ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া নানা জানা-অজানা - ৯ম পর্ব

কূটনৈতিক তৎপরতা ফিরে দেখা
ওয়ান-ইলেভেন ও মাইনাস টু’র পরিকল্পনা ঢাকায় ২০০৫ সালেই শুনেন
কানাডীয় আইনজীবী সেস্নান



মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী উইলিয়াম সেস্নান ৮ মার্চ ২০০৭ নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে তার তৎকালীন ঢাকা সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন:
‘পাকিস্থানি স্টাইলে বাংলাদেশে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হঠাৎ করে আসেনি। ১/১১-এর পরিস্থিতিও পূর্বপরিকল্পিত। নির্বাচনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকায় প্রকাশ্যে মানুষ পিটিয়ে হত্যার নীলনকশাও পুরনো। আর এহেন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পাশ্চাত্যের স্বার্থ সংরক্ষণ করার ব্যাপারটিও সভ্য বিশ্বের অজানা নেই।’
পিলে চমকানোর মতো এসব তথ্য ফাঁস করেন আমেরিকা অঞ্চলের মানবাধিকার আইনজীবীদের সংগঠন ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব জুরিস্ট’র কানাডা চ্যাপ্টারের সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্র্যাটিক ল’ ইয়ার্সের কর্মকর্তা অ্যাটর্নি উইলিয়াম সেস্নান। অ্যাটর্নি উইলিয়াম সেস্নান ১৬ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ পর্যন্ত ঢাকা সফরের অভিজ্ঞতার রিপোর্ট বিশ্বব্যাপী একযোগে প্রকাশ উপলক্ষে ৮ মার্চ নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে এক সংবাদ সম্মেলনে এ সব কথা বলেন। প্রকাশিত রিপোর্টেও তিনি স্পষ্টভাবে তা উল্লেখ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা সফরের সময় একজন এমপি এবং একটি পত্রিকার আরেকজন সম্পদকের সাথে বৈঠকের সময় ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার কথা তিনি বিস্তারিতভাবে শুনেন। সে সময় ওই এমপি ও সম্পদক (বারবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও তিনি তাদের নাম বলেননি) তাকে বলেছিলেন, সব পরিকল্পনার তথ্য। খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগের সাথে সাথে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনের ইস্যুতে কী ধরনের আন্দোলন হবে এবং নির্বাচন বানচালের জন্য কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির অবতারণা করা হবে, এরপর জরুরি আইন হতে পারে, জরুরি আইনের সময় সামরিক বাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত¦ দেয়া হবে, এমনি অবস্থায় চালানো হবে দুর্নীতি দমন অভিযান এবং সে অভিযানের টার্গেট হবেন দুই নেত্রী, সংস্কারের নামে প্রধান দু’টি দলকে ভেঙে চুরমার করার পর আমেরিকার পছন্দের লোকদের নেতৃতে¦ গঠন করা হবে নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সেই ফ্রন্টের লোকজনের সমন্বয়ে সরকার গঠন করা হবে।
উইলিয়াম সেস্নান তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন, পাকিস্থানে জেনারেল মোশাররফকে ক্ষমতায় বসানোর স্বার্থে যেভাবে বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফকে দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের দুই বেগমকেও নির্বাসনে পাঠানোর কথা সে সময় শুনেছি। ১/১১-এর আগের কয়েক সপ্তাহে ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং কানাডা ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারদ্বয়ের তৎপরতার মধ্যেও এ ধরনের সংঘবদ্ধ পরিকল্পনার আভাস প্রতিভাত হয়।
উইলিয়াম সেস্নান বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ড. ফকরুদ্দিনের কেয়ারটেকার সরকারের কোনোই বৈধতা নেই। তাই তারা যত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবেন, ততই মঙ্গল হতে পারে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের।
তিনি বলেন, সস্তা বাহবা কুড়ানোর জন্য কেয়ারটেকার সরকার বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে পৃথক করার কথা বললেও জরুরি আইনের নামে পুরো বিচার ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশে হাইকোর্ট বিভাগের যথেষ্ট প্রশংসা করেন তিনি। হাইকোর্টে এখনো নিরপেক্ষতা বজায় রয়েছে বলেও দাবি করেন এই মানবাধিকার আইনজীবী।
তিনি জানান, ফেব্রুয়ারিতে তাকে বাংলাদেশে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশীরা। শেখ হাসিনাসহ অন্য রাজবন্দীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং বিচারকার্য পরিদর্শন করাই ছিল তার সফরের মূল লক্ষ্য। কিন্ত– সরকারের বিশেষ বাহিনীর কারণে তিনি তা করতে সক্ষম হননি। এমনকি তাকে সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
অ্যাটর্নি উইলিয়াম সেস্নান কেয়ারটেকার সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান প্রসঙ্গে বলেন, দুর্নীতিতে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণার সময় টিআইবি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ বলে চিনহিত করা হয়। অথচ সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে অভিযোগও গঠন করা হয়নি। সেই মান্নান ভূঁইয়া জরুরি আইনের মধ্যেও বিএনপিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার তৎপরতা যথারীতি চালিয়ে যান। অথচ সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলেও তাদের গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়েছে।
সেস্নান বলেন, এ ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করলেই কেয়ারটেকার সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের গতি-প্রকৃতি এবং ২০০৫ সালের আগ¯েট যে আভাস পেয়েছি তার সত্যতা স্পষ্ট হয়।
তিনি অভিযোগ করেন, ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিনহার্টে বিচার বহির্ভূতভাবে কয়েক ডজন লোককে হত্যা করা হয়েছে। সে সময় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন লে. জে. হাসান মশহুদ চৌধূরী। তার নেতৃতে¦ মানুষ ন্যায়বিচার পাবে কিভাবে?
তিনি অভিযোগ করেন, জরুরি আইনে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ, ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রমও বন্ধ, কোনো ধরনের দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি হওয়ারও কোনো আশঙ্কা ছিল না, এতদসত্ত্বেও ২০০৭ সালে বিচার বহির্ভূতভাবে ২০০ মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতার হয়ে সরকারের কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ৩০ জন।
অ্যাটর্নি সেস্নানের সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল নিউইয়র্ক ভিত্তিক ‘ফেডারেশন অব অর্গানাইজেশন্স এগেইনস্ট বাংলাদেশ ওয়ার ক্রিমিনালস’ নামক একটি সংগঠন। কিন্ত– মঞ্চের পেছনে সে সংগঠনের ব্যানার লাগাতে দেননি সেস্নান। ব্যানারটি অর্ধেক লাগানোর পর তিনি সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেন, আমি অন্য কোনো সংগঠনের ব্যানারে বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা বিবৃত করতে চাই না। তবে সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে তার দু’পাশে উপবেশন করেন ওই সংগঠনের আহ্বায়কসহ নেতৃবৃন্দ। এর মধ্যে ছিলেন ড. নূরন্নবী, সৈয়দ মুহম্মদ উল্লাহ, রতন বড়ুয়া, ডা. টমাস দুলু রায়, খোরশেদ খন্দকার, সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, নিজাম চৌধুরী, ফাহিম রেজা নূর, মিসবাহ আহমেদ, মহিউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হোসেন, কায়কোবাদ খান, ড. প্রদীপ রঞ্জন কর, সউদ চৌধুরী প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে, সংবিধান প্রদত্ত ন্যূনতম মৌলিক অধিকারও ভোগ করতে পারছেন না শীর্ষ রাজনীতিকরাও। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই মাসের পর মাস তাদের আটক রাখা হয়েছে। শেখ হাসিনা, তারেক রহমানকে মুক্তির জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও সরকার সে নির্দেশ পালন করেনি, হাইকোর্টের নির্দেশে জেল থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আবার নতুন মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে রাজনীতিকদের ইত্যাদি সমন্বয়ের এই রিপোর্ট আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত সব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসঙ্ঘকে প্রদান করা হচ্ছে বলেও অ্যাটর্নি উইলিয়াম সেস্নান জানান।

রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী আলেক্সান্ডার ডাউনার নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সমঝোতার অনুরোধ জানান।
৮ জানুয়ারি ২০০৭ এক বিবৃতিতে তিনি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন বর্জনের কথা উল্লেখ করে ডাউনার বলেন, নির্বাচনে ব্যাপক অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক সমাজের মূল ভিত্তি।
তিনি বলেন, এশিয়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের সক্ষমতা বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন কমিশন অসএইডের অর্থায়নে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের দিকে অস্ট্রেলিয়া গভীর নজর রাখবে বলে ডাউনার মন্তব্য করেন।

কূটনীতিকদের অতিমাত্রায় তৎপরতা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের শামিল
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী কূটনীতিক ও উন্নয়ন সহযোগীদের অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়াকে দুঃখ ও আশঙ্কাজনক মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রায়ন ও বিশ্বায়নের সুযোগে বিদেশীরা মানবাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলতে পারেন। কিন্ত– অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খুঁটিনাটি বিষয়সহ সব ক্ষেত্রে বিদেশীরা যেভাবে জড়িয়ে পড়েন তা হস্তক্ষেপের শামিল। যা ভবিষ্যতে দেশের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বকে আরো অস্থির করে তুলে। দেশের রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিভেদকে পুঁজি করেই তারা এভাবে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কয়েক দিনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারসহ বিদেশী কূটনীতিকদের অতিমাত্রায় দৌড়ঝাঁপ ও নানা মন্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠে। অনেকে উদ্বেগও প্রকাশ করেন। ৭ ও ৮ জানুয়ারি ২০০৭ দুই দিনে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে নির্বাচনের তারিখ পেছানোর জন্য একটি প্রস্তাব নিয়ে তারা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন।
দেশের রাজনীতিতে এভাবে বিদেশীদের তৎপরতার বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বলেন, “গণতন্ত্রায়ন শুধু একটি দেশ বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটা বৈশ্বিক ধারণা। এ হিসেবে বিদেশীরা কিছু কিছু বিষয় যেমন মানবাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ে বলতে পারেন। কিন্ত– এখন তারা যেভাবে খুঁটিনাটি বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন, রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে স¤পর্ক সৃষ্টি করছেন, রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে পদচারণা করছেন সেটা দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল যা দেশের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বকে ভবিষ্যতে আরো অস্থির করে তুলবে। আরেকটা দিক হচ্ছে কূটনৈতিক আচরণের জন্য জেনেভা কনভেনশনে যে নীতিমালা রয়েছে, তারা সেটি মানেন নি। এ জন্য শুধু তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা রাজনৈতিক বিভেদ-অনৈক্যকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছি যে, বাইরের শক্তি এগুলোকে পুঁজি করে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীনিতেও ঢুকে পড়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ড. আ স ম আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের রাজনীতিই তাদেরকে এ সুবিধা দিয়েছে। এ বাস্তবতা মেনেই আমাদের চলতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এখন হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড। এখানকার ঘটনা বাইরের দেশকেও প্রভাবিত করে যেমন বিশ্বের কোনো ঘটনা বাংলাদেশকে প্রভাবিত করে। এ অবস্থায় বিদেশী উন্নয়ন সহযোগীরা সমস্যা সমাধানে সমঝোতার পদক্ষেপ নিতে পারেন। তারা সমঝোতার জন্য উদ্যোগ নিতে পারেন। কিন্ত– সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনীতিবিদদের। উন্নয়ন সহযোগীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এখন আমরা এমন এক সরকারের অধীনে আছি যেখানে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। সেই হিসেবে এক রকম বিদেশীরাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে।”
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, “দেশের রাজনীতিতে তাদের এ ভূমিকা খুবই অন্যায়। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে এসব কূটনীতিকের সংযত আচরণ করা দরকার। তারা আমাদের দেশের রাজনীতিতে এভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এ দেশের জনগণ এটা পছন্দ করেন না। তাদের কোনো কথা থাকলে সেটা তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাতে পারেন। অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের এ ধরনের ভূমিকা নিন্দনীয়। এটা এখানেই থামানো দরকার।”
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেন, “আমি মনে করি সমস্যা আমাদের। এর সমাধান আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। আমরা বিদেশীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারি। আলোচনাও করতে পারি। অতীতে আমরা এর চেয়ে আরো অনেক বড় সঙ্কটের সমাধান করেছি। তাই এ দেশের জনগণকেই চলমান সঙ্কট থেকে উত্তীর্ণ হতে হবে। আশা করব, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সেটা হ্রদয়ঙ্গম করবেন।”


সবার অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা না দেবার ঘোষণা পশ্চিমাদের
নির্বাচনী কর্মকাণ্ড থেকে সরে দাঁড়ান দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের অনেকে। দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নে ৩৪টি এনজিও নিয়ে গঠিত ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্র“প নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে তাদের অবস্থান জানিয়ে দেন।
এদিকে সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা না দেয়ার ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলো এককাতারে চলে আসে। আমেরিকা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার পর ৯ জানুয়ারি ইউরোপীয় কমিশনের রাষ্ট্রদূত এবং কানাডীয় হাইকমিশনারও একই মত ব্যক্ত করেন। অবশ্য অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ নিয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ থেকে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তকে একটি বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ গ্র“প দেশের ৩০০টি আসনের প্রতিটি ভোটকেন্দ্র মোট ১ লাখ ৬৫ হাজার পর্যবেক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল। এর বাইরে আরো ৩ হাজার পর্যবেক্ষক ১০ জনের গ্র“পে ভাগ হয়ে প্রতিটি আসনে ভ্রাম্যমাণ পর্যবেক্ষক হিসেবে কর্তব্য পালন করত। এশিয়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দাতাগোষ্ঠীদের ফোরাম লোকাল কনসালটেটিভ গ্র“প (এলসিজি) এতে অর্থায়ন করে।
ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিচালক ড. জহিরুল আলম এ ব্যাপারে বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী নির্বাচনে অংশ নেয়া বা ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ফলপ্রসূ হবে না বিবেচনায় নির্বাহী বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ গ্র“প একই সঙ্গে ভোটার এবং নাগরিক শিক্ষা-সংক্রান্ত কার্যক্রমও স্থগিত করেছে।
নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের সবচেয়ে বড় দলটি আনার পরিকল্পনা করেছিল ইইউ। ঢাকায় সদর দফতর স্থাপন করে ইইউ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন কর্মকাণ্ডও শুরু করে দিয়েছিল। কিন্ত– ৩ জানুয়ারি মহাজোট মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ায় এ কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে। ৬ জানুয়ারি ইইউর দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষকদের একটি দল ঢাকা আসার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়। ইইউর আওতায় প্রায় ২০০ পর্যবেক্ষক আসার কথা ছিল।
ইইউ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশনের মুখপাত্র সারাহ বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই মিশনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে।’

ইউরোপীয় কমিশনের রাষ্ট্রদূত ড. স্টিফেন ফ্রয়েন ৯ জানুয়ারি অধিকার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। কানাডীয় হাইকমিশনার বারবারা রিচার্ডসন বিসিডিজেসি আয়োজিত অপর এক অনুষ্ঠানে সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মন্তব্য করেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এর আগে পরিস্কারভাবেই জানিয়ে দেন, একপক্ষীয় নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার সেক্রেটারি নিকোলাস বার্নস রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে টেলিফোন করে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ করেন। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেক্সজান্ডার ডাউনার রাজনৈতিক সংঘাত থেকে বিরত থেকে বাংলাদেশের সব নাগরিকের স্বার্থ রক্ষাকারী একটি অবাধ নির্বাচনের জন্য সমঝোতার আহ্বান জানান। কানাডীয় হাইকমিশনার একপক্ষীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না মনে করলেও কূটনীতিকদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ অনুচিত বলে মন্তব্য করেন।


নির্বাচন পর্যবেক্ষণ থেকে সরে দাঁড়ান এনডিআই ও আইআরআই
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ঘোষিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত থাকবে বলে ঘোষণা দেয়। সব প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় আন্তর্জাতিক মিশনের পর্যবেক্ষণ কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে না বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে একটি যৌথ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এতে বলা হয়, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নিরাপদ ও কার্যকরভাবে দায়িত¦ পালন করতে পারবেন না বলে এনডিআই ও আইআরআই উদ্বিগ্ন। প্রতিষ্ঠান দুটি ভোট গ্রহণের দিনের কার্যক্রমের ওপর কোনো প্রতিবেদন দেয়া থেকে বিরত থাকবে।
সে সময় এনডিআইর ২০ জন এবং আইআরআইর ১২ জন দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষক ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষকরা ঢাকায় অবস্থান করে নির্বাচনের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করেন। এ পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে নিজ নিজ সদর দফতরকে প্রতিবেদন দেবেন। তবে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে না।
মহাজোটের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এনডিআই ও আইআরআই ভোট গ্রহণের দিন স্বল্পমেয়াদি পর্যবেক্ষকদের দিয়ে যে কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিল, তা স্থগিত করে।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচন পর্যবেক্ষক মিশনের মুখপাত্র সারাহ ১০ জানুয়ারি বাতে জানান, ইইউ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে কি না, তা আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে জানানোর ঘোষণা দেন। (চলবে) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন