৪শ’ মেগাওয়াট করে বিবিয়ানা-১ ও বিনিয়ারা ২ বিদ্যুত্ কেন্দ্র, ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার মেঘনাঘাট-২, ১০২ মেগাওয়াট ক্ষমতায় নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জে, ১১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার খুলনা কেপিসিএল, সৈয়দপুরে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুেকন্দ্র উল্লেখযোগ্য। এছাড়া খানজাহান আলী পাওয়ার কোম্পানির কাছ থেকে নওয়াপাড়ার ৪০ মেগাওয়াট
কেন্দ্র কিনে নিয়েছে এ গ্রুপ। অনেক প্রজেক্ট নিজেরা সময়মত বাস্তবায়ন করতে না পেয়ে উল্টো সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজ পায় রাজশাহী-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এনামুল হকের মালিকানাধীন নর্দার্ন পাওয়ার সলিউশন লিমিটেড (এনপিএসএল)। নর্দার্ন পাওয়ার নামে বন্ড ছেড়ে শেয়ারবাজার থেকে ১৭৫ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সটেক্স লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যানও এর অংশীদার বলে জানা গেছে। এছাড়া বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজ পেয়েছে সরকার সমর্থিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান শিকদার গ্রুপের পাওয়ারপ্যাক হোল্ডিংস। এতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এনামুল হক শামীমের অংশীদারিত্ব রয়েছে। স্পেন ও দক্ষিণ কোরিয়া আইসোলেক্স স্যামসাং সিদ্ধিরগঞ্জে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজ পায়। বিদেশি এ প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় প্রতিনিধি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনাল। ফার্নিচার ব্যবসায়ী অটবির কর্ণধার আওয়ামী লীগ ঘরনার ব্যবসায়ী অনিমেষ কুণ্ডুর মালিকানাধীন কোয়ান্টাম পাওয়ার লিমিটেড পেয়েছে একাধিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজ। সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ী এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আনিসুল হক ও ওরিয়ন গ্রুপ একাধিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজ পেয়েছে। এছাড়া নামে বেনামে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের একজন হুইপ, ঢাকার একজন সংসদ সদস্যসহ সরকারি দলের বেশ কয়েকজন নেতা ও এমপি পেয়েছেন বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ কাজ। এদিকে অতিমাত্রায় ভর্তুকির কারণে সরকার রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন না করার সিদ্ধান্ত নিলেও কেবল দলীয় নেতাকর্মীদের সুবিধা দিতে নতুন করে আরও তিনটি রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করতে যাচ্ছে। তিনটি কেন্দ্রই আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদকসহ দলের নেতারা পাচ্ছেন বলে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে বিদ্যুত্ সেক্টরে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে সরকারি খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন : বর্তমান মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশী (এনআরবি) মালিকানাধীন ৩টি ব্যাংকসহ ৯টি বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। সবক’টির উদ্যোক্তা সরকারি দলের লোকজন। রাজনৈতিক বিবেচনায় এতো ব্যাংক দেয়ার নজিরবিহীন ঘটনায় এ খাতে চলমান তারল্য ও আমানত সঙ্কট এখন তীব্র। এটা গোটা ব্যাংকিং খাতকেই চাপের মুখে ফেলে দিতে পারে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
যেসব বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে তার মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংক, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (ঢাকা-১২) ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের মধুমতি ব্যাংক, প্রধানমন্ত্রীর আয়কর উপদেষ্টা ও তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এম মনিরুজ্জামান খন্দকারের মিডল্যান্ড ব্যাংক, এ ব্যাংকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তারও অংশীদারিত্ব রয়েছে। দলের কোষাধ্যক্ষ ও দলীয় সংসদ সদস্য এইচএন আশিকুর রহমান পেয়েছেন মেঘনা ব্যাংকের অনুমোদন। এর পরিচালকদের তালিকায় রয়েছেন ঢাকা-৩ আসন থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ বিপু। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা ও আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত আবদুল মান্নান চৌধুরী পেয়েছেন সাউথবাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টাও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে। মহাজোটের শরিক দল ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পেয়েছেন ইউনিয়ন ব্যাংক। এছাড়া জাতীয় পার্টির একাধিক সংসদ সদস্য ও নেতা এ ব্যাংকের সঙ্গে রয়েছেন। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক পেয়েছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আহমেদ। অপর দুটি এনআরবি ব্যাংকের উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগের নেতা ফরাসত আলী ও নিজাম চৌধুরী। 
উল্লেখ্য, নতুন ৯টি ব্যাংক অনুমোদনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের দুই শাসনামলে (৮ বছরে) ২৩টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হলো। আর বিএনপির দুই শাসনামলে (১০ বছরে) নতুন ব্যাংক দেয়া হয় ৮টি। 
টিভি চ্যানেলের অনুমোদন : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দলীয় বিবেচনায় দেয়া হয়েছে বেসরকারি টেলিভিশনের অনুমোদন—যার বেশিরভাগই পেয়েছেন সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রী কিংবা তাদের স্বজনরা। এ সরকারের সময় দেয়া ১৬টি টিভির লাইসেন্সের মধ্যে সরকার দলের সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার পেয়েছেন মোহনা টিভি, গাজী গোলাম দস্তগীর গাজী টিভি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিজয় টিভি, বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ভাই সৈয়দ সাফায়েত চ্যানেল নাইন, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের ভাই মোরশেদুল ইসলাম সময় টেলিভিশন, আওয়ামী লীগ ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত মোজাম্মেল বাবু ৭১ টেলিভিশন, সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাসিনা দৌলা চ্যানেল সিক্সটিন, এফবিসিসিআইয়ের সদ্যবিদায়ী সভাপতি ও আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ী এ কে আজাদের চ্যানেল ২৪, সরকার দল সমর্থিত নাসির উদ্দিন মাই টিভি, সালাহউদ্দিন আহমেদের এসএ চ্যানেল প্রাইভেট লিমিটেড এবং বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ নেতা মো. হারুন-উর রশীদ এশিয়ান টিভি, আওয়ামী লীগ ঘরানার সৈয়দ আহমেদ ফারুক গানবাংলা, কাজী মিডিয়া লিমিটেডের কাজী জাহেদুল হাসানকে দীপ্ত বাংলা চ্যানেলের অনুমতি পেয়েছেন। আওয়ামী ঘরানার মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মঞ্জুরুল ইসলাম ও এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহাফুজুর রহমান যৌথভাবে এটিএন নিউজ চ্যানেলের অনুমতি পেলেও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে মঞ্জুরুল ইসলাম তার শেয়ারের অংশ মাহফুজুর রহমানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এর বাইরে ব্যবসায়ী হিসেবে স্কয়ার গ্রুপের অঞ্জন চৌধুরী পেয়েছেন মাছরাঙা টেলিভিশনের অনুমোদন। বর্তমান সরকারের সময় অনুমতি পাওয়া স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর মধ্যে ১১টি সম্প্রচার শুরু করেছে।
দলীয় বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় : বর্তমান সরকার তিন দফায় মোট ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে। সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় প্রথম দফায় এ বছরের ১৩ মার্চ ৮টি, ১৬ অক্টোবর একটি এবং সর্বশেষ ১৮ নভেম্বর দিয়েছে ৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। আছেন সরকার দলের সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও ঘনিষ্ঠজন। নতুন অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়। এর সঙ্গে আছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। অনুমোদন পাওয়া ফেনী ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আগের মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন সহকারী একান্ত সচিব আলাউদ্দিন নাসিম এবং বর্তমান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, খুলনায় সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এনামুল হক শামীম পেয়েছেন চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। এর সঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার রোটনও জড়িত আছেন। ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কুমিল্লার সঙ্গে আগের সরকারের কয়েকজন ঘনিষ্ঠজন খাজা ইউনূস আলী ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা পদত্যাগী যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ভায়রা। আবুল হোসেনের শ্বশুর খাজা ইউনূস আলীর নামে বিশ্ববিদ্যালয়টি নামকরণ করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির মালিক বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। রাজশাহী বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর এপিএস ও ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুজ্জামান শেখর, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদারসহ কয়েকজন সাবেক নেতা। সিলেটের গোলাপগঞ্জের নর্থইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকবাল আহমেদ চৌধুরী। চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা ওই এলাকার সরকারদলীয় সংসদ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার। কিশোরগঞ্জের ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি দুর্গাদাস ভট্টাচার্য্য এবং শরীয়তপুরের জেড এইচ সিকদার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির মালিক আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। এ গ্রুপের সঙ্গে এনামুল হক শামীমও জড়িত। এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ আওয়ামী ঘরানার কয়েকজন ব্যবসায়ী পেয়েছেন এক্সিম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন। এর বাইরে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউনানী ঔষধালয় হামদর্দের হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় ও ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ডা. এ কে আজাদ খানের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইন্সেস।
বর্তমান সরকারের ১৬টি মিলিয়ে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০-এ। এর মধ্যে ১০-১২টি মোটামুটি ভালো হলেও বাকিগুলোর বিরুদ্ধে সনদবাণিজ্য, লেখাপড়ার মান বজায় না রাখাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে। তাছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি এসব বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে দেখভাল করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
জাহাজ নির্মাণ শিল্প : বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, এমপি, তাদের স্বজন কিংবা সরকারদলীয় নেতারা নতুন জাহাজ তৈরির ৩২ লাইসেন্স ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। অনেক মন্ত্রী-এমপি জাহাজ তৈরির লাইসেন্স নিয়েছেন স্বনামে-বেনামে। তাদের মধ্যে রয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিন এমপি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী ড. আওলাদ হোসেন, জাতীয় পার্টির এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু, বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রামের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি জাতীয় পার্টির মাহজাবিন মোরশেদ পটিয়ার এমপি শামসুল হক চৌধুরী সরাসরি কোনো লাইসেন্স না নিলেও অন্য ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডকে একাধিক লাইসেন্স পাইয়ে দিয়েছেন। বিনিময়ে এমপির ছেলে নাজমুল করিমকে করা হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার। ফরিদপুরে ঠিকাদার ব্যবসায়ী ওয়াহিদ মিয়া ও জাহিদ মিয়া নামে দুই ভাই মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে নিয়েছেন তিনটি লাইসেন্স। মহীউদ্দীন খান আলমগীরের প্রতিষ্ঠান বে-প্যাসিফিক ক্যারিয়ারস লিমিটেডও নিয়েছেন একাধিক লাইন্সেস। 
টেলিযোগাযোগ খাত : বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উদীয়মান আইটি ও টেলিযোগাযোগ খাতের ব্যবসা এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দখলে। বর্তমান সরকারের আমলে আইটি তথা টেলিযোযোগ খাতে যত লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, তার বেশিরভাগই পেয়েছে সরকার দলের লোকজন। বিদ্যুতের মতো এ খাতেও এগিয়ে রয়েছে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের পরিবারিক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ। টেলিযোগাযোগ খাতের যত নতুন সেবা লাইসেন্স আসছে, তার সবই পেয়ে যাচ্ছে সামিট গ্রুপ। একাধিক লাইসেন্স পাওয়ার জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি কৌশলেরও আশ্রয় নেয়। তারা সামিট ছাড়া ক্যাপস্টন কমিউনিকেশন্স লিমিটেড এবং ভারটেক্স কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের নামে একাধিক লাইন্সেস নিয়েছে। এছাড়া কয়েক হাজার কোটি টাকার বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পের কনসালট্যান্ট নিয়োগের বাংলাদেশী অংশীদারও সামিট। ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক বা এনটিটিএন লাইসেন্সও পেয়েছে সামিট টেলিকমিউনিকেশন্স।
সামিট গত বছরের শেষের দিকে পেয়েছে ইন্টারন্যাশনাল টেরেসট্রিয়াল কেবল বা আইটিসি লাইসেন্স। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আইটিসির নীতিমালায় তিনটি লাইসেন্স দেয়ার কথা থাকলেও সামিটকে লাইসেন্স দিতে নীতিমালা ভঙ্গ করে লাইসেন্স সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে।
২০১২ সালের শুরুতে টেলিযোগাযোগের আন্তর্জাতিক লং ডিস্টেন্স গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ), আন্তঃসংযোগ এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) এবং আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইআইজি) এই তিন বিভাগে ৮২টি গেটওয়ে লাইসেন্স দেয়—যার প্রতিটির পেছনে কোনো না কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি রয়েছেন। সরকারের সঙ্গে ব্যবসা না করার ক্ষেত্রে এমপিদের বিধান উপেক্ষা করে অনেক এমপি-মন্ত্রী নিজের নামে লাইসেন্স নিয়েছেন। অনেকে নিয়েছেন আত্মীয়ের নামে।
দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছেলে সৌমেন সেনগুপ্ত পেয়েছেন আইজিডব্লিউ লাইসেন্স। তার সেনগুপ্ত টেলিকম নামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুরঞ্জিত সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। পরে মন্ত্রী হওয়ার প্রেক্ষাপটে তিনি তার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার নিজ নামে একাধিক ক্যাটাগরির গেটওয়ে লাইসেন্স নিয়েছেন। নিজ নামে লাইসেন্স নিয়েছেন সরকার দলের এমপি গাজী গোলাম দস্তগীর। গাজী নেটওয়ার্কের নামে তিনি পেয়েছেন আইসিএক্স লাইসেন্স। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন চার ক্যাটাগরির টেলিযোগাযোগ লাইসেন্সের প্রতিটিই নিয়েছেন। এর মধ্যে বিডি লিংক নামে একটি ইন্টারন্যাশনাল টেরেসট্রিয়াল লিংক বা আইটিসি লাইসেন্স এবং একটি ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইআইজির লাইসেন্স তিনি নিজের নামে রাখলেও বাকি দুটি লাইসেন্সের মালিকানা বদলে ফেলেছেন। এছাড়া তিনি ভাইয়ের নামেও একাধিক ক্যাটাগরির লাইসেন্স নিয়েছেন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ভাই পেয়েছেন আইআইজি গেটওয়ে লাইসেন্স। সরকারদলীয় এমপি সাবের হোসেন চৌধুরীর ভাইয়ের মালিকানাধীন এইচআরসি টেকনোলজিসও পেয়েছে আইজিডব্লিউ গেটওয়ে লাইসেন্স।
এদিকে টেলিযোগাযোগ খাতের লাইসেন্স সরাসরি না পেলেও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের মেয়ে আইজিডব্লিউ এবং আইসিএক্সের শেয়ার কিনেছেন বলে জানা গেছে। র্যাংকস টেলিকমও পেয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতের একাধিক লাইসেন্স। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই র্যাংকস গ্রুপের অংশীদার রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে বিটিআরসির নীতিমালা ও টেন্ডারের শর্ত লঙ্ঘন করে দলীয় বিবেচনায় ৬টি প্রতিষ্ঠানকে ইন্টারন্যাশন্যাল টেরেসট্রিয়াল কেবলের (আইটিসি) লাইসেন্স দেয়া হয়। মুলত টেন্ডারে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়ার কথা বলা হলেও তালিকায় পঞ্চম স্থানে থাকা সামিটসহ পছন্দের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়ে সরকার নিজেই শর্ত ভঙ্গ করে। পয়েন্টের ভিত্তিতে নভোকম লিমিটেড প্রথম, ওয়ান এশিয়া-এএইচজেভি দ্বিতীয় বিডি লিংক কমিউনিকেশন লিমিটেড তৃতীয়, ম্যাংগো টেলিসার্ভিসেস লিমিটেড চতুর্থ, সামিট কমিউনিকেশন লিমিটেড পঞ্চম ও ফাইবার অ্যাট হোম লিমিটেড ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করে। সামিট ছাড়া শর্ত ভঙ্গ করে যাদের দেয়া হয়, তার প্রতিটির সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী লোকজনও জড়িত হয়েছে। তাদের মধ্যে দুইজন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরর প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রভাব খাটিয়ে সরকার দলের লোবজন বড় বড় ব্যবসা সংগঠনের নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকটা দখলি কায়দায় জনশক্তি রফতানিকারকদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস অব বাংলাদেশের (বায়রা) সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত হন যুবলীগ নেতা আবুল বাসার। একই কায়দায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ বিপু দখল করেন আবাসন শিল্প মালিকদের প্রতিষ্ঠান রিহ্যাবের সভাপতির পদ। সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য কাজী আকরাম উদ্দিন। এ সংগঠনটির নির্বাচনে দুই গ্রুপের মারামারিসহ প্রভাব খাটানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। চিকিত্সকদের সংগঠন মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএমএ) নির্বাচনেও কারচুপি ও ক্ষমতার জোরে সরকার সমর্থিত চিকিত্সকরা নিরঙ্কুশভাবে জয়ী হয়েছেন। নির্বাচনের প্রভাব খাটিয়ে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই এ কে এম সেলিম ওসমান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন