১৯৫৭: ১০ মার্চ সৌদি আরবের রিয়াদে এক বনেদি পরিবারে লাদেনের জন্ম। মৃত্যুকালে বয়স ৫৪ বছর। বাবা মোহাম্মদ আওয়াদ ওসামা বিন লাদেন। সৌদি আরবের নামকরা তেল ব্যবসায়ী ও সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্র্ক ছিল তাদের। তার বাবার ২২ স্ত্রীর মধ্যে ১০ম স্ত্রীর একমাত্র সন্তান লাদেন। লাদেনের জন্মর পরপরই ডিভোর্স হয় বাবা-মায়ের। লাদেনের মা পুনরায় বিয়ে করলে লাদেনের সঙ্গী হন আরো চার সৎ ভাই-বোন।
১৯৬৮-১৯৭৬: রিয়াদের আল থাগের মডেল হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন।
১৯৭৪: ১৭ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেন তার সিরিয়াবাসী খালাতো বোন নাজওয়া গেনেমকে। ২০০২ সাল পর্যন্ত লাদেনের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৪ এবং সন্তান ২৬ জন। এছাড়া আরো বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ সন্তান আছে আরো ১২ -১৪ জন।
১৯৭৯: অর্থনীতি, ব্যবসায় ও প্রশাসন বিষয়ে জেদ্দার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইকোনোমিকস স্কুল অব কিং আবদুল্লাজ ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। পড়াকালীন সময়ে জড়িয়ে পড়েন আফগানিস্তান যুদ্ধে।
১৯৮১: পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে ডিগ্রি নেন। পড়াশোনা এসব বিষয়ে করলেও তার প্রবল আগ্রহ ছিল রাজনীতির উপর। ২৩ বছর বয়স থেকে ইসলাম শিক্ষা শুরু হয়। ২৪ বছর বয়সে তখনকার সবচে বড় ইসলামিক স্কলার মুসা আল-কোরানির সঙ্গে পরিচয় হয়।
১৯৮৮ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে বেশ কয়েকজন বড বড় মুসলিম নেতা মিসরীয় ইসলামিক জিহাদ গঠন করে। এ সময় আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দিতেন লাদেন। সেসময় আফগানিস্তান যুদ্ধের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ আগষ্ট জন্ম নেয় আল-কায়েদা নামে একটি গ্রুপ।
১৯৮৯: ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়ত আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার পর এ জিহাদের হিরো হয়ে উঠেন লাদেন।
১৯৯০: সৌদি আরবের সবচে দামি দুটি তেল ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করলে লাদেন পশ্চিমা হামলার হুমকি দেয়।
১৯৯৩ সালে ৫ নভেম্বর নিউ জার্সির ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলা চালায় আল কায়েদা।
১৯৯৭ সালে নর্থ আমেরিকার হামলায় ৬২ জন নিহত হয়।
১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হাইজ্যাক করে। ও হামলার মহড়া দিতে থাকে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়েই যাচ্ছে আল কায়েদা। লাদেনের নেতৃত্বে আল কায়েদা কেনিয়া ও তানজানিয়ার দূতাবাসে হামলা করে। এ হামলায় ২০০ জন নিহত হয়।
১৯৯৯ থেকে এফবিআই-এর তালিকায় শীর্ষ ফেরারি সন্ত্রাসী ছিল।
২০০০ সালের ৩ জানুয়ারি জর্ডানে বোমা হামলা করে।
২০০১: যুক্তরাষ্টের টুইনটাওয়ারে ভয়াবহ বোমা হামলা ঘটায় ৯ সেপ্টেম্বরে। সেখানে ৩ হাজার লোক নিহত হয়। এরপর থেকে পলাতক লাদেন। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল লাদেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকায় পলাতক।
২০১১ সালে ২ মে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অভিযানে পাকিস্তানে নিহত লাদেন।
****************************************************************
ইসলামাবাদে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রায় আড়াই হাজার ফুট দূরেই ১০ লাখ ডলার মূল্যের একটি বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। এখানে তিনি তার স্ত্রী-পুত্রসহ অবস্থান করছিলেন। বিলাসবহুল বাড়িটির সূত্র ধরে সন্দেহ করতে থাকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। এ ভবনে রোববার রাতে মার্কিন সেনাবাহিনীর ছোট একটি দলের অভিযানে নিহত হন আল কায়েদার শীর্ষ নেতা। পাকিস্তানের ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সমপর্যায়ের বিবেচনা করা হয় বলে বিবিসি জানিয়েছে। রাজধানী ইসলামাবাদের উত্তরে আব্বোতাবাদ ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই এর অবস্থান। এলাকাটিতে প্রচুর সেনা ও অনেকগুলো চেকপয়েন্ট রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানায়, পাকিস্তানের স্থানীয় সময় রোববার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টা) এ অভিযান শুরু হয়। মাত্র ৪৫ মিনিটের অভিযানেই নিহত হন লাদেন।
ওই সময় সামান্য উঁচুতে দুই-তিনটি হেলিকপ্টার উড়ে যাওয়ায় কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এলাকাবাসীরা। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভেতরেই একটি বড় তিনতলা ভবন ছিল অভিযানের লক্ষ্য। ভবনটির বাইরে হেলিকপ্টারগুলো অবতরণ করে। হেলিকপ্টার থেকে নেমে সেনারা পশতু ভাষায় স্থানীয়দের সঙ্গে কথাও বলেন। এরপর বাতি নিভিয়ে ঘরের ভেতর থাকতে বলা হয় স্থানীয় বেসামরিক লোকজনকে । কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় গোলাগুলি। এ সময় স্থানীয়রা একটি হেলিকপ্টারে আগুন লাগতে দেখেছেন।
প্রায় ৯ হাজার বর্গফুট জমির ওপর ওই তিনতলা ভবনটির অবস্থান। চারদিকে ১৪ ফুট উঁচু দেওয়াল। তাই ভেতরে কী হচ্ছিল তা দেখেনি স্থানীয়রা। দেয়ালে কাঁটাতারের বেড়া ও বিভিন্ন পয়েন্টে ছিল ক্যামেরা। বাড়ির প্রবেশফটক ছিল দুটি। তবে টেলিফোন বা ইন্টারনেটের সংযোগ ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, অভিযান শেষে সেনাদের ওই চত্বর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। এ সময় তারা অন্য কাউকে নিয়ে আসছিল কি-না তা বোঝা যায়নি। তবে কয়েকজন নারী ও শিশু ওই ভবনে ছিল বলে স্থানীয়রা জানায়। ১০-১২ বছর আগে ওই বাড়ি নির্মাণ করেন এক পশতু ধনকুবের। এরপর ওই বাড়িতে কারা থাকত, তা নিয়ে স্থানীয়দের কোনো ধারণাই ছিল না। অভিযান শেষে পাকিস্তানি সেনারা সেখানে যায় এবং অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নেয়
****************************************************************
বুশের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করলেন ওবামা। দীর্ঘ এক দশকের অভিযান শেষে যবনিকা পড়ল লাদেন অধ্যায়ের। মার্কিন গোয়েন্দাবাহিনী সিআইএ, মার্কিন বিশেষবাহিনী ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর যৌথ অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন। গতকাল সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে লাদেনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামার ঘোষণার ঘণ্টাখানেক আগেই এক মার্কিন সেনার বরাত দিয়ে বিবিসি, সিএএন, এপি, ওয়ালস্ট্রিট জার্নালসহ আরো অনেক গণমাধ্যম প্রচার করেছে খবরটি। ডিএনএ পরীক্ষা করেই লাদেনের মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানায় এবিসি নিউজ।
লাদেন সপরিবারে ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরের আব্বোতাবাদ শহরের একটি ভবনের ভেতরে ছিলেন বলে জানা গেছে। রোববার গভীর রাতে গোলাগুলির সময় ঘটনাস্থলে আইএসআই-এর সদস্যরাও উপস্থিতি ছিলেন বলে সংস্থাটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। তবে এক মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লাদেন হত্যায় কোনো সহায়তা করেনি আইএসআই। গোলাগুলি হয়েছে টানা ৪০ মিনিট। এ সময় লাদেনের মাথায় গুলি লাগে। হামলায় লাদেনের এক নারী দেহরক্ষীসহ মারা গেছে মোট ৫ জন। এদের মধ্যে লাদেনের ছেলে থাকতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
অভিযানের সময় যান্ত্রিক ত্র“টির কারণে বিধ্বস্ত হয় মার্কিন বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার। তবে এতে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেনি। দুর্ঘটনার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে হেলিকপ্টারটি ধ্বংস করে দেয় মার্কিন সেনারা। টুইন টাওয়ার হামলার পর-পরই যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার শীর্ষে ছিলেন ওসামা। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় ২০০৭ সাল থেকে আফগানিস্তানের যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের প্রায় ৫ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। আর সব মিলিয়ে এ খরচ ২০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশাল অংকের খরচের পর অবশেষে সফল হল যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে, লাদেনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ায় মার্কিন ও অস্ট্রেলীয় শেয়ারবাজারের চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে। এদিকে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে লাদেনের মৃত্যু ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওবামা মার্কিনীদের সতর্ক করে বলেন, লাদেনের মৃত্যু হলেও আল কায়দা যুক্তারাষ্ট্রে হামলা অব্যাহত রাখবে। হোয়াইট হাউজে আকস্মিক ভাষণে ওবামা বলেন, লাদেন গোটা বিশ্বে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। হাজার হাজার নিরপরাধ নারী-পুরুষ ও শিশু হত্যা করেছে। তার মৃত্যু হলেও আল-কায়দার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলবে। ওবামা আরো বলেন, আল কায়দা যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পরিকল্পনা করবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গে সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানান ওবামা।
সমাধিস্হল সন্ত্রাসীদের তীর্থ¯স্হান হতে পারে আশঙ্কায় সাগরে সমাহিত লাদেন:
ওসামা বিন লাদেনের সমাধিস্হল যেন সন্ত্রাসীদের তীর্থ স্হান হয়ে না উঠে সে কারণে লাদেনের মরদেহ সাগরে সমাহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এক মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে, আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানে নিহত হওয়ার পর তার মরদেহ প্রথমে আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তা সাগরে দাফন করা হয়। অবশ্য মার্কিন সরকার আনুষ্ঠানকিভাবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানায়নি। কয়েকটি ইসলামী ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান লিখেছে, বিশেষ পরিস্হিতিতে মুসলিমদের মরদেহ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার বিধান রয়েছে। যেমন সমুদ্রে দীর্ঘযাত্রায় কেউ মারা গেলে অথবা শত্রুপক্ষ কবর থেকে লাশ তুলে নিতে পারে, এমন আশঙ্কা থাকলে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বিন লাদেনের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র একই যুক্তি দেখাতে পারে বলে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। লাদেনের মরদেহের ভাগ্যে কী ঘটবে, তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রশ্ন ওঠার পর যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ইসলামী রীতি অনুযায়ীই তাকে দাফন করা হবে। এত অল্প সময়ে মরদেহ সমাহিত করা হলে লাদেনের মৃত্যু নিয়েই যে সন্দেহ তৈরি হতে পারে, তা-ও জানা ছিল তাদের। এ কারণে মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব দাফন করার ইসলামি বিধানের উদ্ধৃতি টানছেন তারা। বলছেন, কাউকে সাগরে দাফন করার ঘটনা বিরল হলেও ইসলামি আইনের পরিপন্হী নয়। নামপ্রকাশ না-করে এক মার্কিন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীর মরদেহ নিতে চায়, এমন দেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন