তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে দেশে
উপমহাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য নির্বাচন মেরুদণ্ড স্বরূপ। সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং ক্ষমতার স্বাভাবিক হস্তান্তর যেকোন দেশের স্থিতিশীল গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনেকটা প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করছে। কারণ এর অধিকাংশ দেশেরই স্বাধীনতা অর্জনের সময়কাল ১০০ বৎসরের অধিক নয়। পকিস্তান ভারত ও বাংলাদেশের মত দেশসমূহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা আধুনিকায়ন তথা সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে তাদের গনতন্ত্রকে একটি প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এসব দেশ তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সমস্যা মুক্ত করে অধিকতর স্বচ্ছ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অধিক স্বাধীন, নির্বাচনের সময় বিদেশী নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক রাখা, স্বচ্ছ ব্যালট বক্সের ব্যবহার ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে কম্পিউটারাইজড করার চেষ্টা করছে। যেহেতু এসব দেশে অনুষ্ঠিত অধিকাংশ নির্বাচন নিয়েই অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কারনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্বাচনে অনিয়ম করে থাকে। ফলে শাসক দলের বিদায়ের প্রাক্কালে তত্ত্বাবধয়াক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ধারণা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সামনে চলে আসে।
পাকিস্তানের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
পাকিস্তানের সংবিধান অনুসারে লিগ্যাল ফ্রেসওযার্ক অর্ডার ২০০১ এর মাধ্যমে ২২৪ অনুচ্ছেদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুযোগ রাখা হয়েছে।
২২৪ (১) এ বলা হয়েছে “একটি পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষে রাষ্ট্রপতি কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে গভর্নর (পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে একটি তত্ত্বাবধায়ক ক্যাবিনেট নিয়োগ দেবেন। ২২৪ (৭) অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়েছে। “অনুচ্ছেদ ৫৮ অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের অথবা অনুচ্ছেদ ১১২ অনুযায়ী প্রাদেশীক পরিষদের কিংবা যেকোন পরিষদের মেয়াদ শেষে যখন একটি তত্ত্বাবধয়াক মন্ত্রীসভা/প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হবে, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মন্ত্রী কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে মুখ্য মন্ত্রী পরিষদের আসন্ন নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করার যোগ্য বিবেচিত হবেন না। পাকিস্তান সংবিধানের ২২৪ অনুচ্ছেদের উল্লেখিত দুটি ধারায় নিশ্চিত করে নির্দলীয় তথা নিরপেক্ষ কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাধ্যবাধকতার কথা না বললেও উক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্য মন্ত্রীকে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আযোগ্যতার কথা বলে নিরপেক্ষতার একটা মাত্রা নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যদের বেলায় উপরিউক্ত অযোগ্যতা কর্যকর নয়।
এখানে আরো লক্ষ্যনীয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিযুক্ত রাষ্ট্রপতির পুরোপুরি এখতিয়ারভুক্ত। এক্ষেত্রে কোন যোগ্যতা কিংবা অন্য কোন শর্ত উল্লেখ নেই।
এখানে আরো উল্লেখযোগ্য যে, রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্বে অব্যাহত থাকবেন। এমনকি জাতীয় কিংবা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের সময়ও তার দায়িত্বভার যথারীতি বলবৎ থাকবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি দলীয় কেউ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিষ্পন্ন করা দু:সাধ্য। উল্লেখ্য পাকিস্তানের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির দলীয় হওয়াটা দোষের নয়।
অষ্টম সংশোধনী পর্যন্ত অনেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নজির রয়েছে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি জাতীয় পরিষদ এবং তাদের কেবিনেট বাতিল করে দিয়েছেন।
জেনারেল জিয়াউল হক ও গোলাম ইসহাক খানের অধীনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ১৯৮৮ সারের ২৩ মে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউল হক সংবিধানের ৫৮ (২) চ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ খান জুনেজকে অপসারন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী ব্যতিরেকে সরাসরি তার অধীনে একটি তত্ত্বাবধায়ক কেবিনেট গঠন করেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। ফলে সংবিধান অনুসারে তৎকালীন সিনেটের চেয়ারম্যান গোলাম ইসহাক খান ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। কিন্তু তিনি পূর্বের তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা ঠিক রাখেন। সে সময়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং বিশেষ করে আই এম আই সহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎকালীন প্রভাবশালী প্রতিযোগী বেনজির ভুট্রোর পিপিপি’র বিপরীতে একটি নির্বাচনী জোট তৈরী করে তাকে জিতিয়ে আনার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু তাদের এই নগ্ন হস্তক্ষেপের পরেও বেনজির ভুট্রোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি এককভাবে জয়ী হয়। উক্ত নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ নিরপেক্ষতা কেবল প্রশ্নবিদ্ধই ছিল না বরং তা ছিল একেবারেই নগ্ন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
গোলাম মোস্তফা জাতই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯০
১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর বলে অষ্টম জাতীয় পরিষদ বাতিল ও প্রধান মন্ত্রি বেনজির ভূট্রোকে তার পদ থেকে দূর্নীতির দায়ে/অজুহাতে অপসারন করে গোলাম মোস্তাফা জাতই কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। গোলাম মোস্তফা জাতই ছিল বাতিলকে জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে নির্বাচনী তফসিল ঘোষনা করা হয়। নিসন্দেহে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি ছিল দলীয়। পিপিপি তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অনিয়মের অভিযোগ আনে। উক্ত নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ইসলামী জামহরি জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে।
বালাখ শের মাজারির সংক্ষিপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৩
১৯৯৩ সালে এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান ৯ম জাতীয় পরিষদও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ নওয়াজ শরীফের সরকারকে বিলুপ্ত ঘোষনা করেন। জনাব বালাখ শের মাজারি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয় জুলাই ’৩৯ কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের আদেশে রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খানের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রি নওয়াজ শরীফকে পুনরায় তার পদে বহালের আদেশ দেওয়ায় ২৬ মে ’১৯৯৩ বালাখ মাজারি’র মেয়াদ কাল শেষ হয়। সুপ্রীম কোর্টের আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান ও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় উভয়ে তাদের পদত্যাগ করেন এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্ত করে দেয়া হয়।
মঈন কোরেশীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৩
তৎকালীন সেনা প্রধান ওয়াহিদ কাকারের মধ্যস্থতায় গোলাম ইসহাক খান ও নওয়াজ শরীফের মধ্যে সমঝোতার মাধমে বিশ্ব ব্যাংকের (অব) কর্মকর্তা মঈন কোরেশিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয় এবং সিনেটের চেয়ারম্যান ওয়াসিম সাজ্জাদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে মঈন কোরেশি দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন ফলে পাকিস্তানীরা তাকে খুবই কম চিনত/জানত। ধারনা ছিল মঈন কোরেশি যেহেতু দীর্ঘ দিন দেশের রাজনীতি থেকে দূরে তাই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু মোহাম্মদ নওয়াজ শরীফ তার নিরপেক্ষতার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন এবং পরাজিত হওয়ার পরে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তবে নির্বাচনটি তুলনামূলক ভাবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হয়েছিল।
মালিক মেজারি খালিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৬
রাষ্ট্রপতি ফারুক লেঘারি ১৯৯৬ সালে ৫ নভেম্বরে জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গে দেন এবং দুর্নীতির অভিযোগে প্রধান মন্ত্রী বেনজির ভুট্রোর নেতৃত্বাধীন পিপিপি’র সরকারকে বরখাস্ত করেন। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির রেকটর মালিক মেজারি খালিদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয় ১৯৯৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী মালিক মেজারি খালিদ ৬ নভেম্বর ’৯৬ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৭ পর্যন্ত তত্ত্বাবধয়াক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পিপিপি নির্বাচনে পরাজিত হয় এবং সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ আনে।
পাকিস্তানে তত্ত্বাবধাযক সরকার আস্থা আনয়নে ব্যর্থ
পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনসমূহ জনগণের আস্থা আনয়নে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কারন দলীয় রাষ্ট্রপতির একক ইচ্ছায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার কারনে নিরপেক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। মঈন কোরেশি ছাড়া বাকি সবগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারই নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ভারতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মত ভারতে নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলবৎ নেই। ভারতে লোকসভার মেয়াদ শেষ বা বিলুপ্ত হওযার পরে নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ীদের দায়িত্ব ভার গ্রহনের পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব সরকার দায়িত্ব অব্যাহত রাখবে। ভারতীয় সংবিধানের ৭৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী সহ মন্ত্রিসভা তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পার্লামেন্টের সদস্যপদ ছাড়াই ছয় মাস পর্যন্ত দায়িত্বে থাকতে পারবে। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের নিয়মও প্রথা ছাড়াই স্বল্প সময়ের জন্য সাংসদদের বাইরেও একটি মন্ত্রিসভা কাউন্সিল গঠন করতে পারবেন। যাকিনা হবে শুধু মাত্র সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য।
মূল্যায়ন
একটি পরিপক্ক গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচিত সরকারই সাধারন নির্বাচনের সময়ে তত্ত্বাবধয়াক সরকারের দায়িত্ব পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে জনগনের কোন ধরনের সন্দেহের অবকাশ থাকেনা। কারন এক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মত যথেষ্ট স্বাধীনতা ও ক্ষমতা থাকে। সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ থাকেনা। এরকম রাষ্ট্রে সরকারের যেকোন রকম হস্তক্ষেপ মোকাবেলা করে যথার্থ দায়িত্ব পালন করার মত প্রজাতন্ত্রের পতিষ্ঠান সমূহের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সূদূঢ় থাকে। ভারতন এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরন যেখানে নির্বাচনের সময়ে নির্বাচন কমিশন একটি ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন (ভারতে) হয়নি। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে নির্বাচন একটি বিরাট প্রশ্ন ও শঙ্কার বিষয়। এসব দেশে ক্ষমতাসীনও বিরোধী দলের মধ্যে মারাত্মক আস্থার সংকট লক্ষ্যনীয়। ক্ষমতাসীনরা তাদের স্বার্থে নির্বাচনে অনিয়ম করার আশক্সক্ষাও থাকে। এসব দেশে নির্বাচন কমিশন জোটে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ফলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু উভয় দেশেই সমস্যা দেখা দেয় রাষ্ট্র প্রধানকে নিয়ে। কারন রাষ্ট্রপতি দলীয় থাকার কারনে নির্বাচনের একটা প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে পাকিস্তান তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রপতির (নিজস্ব) একক পছন্দ হওয়ার কারনে নিরপেক্ষ ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগের সংবিধানের বিশেষ বিধান থাকলেও সর্বশেষ ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মনোনয়নে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের বিচার বিভাগের বিশেষ সংস্কার বিতর্কের মুখে পড়ে। বিরোধী দল নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কার দাবী করে। কিন্তু এসব দেশে মূল সমস্যা হলো দূর্বল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পরস্পরের আস্থাহীণতা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিষ্ঠানিক মজবুতির অভাব। পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা বিশ্ব দরবারে অনেকটা আদর্শ হতে চলছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে বাংলাদেশের এ ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতের সবগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারই অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হলেও গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারিতার অভাবে বিরোধীদল সমূহের প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনায় ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিপক্কতার কারনেই গণতন্ত্র সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ মুক্ত থাকতে পেরেছে। দেশের রাজনীতিবিদরা পরাশক্তিসমূহের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে অবস্থার উত্তরণ সূদূর পরাহত। (চলবে)
উপমহাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য নির্বাচন মেরুদণ্ড স্বরূপ। সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং ক্ষমতার স্বাভাবিক হস্তান্তর যেকোন দেশের স্থিতিশীল গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনেকটা প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করছে। কারণ এর অধিকাংশ দেশেরই স্বাধীনতা অর্জনের সময়কাল ১০০ বৎসরের অধিক নয়। পকিস্তান ভারত ও বাংলাদেশের মত দেশসমূহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা আধুনিকায়ন তথা সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে তাদের গনতন্ত্রকে একটি প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এসব দেশ তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সমস্যা মুক্ত করে অধিকতর স্বচ্ছ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অধিক স্বাধীন, নির্বাচনের সময় বিদেশী নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক রাখা, স্বচ্ছ ব্যালট বক্সের ব্যবহার ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে কম্পিউটারাইজড করার চেষ্টা করছে। যেহেতু এসব দেশে অনুষ্ঠিত অধিকাংশ নির্বাচন নিয়েই অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কারনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্বাচনে অনিয়ম করে থাকে। ফলে শাসক দলের বিদায়ের প্রাক্কালে তত্ত্বাবধয়াক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ধারণা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সামনে চলে আসে।
পাকিস্তানের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
পাকিস্তানের সংবিধান অনুসারে লিগ্যাল ফ্রেসওযার্ক অর্ডার ২০০১ এর মাধ্যমে ২২৪ অনুচ্ছেদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুযোগ রাখা হয়েছে।
২২৪ (১) এ বলা হয়েছে “একটি পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষে রাষ্ট্রপতি কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে গভর্নর (পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে একটি তত্ত্বাবধায়ক ক্যাবিনেট নিয়োগ দেবেন। ২২৪ (৭) অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়েছে। “অনুচ্ছেদ ৫৮ অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের অথবা অনুচ্ছেদ ১১২ অনুযায়ী প্রাদেশীক পরিষদের কিংবা যেকোন পরিষদের মেয়াদ শেষে যখন একটি তত্ত্বাবধয়াক মন্ত্রীসভা/প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হবে, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মন্ত্রী কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে মুখ্য মন্ত্রী পরিষদের আসন্ন নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করার যোগ্য বিবেচিত হবেন না। পাকিস্তান সংবিধানের ২২৪ অনুচ্ছেদের উল্লেখিত দুটি ধারায় নিশ্চিত করে নির্দলীয় তথা নিরপেক্ষ কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাধ্যবাধকতার কথা না বললেও উক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্য মন্ত্রীকে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আযোগ্যতার কথা বলে নিরপেক্ষতার একটা মাত্রা নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যদের বেলায় উপরিউক্ত অযোগ্যতা কর্যকর নয়।
এখানে আরো লক্ষ্যনীয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিযুক্ত রাষ্ট্রপতির পুরোপুরি এখতিয়ারভুক্ত। এক্ষেত্রে কোন যোগ্যতা কিংবা অন্য কোন শর্ত উল্লেখ নেই।
এখানে আরো উল্লেখযোগ্য যে, রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্বে অব্যাহত থাকবেন। এমনকি জাতীয় কিংবা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের সময়ও তার দায়িত্বভার যথারীতি বলবৎ থাকবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি দলীয় কেউ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিষ্পন্ন করা দু:সাধ্য। উল্লেখ্য পাকিস্তানের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির দলীয় হওয়াটা দোষের নয়।
অষ্টম সংশোধনী পর্যন্ত অনেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নজির রয়েছে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি জাতীয় পরিষদ এবং তাদের কেবিনেট বাতিল করে দিয়েছেন।
জেনারেল জিয়াউল হক ও গোলাম ইসহাক খানের অধীনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ১৯৮৮ সারের ২৩ মে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউল হক সংবিধানের ৫৮ (২) চ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ খান জুনেজকে অপসারন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী ব্যতিরেকে সরাসরি তার অধীনে একটি তত্ত্বাবধায়ক কেবিনেট গঠন করেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। ফলে সংবিধান অনুসারে তৎকালীন সিনেটের চেয়ারম্যান গোলাম ইসহাক খান ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। কিন্তু তিনি পূর্বের তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা ঠিক রাখেন। সে সময়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং বিশেষ করে আই এম আই সহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎকালীন প্রভাবশালী প্রতিযোগী বেনজির ভুট্রোর পিপিপি’র বিপরীতে একটি নির্বাচনী জোট তৈরী করে তাকে জিতিয়ে আনার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু তাদের এই নগ্ন হস্তক্ষেপের পরেও বেনজির ভুট্রোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি এককভাবে জয়ী হয়। উক্ত নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ নিরপেক্ষতা কেবল প্রশ্নবিদ্ধই ছিল না বরং তা ছিল একেবারেই নগ্ন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
গোলাম মোস্তফা জাতই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯০
১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর বলে অষ্টম জাতীয় পরিষদ বাতিল ও প্রধান মন্ত্রি বেনজির ভূট্রোকে তার পদ থেকে দূর্নীতির দায়ে/অজুহাতে অপসারন করে গোলাম মোস্তাফা জাতই কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। গোলাম মোস্তফা জাতই ছিল বাতিলকে জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে নির্বাচনী তফসিল ঘোষনা করা হয়। নিসন্দেহে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি ছিল দলীয়। পিপিপি তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অনিয়মের অভিযোগ আনে। উক্ত নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ইসলামী জামহরি জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে।
বালাখ শের মাজারির সংক্ষিপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৩
১৯৯৩ সালে এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান ৯ম জাতীয় পরিষদও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ নওয়াজ শরীফের সরকারকে বিলুপ্ত ঘোষনা করেন। জনাব বালাখ শের মাজারি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয় জুলাই ’৩৯ কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের আদেশে রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খানের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রি নওয়াজ শরীফকে পুনরায় তার পদে বহালের আদেশ দেওয়ায় ২৬ মে ’১৯৯৩ বালাখ মাজারি’র মেয়াদ কাল শেষ হয়। সুপ্রীম কোর্টের আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান ও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় উভয়ে তাদের পদত্যাগ করেন এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্ত করে দেয়া হয়।
মঈন কোরেশীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৩
তৎকালীন সেনা প্রধান ওয়াহিদ কাকারের মধ্যস্থতায় গোলাম ইসহাক খান ও নওয়াজ শরীফের মধ্যে সমঝোতার মাধমে বিশ্ব ব্যাংকের (অব) কর্মকর্তা মঈন কোরেশিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয় এবং সিনেটের চেয়ারম্যান ওয়াসিম সাজ্জাদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে মঈন কোরেশি দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন ফলে পাকিস্তানীরা তাকে খুবই কম চিনত/জানত। ধারনা ছিল মঈন কোরেশি যেহেতু দীর্ঘ দিন দেশের রাজনীতি থেকে দূরে তাই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু মোহাম্মদ নওয়াজ শরীফ তার নিরপেক্ষতার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন এবং পরাজিত হওয়ার পরে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তবে নির্বাচনটি তুলনামূলক ভাবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হয়েছিল।
মালিক মেজারি খালিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৬
রাষ্ট্রপতি ফারুক লেঘারি ১৯৯৬ সালে ৫ নভেম্বরে জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গে দেন এবং দুর্নীতির অভিযোগে প্রধান মন্ত্রী বেনজির ভুট্রোর নেতৃত্বাধীন পিপিপি’র সরকারকে বরখাস্ত করেন। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির রেকটর মালিক মেজারি খালিদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয় ১৯৯৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী মালিক মেজারি খালিদ ৬ নভেম্বর ’৯৬ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৭ পর্যন্ত তত্ত্বাবধয়াক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পিপিপি নির্বাচনে পরাজিত হয় এবং সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ আনে।
পাকিস্তানে তত্ত্বাবধাযক সরকার আস্থা আনয়নে ব্যর্থ
পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনসমূহ জনগণের আস্থা আনয়নে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কারন দলীয় রাষ্ট্রপতির একক ইচ্ছায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার কারনে নিরপেক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। মঈন কোরেশি ছাড়া বাকি সবগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারই নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ভারতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মত ভারতে নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলবৎ নেই। ভারতে লোকসভার মেয়াদ শেষ বা বিলুপ্ত হওযার পরে নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ীদের দায়িত্ব ভার গ্রহনের পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব সরকার দায়িত্ব অব্যাহত রাখবে। ভারতীয় সংবিধানের ৭৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী সহ মন্ত্রিসভা তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পার্লামেন্টের সদস্যপদ ছাড়াই ছয় মাস পর্যন্ত দায়িত্বে থাকতে পারবে। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের নিয়মও প্রথা ছাড়াই স্বল্প সময়ের জন্য সাংসদদের বাইরেও একটি মন্ত্রিসভা কাউন্সিল গঠন করতে পারবেন। যাকিনা হবে শুধু মাত্র সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য।
মূল্যায়ন
একটি পরিপক্ক গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচিত সরকারই সাধারন নির্বাচনের সময়ে তত্ত্বাবধয়াক সরকারের দায়িত্ব পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে জনগনের কোন ধরনের সন্দেহের অবকাশ থাকেনা। কারন এক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মত যথেষ্ট স্বাধীনতা ও ক্ষমতা থাকে। সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ থাকেনা। এরকম রাষ্ট্রে সরকারের যেকোন রকম হস্তক্ষেপ মোকাবেলা করে যথার্থ দায়িত্ব পালন করার মত প্রজাতন্ত্রের পতিষ্ঠান সমূহের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সূদূঢ় থাকে। ভারতন এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরন যেখানে নির্বাচনের সময়ে নির্বাচন কমিশন একটি ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন (ভারতে) হয়নি। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে নির্বাচন একটি বিরাট প্রশ্ন ও শঙ্কার বিষয়। এসব দেশে ক্ষমতাসীনও বিরোধী দলের মধ্যে মারাত্মক আস্থার সংকট লক্ষ্যনীয়। ক্ষমতাসীনরা তাদের স্বার্থে নির্বাচনে অনিয়ম করার আশক্সক্ষাও থাকে। এসব দেশে নির্বাচন কমিশন জোটে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ফলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু উভয় দেশেই সমস্যা দেখা দেয় রাষ্ট্র প্রধানকে নিয়ে। কারন রাষ্ট্রপতি দলীয় থাকার কারনে নির্বাচনের একটা প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে পাকিস্তান তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রপতির (নিজস্ব) একক পছন্দ হওয়ার কারনে নিরপেক্ষ ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগের সংবিধানের বিশেষ বিধান থাকলেও সর্বশেষ ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মনোনয়নে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের বিচার বিভাগের বিশেষ সংস্কার বিতর্কের মুখে পড়ে। বিরোধী দল নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কার দাবী করে। কিন্তু এসব দেশে মূল সমস্যা হলো দূর্বল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পরস্পরের আস্থাহীণতা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিষ্ঠানিক মজবুতির অভাব। পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা বিশ্ব দরবারে অনেকটা আদর্শ হতে চলছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে বাংলাদেশের এ ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতের সবগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারই অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হলেও গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারিতার অভাবে বিরোধীদল সমূহের প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনায় ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিপক্কতার কারনেই গণতন্ত্র সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ মুক্ত থাকতে পেরেছে। দেশের রাজনীতিবিদরা পরাশক্তিসমূহের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে অবস্থার উত্তরণ সূদূর পরাহত। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন