
একাত্তর সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর এক অকথ্য গণহত্যা চালায়। হাজার হাজার মানুষকে তারা রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। যে হত্যা থেকে বাদ যায়নি নারী, শিশু, বৃদ্ধও। এসব হত্যাকাণ্ডের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু তাত্ক্ষণিক প্রতিরোধের শক্তি-সামর্থ্য ছিল না এদেশের জনগণের। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা পরিস্থিতি বিবেচনায় আত্মগোপনের কৌশল নিয়েছিলেন। নিরীহ জনগণের সামনে ছিল না কোনো দিকনির্দেশনা। এই অসহায়ত্বের ভার গিয়ে পড়েছিল বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও। যেখানে অবস্থান করছিল আমাদের অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। তখন রাত আনুমানিক ১১টা। অষ্টম ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক কর্নেল জানজুয়া মেজর জিয়াউর রহমানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বন্দরে যাওয়ার জন্য। আকস্মিক ও রহস্যজনক এই নির্দেশের অর্থ মেজর জিয়ার বোধগম্য হয়নি। রাত ১১.৩০ মিনিটের দিকে জানজুয়া নিজে এসে তাকে নৌবাহিনীর একটি ট্রাকে তুলে ষোলশহর থেকে বন্দরের দিকে রওনা দেন। জিয়াকে তখন রাস্তার ব্যারিকেড সরিয়ে সরিয়ে যেতে হয়। আগ্রাবাদে একটি বড় ব্যারিকেডের কারণে ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ে। এ সময় পেছন থেকে ছুটে আসে একটি ডজ গাড়ি। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী ওই গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে যান মেজর জিয়ার কাছে। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যান রাস্তার ধারে। খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে বলেন, পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে। শহরে বহু লোক হতাহত। তার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর থেকে আরেকটি কথা ঝরে পড়ে। 'কী করবেন জিয়া ভাই এখন?' খালেকুজ্জামানের কথা শুনে গভীর চিন্তায় তলিয়ে যান মেজর জিয়া। তারপর বজ্রনির্ঘোষে বলে ওঠেন ; 'উই রিভোল্ট।' এই বিদ্রোহ ঘোষণার পর বিদ্রোহী মেজর জিয়ার সামরিক সাহসিকতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সমন্বয়ে শুরু হওয়া এক একটি নির্দেশনা ও প্রচেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য ও সাফল্যমণ্ডিত করে তোলে। তিনি তার বিদ্রোহকে শক্তি হিসেবে ধরে নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড জেনেও পশ্চিমাদের গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তার সহযোগীদের নিয়ে উল্টো পাকসেনাদের গ্রেফতার ও ধ্বংসের জন্য সামরিক যুদ্ধ সূচনার পথে অগ্রসর হতে থাকেন। জিয়া সঙ্গে সঙ্গে খালেকুজ্জামানকে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্সে ফিরে যেতে বলেন। তিনি তার মাধ্যমে অলি আহমদকে নির্দেশ পাঠান ব্যাটালিয়নের সব বাংলাভাষী সেনাকে প্রস্তুত করতে। একই সঙ্গে আরও নির্দেশ পাঠান ব্যাটালিয়নের সব পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের। খালেকুজ্জামান যাওয়ার পর জিয়া ফিরে যান ট্রাকে। ট্রাকে তার সঙ্গে ছিল একজন পাকসেনা কর্মকর্তা। তাকে তিনি বলেন, হুকুম বদলে গেছে। বন্দরে যেতে হবে না। আর সঙ্গে থাকা এদেশীয় সেনা যারা তার সঙ্গে ছিলেন, তাদের ইশারায় বলেন, অস্ত্র লোড করে রাখতে। প্রয়োজন হতে পারে। তারা ফিরে যান ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্সে। সেখানে পৌঁছেই তার নেতৃত্বে শুরু হয়ে যায় হানাদার গ্রেফতারের পাল্টা প্রক্রিয়া। তিনি সেখানে থাকা পাকসেনা কর্মকর্তা ও নৌসেনাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। এ আদেশ শোনামাত্রই তারা হতভম্ব হয়ে যায়। কিন্তু জিয়ার দৃঢ়চেতা ও লড়াকু দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হতচকিত পাকিস্তানি সবাই আত্মসমর্পণ করে। জিয়া এখানেই না থেমে একাই একটি গাড়ি নিয়ে কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জানজুয়ার বাড়িতে যান। কলিংবেল টিপতেই কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে আসে জানজুয়া। জিয়াকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। তার ধারণা ছিল জিয়া বন্দরে বন্দি আছেন। জিয়া তখন জানজুয়াকে নিয়ে আসেন ষোলশহরে। জিয়া জানজুয়াকে তারই ব্যাটম্যানদের দ্বারা গুলি করে হত্যা করান। গণহত্যার প্রতিশোধ ও প্রতিরোধ শুরু হয়ে যায় এভাবেই। যেখান থেকে পিছু হটে যাওয়া যেমনি জিয়ার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তেমনি পাক হানাদারদেরও আর বাধাহীনভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জিয়ার এই একক অসীম সাহসিকতার প্রমাণ পাই এভাবে, '২৫ মার্চ মুজিবকে গ্রেফতারকারী দলের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জেড এ খানের সাক্ষ্য থেকে। তিনি লিখেছেন, '২৫ মার্চ রাতেই জিয়া তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্নেল জানজুয়াকে ঘুম থেকে জাগিয়ে রাতের পোশাকেই তার সঙ্গে বন্দি করে নিয়ে যান। অফিসের চেয়ারে বসিয়ে জিয়া জানজুয়ারই ব্যাটম্যানদের দ্বারা তাকে গুলি করে হত্যা করান। এই মুহূর্তের পর, জিয়ার পেছনে যাওয়ার উপায় ছিল না।' এই দুঃসাহসিক ঘটনা প্রকাশ পাওয়া শুরু করলে একদিকে পাকসেনারা যেমন কাবু হয়ে পড়তে থাকে, অন্যদিকে মুক্তিসেনাদের মনোবল হয়ে যায় আপসহীন। জিয়া তার বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ আক্রমণ রাজনৈতিক নেতাদের জানানোর জন্য তাদের ফোন করেন। কিন্তু কোনো নেতাকে তিনি তখন পাননি। শীর্ষ নেতাদের মতো সেখানকার নেতারাও সেদিন আত্মগোপনের নিদারুণ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তখন জিয়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জে তার বিদ্রোহের কথা জানান। এক্সচেঞ্জের অপারেটর সানন্দে তার এই বিদ্রোহের বাণী প্রকাশে রাজি হয়ে যান।
এদিকে খালেকুজ্জামান ও অলি আহমদরা জিয়ার নির্দেশনার পর পরই ষোলশহরের বিপ্লবী উদ্যানে বাংলাভাষী ৩০০ সেনাকে সমবেত করেন। তখন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর রাত ২.৩০ মিনিট। সেখানে সেনারা জিয়ার বিদ্রোহ ও পাকসেনা বধকে অগ্রসরমাণ রেখে স্বাধীনতার যুদ্ধ সূচনা করতে তাত্ক্ষণিকভাবে ৪৫ গ্যালনের ড্রাম দিয়ে একটি সৃজনশীল ঘোষণামঞ্চ তৈরি করে। জিয়া সেখানে উপস্থিত হয়ে সেই মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বিদ্রোহীকণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'আমরা বিদ্রোহ করেছি। দেশের স্বাধীনতার জন্য আমরা যুদ্ধ করব। আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করব।' ঘোষণাটির মাধ্যমে মুক্তিসেনারা সেখান থেকে তাদের যুদ্ধ সূচনা করেন। এই বিপ্লবী কর্মযজ্ঞ দ্রুতই চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। জিয়া তখন সৈন্য নিয়ে কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে অবস্থিত বেতারকেন্দ্র দখলের নির্দেশ দেন। ভোর ৬টার দিকে তিনি তার সঙ্গে থাকা সেনাদের স্বাধীনতা শপথ পাঠ করান। শপথে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার।' সেখান থেকে জিয়া পাক বাহিনীকে অস্থির রাখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রণকৌশল অবলম্বন করেন। ২৬ মার্চ সারাদিন যুদ্ধের মানসিকতায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাটান। তার শুরু করা যুদ্ধের খবর পেয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা বাজারগলি ও রেলস্টেশন সংলগ্ন পাড়া-মহল্লা থেকে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসেন। দুপুর আড়াইটার দিকে জিয়ার ঘটনাবলির প্রবহমান ধারায় বেতারকর্মী বেলা মোহাম্মদের সহযোগিতায় আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, হান্নানসহ আরও ব্যক্তিরা একটি বুলেটিন প্রচার করেন। তাদের এই বুলেটিন প্রায় সাড়ে চারটা পর্যন্ত প্রচার হলেও, পাকিস্তানি সেনারা তো নয়ই, এমনকি এদেশের মানুষের কারও মনেই কোনো ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারেনি। তারা এ কাজটিতেও ব্যর্থ হয়ে, ২৫ মার্চের বিদ্রোহ ঘোষণাকারী ও ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণাকারী মেজর জিয়াউর রহমানের মুখাপেক্ষি হন। যদিও সেখানে আরও পদবিধারী সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। জিয়া তাদের এহেন ব্যর্থতার কথা শুনে উদ্বিগ্ন হন। তখন তিনি নিজে দ্বিতীয়বারের মতো (আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম) স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য অগ্রসর হন। তিনি ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় বেতারকেন্দ্রে এসে নিজের হাতে ঘোষণাটি লিখেন। তারপর বিশ্বকণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'ইনডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ' অর্থাত্ 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা'। এই ঘোষণার মাধ্যমে ৫৬ হাজার বর্গমাইল প্রায় এক দুর্দমনীয় শক্তি-সাহস। বিশ্বসভ্যতা এই ঘোষণার সূত্র ধরে জানতে পারে বাংলার মানুষের স্বাধীনতা ঘোষণার অকৃত্রিম বহিঃপ্রকাশের কথা। বিশ্বের সব স্বাধীনতাকামী মানুষের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয় বাংলাদেশের দিকে, যা অটুট থাকে দীর্ঘ ৯ মাস। এই ঐতিহাসিক ও অমর ঘোষণার পর আওয়ামীপন্থী কিছু লোক এসে জিয়াকে মুজিবের পক্ষে ঘোষণা দিতে অনুরোধ করেন। জিয়া ওই সময় কোনো ধরনের বিভাজনের দিকে না গিয়ে তার অনুরোধে ঘোষণাটি দেন। উল্লেখ্য, সেখানে যদি ভাসানীপন্থী কেউ এসে জিয়াকে ভাসানীর পক্ষ নিতে অনুরোধ করতেন, তাহলে তিনি হয়তো শ্রদ্ধাভরে ভাসানীকেও স্মরণ করতেন। আসলে একজন স্বাধীন বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের সাধারণ ধারণা হলো, কার পক্ষে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, তার চেয়ে বড় কথা হলো তিনি সে সময় সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যা তাকে চিরকাল এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অতুলনীয় স্থানে প্রদর্শন করে যাবে। তাই একাত্তরের ইতিহাসে ২৫, ২৬, ২৭ মার্চের ঘটনাবলি ও মেজর জিয়াউর রহমানের সাবাসপূর্ণ অবদান এক ও অবিচ্ছেদ্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন