এই ঢাকা সেই ঢাকা
ঢাকা শহর আইসা আমার পরান জুড়াইছে..
নাল নীল নাল নীল বাত্তি দেইখা
আশা পুরাইছে...।
ছোট বেলায় এই গানটি গাইতাম আর স্বপ্ন দেখাতাম ঢাকা যাবার। এখন বড় হয়েছি। ঢাকায় থাকছি। সেই সময়ের ঢাকা এখন পুরোটাই পাল্টে গেছে। ঢাকার এই পরিবর্তন নিয়েই এবারের রচনা।
দুই
৫০০ বছর আগে ঢাকা একটি শহর ছিল। সেখানে মোগল রাজধানী স্থাপিত হয়েছে এমন একটি ধারণা মানুষের মধ্যে রয়েছে। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। শহর বলতে আমরা এখন বুঝি অনেক লোক, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, শিক্ষার সমাবেশ, সাফল্যের কেন্দ্রস্থল। কিন্তু আগে সেই অর্থে শহর ছিল না। আগে ছিল বন্দর ও বাজার। আমাদের সভ্যতার ধারণাটা ছিল গ্রামভিত্তিক। ঢাকা ছিল একটি গ্রাম। সোনারগাঁও রাজধানী হওয়া সত্ত্বেও তা গড়ে উঠেছিল গ্রামকে কেন্দ্র করেই। ঢাকায় রাজধানী হওয়ার পর সোনারগাঁ আবার গ্রাম হয়ে যায়। বাজার হিসেবে ঢাকা অবশ্যই অনেক পুরনো। ঢাকায় সুলতানি আমলের টাঁকশালের বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে। সে যুগে বিভিন্ন স্থানে টাঁকশালের বিজ্ঞাপন দেয়া হতো, পাথরের স্তম্ভের ওপর লেখা হতো ঢাকায় টাকা পাওয়া যায়। সব জায়গায় টাকার প্রচলন ছিল না। বিনিময় হতো দ্রব্যাদির মাধ্যমে। বড় বাজার ছাড়া শহর বলতে তখন আর কিছু ছিল না। এর আগে ঢাকার অস্তিত্ব ছিল শুধু গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার বা ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে।
তিন
মোগলরা ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করে ১৬০৮ বা ১৬১০ সালে । সুনির্দিষ্ট কোন তারিখ নেই। মির্জা নাথান রচিত ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবি’ গ্রন্থের একটি উৎস থেকে জানা যায় ১৬০৮ সালে সোনারগাঁয়ের পতন হয়। সোনারগাঁ যাতে আর জেগে উঠতে না পারে সেজন্য এর কাছাকাছি ঢাকায় ছাউনি গাড়া হয়। এ জায়গা থেকে মোগলরা শাসনকাজ শুরু করে। তখন থেকেই রাজধানীর কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়।
চার
অনেক আগে থেকেই জনবসতি ছিল তা আরও প্রমাণ হয় উয়ারি-বটেশ্বরে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের ফলে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে এগুলো দুই হাজার বছর আগের। সেখানকার মাটি লাল। ঢাকার মাটিও লাল। অর্থাৎ জায়গাটি পলিমাটি দিয়ে গঠিত হয়নি, গঠিত হয়েছে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়। ঢাকায় একটা মাত্র বাজার আছে যা পুরনো চরিত্র ধারণ করে এখনও রয়েছে এবং সেটা হল বাবুরহাট। সেখানে এখনও সপ্তাহে একদিন বাজার বসে। ঢাকা শহর বলতে ছিল এই বাবুরহাট-এক হাজার-দেড় হাজার বছর আগে থেকেই বাজার হিসেবে এর অস্তিত্ব ছিল।
মোগল সুবাদার এসে আস্তানা গাড়ার পর থেকেই ঢাকা শহর হিসেবে গড়ে ওঠে। এরপর থেকে তা বিরতিহীনভাবে শহর হিসেবে থেকেছে। তবে ঢাকার জনসংখ্যা ও গুরুত্ব কখনও বেড়েছে, আবার কখনও কমেছে। যেমন, ঢাকা থেকে যখন রাজধানী মুর্শিদাবাদে চলে যায়, তখন ঢাকার গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। কিন্তু শহর হিসেবে, ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে এর গুরুত্ব থেকে যায়।
পাঁচ
একদম শুরু থেকে ঢাকা যে বৈশিষ্ট্যটি ধরে রেখেছে তা হল এর বাণিজ্য। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এর বাণিজ্যিক চরিত্র চিরকাল অটুট থেকেছে। বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল বা বাজার হিসেবে এর গুরুত্ব কখনও কমেনি। সব সময় পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে এর গুরুত্ব ধরে রেখেছে। ঢাকার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল: বয়সের অধিকাংশ সময় এটা রাজধানী ছিল না। কিন্তু শহর হিসেবে টিকে ছিল, বজায় ছিল এর নাগরিক গুরুত্ব। আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল: ঢাকার নাগরিক। মোগল আমলে ঢাকার জনসংখ্যার বেশিরভাগ ছিল মুসলমান। মোগল আমলের পর অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কোম্পানি আমলে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য নানা কারণে আর্মেনীয় ও পারসীয়দের হাত থেকে চলে যায় স্থানীয় হিন্দু বণিকদের হাতে। এর কারণ মুসলমানরা সে সময় ইংরেজদের সহযোগিতা না করে প্রতিরোধ করছিল। প্রতিরোধ অবশ্য হিন্দুরাও করছিল। তবে অর্থনীতিটা চলে যায় হিন্দু বণিকদের হাতে। এরপর ধীরে ধীরে হিন্দুদের আধিপত্য শুরু হয়। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এটা সম্পূর্ণ হিন্দু অধ্যুষিত শহর হয়ে যায়। কিন্তু ১৯০৫ সালে ঢাকা আবার রাজধানী হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান জনসংখ্যা প্রায় সমান হয়ে যায়। এরপর ধীরে ধীরে মুসলমানদের প্রাধান্য ঘটতে থাকে এবং ১৯৪৭ সালের মধ্যে ঢাকা মুসলমান অধ্যুষিত শহরে পরিণত হয়।
ছয়
বাকরখানি পুরান ঢাকার ঐতিহ্য। পুরান ঢাকার অধিবাসীদের অনেকেই তাদের সকালের নাস্তা শুরু করেন মিষ্টি বা মাংসের সাথে বাকরখনি দিয়ে। অনেকে চায়ের সাথেও খান। বাকরখানি ময়দা, তেল, পানি ও খানিকটা সোডা দিয়ে তৈরি হয়। অনেকটা রুটি বানাবার মতোই উপাদানগুলো মিশিয়ে ভালোমতো মাখিয়ে খামির তৈরি করা হয়। সেই খামির ছোট ছোট রুটির আকারে বেলে, মাঝখানে দুটো দাগ কাটা হয়। তারপর বিশেষ চুলার ভিতরে সেগুলোকে গরম করা হয়। গরম করার পরে বাকরখানি শক্ত হয় তবে অল্প চাপেই দিলেই ভেঙ্গে ঝুরঝুরা হয়ে যায়। প্রতিটার দাম এক থেকে দুই টাকা। অনেক ধরনের বাকরখানি পাওয়া যায়। মিষ্টি (চিনি দেওয়া), নোনতা, পনিরের, ঘিয়ের, মাংসের আরো অনেক অনেক রকম। ঘি, পনির, মাংস ইত্যাদির হলে দাম বেশি হয়।
সাত
বাকরখানির নামকরণের ইতিহাস একটু জটিল। মুঘল আমলে মুর্শিদকুলি খানের ছেলে আগা বাকর খান নর্তকি খানি বেগমের প্রেমে পড়েন। খানি বেগমের জন্য আগা বাকর মুর্শিদকুলি খানের উজিরের ছেলের সাথে যুদ্ধ করেন, বাঘের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। এই সব মারামারিতে একপর্যায়ে খানি বেগম নিহত হয়। আগা বাকর খান ও খানি বেগমের প্রেম কাহিনীর ইতি ঘটে তখনই। তবে পুরান ঢাকাবাসি তাদের নামকে ধারণ করেছে ঐতিহ্যবাহী খাবার বাকরখানির মাধ্যমে।
আট
ঐতিহাসিক ঢাকার অনেক আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য থাকলেও আজ আধুনিক ঢাকার ছোঁয়ায় তা অনেকটাই বিলীন। তবুও আজকের পুরান ঢাকা নামে পরিচিত অতীতের ঢাকা শহরে এসব আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ কিছু কিছু চোখে পড়ে। খাদ্য ও রান্নাবান্না সম্পর্কিত খ্যাতি বিদেশী খাদ্য এবং রান্নাবান্নায় পারদর্শিতার ক্ষেত্রে ঢাকার খ্যাতি গত কয়েক শতাব্দী ধরে অক্ষুন্ন রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী মোগল রন্ধন প্রণালী যেমন পোলাওভাত, বিরিয়ানী, বাকরখানি এবং বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টান্ন এ এলাকার সুখ্যাতি ধরে রেখেছে। পুরান ঢাকার পুরুষরা ধুতি, লুঙ্গি, শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি এবং মহিলারা শাড়ি সালোয়ার, কামিজ ও পর্দা হিসাবে বোরখা ব্যবহার করে থাকে। হিন্দু মেয়েদের মধ্যে শাখা, সিঁদুর, বাজু ইত্যাদির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ঢাকার বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় সনাতন বাহনগুলো হল পাল্কি, গরু ও ঘোড়ার গাড়ি, গয়না নৌকা, সাম্পান নৌকা ইত্যাদি। এর মধ্যে পুরান ঢাকার রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি এবং বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকার চলন দেখা যায়। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্পের মধ্যে তাঁত, কাঁসা ও পিতল, সেলাই কাজ, বাঁশ ও বেতের কাজ, স্বর্ণকার, কামার, কুমার কাঠের কাজ, হস্তলিপি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মসলিন একসময় সারা বিশ্বে সমাদৃত ছিল কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় এ শিল্প বন্ধ হয়ে যায়। এখানকার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ঢাকাবাসীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাইতো পরবর্তীতে ঢাকাকে কেন্দ্র করে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেমন, শিল্পকলা একাডেমী, নজরুল ইনষ্টিটিউট, বাংলা একাডেমী, চারুকলা ইনষ্টিটিউট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ইত্যাদি। ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার ব্যতিক্রমী পরিচয় আজও অনেকটা উজ্জ্বল বলতে হবে।
শেষকথা
বর্তমানের ঢাকা অনেকটাই রোবটের মতো। এখন ঢাকাকে বলা হয় যানজটের শহর। পরিবেশের ক্ষেত্রেও দূরাবস্থা বিরাজ করছে। তবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আর তার বাস্তবায়ন করা গেলে এই ঢাকাই হয়তো একদিন সেই ঢাকার পরিবেশে ফিরে যেতে পারে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন