পরদিন ১৭ ডিসেম্বর আইয়ুব খান তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমাদের বাহিনীর আত্মসমর্পণে ইসলামাবাদ ও পিন্ডিতে বসবাসরত বাঙালিরা আহ্লাদিত হয়ে মিষ্টি বিতরণ করছে। কিন্তু খুব শিগগির তারা মিষ্টির বিষাক্ত স্বাদটি টের পাবে।...যুদ্ধবিরতির (আত্মসমর্পণ) বিরোধিতা করে করাচি, লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডিতে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। দেশকে এই অচলাবস্থায় ঠেলে দেওয়ার জন্য জনগণ ইয়াহিয়াকে ও রাজনৈতিক নেতাদের দায়ী করে গালাগাল দিচ্ছে। এখন ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করায় তারা আমাকেও দোষ দিচ্ছে। আমি কী করতে পারতাম? ইয়াহিয়া ছিলেন সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ। আমি জানি, মাদকাসক্তি মানুষের ব্যক্তিত্ব বদলে দিতে পারে। গুজব শুনছি, ইয়াহিয়াকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পেশোয়ারে তাঁর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
আইয়ুব খানের ডায়েরির এর পরের দিনের ভাষ্য, ‘নিশ্চিত হওয়া গেছে ক্ষুব্ধ জনতা ইয়াহিয়ার বাড়ি ও আসবাব আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। এটা দুঃখজনক ও বাজে একটা নজির। আভাস পাওয়া যাচ্ছে, ইয়াহিয়াকেও পদত্যাগ করতে হতে পারে। তাঁর ওপর চাপ বেড়েই চলেছে। জনগণ ভুট্টোর বিরুদ্ধেও সোচ্চার। তারা মনে করে, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোই বাংলাকে ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে নিজেরা যখন করতে পারেননি, তাঁরা চেয়েছেন ভারত এসে সামরিক প্রক্রিয়ায় বাংলাকে বের করে নিক। দুজন তাঁদের ব্যক্তিস্বার্থে আমাদের চমৎকার এই সেনাবাহিনীকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিলেন।’
ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে ২১ ডিসেম্বর নিজের ডায়েরিতে আইয়ুব খান লিখেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও আনুগত্যহীনতার পরও যে পরিস্থিতিতে, যে অবস্থায় তাঁকে চলে যেতে হলো, তার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে!’ ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ইয়াহিয়া।
ইয়াহিয়ার লজ্জাজনক বিদায় দৃশ্যত উপভোগই করলেন আইয়ুব খান। ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব রণাঙ্গনে যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব দম্ভ ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু আইয়ুব খানের লেখায় তা-ই যেন পাকিস্তানের সেনানিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার রাজনীতিতে তাঁর জন্য এক ধরনের সূক্ষ্ম বিজয়। তবে বাঙালিদের কাছে আইয়ুব-ইয়াহিয়া সব সময়ই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাঁর ডায়েরিতেও সে চিত্র পাওয়া যায়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ডায়েরিতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘...ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেছেন, যেহেতু তাঁদের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, তাঁরা এককভাবেই আগামীকাল সন্ধ্যা সাতটা ৩০ মিনিট থেকে যুদ্ধবিরতি করতে যাচ্ছেন। আমার ধারণা, এই পরিবর্তিত শান্তিবাদী ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বজনমতকে প্রতারণা করে কিছুটা সময় বের করে পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিম সীমান্তে সেনা নিয়ে আসাই তাঁদের লক্ষ্য। যদিও এটারও প্রমাণ আছে যে তাঁরা এখন থেকে সেনা উঠিয়ে চীন সীমান্তে মোতায়েন করছেন। আসলে চীনের তেমন কিছুই করতে হবে না। চীন হিমালয় সীমান্তে কিছুসংখ্যক সেনাসমারোহ ঘটালেই ভারতকে পূর্ব সীমান্তে পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েন করতে হবে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর চাপ কমে আসবে।’
আইয়ুব খান আরও লিখেছেন, ‘এটি পাকিস্তানের জন্য একটি কালো দিন, কেবল যে সাড়ে ছয় কোটি মুসলমানের একটি প্রদেশ ভারতীয় প্রভাব-বলয়ে চলে গেল তা নয়, আমাদের অত্যন্ত চমৎকার সেনা ডিভিশন, কিছু বিমান ও নৌশক্তিও হাতছাড়া হয়ে গেল। তাদের কেমন করে ভারতের কাছ থেকে মুক্ত করা হবে, সেটাই বড় চিন্তা। এই জিম্মিদের ছাড়িয়ে আনতে গেলে ভারত বড় একটা বিনিময়মূল্য চেয়ে বসবে।’
আইয়ুব খানের মতে, পাকিস্তান থেকে বাংলার এই ভাগ হয়ে যাওয়া যদিও কষ্টকর, কিন্তু এটাই ছিল অনিবার্য ও অপরিহার্য। সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তান তাঁদের শত্রু। তিনি বলেন, ‘আমার আফসোস, আমাদের শাসকেরা যদি এটা বুঝতে পারতেন এবং ভারতকে দিয়ে এই ব্যবচ্ছেদ করানোর চেয়ে শান্তিপূর্ণভাবেই বাঙালিদের যদি বেরিয়ে যেতে দিতেন, সেটা ভালো হতো।’
আইয়ুব খান লিখেছেন, ‘...এই বেদনা সইতে আমাদের অনেক সময় লেগে যাবে। কিন্তু ভারতীয় উল্লাসও শিগগিরই মিলিয়ে যাবে। যে সমস্যার মোকাবিলা তাদের করতে হবে, তা ভয়ংকর। যোগাযোগব্যবস্থা—রেল, সড়ক, নৌ যেভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে। শরণার্থীদের পুনর্বাসন করতে হবে। খাদ্যঘাটতির বিষয়টি দেখতে হবে, ৩০ লাখ টন খাবারের জোগান দিতে না পারলে বড় ধরনের খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। যুদ্ধের কারণে সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে ও শিল্পকারখানা যেভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল অঙ্কের অর্থ। এটা ভারত কুলিয়ে উঠতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। বাঙালি শিগগিরই বুঝতে শুরু করবে, পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা কিনে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বড্ড বেশি দাম দিতে হয়েছে।’
আইয়ুবের লেখায় তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁদের চিরাচরিত অবজ্ঞাও ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, ‘...প্রত্যাশা এই যে, মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ বেশি দিন টিকবে না। কমিউনিস্টরা তাদের টপকে যাবে এবং শিগগিরই তারা হাত মেলাবে নকশাল ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য কমিউনিস্টের সঙ্গে।’
আইয়ুব খান বাঙালি ও বাঙালি নেতৃত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত হীন ধারণা পোষণ করতেন। তবে ভুট্টোর প্রসঙ্গ এলেই তিনি প্রতিবার খেপে উঠেছেন। খোলামেলাভাবে লিখেছেন, ‘ভুট্টো যত দিন থাকবে, পাকিস্তানে তত দিন শান্তি আসবে না।’ ইয়াহিয়া খানের মদ ও নারী আসক্তির কথা তিনি একাধিকবার বলেছেন এবং পাকিস্তানের দুরবস্থার জন্য উভয়কেই দায়ী করেছেন।
২১ নভেম্বর আইয়ুব খান লিখেছেন, ‘একজন কূটনীতিবিদকে উদ্ধৃত করে টাইম ম্যাগাজিন-এর একটি অনুচ্ছেদ পড়ে আমি ভীষণ লজ্জিত হই: “পাকিস্তান এমনিতেই একটি ডুবন্ত কুকুর। ভারতের আর এর মাথা চেপে ধরার দরকার নেই।” শুনেছি, নিউজ উইক-এ পাকিস্তানের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। পাকিস্তানে নিষিদ্ধঘোষিত এ সংখ্যায় ইয়াহিয়া খানের ১০ জন বান্ধবী, তাঁদের কর্মকাণ্ড এবং ইয়াহিয়ার ওপর তাঁদের প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।’
গোটা ১৯৭১ সালই আইয়ুব খান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। ইয়াহিয়া খানের ব্যর্থতাগুলো তাঁর সামনে একটার পর একটা ধরা পড়েছে। ইয়াহিয়ার জায়গায় তিনি থাকলে কী করতেন, সে কথাও কখনো কখনো আইয়ুব বলেছেন। ইয়াহিয়া কেন জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দিয়ে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানাচ্ছেন না, সে জন্য তিনি আক্ষেপ করছেন। যুদ্ধের শুরুতেই তিনি আশঙ্কা করেছেন, ঢাকা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
আইয়ুব খানের ১৭ ডিসেম্বরের লেখায় আছে, সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তি ডিসেম্বরের প্রথম দিনই তাঁকে এসে বললেন, জনগণ ভুল বুঝতে পেরেছে, এমনকি যারা আইয়ুবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ করেছিল, তারাও এখন সবাই আবার তাঁকে ফিরে চায়।
ক্ষমতাহারাদের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার বাসনা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে এটুকু সম্ভবত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আইয়ুবের হাতেই ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাও লন্ডনের নির্বাসিত জীবনে প্রতিদিনই নাকি প্রত্যাশা করতেন, তাঁর আবার ডাক পড়ছে, তিনি আবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। একসময় তিনি এক মাসের জন্য নিজ দেশে ফিরতেও চেয়েছিলেন। অনুমতি পাননি। ১৯৬৯-এর ১৪ নভেম্বর মৃত্যুর পর মির্জার মরদেহ ইরানে নেওয়া হয়েছিল এবং সেখানেই তাঁর দাফন হয়েছে। পাকিস্তান তাঁর মরদেহও কবুল করেনি।
আশার কথা, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ এখন তার ৪০ বছরের দ্বারপ্রান্তে। স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে এবং উন্নয়নের অধিকাংশ সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন