২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইন উ আহমেদ ও তিন বাহিনীর প্রধান স্থানীয় সময় বিকাল প্রায় ৫টায় সাক্ষাৎ করেন প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে। ওই সাক্ষাতে তারা প্রেসিডেন্টকে কোনো সময় না দিয়ে তাকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন।
একই সঙ্গে তারা একজন নতুন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে বলেন। ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করতে বলেন এবং সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি নতুন নির্বাচনী
সিডিউল দিতে বলেন।
এ সময় প্রেসিডেন্টকে কোনো সময় দেয়া হয়নি। কারণ তাতে তিনি বেঁকে বসতে পারেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এদিন জরুরি অবস্থা জারির সেনাবাহিনীর প্রস্তাব মেনে নেন। অন্যদিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান করা হলে তিনি সে প্রস্তাবে রাজি হননি।
আলোচিত এক-এগারোতে বঙ্গভবনে এসব ঘটনা ঘটেছিল বলে ওয়াশিংটনে একটি গোপন তারবার্তা (ঢাকা ০০০০৬৬) পাঠান তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস। গত ৩০ আগস্ট উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক গোপন তারবার্তা থেকে এসব জানা যায়।
বার্তায় বলা হয়, ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স কাউন্টার টেররিজম প্রধান ব্রিগেডিয়ার এ টি এম আমিন ১২ জানুয়ারি সাক্ষাৎ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। তারবার্তায় বলা হয়েছে, এ টি এম আমিনের মতে, তিন বাহিনী প্রধান ও আর্মি চিফ অব স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইন উ আহমেদ ১১ জানুয়ারি বিকাল প্রায় ৫টার দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
ওই বৈঠকে তারা প্রেসিডেন্টকে কোন সময় না দিয়ে ওপরের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে বলেন। আমিন দাবি করেন, প্রেসিডেন্ট সেসব দাবি মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের প্রাক্কালে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের ডাইরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল মোঃ রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তবে তখনো নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়নি যে, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না।
আমিন বলেন, মেজর হায়দারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং তাকে অবসরে যেতে বাধ্য করা হতে পারে। (বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে অনেকেই মনে করেন)। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে আমিন বলেন, আমরা এ বিষয়টি দেখবো।
আমিন আরো বলেন, প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব এম মোখলেসুর রহমান চৌধুরীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে তাকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। রাষ্ট্রদূতকে আমিন বলেন, এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্টের কাছে যেতে সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্তকে দুটি বিষয় প্রভাবিত করেছিল।
সেনাবাহিনী যদি একপক্ষীয় নির্বাচনে সমর্থন দিয়ে কাজ করে তাহলে তা নিয়ে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অব্যাহত অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশের ওপর একটি বিবৃতি। জাতিসংঘের স্থানীয় প্রতিনিধির জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনও নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সমর্থনকে সম্পর্কিত করে বিবৃতি দেয়। তাতে নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সমর্থনের বিষয়টি উঠে আসে।
শুরুতেই জেনারেল মইন জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ করেন, যাতে জাতিসংঘ একটি চিঠি ইস্যু করে এবং তিনি ওই চিঠি নিয়ে প্রেসিডেন্টকে রাজি করাতে পারেন যে, যদি রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না করা যায় তাহলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন বাধাগ্রস্ত হবে।
দ্বিতীয় ফ্যাক্টরটি ছিল জেএমবির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিস্ফোরক উদ্ধার। যে প্রমাণ পাওয়া গেলো তাতে দেখা গেলো জেএমবি নির্ধারিত নির্বাচন বিঘিœত বা প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এসব ঘটনায় সেনাবাহিনীকে প্রেসিডেন্টের কাছে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য।
আমিন আরো বলেন, প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর বর্তমান সব উপদেষ্টা তাদের পদত্যাগপত্র পেশ করেন। তবে সবচেয়ে বেশি সিনিয়র র্যাংকের উপদেষ্টা ছিলেন আইন ও বিচার বিষয়ক উপদেষ্টা বিচারপতি ফজলুল হক। নতুন প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন না করা পর্যন্ত তিনিই ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনে সম্মত হন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন