ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া নানা জানা-অজানা ও এক্সক্লুসিভ...ষষ্ঠ পর্ব

প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে
রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ  


২৯ অক্টোবর দিনভর আলোচনা বৈঠকসহ নানা ঘটনার পর সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সংবিধানের ৫৮(গ) ৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তার দায়িত্বের অতিরিক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। রাতে বঙ্গভবনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বাংলদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন তাকে শপথ বাক্য পাঠ করান। এ সময় বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, চারদলীয় জোট নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং তার বিদায়ী মন্ত্রি পরিষদের সদস্য, রাজনীতিক, কূটনীতিক, তিন বাহিনীর প্রধান, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং আমন্ত্রিত অতিথীরা উপস্থিত ছিলেন। কেবিনেট সচিব আবু সোলায়মান চৌধুরী শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। দিনভর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে নানা নাটকীয় ঘটনা এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী বিএনপি আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং অপর একজন প্রতিনিধির সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আলোচনা করেন। আলোচনাকালে তিনি সাংবিধানিক পন্থায় সংকট সমাধানের উপায় তাদের কাছে জানাতে চান। সংবিধান অনুযায়ী পঞ্চম বিকল্প হিসেবে সব দল একমত না হওয়ায় সর্বশেষ বিকল্প অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। বেলা প্রায় ৩ টার মধ্যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা পর্ব শেষ হওযার পর বিকেলে বঙ্গভবন থেকে শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যাপারে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো শুরু হয়। দেড় শতাধিক অতিথিকে শপথ অনুষ্ঠানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনেককে টেলিফোনে শপথ অনুষ্ঠানের বিষয়ে অবহিত করা হয়। সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে একে একে অতিথিরা বঙ্গভবনের দরবার হলে আসতে থাকেন। রাত ৮টায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অনুষ্ঠান স্থলে আসেন। রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এরপরই দরবার হলে আসেন এবং শপথ গ্রহনের কার্যক্রম শুরু হয় ৮টা ৫ মিনিটে এবং ৮টা ১২ মিনিটে শেষ হয়। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যসহ অন্য আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে এরপর রাষ্ট্রপতি চা চক্রে মিলিত হন। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এই শপথ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না। তবে চারদলীয় জোট নেতৃবৃন্দের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও স্পীকার ব্যারিস্টার মুহাম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার, সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজ, বিএনপি মহাসচবি ও সাবেক এল জি আর ডি মন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. খন্দকার মোশররফ হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আব্দুল মতিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমিনুল হক, মির্জা আব্বাস, সাদেক হোসেন খোকা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মোরশেদ খান, ড. ওসমান ফারুক, মেজর অব: হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বীর বিক্রম, ড. আব্দুল মঈন খান, জিয়াউল হক জিয়া, এহছানুল হক মিলন, আমান উল্লাহ আমান মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, এ টি এম আজহারুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির (এরশাদ) মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, ডেপুটি স্পীকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ. বিউটেনিস, ভারতের রাষ্ট্রদূত বীনা সিক্রিসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতকিরা উপস্থিত ছিলেন। 


রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তার দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের বিষয়টি নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মহাসচিবের সঙ্গে শপথ গ্রহণের আগের দিন অনুষ্ঠিত বৈঠকে আলোচনা করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল বিষয়টি মেনে নিয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন এবং সন্ধ্যার মধ্যেই উপদেষ্টা পরিষদে তাদের পক্ষ থেকে পাঁচজনের নাম জানাবেন বলে জানিযে দেন। কিন্তু রাতে ১৪ দলের বৈঠকেই বিষযটি উল্টে যায় এবং আওয়ামী লীগ মত পাল্টে ফেলে। তারা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেন। কেবিনেট সচিব আবু সোলায়মান চৌধুরী বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়ে বলেন, এরপরই সংবিধান অনুযায়ী বিকল্প হিসেবে এই চিন্তা করা হয়। শপথ গ্রহণ শেষে রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তার সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, উপদেষ্টা পরিষদের শপথ শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে।


অতীত ফিরে দেখা
তিন যুগের অধিককাল বাংলাদেশের বয়স। এই ৩৬ বছরে প্রত্যাশার তুলনায় বাংলাদেশের অর্জন সমসাময়িক উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর নিরিখে অনেক কম। এর বিবিধ কারণ রয়েছে। গত ৩৬ বছরে প্রথমে ৩ বছর সংসদীয় গণতন্ত্রের পর একদলীয় বাকশাল চলেছে সাত মাসের মতো। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে শহীদ জিয়াউর রহমান দেড় বছর সামরিক শাসনে দেশ পরিচালনা করেন, পরে বহুদলীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে চার বছর দেশ পরিচালনা করেন। এরপর ৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। এরশাদের নেতৃত্বে দেশ চলেছে সামরিক শাসনে ৯ বছর। মোট ১৪ বছর দেশ চলেছে স্বৈরশাসনে। ’৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সর্বস্তরের মানুষের স্বত:স্ফূতভাবে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটে। বলতে গেলে, ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের তিন বছর শাসনামল ছিল মন্দের ভালো। বাকি ১১ বছর ছিল তলাবিহীন। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল্ল এই ১৫ বছর কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে গণতান্ত্রিক সরকার দেশ পরিচালনা করলেও সংসদীয় গণতন্ত্র নিজস্ব ধারায় এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হয় লাগাতার সংসদ বর্জনের কারণে। বিরোধী দলে যারাই থেকেছেন, এই অগণতান্ত্রিক পথটি তারা বেছে নিয়েছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতীয় ইস্যুর সব আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদ। গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটলেও তার পরিচর্যা ও বিকাশসাধনে সংসদভিত্তি গড়ে তোলা হয়নি। যারাই বিরোধী দলে থাকেন কোনো না কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে বা ইস্যু সৃষ্টি করে সংসদ বর্জন করে রাজপথকে বেছে নেন এবং হরতাল, অবরোধ, ঘেরাওসহ নানা রকম ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় দিকগুলোকে নস্যাৎ করে দেয়া হয়। এক দিনের হরতালে আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়­ এই হিসাব অর্থনীতিবিদদের। বিগত ১৫ বছরে যারাই বিরোধী দলে ছিলেন তারা ৬০০ দিনের অধিক হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিয়েছেন এবং দেশের রফতানি খাতগুলোকে ধ্বংস করে দেশকে পিছিয়ে দিয়েছেন­ এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। জনগণের প্রতিনিধিরা (সংসদ সদস্য) জনগণের এবং স্ব স্ব এলাকার দুঃখ-দুর্দশার কথা বলবেন সংসদে বসে। এ কারণেই জনগণ তাদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠানন। 

 কিন্ত– দেখা গেছে, তারা গত ১৫ বছরে সংসদের কর্মদিবসের হিসাবানুযায়ী অর্ধেক সময়েরও বেশি সংসদে অনুপস্থিত থেকেছেন। অনেক সময় কোরাম পর্যন্ত পূরণ না হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিল অধিবেশনে পাস করা যায়নি। এ-ও লক্ষ করা গেছে, দেশের ও জনগণের কথা না বলে সেখানে এমন কিছু বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়, বিশেষ করে দুই মরহুম নেতাকে উদ্দেশ করে, যা সংসদের পরিবেশকে কলুষিত করে তোলে। অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেক সময় নষ্ট করা হয়। 

জোরগলায় গণতন্ত্রের কথা বলা ও সংবিধানের দোহাই হয় সব সময়। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে­ এসব কথাও বলা হয়। কিন্ত– কাজটি করছি বহুক্ষেত্রে গণতন্ত্র, সংবিধান এবং জনগণের মৌলিক চাহিদার পরিপন্থী। এসব কর্মকাণ্ড করছি সংসদকে বাদ দিয়ে রাজপথকে বেছে নিয়ে। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ৩৬৫ দিনের মধ্যে যদি আমরা ন্যূনতম ৫০ দিনও কর্মজীবী মানুষের চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করি, তাহলে ওই ৫০ দিন তাদের রুজি-রোজগারে যে ক্ষতি হলো, পড়াশোনায় যে ব্যাঘাত ঘটল, শিল্প-বাণিজ্যের যে ক্ষতি হলো, তা কিভাবে পূরণ করা যাবে? এই বিষয়টি একশ্রেণীর পেশাজীবী রাজনীতিবিদের মগজে প্রভাব ফেলছে বলে মনে হয় না। কারণ তাদের সন্তান এ দেশে পড়াশোনা করে না। অঢেল টাকার মালিক তারা অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ পথে অর্জিত ওই টাকার মালিক প্রকৃত অর্থে জনগণই। সংসদ বর্জন করে অথবা সংসদে এসে বিতর্কিত কথা বলে শেষ অবধি রাজপথ দখল করে সহিংসতা প্রকাশ করে এবং দলীয় মিডিয়ায় তা সাজিয়ে-গুছিয়ে প্রচার করে, আমাদের দেশের একশ্রেণীর নেতানেত্রীই দেশটাকে পিছিয়ে দিয়েছে। দলবাজি করতে গিয়ে দেশপ্রেম তাদের মধ্য থেকে উধাও হয়ে গেছে। দুঃখজনক যে, এরাই দেশের চালিকাশক্তি।

 ব্রিটিশ আমলে এমনকি পাকিস্তান আমলেও এত সহিংসতা, এত খুন-খারাবি, এত নির্দয় আচরণ দেখা যায়নি। যেমন­ ২৮ নভেম্বর পাঁচজন মেধাবী ছাত্রকে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে গজারী লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা দল করি বলেই তখন ভুলে যাই মানবতা বা মনুষ্যত্ববোধ। সে কারণেই দলের পক্ষে হলে সেটা বাড়িয়ে প্রচার করি। বিপক্ষ দলের লোক হলে প্রচার থেকে বিমুখ থাকি। আমাদের এই দ্বিধাবিভক্ত চরিত্র গত ৩৬ বছর আমাদের শান্তিতে-স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। ’৭১ সালের পর থেকে, অর্থাৎ জন্ম থেকে আমরা জ্বলছি ওই একটি কারণে। এ দেশে যারা অবৈধ উপায়ে কালো টাকার মালিক হয়েছে, ব্যাংক- বীমার মালিক হয়েছে, জিরো থেকে হিরো বনেছে, এরা কারা? জনগণের টাকা আত্মসাৎ করেছে যারা, তারাই বড় গলায় কথা বলছে আজ। ঋণখেলাপি, বিল খেলাপি ওরাই তো। পত্রিকায় উঠেছে, ২০০০ সালের শেষে দেখা গেছে­ ২০০ সংসদ সদস্যের বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের বিল বকেয়া শতাধিক কোটি টাকার ওপর। যারা নির্বাচন কমিশন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারের প্রশ্ন তোলেন তাদের আজ নিজেদের চরিত্রের সংস্কার প্রথমে করা উচিত। দর্পণে নিজের চেহারাটা একবার দেখুন। দল ও দেশ কী দিল সেটা বড় কথা নয়, আমি দেশ ও দলকে কী দিলাম­ এই প্রশ্নটা করুন। দল থেকে ভাগে কম পড়লেই অন্য দলে যোগদান বা ভিন্ন দল গঠন করা­ এটা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ১৮ দলের মোর্চায় এখন যারা আছেন, তাদের কেউ কেউ নাকি এরশাদের স্বৈরশাসনকে বৈধতার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন মোটা অঙ্কের মাসিক ভাতার বিনিময়ে। এদের মধ্যে ডান ও বামপন্থী উভয়ই আছেন।  


এভাবেই রাজনীতি পুঁজিবিহীন একটি সস্তা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। নীতিবোধ, আদর্শ এগুলো এখন অভিধানিক কতগুলো শব্দ মাত্র। রাজনীতিতে স্বার্থের খেলা চলছে। রাজনীতি থেকে নীতিবোধ পালিয়েছে। যেন বুলডোজার দিয়ে রাজনীতি থেকে নীতি-আদর্শ-চরিত্র সবকিছুই উচ্ছেদ করা হয়েছে। না হলে একুশ শতকে এসে দেখতে হতো না শতাধিকের ওপর রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে কয়েক ডজন আছে ‘ইসলামিক দল’। এসব কারণেই মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে রাজনীতিবিদদের ওপর। দলের দোষ-ত্রুটি থাকবে। দলের মধ্যে অবস্থান করেই তার শুদ্ধতার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দল ভেঙে শুধু দলের নয়, নিজের ইমেজও কমছে, দেশেরও ক্ষতি হচ্ছে।  

পত্রিকায় দেখলাম, নগরীর ২৭টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে বিজয় উৎসব মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। ‘বিজয়’টি হলো, বিচারপতি হাসান ও বিচারপতি এম এ আজিজ এই দুজনকে দুটি গুরুত¦পূর্ণ পদ থেকে সরাতে পেরেছেন। এ ধরনের মঞ্চ ’৯৬ সালেও করা হয়েছিল্ল নাম ছিল জনতার মঞ্চ। বিজয় জিনিসটি ভালো। কিন্ত– রাস্তা দখল করে মানুষকে কষ্ট দিয়ে এই বিজয়ের উৎসব কতটুকু যৌক্তিক সেটাও ভাববার বিষয়।  


সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমানের বাসায় আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে একটি মহল হুলস্থুল কাণ্ড ঘটাচ্ছে। বিদায়ী সরকারি কর্মকর্তারা একটি বাসায় দাওয়াত খেতে পারেন, আলোচনা করতে পারেন। এটা গণতান্ত্রিক অধিকার। তারা যদি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্র করে থাকেন, সেটা অপরাধ। এটাই তদন্ত করে দেখার ব্যাপার। পেছনে ফিরে তাকালে এর চেয়েও গুরুতর অপরাধ চোখের সামনে ভেসে উঠবে। ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চে সরকারি চাকরিবিধি অমান্য করে প্রজাতন্ত্রের সচিব ও আমলারা যখন জনতার মধ্যে অবতীর্ণ হয়ে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিলেন (যাকে বলা যায় সরকারের বিরুদ্ধে আমলা অভ্যুত্থান) তখন কিন্ত– মিডিয়া আজকের মতো সরব ছিল না। ঘুরেফিরে সেই একটাই কথা­ আমরা দল করি বলেই দলের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের পক্ষে, জনতার পক্ষে কথা বলতে পারি না।  


দেশের সুশীল সমাজ কিছু দিন পরপরই সরকারের দুর্নীতির খতিয়ান মিডিয়ায় তুলে ধরেন অনেকটা ফ্যাশন শোর মতো। দুর্নীতির পরিমাণ ৫০০ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। প্রশ্ন হলো, ২ সপ্তাহে দেশে ২০ হাজার কোটি টাকার যে ক্ষতি হলো, তা নিয়ে ওরা সরব নয়। গত ১৫ বছরে দুর্নীতি করে যে ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ১৫ বছরে হরতাল ও অবরোধ করে। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের এক সভায় বদরুদ্দীন উমর অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, সামরিক সরকারের চেয়েও নির্বাচিত সরকার অনেক বেশি নির্যাতন ও শোষণকারী। বড় দুটি দল ক্ষমতায় গেলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি।  


কথায় কথা আসে। সাবেক চিফ ইলেকশন কমিশনার আবু হেনা ও এম এ সাঈদ, নির্বাচন কমিশনার সফিউর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি লতিফুর রহমান তাদের নিয়ে বিএনপি অপসারণের কথা বলেছিল কারো কারো। রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপির কথায় কর্ণপাত করেননি। কিন্ত– বিএনপি নির্বাচনে দুই টার্মে জয়লাভ করেছিল। এক টার্মে (১৯৯৬-০১) আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছিল। প্রশ্ন হলো গণতন্ত্রের স্বার্থে কেউই নির্বাচন বয়কট করেনি। হেরে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী কারচুপির প্রশ্ন তুলেছিলেন। জেতার সময় এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেননি। বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। আজ নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের বিরুদ্ধে ১৪ দলসহ আরো কয়েকটি দল আদালতে মামলা পর্যন্ত করেছে। উপদেষ্টাদের নিয়েও বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। উল্টাপাল্টা সংবাদ ছাপানো হচ্ছে উপদেষ্টাদের নিয়ে। নির্বাচন যদি সময়মতো না হয় তাহলে ক্ষতি তো রাজনীতিবিদদেরই। জনগণ দোষারোপ করবে তাদের। হাঁটি হাঁটি পা পা করে যে গণতন্ত্রের শুভ সূচনা ১৯৯০ সালে হয়েছিল, আমাদের ইগোর কারণে তা যদি নস্যাৎ হয়ে যায় তাহলে গণতন্ত্রের জন্য ড. মিলন ও নূর হোসেনের রক্তের সঙ্গে আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছি বলেই সচেতন বিবেক রায় দেবে। এবং তখন গণতন্ত্র ধ্বংসের দায়ভার সব দলকেই বহন করতে হবে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন