উইকিলিকসে বাংলাদেশ: ছাত্রলীগ ব্যস্ত চাঁদাবাজিতে

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসার পরপরই বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করে ছাত্রলীগ। নেতা-কর্মীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডার দুর্নীতি এবং হলগুলোতে ছাত্র আসন বরাদ্দের অনিয়মেও জড়িয়ে পড়েন। এ কারণে সরকারের ভাবমূর্তি অনেক ক্ষুণ্ন্ন হয়েছে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় ছাত্রলীগ সম্পর্কে এসব মন্তব্য উঠে এসেছে। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ২০১০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি 'ইনক্রিজেস স্টুডেন্ট ভায়োলেন্স রেইজেস অ্যালামর্স' শিরোনামে এই বার্তাটি ওয়াশিংটনে পাঠান।

এ বার্তাটিও গত ৩০ আগস্ট প্রকাশ করেছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকস। বার্তায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সহিংসতায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। আর এ ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করা হয় মার্কিন ওই গোপন বার্তায়। বার্তায় বলা হয়, অবৈধ উপায়ে টাকা কামানোর জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষ-দখল এবং মারামারির মতো ঘটনা ঘটছে। তিনি মন্তব্য করেন, ২০১০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে যেভাবে ছাত্র সংঘর্ষের জের ধরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, তা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার মতোই কোনো পরিস্থিতি হতে পারে।

বার্তায় বলা হয়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর পরই বেশির ভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের দখল নেয় ছাত্রলীগ। মার্কিন এক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে এ নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রক্টর নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তিনি মার্কিন ওই কর্মকর্তাকে জানান, এখনকার ছাত্রনেতারা টাকা আয় করতে ব্যস্ত। ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগের নেতারা ঠিকাদারি, দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি করছে। ওই বার্তায় বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের ভর্তি বাণিজ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। ছাত্রলীগ সাধারণভাবে ভর্তির নিয়ম উপেক্ষা করে টাকার বিনিময়ে ছাত্র ভর্তি করছে। এ কারণে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া কোন্দলের কারণে দুই বছরে অন্তত ১১টি হত্যাকাণ্ডের জন্য ছাত্রলীগ দায়ী। এ ছাড়াও প্রতিপক্ষের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির কথাও উঠে আসে ওই বার্তায়। এতে বলা হয়, ছাত্র-আন্দোলন সংগ্রামের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাসে জড়িত।

কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ছাত্রদলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ অন্তত ৫০ জন আহত হন। টুকুর অভিযোগ, ছাত্রদলের বিদ্রোহী পক্ষের নেতাদের অস্ত্র ও লোকবল দিয়ে সহায়তা করেছে ছাত্রলীগ। এই সংঘর্ষে পিস্তল ও দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে। সংসদ সদস্য ও বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন, পুলিশ ওই হামলা ঠেকাতে কোনো ভূমিকা নেয়নি। এমনকি অস্ত্রসহ মহড়া দেওয়ার পরেও তারা কাউকে গ্রেফতার করেনি। বার্তায় বলা হয়, কারা ওই হামলা চালিয়েছে, সেটি স্পষ্ট হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলের কথাও উঠে আসে এই বার্তায়। এতে বলা হয়, হল দখল নিয়ে ছাত্রলীগের কোন্দলের কারণেই পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে সংঘর্ষের সময় টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে। এই সংঘর্ষের কারণে মেধাবী ছাত্র আবু বকর মারা যান। আবু বকরের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগে শিবির ঢুকে পড়েছে এবং তারাই এসব কাজ করছে। সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে।

বার্তায় বলা হয়, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ ছিলেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও ছাত্রলীগকে সতর্ক করতে চেয়েছেন। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের অনানুষ্ঠানিক প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবারই বলেছেন, কঠোর অ্যাকশন (ব্যবস্থা) নেওয়া হবে। কিন্তু কোনো ঘটনার পরই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা স্বীকার করেছেন, তারা চাইলেও ছাত্রলীগের এই অনিয়ম বন্ধ করতে পারছেন না। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন