তিনি অফিসে আসেন বেলা গড়িয়ে। এসেই শুরু করেন খাজুরে আলাপ। সামনে যাকে পান তার কাছেই শুরু করেন ব্যক্তিগত গুণগান গাওয়া। ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পূরণে করেন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অপব্যবহার। আদালত কর্তৃক নিয়োগ অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও তা টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করে উচ্চতর আদালতে মামলা চালিয়ে যান। প্রাতিষ্ঠানিক কাজের চেয়ে বিদেশ ভ্রমণে বেশি আগ্রহ। এই স্বখ্যাত ব্যক্তিটি হলেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন। তার অদক্ষতা আর হেয়ালিপনায় আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি। ভোক্তার অধিকার আর বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে গঠিত হলেও শুধু বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি আর পেট্রোল পাম্প ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসেন্স প্রদানের মধ্যেই কমিশনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। কমিশনের জরুরি সভাগুলো প্রায়শই ফলপ্রসূ হয় না শুধু চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছাচারিতায়। সভার অধিকাংশ সময় জুড়ে চলে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সাফল্য আর সততার (!) খতিয়ান। চেয়ারম্যানের পরিবারের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দের অতিরিক্ত গাড়ি সরবরাহ করতে হয় বিইআরসিকে। এ যেন হীরক রাজার রাজত্ব।
অবৈধ পদ ধরে রাখতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়
২০০৯ সালের ১১ অক্টোবর সৈয়দ ইউসুফ হোসেনকে বিইআরসি'র চেয়ারম্যান হিসেবে তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। সে বছরেই বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ল এন্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান তসলিমউদ্দিন আহমেদ ওই নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিট আবেদনে বলা হয়, সংবিধান অনুসারে তার এ নিয়োগ অবৈধ। কারণ, তিনি ২০০২ সালে মহা হিসাব নিরীক্ষকের পদ থেকে অবসর নেন। সংবিধানের ১২৯ এর (৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে, কর্মাবসানের পর মহা হিসাব নিরীক্ষক প্রজাতন্ত্রের অন্য কোন পদে নিযুক্ত হবার যোগ্য হবেন না।
এ মামলার প্রেক্ষিতে চলতি বছর হাইকোর্ট বিইআরসি চেয়ারম্যানের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে। মামলাটি এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নিয়োগটি অসাংবিধানিক এবং ত্রুটিপূর্ণ। সম্প্রতি এটর্নি জেনারেল অফিস জ্বালানি বিভাগকে মৌখিকভাবে জানিয়েছে যে, এ মামলায় জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবু মামলা চালিয়ে যাচ্ছেন বিইআরসি চেয়ারম্যান। মামলা পরিচালনার জন্য বিইআরসি চেয়ারম্যান আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন। হাইকোর্টে শুনানি এবং লিভ টু আপিল পর্যন্ত ওই আইনজীবী ২৩ লাখ টাকার বিল দিয়েছেন। মামলা শেষ হওয়া পর্যন্ত ব্যয় দাঁড়াতে পারে ৫০ লাখ টাকার মতো। বিইআরসি'র আইনি কর্মকা- পরিচালনার জন্য বছরে সরকার পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার বেশি বরাদ্দ দেয় না। সেখানে এক বছরে ২৩ লাখ টাকা দিলে বিইআরসি'র অন্য আইনি কর্মকা- কিভাবে পরিচালিত হবে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেই বিপাকে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদের মতে, চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগে বছরে বিইআরসি চেয়ারম্যানকে সরকার যে বেতন দিচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে তার পদ টিকিয়ে রাখতে।
আয়েশি রাজার বিলাসী রুটিন
গত কয়েক মাসে শীর্ষ কাগজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে হীরক রাজা খ্যাত বিইআরসি'র চেয়ারম্যানের প্রতিদিনের খামখেয়ালিপূর্ণ কর্মকা-ের নানা চিত্র। দেখা গেছে, বিইআরসি চেয়ারম্যান বিশেষ দিন ছাড়া অন্যসব দিনে অফিসে আসেন বেলা (১২টা থেকে দেড়টার মধ্যে)। অফিসে এসে সকালের নাস্তা খান। চেয়ারম্যানের সকালের নাস্তা খাওয়া শেষ হলে টিফিন কেরিয়ারটি নিয়ে প্রতিদিনই একটি গাড়ি তার দুপুরের খাবার আনতে যায় উত্তরার বাসায়। দেখা যায়, গাড়ির প্রতিদিনের খরচের চেয়ে উনার খাবারের দাম অনেক কম।
দুপুরের খাওয়ার আগে কোন মিটিং থাকলে তাতে অংশ নেন। নয়তো অফিসের জুনিয়র কলিগদের ধরে নিজ কক্ষে নিয়ে যান। শুরু করেন গল্প। দুপুরের খাবারের আগ পর্যন্ত তা চলে। বিইআরসি'র এক কর্মকর্তা বলেন, 'স্যার অফিসে ঢুকছেন, আর কেউ উনার সামনে পড়েছে, তাহলে সে বেচারার বারটা বেজে যায়। অর্থাৎ সেই দিনে তার সব কাজ শেষ। উনি না ছাড়া পর্যন্ত জ্বী স্যার, হু স্যার করে সময় পার করতে হয়। এজন্য উনি এসেছেন শুনলে এখন অফিসের প্রবেশের পথটি পরিষ্কার হয়ে যায়। একটা পিওনও দাঁড়িয়ে থাকে না। উনার গল্পের বিষয়বস্তু কি জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, উদ্দেশ্যহীন। যখন যেটা মনে আসে তখন সেটাই বলেন। প্রথমে নাম, পড়ালেখা কোথায়-কোন বিষয়ে এসব জানতে চান। এরপর উনি কি, উনার বাবা কি ছিলেন অথবা দাদা বা তার বাবার প্রতিষ্ঠিত জীবনের গল্প বলেন। তবে কেউ অর্থনীতিতে পড়েছে শুনলে তিনি খুশি হন। কারণ, নিজেই অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন। এ বিষয়ে নানা রকম প্রশ্ন করেন যেন চাকরিতে যোগদানের মৌখিক পরীক্ষা। না পারলে শুরু করেন অকথ্য ভাষায় গালাগাল।
বেলা চারটার পর দুপুরের খাবার। এরপর ছয়টা পর্যন্ত বিশ্রাম। তিনি ঘুম থেকে জাগার আগেই অফিস ছুটি হয়ে যায়। ঘুম থেকে জেগে না উঠা পর্যন্ত অফিসের যত জরুরি কাজই থাকুক সংশ্লিষ্টদের অপেক্ষা করতে হয়। তিনি সাধারণত অফিস ত্যাগ করেন রাত সাড়ে আটটার পর। এ সময়টা উনি কি করেন জানতে চাইলে বিইআরসি'র অপর এক কর্মকর্তা বলেন, গল্প করার জন্য নতুন সঙ্গী খোঁজেন। যে কোন অজুহাতে কাউকে কাউকে আটকে দেন। এসব কারণে টাইপিস্ট, পিও আর পিওনদের উনার সঙ্গে আটটা পর্যন্ত অফিস করতে হয়।
চেয়ারম্যানের মেয়ের জন্যও কমিশনের গাড়ি
নিয়ম অনুযায়ী একটি গাড়ি পাবার কথা থাকলেও বিইআরসি চেয়ারম্যান সার্বক্ষণিক দু'টি গাড়ি ব্যবহার করেন। এ দু'টি গাড়ির নম্বর (ঢাকা মেট্রোগ_২১৪১৬৩ ও ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩২৩৯৬)। দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত 'বিইআরসিকে শক্তিশালীকরণ' প্রকল্পের জন্য কেনা একটি গাড়ি চেয়ারম্যান নিজে ব্যবহার করেন। আর তার জন্য বরাদ্দকৃত গাড়িটি ব্যবহার করে তার কনিষ্ঠ মেয়ে। দেড় কোটি টাকা দামের এ 'প্রটোন' গাড়ি সাধারণত ব্যবহার করেন মন্ত্রীরা।
আর দুপুরের খাবার আনার জন্য অফিস থেকে আরো একটি গাড়ি সবসময় প্রস্তুত রাখা হয়। এছাড়াও যদি অন্য কোনো কাজে প্রয়োজন পড়ে তাহলে কমিশনের অন্য সদস্য বা কর্মকর্তাদের গাড়ি চেয়ারম্যানের জন্য সরবরাহ করতে হয়।
সভা যেন আত্মচর্চার অনুষ্ঠান
বিইআরসি আইন অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কমিশন গণশুনানীর আয়োজন করে। গত দু'বছর ধরে এসব বৈঠক হয়ে উঠেছে বিইআরসি'র চেয়ারম্যানের আত্ম প্রচারের সভা। তিনি কি ছিলেন, কি করেছেন, তার বাবা কি করেছেন, তিনি কতটা সৎ (!) ছিলেন এসব বর্ণনা শুনতে হয় আগত ভোক্তা-গ্রাহক ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের। তার এমন কর্মকা-ে প্রায়ই এসব বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়া মুলতবি করতে হয়। ২ ঘণ্টার বৈঠক চলে ৫/৬ ঘণ্টা। এমনকি কমিশনের অভ্যন্তরীণ বৈঠকেও এমন ঘটনা ঘটে। এ সভাগুলোতে বিইআরসি'র অনেক কর্মকর্তাকে অযথা চেয়ারম্যান কটূ বাক্যবাণে জর্জরিত করেন। তার এ দুর্ব্যবহারে অনেকেই বিইআরসি ত্যাগ করেছেন।
বিআইরসি'র কর্মকা-ে গতিশীলতা আনতে বিগত চেয়ারম্যানের সময় সহকারী পরিচালক পদে ১৬ জনের মতো মেধাবী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যানের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে এদের থেকে ৭ জন ইতিমধ্যে বিইআরসি ত্যাগ করেছেন। বাকিদেরও ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
কমিশন নয় নিজের সুবিধা আদায়ে তৎপর
বিইআরসি চেয়ারম্যান হিসেবে সৈয়দ ইউসুফ হোসেন কমিশনের কাজের চেয়ে নিজের সুবিধা আদায়ের পথ অনুসন্ধানে বেশি ব্যস্ত থাকেন। চেয়ারম্যানের পদটি যেন আপিল বিভাগের বিচারপতির সমমর্যাদা পায় প্রথমে এ প্রচেষ্টা চালান ইউসুফ হোসেন। এটি অর্জনের পর দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেন গাড়িতে পতাকা লাগানোর বিষয়টি নিয়ে। বিইআরসি'র বৈঠকে তিনি এটি উত্থাপন করেন। বিষয়টি অনৈতিক হলেও কেউ তার কথার বিরোধিতা করেন না। বর্তমানে উনার গাড়িতে পতাকা লেগেছে। বিইআরসি'র আইন অনুযায়ী চেয়ারম্যানের পতাকা ব্যবহারের কোন এখতিয়ার নেই। কেন গাড়িতে পতাকা লাগানো হয়েছে, জানতে চাইলে বিআরসি'র এক কর্মকর্তা বলেন, উত্তরা থেকে আসতে উনাকে যানজটের কবলে পড়তে হয় । পতাকা থাকলে উল্টোপথ ধরেও আসা যায়। এ জন্যই উনার এই আবিষ্কার। এছাড়া তিনি নিজের বেতন বৃদ্ধি, লাল পাসপোর্ট এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সম্প্রতি তিনি বিইআরসি চেয়ারম্যানের মেয়াদ বাড়ানো ও হাইকোর্টের রায় থেকে বাঁচার জন্য একটি আইনি সংশোধনী জ্বালানি বিভাগে পাঠিয়েছেন। এছাড়াও প্রায় দিনই উনি অফিসে এসেই একটি ভাউচার লেখেন চিকিৎসা বিলের। এর পরিমাণ এক থেকে দেড় বা দু'হাজার টাকার। ভাউচার পাওয়া মাত্রই উনাকে নগদ টাকা দিতে হয়। বিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় পরে। সরকার যে চিকিৎসা বিল বরাদ্দ করেছে তার কয়েকগুণ নেয়া হলেও এখনও উনি চিকিৎসা বিলের ভাউচার দিয়েই যাচ্ছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, এক বছরে তিনি তিন লাখ টাকা চিকিৎসা বিল নিয়েছেন। অন্য খাতে খরচ দেখিয়ে এ হিসাব সমন্বয় করা হয় বলে জানান তিনি।
লোভাতুর বিদেশ ভ্রমণ
বিদেশ ভ্রমণের দিকে একটু বেশি আগ্রহী বিইআরসি'র চেয়ারম্যান। সেমিনার আর প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণ এলেই আগে চেয়ারম্যানের যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। পরে অন্য কারও। গত বছর বিইআরসি'র বিদেশ ভ্রমণ বাবদ যে পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল তার পুরোটা চেয়ারম্যান একাই খরচ করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, অনুমোদন হীনভাবে নির্ধারিত সময়ের আরো বেশি সময় তিনি বিদেশে অবস্থান করেন। বিদেশ থেকে ফিরেও তিনি এক দুই সপ্তা বিশ্রাম নেন। এসময় কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ যত কাজই থাকুক না কেন।
প্রতিকার কি নেই?
অদক্ষ আর অবিবেচক এমন চেয়ারম্যানের এসব কাজ সরকার কেন নীরবে সয়ে যায় এমন প্রশ্নে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিইআরসি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তাদের কর্মকা-ে জ্বালানি বিভাগ সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিইআরসি চেয়ারম্যানকে অপসারণের প্রক্রিয়াও দীর্ঘ। এই প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়লে আলোচনা-সমালোচনা সইতে হবে। এমন ধারণা থেকে এ বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয় না মন্ত্রণালয়। ওই কর্মকর্তা আরো জানান যে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনেক ব্যক্তির সঙ্গে সৈয়দ ইউসুফ হোসেনের রয়েছে দহরম-মহরম। না হলে অসাংবিধানিক জেনেও তাকে নিয়োগ দেয়া হয় কিভাবে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন