আমাদের স্বাধীনতা
আমাদের স্বাধীনতা আলোচনা করতে হলে ইতিহাসের একটু পিছনের দিকে যেতে হবে এবং অনেক অপ্রিয় সত্য কথা বলতে হবে , যা সাম্প্রদায়িক মনে হতে পারে । বিশেষ করে পাশাপাশি বসবাসকারী হিন্দু ভাইদের মনোকষ্ট হতে পারে । তবে এটা ঠিক উদার মন নিয়ে ইতিহাস অধ্যয়ন করলে , প্রত্যেক জাতি তার সঠিক ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারে । এ উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু - মুসলিম এই দুই জাতি পাশাপাশি বসবাস করে আসছে । উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটেছিল প্রায় ১২০০ বছর পূর্বে । এদের আগমন ইরাক , ইরান , আরব হতে এবং পরবর্তীতে রাশিয়া , আফগান ইত্যাদি স্থান হতে ঘটেছিল । তবে ১২০৩ সালে বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের পর বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ও প্রভাব বিস্তার ঘটে । তবে বণিক হিসেবে আরও পূর্বে মুসলমানরা বাংলায় এসেছিল । ডক্টর আব্দুল করিম তার “চট্টগ্রামের ইতিহাস” গ্রন্থে বলেন , খৃষ্টীয় ৭ম / ৮ম শতাব্দীতে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরবীয় মুসলমান বণিকের যোগাযোগ ছিল । তাই মুসলমানদের তুলনায় প্রাচীন জনগোষ্ঠি হিন্দুরা মুসলমানদের বিদেশী মনে করে থাকেন । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হিন্দুরাও এখানকার আদি অধিবাসী বলে দাবী করতে পারে না । কারণ ১২০০ বছর পূর্ব হতে আরব , আফগান , মোঘল রক্তের সাথে প্রধানত নিম্ন বর্ণের হিন্দু রক্তের মিলনের মাধ্যমে বর্তমান মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছে । একই ভাবে ৩০০০ হাজার বছর পূর্বে আসা আর্য রক্তের মাধ্যমে বর্তমান হিন্দু সমাজ গড়ে উঠেছে । মুসলমানদের আদি পুরুষ যেমন উপমহাদশের বাইর হতে এসেছিল , তেমনি বর্তমান হিন্দু সমাজের আদি পুরুষ আর্যরা ৩০০০ বছর পূর্বে উপমহাদেশে বাইর হতে এসেছিল । তাই সময়ের পিছনের দিকে গেলে হিন্দু - মুসলিম উভয় জাতির পূর্ব পুরুষরা এ অঞ্চলের ছিল না । কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই উভয় জাতি উপমহাদেশের আলো , বাতাস , পানির সাথে মিশে গিয়েছে । এ উপমহাদেশে বৌদ্ধরাও ছিল । খৃষ্টপূর্ব প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করায় এবং বৌদ্ধ ধর্মকে ভারতের রাজ ধর্ম ঘোষণা করায় হিন্দু ধর্মের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় । ফলে বৌদ্ধ ধর্মের সাথে হিন্দু ধর্মের সংঘাত বাধে এবং সে সাম্প্রদায়িক সংঘাতে হিন্দুরা বৌদ্ধদেরকে ভারত বর্ষের বাইরে পাঠিয়ে দেয় । ফলে বৌদ্ধরা অবস্থান নেয় সিংহলে (বর্তমান শ্রীলংকা) , ব্রক্ষদেশে এবং জাপানের দিকে । শ্রী বিনয় ঘোষ তার “ভারত জনের ইতিহাস” এর ১০০ পৃষ্ঠায় বলেছেন “হিন্দু ধর্মের কাছে নতি স্বীকার করিয়া তাহাকে নিজের শ্রেষ্ঠ নীতি ও গুণগুলি দান করিয়া বৌদ্ধ ধর্ম ভারত বর্ষ হইতে বিদায় লইয়াছে ।” এজন্যই আমাদের বাংলাদেশে বৌদ্ধদের মহাস্থান গড় আছে , আছে সোমপূর বৌদ্ধ বিহার , আছে ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার , কিন্তু নাই বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি । অন্যদিকে মুসলমানরা প্রায় ৭০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করার পরও ভারতবর্ষে তারা সংখ্যালঘু থাকে এবং হিন্দুদেরকে বৌদ্ধদের মত ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে হয়নি । এসব ঘটনাই প্রমাণ করে ইতিহাসে কারা সাম্প্রদায়িক ছিল এবং কারা সাম্প্রদায়িক ছিল না । হিন্দু ঐতিহাসিকরা তাদের কলমের জোরে মুসলমান বাদশাহদের বিরুদ্ধে অনেক কালিমা লেপনের মাধ্যমে তাদেরকে সাম্প্রদায়িক বানানোর কম চেষ্টা করেননি । যেমন সুলতান মাহমুদের ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে যে , তিনি ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন এবং সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করে ধনসম্পদ লুন্ঠণ করেন । এটা ঠিক সে সময় হিন্দুরা তাদের সম্পদ সোমনাথ মন্দিরে রাখতেন । প্রকৃত ইতিহাস হল সোমনাথ মন্দির হিন্দুদের রাজনৈতিক তীর্থক্ষেত্র ছিল এবং এ মন্দিরে সোমনাথের মূর্তি মন্দিরের মাঝামাঝি শূন্যে ঝুলে থাকত । এটি তৌহিদে বিশ্বাসী সুলতান মাহমুদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হত । তাই তিনি সোমনাথ মন্দির আক্রমণের সময় তার সাথে ইন্জিনিয়ার , ধাতুবিদ নিয়ে আসেন । তারা মূর্তি পরীক্ষা করে দেখেন এটি লোহার তৈরি এবং চারিদিকের দেয়ালের পাথরে চৌম্বক রাখা হয়েছে । তাই যখন দেয়ালের পাথর খুলে নেয়া হল তখনই লোহার তৈরি সোমনাথের মূর্তি মাটিতে পড়ে গেল এবং প্রমাণিত হল যে , শূন্যে ঝুলে থাকার জন্য এই মূর্তির নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই । রাজ্য বিস্তারের জন্য সুলতান মাহমুদ সোমনাথ মন্দির অক্রমণ করে এ মন্দিরের প্রতি তৎকালীন অন্ধ বিশ্বাস যা হিন্দুদের বিশেষ শক্তি প্রদান করত , তা নষ্ট করে দেন । আবার ভারত বিজয়ের পর পরাজিত ভারতের রাজাগণ কর্তৃক তার সাথে সম্পাদিত চুক্তি বারবার ভঙ্গ করার কারণে , তাকে বার বার অভিযান চালাতে হয়েছিল । আর মধ্যযুগে এ ধরনের রাজ্য বিস্তার বল্লাল সেন , লক্ষণ সেন , গোপাল , ধর্মপাল সবাই করেছিলেন । বলা যায় , এগুলো ছিল সে সময়ের রীতি । সুলতান মাহমুদের মত আওরঙ্গজেবও হিন্দু ঐতিহাসিক দ্বারা নিন্দিত হয়েছেন । হিন্দু ঐতিহাসিকগণ যেমন বিনয় ঘোষ সহ অনেকেই আওরঙ্গজেবের নামকে বিকৃতভাবে ঔরঙ্গজীব বলেছেন । লক্ষ্য করুন ঔরঙ্গজীব = ঔরঙ্গ + জীব । এর অর্থ হল আওরঙ্গজেবকে তারা জীব অর্থাৎ জীব-জন্তুর জায়গায় নিয়ে এসেছেন । কারণ আওরঙ্গজেব মোঘল সম্রাটের মধ্যে সবচেয়ে ধার্মিক সম্রাট ছিলেন । তার সময়েই “ফতোয়া ই আলমগীরি ” রচিত হয় । তার নামে হিন্দু ঐতিহাসিকরা মন্দির ধ্বংসসহ হিন্দু নিপীড়নের অনেক কাহিনী রচনা করেছেন । কিন্তু ১৯৪৬ সালে ভারতের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্য বইতে আছে , “ জোর করে মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যই যদি আওরঙ্গজেবের থাকিত , তবে ভারতে কোন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব থাকিত না ” (উৎসঃ ইতিহাসের ইতিহাস)। মূল কথা হল হিন্দু ঐতিহাসিকরা মুসলমান বাদশাহর উপর সাম্প্রদায়িকতার কালিমা রচনাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন ।
খৃব বেশি ইতিহাসি বর্ণনা করার ইচ্ছা আমার নেই । আমি শুধু উপমহাদেশে দুটি জাতি হিন্দু ও মুসলমানদের অবস্থা তুলে ধরা চেষ্টা করব । তাই সরাসরি চলে যাচ্ছি ১৭৫৭ সালে । এটা ঠিক যে , ১৭৫৭ সালে এ উপমহাদেশে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে দূরত্ব যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায় । মুসলমানরা ক্ষমতা হারানোর পর স্বাভাবিক ভাবেই তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং দেশ হতে ইংরেজ বিতারণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে । ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ , সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর আন্দোলন , হাজী শরীয়ত উল্লাহ , দুদু মিয়া , তিতুমীরের আন্দেলন এর উদাহরণ । অন্যদিকে হিন্দু জনগোষ্ঠি মুসলমানদের বিপর্যে উৎসাহিত হলেন এবং ইংরেজদের সহযোগিতায় নামলেন । এ কারণেই চরম মুসলিম বিদ্বেষী ডব্লিও ডব্লিও হান্টার তার “ইন্ডিয়ান মুসলমানস” বইয়ে মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী , জিহাদী , দস্যু ইত্যাদি শব্দে এবং হিন্দু জনগোষ্ঠিকে ভদ্র সমাজ হিসেবে পরিচিত করেছেন । ইংরেজরা ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন করেন এবং এ আইনের মধ্যে একটি ছিল সূর্যাস্ত আইন । এ আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্ত এর পূর্বে জমিদারীর খাজনা পরিশোধ করতে না পারলে জমিদারী নীলামে উঠবে । ফলে বিভিন্ন কারণে মুসলমানদের জমিদারী নীলামে উঠে এবং তা ইংরেজ সরকারের রাজস্ব বিভাগের হিন্দু কর্মচারীরা ক্রয় করে নতুন জমিদারে পরিণত হয় । এভাবে বাংলার মুসলমানরা কৃষিজীবি শ্রেণীতে পরিণত হয় এবং নতুন হিন্দু জমিদাররা কলকাতায় বসবাস করতে থাকে এবং তাদের নায়েব আমলাদের দ্বারা খাজনা আদায়ের মাধ্যমে দরিদ্র মুসলমানদের শোষণ করতে থাকে । হাণ্টার সাহেব তার “ইন্ডিয়ান মুসলমানস” বইয়ের (সংস্করণ জুন , ১৯৮২) ১৪২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন “যে সব হিন্দু কর আদায়কারী ঐ সময় নিম্ন পদের চাকুরিতে নিযুক্ত ছিলেন , নয়া ব্যবস্থার (১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয় । ” ১৪৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে “অভিজাত মুসলমানদের জন্য সেনাবাহিনীতে প্রবেশের দরোজা আমরা (ইংরেজরা) বন্ধ করে দিয়েছি কারণ আমাদের নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে বাইরে রাখা প্রয়োজন আমরা মনে করেছি । ” সরকারি চাকুরির পথ মুসলমানদের জন্য প্রায় বন্ধ হয়ে গেল । ১৪৮ পৃষ্ঠায় লেখা আছে “বাংলার রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনের খতিয়ানঃ এপ্রিল ১৮৭১অনুযায়ী সহকারী কমিশনার হিন্দু ৭ জন , মুসলমান ০, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিন্দু ১১৩ জন , মুসলমান ৩০ জন , ইনকাম টেক্স প্রসেসর হিন্দু ৪৩ জন , মুসলমান ৬ জন , রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেণ্ট হিন্দু ২৫জন , মুসলমান ২ জন , মুন্সেফ হিন্দু ১৭৮ জন , মুসলমান ৩৮ জন । এ বৈষম্যের কারণ হিসেবে ১৪৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে “ এদেশের শাসন কর্তৃত্ব যখন আমাদের হাতে আসে তখন মুসলমানরা ছিল উচ্চতর জাতি । ” আর এ উচ্চতর জাতি ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলন করার কারণে এবং হিন্দুরা ইংরেজদের সহযোগী হওয়ার কারণে মুসলমানরা বিভিন্ন ধরনের চাকুরি হতে বঞ্চিত হয় এবং হিন্দুরা লাভবান হয়। এ ব্যাপারে ১৫৩ পৃষ্ঠা বলা হয়েছে , “সুন্দরবন কমিশনারের অফিসে কতিপয় চাকরিতে লোক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । -------সরকারি গেজেটে কর্মখালির যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তাতে বলা হয় যে , এই শূন্য পদগুলোতে কেবলমাত্র হিন্দুদের নিয়োগ করা হবে । ” এভাবেই ইংরেজদের সহযোগীতা করে হিন্দুরা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হল এবং চাকুরি ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য তৈরি করল । অন্যদিকে মুসলমানরা ইংরেজ বিতারণের উপর গুরুত্ব দেয়ার কারণে জমিদারী হারাল এবং চাকুরি ক্ষেত্র হতে বিতারিত হল । যার ফলে বাংলায় শুধুমাত্র চোখে পড়ে হিন্দু জমিদারী , যা পূর্বে ছিল মুসলামানদের অধীনে । এখন আমরা দেখব হিন্দু জমিদারদের অধীনে মুসলমান প্রজাদের কী অবস্থা ছিল । মত প্রকাশের স্বাধীনাতায় বিশ্বাসী ভারত সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ গোলাম আহমদ মর্তুজার “ইতিহাসের ইতিহাস” বইয়ের ২০৯ পৃষ্ঠায় এবং আব্দুল মওদুদের “ওহাবী আন্দেলন” , আব্দুল গফুর সিদ্দিকীর “শহীদ তিতুমীর” বই-এ আছে “তারাগুনিয়ার জমিদার রামনারায়ন বাবু , পুড়ার কৃষ্ন দেব , নগড় পুড়ার গৌরদেব চৌধূরী , তাদের জমিদারী এলাকায় ৫টি নোটিশ জারি করলেন । (১) দাড়ির উপর আড়াই টাকা ফি (২) কাঁচা মসজিদ নির্মাণের উপর পাঁচশত টাকা ও পাকা মসজিদ নির্মাণের উপর এক সহস্র টাকা ফি (৩) আরবী নাম রাখলে পঞ্চাশ টাকা ফি (৪) গোহত্যা করলে দক্ষিণ হস্ত কাটিয়া দেয়া হইবে (৫) তিতুমীরকে নিজ বাড়ীতে স্থান দিলে ভিটা হতে উচ্ছেদ করা হবে ।” পাঠকরা দয়া করে মনে রাখবেন পূর্বের ৫ বা ৫০০ টকা আজকের ৫ বা ৫০০ টাকা হতে অনেক অনেক মূল্যবান ছিল । আওয়ামিলীগের শুরু হতে আওয়ামি রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত জনাব আবুল মনসুর আহমদের “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইয়ের ১ম খন্ডের (৫ম সংস্করণ) ১৪ পৃষ্ঠা লিখেছেন , “আরেকটা ব্যাপার আমাকে খুবই পীড়া দিত । জমিদাররা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব প্রজার কাছ থনেই কালীপূজার মাথট (এক ধরনের কর) আদায় করিতেন । এটা খাজনার সাথে আদায় করা হইত । খাজনার মতই বাধ্যতামূলক ছিল । না দিলে খাজনা নেওয়া হইত না । ফরাজী পরিবারের ছেলে হিসাবে আমি গোঁড়া মুসলমান ছিলাম । মূর্তি পূজার চাঁদা দেওয়া শেরেকী গোনা । এটা মুরব্বীদের কাছে শেখা মাসলা । কিন্তু মুরব্বীরা নিজেরাই সেই শেরেকী গোনা করেন কেন ? এ প্রশ্নের জবাবে দাদাজী , বাপজী , চাচাজী তাঁরা বলিতেনঃ না দিয়া উপায় নাই । এটা রাজার যুলুম । রাজার যুলুম নীরবে সহ্য এবং গোপনে আল্লার কাছে মাফ চাওয়া ছাড়া চারা নাই ।” আশা করি পাঠকরা এ সমস্ত তথ্য হতে বুঝতে পারছেন ইংরেজ আমলে বাংলার মুসলমানদের কী অবস্থা ছিল । দুই বাংলার পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল । প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলাকে দুটি অংশে বিভক্ত করেন । পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন , যার রাজধানী ছিল ঢাকায় । লর্ড কার্জনের এ ঘোষণা হিন্দুদের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল এবং মুসলমানরা আনন্দো-উল্লাস করল । কারণ দুটি জাতি পাশাপাশি বসবাস করলেও তাদের স্বার্থ ছিল ভিন্ন । হিন্দু জমিদাররা দেখলেন বাংলা ভাগ হয়ে গেলে কলকাতায় বসে পূর্ব বাংলায় জমিদারী চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে । আর ঢাকা রাজধানী হওয়ার কারণে শিক্ষায় এবং চাকুরির ক্ষেত্রে মুসলমানরা এগিয়ে যাবে । আবার পূর্ব বাংলার হিন্দুরা মনে করল , বঙ্গ ভঙ্গের কারণে তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে গিয়েছে । ফলে হিন্দুরা ঘোষণা করল কোনভাবেই বঙ্গ মাতার অঙ্গ ছেদন করা যাবে না । অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হবে । যার ফলে হিন্দুরা স্বদেশী আন্দোলন শুরু করে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজ আরম্ভ করল । একই সাথে তারা যে সমস্থ মুসলমানরা স্বদেশী আন্দোলনে আসতে চাইল না , তাদেরকে নাজেহাল করতে লাগল । এমনকি মুসলমানদের প্রাণহানি ঘটতে লাগল । ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরাম বোমা হামলার মাধ্যমে ২জন শেতাঙ্গ মহিলাকে হত্যা করে । ফলে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় (উৎস “একশ বছরের রাজনীতি” , আবুল আসাদ )। এই ক্ষুদিরাম আত্মত্যাগ করেছিলেন তার জাতি হিন্দুদের জন্য , মুসলমানদের জন্য নয় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত কবিও বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে প্রার্থনা সঙ্গিত রচনা করেন -
বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল
--------------------------
বাংগালীর ঘরে যত ভাইবোন
এক হউক এক হউক
এক হউক হে ভগবান ।
তার রচিত “আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায় ভালবাসি ” গান হিন্দু সন্ত্রাসিদের উৎসাহিত করে এবং বধ করতে মুসলমানদের প্রাণ । আবার বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজদের বিপক্ষে চলে গেল , তখন খাঁটি ইংরেজ সমর্থক রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে নিরপেক্ষ হয়ে যান । পাঠকরা একটু লক্ষ্য করবেন হিন্দুরা যে ইংরেজদের সহযোগীতা করেছিল , প্রশাসনিক কারণে সৃষ্ট বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের পক্ষে যাওয়ার কারণে সেই হিন্দুরা ইংরেজদের বিপক্ষে চলে যায় । অন্যদিকে মুসলমানরা নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ যাতে রদ না হয় অর্থাৎপূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ যাতে টিকে থাকতে পারে , সেজন্য আন্দোলন করতে লাগল । ফলে বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানদের দুরত্ব আরও বৃদ্ধি পেতে থাকল । এ ব্যাপারে ''বাংলার মুসলমান'' বইতে আছে মিঃ এন সি চৌধূরী বলেন “ বঙ্গভঙ্গ চিরদিনের জন্য হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক বিনষ্ট করে দেয় এবং বন্ধুত্বের পরিবর্তে আমাদের মনে তাদের জন্য ঘৃণার উদ্রেক হয় । রাস্তাঘাটে , স্কুলে , বাজারে সর্বত্র এ ঘৃণার ভাব পরিস্ফুট হয় । স্কুলে হিন্দু ছেলেরা মুসলমানদের নিকটে বসতে ঘৃণা প্রকাশ করে এই বলে যে , তাদের মুখ থেকে পিঁয়াজের গন্ধ বেরুচ্ছে ।” ((N.C Chowdhury Auto-Biography of an Unknown Indian pp. 227 ,230 ) । যেহেতু হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষায় , ব্যবসা-বাণিজ্যে , চাকুরীতে অগ্রসর ছিল , সেহেতু স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে বিলাতী পণ্য বর্জনের দ্বারা , সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা , ইংরেজ হত্যা ইত্যাদি দ্বারা হিন্দুরা ইংরেজদের কাবু করে ফেলে এবং বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায় । ফলে হিন্দুদের বিজয় হল এবং মুসলমানরা হতাশায় নিমজ্জিত হল , যা ১৯১২ সালের মার্চ মাসে কোলকাতায় মুসলিম লীগের অধিবেশনে নবাব সলিমুল্লাহর বক্তব্য হতে বুঝা যায় । তিনি বলেছিলেন , “বাংলা বিভাগে আমরা তেমন বেশি কিছু লাভ করিনি । কিন্তু তবুও তা আমাদের দেশবাসী অন্য সম্প্রদায়ের ( হিন্দু ) সহ্য হলো না । -----খুন-খারাবী ও ডাকাতির মাধ্যমে তারা প্রতিশোধ নেয়া শুরু করল । তারা বিলেতী দ্রব্য বর্জন করল । ----মুসলিম কৃষক সম্প্রদায় এ বিভাগে লাভবান হয়েছিল । ----- সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করে দেন প্রশাসনিক কারণে । ---- আমাদের সাথে কোন পরমর্শও করা হয়নি । আমরা সব নীরবে সহ্য করেছি । ”(A Hamid t Muslim Separatism in India , p.92 ) নবাব সলিমুল্লাহর এ বক্তব্য তৎকালীন বাংলার মুসলমানের করুণ চিত্র তুলে ধরে । (চলবে)
সুত্রঃ আবু নিশাত(সোনার বাংলাদেশ ব্লগ)
আমাদের স্বাধীনতা আলোচনা করতে হলে ইতিহাসের একটু পিছনের দিকে যেতে হবে এবং অনেক অপ্রিয় সত্য কথা বলতে হবে , যা সাম্প্রদায়িক মনে হতে পারে । বিশেষ করে পাশাপাশি বসবাসকারী হিন্দু ভাইদের মনোকষ্ট হতে পারে । তবে এটা ঠিক উদার মন নিয়ে ইতিহাস অধ্যয়ন করলে , প্রত্যেক জাতি তার সঠিক ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারে । এ উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু - মুসলিম এই দুই জাতি পাশাপাশি বসবাস করে আসছে । উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটেছিল প্রায় ১২০০ বছর পূর্বে । এদের আগমন ইরাক , ইরান , আরব হতে এবং পরবর্তীতে রাশিয়া , আফগান ইত্যাদি স্থান হতে ঘটেছিল । তবে ১২০৩ সালে বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের পর বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ও প্রভাব বিস্তার ঘটে । তবে বণিক হিসেবে আরও পূর্বে মুসলমানরা বাংলায় এসেছিল । ডক্টর আব্দুল করিম তার “চট্টগ্রামের ইতিহাস” গ্রন্থে বলেন , খৃষ্টীয় ৭ম / ৮ম শতাব্দীতে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরবীয় মুসলমান বণিকের যোগাযোগ ছিল । তাই মুসলমানদের তুলনায় প্রাচীন জনগোষ্ঠি হিন্দুরা মুসলমানদের বিদেশী মনে করে থাকেন । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হিন্দুরাও এখানকার আদি অধিবাসী বলে দাবী করতে পারে না । কারণ ১২০০ বছর পূর্ব হতে আরব , আফগান , মোঘল রক্তের সাথে প্রধানত নিম্ন বর্ণের হিন্দু রক্তের মিলনের মাধ্যমে বর্তমান মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছে । একই ভাবে ৩০০০ হাজার বছর পূর্বে আসা আর্য রক্তের মাধ্যমে বর্তমান হিন্দু সমাজ গড়ে উঠেছে । মুসলমানদের আদি পুরুষ যেমন উপমহাদশের বাইর হতে এসেছিল , তেমনি বর্তমান হিন্দু সমাজের আদি পুরুষ আর্যরা ৩০০০ বছর পূর্বে উপমহাদেশে বাইর হতে এসেছিল । তাই সময়ের পিছনের দিকে গেলে হিন্দু - মুসলিম উভয় জাতির পূর্ব পুরুষরা এ অঞ্চলের ছিল না । কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই উভয় জাতি উপমহাদেশের আলো , বাতাস , পানির সাথে মিশে গিয়েছে । এ উপমহাদেশে বৌদ্ধরাও ছিল । খৃষ্টপূর্ব প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করায় এবং বৌদ্ধ ধর্মকে ভারতের রাজ ধর্ম ঘোষণা করায় হিন্দু ধর্মের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় । ফলে বৌদ্ধ ধর্মের সাথে হিন্দু ধর্মের সংঘাত বাধে এবং সে সাম্প্রদায়িক সংঘাতে হিন্দুরা বৌদ্ধদেরকে ভারত বর্ষের বাইরে পাঠিয়ে দেয় । ফলে বৌদ্ধরা অবস্থান নেয় সিংহলে (বর্তমান শ্রীলংকা) , ব্রক্ষদেশে এবং জাপানের দিকে । শ্রী বিনয় ঘোষ তার “ভারত জনের ইতিহাস” এর ১০০ পৃষ্ঠায় বলেছেন “হিন্দু ধর্মের কাছে নতি স্বীকার করিয়া তাহাকে নিজের শ্রেষ্ঠ নীতি ও গুণগুলি দান করিয়া বৌদ্ধ ধর্ম ভারত বর্ষ হইতে বিদায় লইয়াছে ।” এজন্যই আমাদের বাংলাদেশে বৌদ্ধদের মহাস্থান গড় আছে , আছে সোমপূর বৌদ্ধ বিহার , আছে ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার , কিন্তু নাই বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি । অন্যদিকে মুসলমানরা প্রায় ৭০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করার পরও ভারতবর্ষে তারা সংখ্যালঘু থাকে এবং হিন্দুদেরকে বৌদ্ধদের মত ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে হয়নি । এসব ঘটনাই প্রমাণ করে ইতিহাসে কারা সাম্প্রদায়িক ছিল এবং কারা সাম্প্রদায়িক ছিল না । হিন্দু ঐতিহাসিকরা তাদের কলমের জোরে মুসলমান বাদশাহদের বিরুদ্ধে অনেক কালিমা লেপনের মাধ্যমে তাদেরকে সাম্প্রদায়িক বানানোর কম চেষ্টা করেননি । যেমন সুলতান মাহমুদের ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে যে , তিনি ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন এবং সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করে ধনসম্পদ লুন্ঠণ করেন । এটা ঠিক সে সময় হিন্দুরা তাদের সম্পদ সোমনাথ মন্দিরে রাখতেন । প্রকৃত ইতিহাস হল সোমনাথ মন্দির হিন্দুদের রাজনৈতিক তীর্থক্ষেত্র ছিল এবং এ মন্দিরে সোমনাথের মূর্তি মন্দিরের মাঝামাঝি শূন্যে ঝুলে থাকত । এটি তৌহিদে বিশ্বাসী সুলতান মাহমুদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হত । তাই তিনি সোমনাথ মন্দির আক্রমণের সময় তার সাথে ইন্জিনিয়ার , ধাতুবিদ নিয়ে আসেন । তারা মূর্তি পরীক্ষা করে দেখেন এটি লোহার তৈরি এবং চারিদিকের দেয়ালের পাথরে চৌম্বক রাখা হয়েছে । তাই যখন দেয়ালের পাথর খুলে নেয়া হল তখনই লোহার তৈরি সোমনাথের মূর্তি মাটিতে পড়ে গেল এবং প্রমাণিত হল যে , শূন্যে ঝুলে থাকার জন্য এই মূর্তির নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই । রাজ্য বিস্তারের জন্য সুলতান মাহমুদ সোমনাথ মন্দির অক্রমণ করে এ মন্দিরের প্রতি তৎকালীন অন্ধ বিশ্বাস যা হিন্দুদের বিশেষ শক্তি প্রদান করত , তা নষ্ট করে দেন । আবার ভারত বিজয়ের পর পরাজিত ভারতের রাজাগণ কর্তৃক তার সাথে সম্পাদিত চুক্তি বারবার ভঙ্গ করার কারণে , তাকে বার বার অভিযান চালাতে হয়েছিল । আর মধ্যযুগে এ ধরনের রাজ্য বিস্তার বল্লাল সেন , লক্ষণ সেন , গোপাল , ধর্মপাল সবাই করেছিলেন । বলা যায় , এগুলো ছিল সে সময়ের রীতি । সুলতান মাহমুদের মত আওরঙ্গজেবও হিন্দু ঐতিহাসিক দ্বারা নিন্দিত হয়েছেন । হিন্দু ঐতিহাসিকগণ যেমন বিনয় ঘোষ সহ অনেকেই আওরঙ্গজেবের নামকে বিকৃতভাবে ঔরঙ্গজীব বলেছেন । লক্ষ্য করুন ঔরঙ্গজীব = ঔরঙ্গ + জীব । এর অর্থ হল আওরঙ্গজেবকে তারা জীব অর্থাৎ জীব-জন্তুর জায়গায় নিয়ে এসেছেন । কারণ আওরঙ্গজেব মোঘল সম্রাটের মধ্যে সবচেয়ে ধার্মিক সম্রাট ছিলেন । তার সময়েই “ফতোয়া ই আলমগীরি ” রচিত হয় । তার নামে হিন্দু ঐতিহাসিকরা মন্দির ধ্বংসসহ হিন্দু নিপীড়নের অনেক কাহিনী রচনা করেছেন । কিন্তু ১৯৪৬ সালে ভারতের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্য বইতে আছে , “ জোর করে মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যই যদি আওরঙ্গজেবের থাকিত , তবে ভারতে কোন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব থাকিত না ” (উৎসঃ ইতিহাসের ইতিহাস)। মূল কথা হল হিন্দু ঐতিহাসিকরা মুসলমান বাদশাহর উপর সাম্প্রদায়িকতার কালিমা রচনাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন ।
খৃব বেশি ইতিহাসি বর্ণনা করার ইচ্ছা আমার নেই । আমি শুধু উপমহাদেশে দুটি জাতি হিন্দু ও মুসলমানদের অবস্থা তুলে ধরা চেষ্টা করব । তাই সরাসরি চলে যাচ্ছি ১৭৫৭ সালে । এটা ঠিক যে , ১৭৫৭ সালে এ উপমহাদেশে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে দূরত্ব যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায় । মুসলমানরা ক্ষমতা হারানোর পর স্বাভাবিক ভাবেই তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং দেশ হতে ইংরেজ বিতারণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে । ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ , সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর আন্দোলন , হাজী শরীয়ত উল্লাহ , দুদু মিয়া , তিতুমীরের আন্দেলন এর উদাহরণ । অন্যদিকে হিন্দু জনগোষ্ঠি মুসলমানদের বিপর্যে উৎসাহিত হলেন এবং ইংরেজদের সহযোগিতায় নামলেন । এ কারণেই চরম মুসলিম বিদ্বেষী ডব্লিও ডব্লিও হান্টার তার “ইন্ডিয়ান মুসলমানস” বইয়ে মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী , জিহাদী , দস্যু ইত্যাদি শব্দে এবং হিন্দু জনগোষ্ঠিকে ভদ্র সমাজ হিসেবে পরিচিত করেছেন । ইংরেজরা ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন করেন এবং এ আইনের মধ্যে একটি ছিল সূর্যাস্ত আইন । এ আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্ত এর পূর্বে জমিদারীর খাজনা পরিশোধ করতে না পারলে জমিদারী নীলামে উঠবে । ফলে বিভিন্ন কারণে মুসলমানদের জমিদারী নীলামে উঠে এবং তা ইংরেজ সরকারের রাজস্ব বিভাগের হিন্দু কর্মচারীরা ক্রয় করে নতুন জমিদারে পরিণত হয় । এভাবে বাংলার মুসলমানরা কৃষিজীবি শ্রেণীতে পরিণত হয় এবং নতুন হিন্দু জমিদাররা কলকাতায় বসবাস করতে থাকে এবং তাদের নায়েব আমলাদের দ্বারা খাজনা আদায়ের মাধ্যমে দরিদ্র মুসলমানদের শোষণ করতে থাকে । হাণ্টার সাহেব তার “ইন্ডিয়ান মুসলমানস” বইয়ের (সংস্করণ জুন , ১৯৮২) ১৪২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন “যে সব হিন্দু কর আদায়কারী ঐ সময় নিম্ন পদের চাকুরিতে নিযুক্ত ছিলেন , নয়া ব্যবস্থার (১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয় । ” ১৪৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে “অভিজাত মুসলমানদের জন্য সেনাবাহিনীতে প্রবেশের দরোজা আমরা (ইংরেজরা) বন্ধ করে দিয়েছি কারণ আমাদের নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে বাইরে রাখা প্রয়োজন আমরা মনে করেছি । ” সরকারি চাকুরির পথ মুসলমানদের জন্য প্রায় বন্ধ হয়ে গেল । ১৪৮ পৃষ্ঠায় লেখা আছে “বাংলার রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনের খতিয়ানঃ এপ্রিল ১৮৭১অনুযায়ী সহকারী কমিশনার হিন্দু ৭ জন , মুসলমান ০, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিন্দু ১১৩ জন , মুসলমান ৩০ জন , ইনকাম টেক্স প্রসেসর হিন্দু ৪৩ জন , মুসলমান ৬ জন , রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেণ্ট হিন্দু ২৫জন , মুসলমান ২ জন , মুন্সেফ হিন্দু ১৭৮ জন , মুসলমান ৩৮ জন । এ বৈষম্যের কারণ হিসেবে ১৪৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে “ এদেশের শাসন কর্তৃত্ব যখন আমাদের হাতে আসে তখন মুসলমানরা ছিল উচ্চতর জাতি । ” আর এ উচ্চতর জাতি ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলন করার কারণে এবং হিন্দুরা ইংরেজদের সহযোগী হওয়ার কারণে মুসলমানরা বিভিন্ন ধরনের চাকুরি হতে বঞ্চিত হয় এবং হিন্দুরা লাভবান হয়। এ ব্যাপারে ১৫৩ পৃষ্ঠা বলা হয়েছে , “সুন্দরবন কমিশনারের অফিসে কতিপয় চাকরিতে লোক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । -------সরকারি গেজেটে কর্মখালির যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তাতে বলা হয় যে , এই শূন্য পদগুলোতে কেবলমাত্র হিন্দুদের নিয়োগ করা হবে । ” এভাবেই ইংরেজদের সহযোগীতা করে হিন্দুরা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হল এবং চাকুরি ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য তৈরি করল । অন্যদিকে মুসলমানরা ইংরেজ বিতারণের উপর গুরুত্ব দেয়ার কারণে জমিদারী হারাল এবং চাকুরি ক্ষেত্র হতে বিতারিত হল । যার ফলে বাংলায় শুধুমাত্র চোখে পড়ে হিন্দু জমিদারী , যা পূর্বে ছিল মুসলামানদের অধীনে । এখন আমরা দেখব হিন্দু জমিদারদের অধীনে মুসলমান প্রজাদের কী অবস্থা ছিল । মত প্রকাশের স্বাধীনাতায় বিশ্বাসী ভারত সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ গোলাম আহমদ মর্তুজার “ইতিহাসের ইতিহাস” বইয়ের ২০৯ পৃষ্ঠায় এবং আব্দুল মওদুদের “ওহাবী আন্দেলন” , আব্দুল গফুর সিদ্দিকীর “শহীদ তিতুমীর” বই-এ আছে “তারাগুনিয়ার জমিদার রামনারায়ন বাবু , পুড়ার কৃষ্ন দেব , নগড় পুড়ার গৌরদেব চৌধূরী , তাদের জমিদারী এলাকায় ৫টি নোটিশ জারি করলেন । (১) দাড়ির উপর আড়াই টাকা ফি (২) কাঁচা মসজিদ নির্মাণের উপর পাঁচশত টাকা ও পাকা মসজিদ নির্মাণের উপর এক সহস্র টাকা ফি (৩) আরবী নাম রাখলে পঞ্চাশ টাকা ফি (৪) গোহত্যা করলে দক্ষিণ হস্ত কাটিয়া দেয়া হইবে (৫) তিতুমীরকে নিজ বাড়ীতে স্থান দিলে ভিটা হতে উচ্ছেদ করা হবে ।” পাঠকরা দয়া করে মনে রাখবেন পূর্বের ৫ বা ৫০০ টকা আজকের ৫ বা ৫০০ টাকা হতে অনেক অনেক মূল্যবান ছিল । আওয়ামিলীগের শুরু হতে আওয়ামি রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত জনাব আবুল মনসুর আহমদের “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইয়ের ১ম খন্ডের (৫ম সংস্করণ) ১৪ পৃষ্ঠা লিখেছেন , “আরেকটা ব্যাপার আমাকে খুবই পীড়া দিত । জমিদাররা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব প্রজার কাছ থনেই কালীপূজার মাথট (এক ধরনের কর) আদায় করিতেন । এটা খাজনার সাথে আদায় করা হইত । খাজনার মতই বাধ্যতামূলক ছিল । না দিলে খাজনা নেওয়া হইত না । ফরাজী পরিবারের ছেলে হিসাবে আমি গোঁড়া মুসলমান ছিলাম । মূর্তি পূজার চাঁদা দেওয়া শেরেকী গোনা । এটা মুরব্বীদের কাছে শেখা মাসলা । কিন্তু মুরব্বীরা নিজেরাই সেই শেরেকী গোনা করেন কেন ? এ প্রশ্নের জবাবে দাদাজী , বাপজী , চাচাজী তাঁরা বলিতেনঃ না দিয়া উপায় নাই । এটা রাজার যুলুম । রাজার যুলুম নীরবে সহ্য এবং গোপনে আল্লার কাছে মাফ চাওয়া ছাড়া চারা নাই ।” আশা করি পাঠকরা এ সমস্ত তথ্য হতে বুঝতে পারছেন ইংরেজ আমলে বাংলার মুসলমানদের কী অবস্থা ছিল । দুই বাংলার পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল । প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলাকে দুটি অংশে বিভক্ত করেন । পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন , যার রাজধানী ছিল ঢাকায় । লর্ড কার্জনের এ ঘোষণা হিন্দুদের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল এবং মুসলমানরা আনন্দো-উল্লাস করল । কারণ দুটি জাতি পাশাপাশি বসবাস করলেও তাদের স্বার্থ ছিল ভিন্ন । হিন্দু জমিদাররা দেখলেন বাংলা ভাগ হয়ে গেলে কলকাতায় বসে পূর্ব বাংলায় জমিদারী চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে । আর ঢাকা রাজধানী হওয়ার কারণে শিক্ষায় এবং চাকুরির ক্ষেত্রে মুসলমানরা এগিয়ে যাবে । আবার পূর্ব বাংলার হিন্দুরা মনে করল , বঙ্গ ভঙ্গের কারণে তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে গিয়েছে । ফলে হিন্দুরা ঘোষণা করল কোনভাবেই বঙ্গ মাতার অঙ্গ ছেদন করা যাবে না । অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হবে । যার ফলে হিন্দুরা স্বদেশী আন্দোলন শুরু করে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজ আরম্ভ করল । একই সাথে তারা যে সমস্থ মুসলমানরা স্বদেশী আন্দোলনে আসতে চাইল না , তাদেরকে নাজেহাল করতে লাগল । এমনকি মুসলমানদের প্রাণহানি ঘটতে লাগল । ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরাম বোমা হামলার মাধ্যমে ২জন শেতাঙ্গ মহিলাকে হত্যা করে । ফলে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় (উৎস “একশ বছরের রাজনীতি” , আবুল আসাদ )। এই ক্ষুদিরাম আত্মত্যাগ করেছিলেন তার জাতি হিন্দুদের জন্য , মুসলমানদের জন্য নয় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত কবিও বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে প্রার্থনা সঙ্গিত রচনা করেন -
বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল
--------------------------
বাংগালীর ঘরে যত ভাইবোন
এক হউক এক হউক
এক হউক হে ভগবান ।
তার রচিত “আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায় ভালবাসি ” গান হিন্দু সন্ত্রাসিদের উৎসাহিত করে এবং বধ করতে মুসলমানদের প্রাণ । আবার বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজদের বিপক্ষে চলে গেল , তখন খাঁটি ইংরেজ সমর্থক রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে নিরপেক্ষ হয়ে যান । পাঠকরা একটু লক্ষ্য করবেন হিন্দুরা যে ইংরেজদের সহযোগীতা করেছিল , প্রশাসনিক কারণে সৃষ্ট বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের পক্ষে যাওয়ার কারণে সেই হিন্দুরা ইংরেজদের বিপক্ষে চলে যায় । অন্যদিকে মুসলমানরা নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ যাতে রদ না হয় অর্থাৎপূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ যাতে টিকে থাকতে পারে , সেজন্য আন্দোলন করতে লাগল । ফলে বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানদের দুরত্ব আরও বৃদ্ধি পেতে থাকল । এ ব্যাপারে ''বাংলার মুসলমান'' বইতে আছে মিঃ এন সি চৌধূরী বলেন “ বঙ্গভঙ্গ চিরদিনের জন্য হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক বিনষ্ট করে দেয় এবং বন্ধুত্বের পরিবর্তে আমাদের মনে তাদের জন্য ঘৃণার উদ্রেক হয় । রাস্তাঘাটে , স্কুলে , বাজারে সর্বত্র এ ঘৃণার ভাব পরিস্ফুট হয় । স্কুলে হিন্দু ছেলেরা মুসলমানদের নিকটে বসতে ঘৃণা প্রকাশ করে এই বলে যে , তাদের মুখ থেকে পিঁয়াজের গন্ধ বেরুচ্ছে ।” ((N.C Chowdhury Auto-Biography of an Unknown Indian pp. 227 ,230 ) । যেহেতু হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষায় , ব্যবসা-বাণিজ্যে , চাকুরীতে অগ্রসর ছিল , সেহেতু স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে বিলাতী পণ্য বর্জনের দ্বারা , সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা , ইংরেজ হত্যা ইত্যাদি দ্বারা হিন্দুরা ইংরেজদের কাবু করে ফেলে এবং বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায় । ফলে হিন্দুদের বিজয় হল এবং মুসলমানরা হতাশায় নিমজ্জিত হল , যা ১৯১২ সালের মার্চ মাসে কোলকাতায় মুসলিম লীগের অধিবেশনে নবাব সলিমুল্লাহর বক্তব্য হতে বুঝা যায় । তিনি বলেছিলেন , “বাংলা বিভাগে আমরা তেমন বেশি কিছু লাভ করিনি । কিন্তু তবুও তা আমাদের দেশবাসী অন্য সম্প্রদায়ের ( হিন্দু ) সহ্য হলো না । -----খুন-খারাবী ও ডাকাতির মাধ্যমে তারা প্রতিশোধ নেয়া শুরু করল । তারা বিলেতী দ্রব্য বর্জন করল । ----মুসলিম কৃষক সম্প্রদায় এ বিভাগে লাভবান হয়েছিল । ----- সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করে দেন প্রশাসনিক কারণে । ---- আমাদের সাথে কোন পরমর্শও করা হয়নি । আমরা সব নীরবে সহ্য করেছি । ”(A Hamid t Muslim Separatism in India , p.92 ) নবাব সলিমুল্লাহর এ বক্তব্য তৎকালীন বাংলার মুসলমানের করুণ চিত্র তুলে ধরে । (চলবে)
সুত্রঃ আবু নিশাত(সোনার বাংলাদেশ ব্লগ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন