স্বাধীনতা যুদ্ধের আশু কারণ তৈরি হয়েছিল ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর। ওই নির্বাচনে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ জন্য নির্ধারিত ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জিতে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবস্থান অর্জন করেছিল। অন্যদিকে ‘পশ্চিম পাকিস্তানে’ জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপ্লস পার্টি (পিপিপি) পেয়েছিল ৮৮টি আসন। নির্বাচনের পর দুই প্রদেশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে মতা হস্তান্তর করার উদ্ভট দাবি জানিয়ে সঙ্কট তৈরি করেছিলেন ভুট্টো। ভুট্টোর এই দাবিটিকে অজুহাত বানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ ৩ মার্চ থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছিলেন। প্রতিবাদে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়। প্রদেশের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় তার বক্তব্য রাখার কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী নিয়েছিল উস্কানিমূলক পদক্ষেপ। জনসভার ঠিক আগের দিন ‘খুনি জেনারেল’ নামে কুখ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ গভর্নর পদে নিযুক্তি দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। ‘জাতির উদ্দেশে’ প্রচারিত ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সংহতি বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।
গভর্নর পদে টিক্কা খানের নিযুক্তি এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় অসহযোগ আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে উঠেছিল। প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুখে আন্দোলনের সঠিক নির্দেশনা শোনার আকাংখা নিয়ে ৭ মার্চের জনসভায় লাখ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিল। শেখ মুজিব তার ভাষণে অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন, ভুট্টোর দাবি ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার’ আহ্বান জানিয়েছেন এবং সবশেষে বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শেখ মুজিবুর রহমানের এই ভাষণটিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করা দরকার। অসাধারণ বক্তা ছিলেন তিনি, তার যে কোনো ভাষণই মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেতো। পরিস্থিতির পরিপ্রেেিত ৭ মার্চের ভাষণও ছিল অত্যন্ত জ্বালাময়ী ও আবেগপূর্ণ। সে ভাষণ শুনে স্বাধীনতার আকাংখায় উদ্বেলিত ছাত্র-জনতাও প্রচণ্ডভাবেই আন্দোলিত হয়েছিল। কিন্তু সময়ের প্রোপটে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেও আরিক ব্যাখ্যা এবং শেখ মুজিবের কার্যক্রমসহ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের পর্যালোচনা ভাষণের সারকথাকে ভিন্নভাবে সামনে আনে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাত্র ৯১ বাক্যের ভাষণটির অধিকাংশ ব্যয়িত হয়েছিল ইতিহাসের পর্যালোচনায় এবং ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সমালোচনায়। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সমালোচনা করার সময় শেখ মুজিব যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন ‘হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো’, ‘দোষ দেওয়া হলো’ ধরনের অভিযোগ জানানোর বাইরে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তেমন কিছুই বলেননি তিনি। ‘আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান’, ‘আপনি আসুন, আপনি দেখুন’ কথাগুলোর মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব বরং সুকৌশলে ইয়াহিয়ার প্রতি ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
কয়েকদিনের মধ্যে কথাটার সত্যতা প্রমাণিতও হয়েছিল। ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিলেন, ১৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠক। এটা সম্ভব হওয়ার কারণ, ভাষণে শেখ মুজিব শুধু আলোচনার দরোজাই খুলে দেননি, পাকিস্তানের সংহতি রাখার পন্থাও নির্দেশ করেছিলেন।
কারণ, শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদকে বাতিল ঘোষণা করেননি। বলেছিলেন, অধিবেশনে তিনি বসবেন যদি প্রেসিডেন্ট চারটি দাবি মেনে নেন
(১) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে;
(২) সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে;
(৩) সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার করতে হবে; এবং
(৪) জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে মতা হস্তান্তর করতে হবে।
ভাষণের পরপর ৭ মার্চ সন্ধ্যায় পৃথকভাবে প্রচারিত বিবৃতিতেও একই দাবি, বক্তব্য ও আমন্ত্রণের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন শেখ মুজিব। ভাষণ ও বিবৃতির মধ্যে পার্থক্য ছিল বিস্তর। আবেগাপ্লুত ভাষণের তুলনায় বিবৃতির ভাষা ছিল খুবই মার্জিত ও সংযত এবং বড়কথা, বিবৃতির কোথাও স্বাধীনতা শব্দের উল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল শেষের কথাটুকু। ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ও ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ধরনের বাগাড়ম্বরের পরিবর্তে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ের লক্ষ্য হলো অবিলম্বে সামরিক আইনের বিলোপ এবং জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে মতা হস্তান্তর। এ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ (পূর্ণ বিবৃতির জন্য দৈনিক সংবাদ, ৮ মার্চ, ১৯৭১)
এখানে দুটি বিশেষ তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। প্রথম তথ্যটি হলো, ৬ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ নেতাদের বৈঠক চলাকালে পাকিস্তানের একজন ব্রিগেডিয়ার শেখ মুজিবের কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। বার্তা পাওয়ার পর শেখ মুজিব ড. কামাল হোসেনকে এমন একটি বিবৃতি লিখে রাখতে বলেছিলেন যাতে রেসকোর্সের জনসভায় দেয়া ভাষণের কারণে তাকে আইনের দিক থেকে বিপদে না পড়তে হয়। বিবৃতিটি জনসভার পর প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পরদিনের সংবাদপত্রে সে বিবৃতি ছাপাও হয়েছিল, কিন্তু বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল রেসকোর্সের ভাষণ।
দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, ৭ মার্চ সকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান টেলিফোন করে শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, তিনি যেন রেসকোর্সের জনসভায় এমন কিছু না বলে বসেন, যা থেকে ফিরে আসা তার পে সম্ভব হবে না। ইয়াহিয়া খান আসলে ‘ইউনিল্যাটারাল ডিকারেশন অব ইন্ডিপেন্ডন্স’ বা ইউডিআই তথা একপাকি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে নিষেধ করেছিলেন। তথ্যটি জানিয়েছেন ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রী ও ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের সাবেক অধ্যাপক জি ডাব্লিউ চৌধুরী (‘দ্য লাস্ট ডেইজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’, লন্ডন, ১৯৭৪)। টেলিফোনে শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলার সময় সাক্ষী হিসেবে ইয়াহিয়া খান তাকে উপস্থিত রেখেছিলেন। উল্লেখ্য, জি ডাব্লিউ চৌধুরী মুজিব-ইয়াহিয়ার মধ্যে যোগাযোগ কারীর দায়িত্ব পালন করতেন।
৭ মার্চের ভাষণ ও বিবৃতির পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পর্যায়ক্রমিক বৈঠকের পর্যালোচনায়ও পরিস্কার হবে, স্বাধীনতার যে ইতিহাস প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে তার অনেক কিছুই সঠিক নয়। কারণ, বৈঠকে অংশগ্রহণকারী নেতা ও উপদেষ্টাদের কেউই কখনও বলেননি যে, আলোচনার কোনো পর্যায়ে স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছিল। এমনকি শেখ মুজিবের ওপর সকল দায়দায়িত্ব চাপিয়ে প্রকাশিত পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্রেও বলা হয়নি, তিনি স্বাধীনতার দাবি তুলেছিলেন বলেই আলোচনা ভেঙে গিয়েছিল। শেখ মুজিবের দুই উপদেষ্টা ড. কামাল হোসেন ও প্রফেসর রেহমান সোবহানের বিবরণীতে বরং জানা গেছে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আলোচনার বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য ছিল এক পাকিস্তানভিত্তিক সমাধান অর্জন করা। ১৬ মার্চের প্রথম বৈঠকেই শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খানকে বলেছিলেন, বিশেষ করে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং আওয়ামী লীগের কাছে মতা হস্তান্তর ছাড়া অন্য কোনো কিছুই চলমান উত্তেজনা কমানোর জন্য যথেষ্ট হবে না। জবাবে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, সংবিধান রচনার আগে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে দেশে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে। শেখ মুজিব তখন উভয় পরে আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের বৈঠকে শেখ মুজিবের পে ড. কামাল হোসেন তার প্রস্তাবে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ইয়াহিয়া খান এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করবেন, যা সামরিক আইন প্রত্যাহার করার ও সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে আইনসম্মত করবে।
১৭ মার্চের বৈঠকে দেয়া প্রস্তাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, দুই অঞ্চলের জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে দুটি পৃথক সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে এক যৌথ অধিবেশনে সে দুটি সংবিধানের সমন্বয়ে পাকিস্তানের জন্য একটি একক সংবিধান রচনা করা হবে। শেখ মুজিবের প্রস্তাবে ইয়াহিয়া খান একটি বিশেষ ঘোষণায় স্বার করতে সম্মত হয়েছিলেন যাকে অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা হবে। সেদিন আলোচনায় ‘অগ্রগতি’ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল, প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে আসার সময় শেখ মুজিবকেও ‘খুবই হর্ষোৎফুল্ল’ দেখা গিয়েছিল। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছিলেন, একটি সমঝোতায় পৌঁছানো গেছে। এই সমঝোতা অনুযায়ী ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকবেন, তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঁচজন করে মন্ত্রী নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা হবে। সমঝোতাপূর্ণ সে পরিবেশে শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান ২০ মার্চ প্রথমবারের মতো সহকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণায় নিচের তিনটি বিষয় থাকবে
১. সামরিক আইন প্রত্যাহার;
২. জনপ্রতিনিধিদের কাছে মতা হস্তান্তর; এবং
৩. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ‘ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের’ ব্যবস্থা।
২০ মার্চের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবের কাছে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। এতে বলা হয়, প্রদেশগুলোতে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার দিন থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে। আওয়ামী লীগ এই প্রস্তাবকে ‘অসম্পূর্ণ’ আখ্যা দিয়ে নিচের দুটি বিষয়ে দ্রুত পদপে নেয়ার তাগিদ দিয়েছিল
১. প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা অবিলম্বে প্রচার করতে হবে; এবং
২. যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠন করতে দেরি হতে পারে সেহেতু নতুন গভর্নর নিযুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সাতদিনের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
এভাবেই মুজিব-ইয়াহিয়ার আলোচনা এগিয়ে চলছিল। ২৪ মার্চের সর্বশেষ সমঝোতায় বলা হয়েছিল
১. অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে;
২. ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকবেন;
৩. কেন্দ্রের আগে প্রদেশগুলোতে মতা হস্তান্তর করা হবে (এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতো এবং আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়তো); এবং
৪. দুই অঞ্চলের এমএনএ বা জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে দুটি পৃথক সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে যৌথ অধিবেশনে একটি একক সংবিধান রচনা করা হবে। ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের জানানো হয়েছিল, ওপরের বিষয়গুলোসহ প্রেসিডেন্টের ঘোষণা কবে প্রচার করা হবে সে কথা পরদিন জেনারেল পীরজাদা টেলিফোনে ড. কামাল হোসেনকে জানিয়ে দেবেন। শেখ মুজিব ২৫ মার্চ সারাদিন প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন এবং রাত সাড়ে দশটায়ও কামাল হোসেনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি পীরজাদার টেলিফোন পেয়েছেন কি না।
২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবের সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাত করেছিলেন ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তাদের কারও বিবরণীতেই এমন কোনো তথ্য জানা যায় না যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা তৈরি করেছিলেন। তাছাড়া শেখ মুজিবের বাসভবন থেকে তাজউদ্দিন আহমদের বাসায় গিয়ে কামাল হোসেনরা দেখেছিলেন, পাক সেনাদের আক্রমণের মুখে পিলখানা থেকে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বেরিয়ে পড়েছেন। অর্থাৎ ইপিআরের ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে শেখ মুজিবের ঘোষণা প্রচার করার মতো কোনো বাঙালি সৈনিক পিলখানায় ছিল না। ওদিকে শেখ মুজিব গ্রেফতার বরণ করেছিলেন রাত ১২টার পর পর। সুতরাং এমন কোনো দাবি মেনে নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে যে, শেখ মুজিব ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তেমন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা থাকলে সে কথা তিনি কামাল হোসেনদের কাছেও জানাতে পারতেন। তাছাড়া একটি সরকার ও মুক্তিবাহিনী গঠন করা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান পূর্বশর্ত। এ দুটির কোনোটিই শেখ মুজিব গঠন করে যাননি, যার ফলে যুদ্ধের দিনগুলোতে প্রতি পদে পদে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে বাধাগ্রস্ত ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
শেখ মুজিব সম্পর্কে অন্য একটি তথ্য জানিয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিত সিরাজুর রহমান। দৈনিক নয়া দিগন্তে (১৫.৮.১০) ‘শেখ মুজিবের তিনবার লন্ডন সফর’ শিরোনোমের উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে লন্ডন যাওয়ার পর ভারতীয় হাই কমিশনের ব্যবস্থাপনায় শেখ মুজিব ‘ক্যারিজাস হোটেলে’ ওঠেন। সেখানে সিরাজুর রহমানের উপস্থিতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার কাছে ফোন করেন। শেখ মুজিব সবার সামনেই কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিরাজুর রহমান তাকে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার উচিত একাকী কথা বলা। মূলত সিরাজুর রহমানের তাগিদেই শেখ মুজিব বেডরুমে যান কথা বলতে। সেখানে একাকী প্রায় ২০ মিনিট ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে আসার পর শেখ মুজিব সিরাজুর রহমানকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমাকে এক্সিলেন্সি কইলো ক্যান?’ জবাবে সিরাজুর রহমান জানালেন, ‘আপনি প্রেসিডেন্ট, আপনাকে এক্সিলেন্সি কইবো না তো কী কইবো?’ শেখ মুজিব বললেন, ‘আমি আবার কিসের প্রেসিডেন্ট হইলাম? আমরা না অটোনমি পেলাম?’ সিরাজুর রহমান তখন তাকে জানালেন, ‘আপনি তো ছিলেন না দেশে। আমরা আপনার নামে গোটা জাতিকে এক করে ফেলেছি। আমরা দেশ স্বাধীন করে ফেলেছি।’ অর্থাৎ লন্ডন যাওয়ার পর পর্যন্তও শেখ মুজিব জানতেন না যে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। তার ভাবনার মধ্যে স্বাধীনতার বিষয়টি ছিল না বলেই তিনি অটোনমি তথা স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলেন।
এভাবে তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণে প্রতিষ্ঠিত হবে, শেখ মুজিব অন্তত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা দেননি। ২৫ মার্চের সর্বশেষ বিবৃতিতে তিনি বরং ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। সে খবর ইত্তেফাকসহ প্রদেশের দৈনিকগুলোতে প্রকাশিতও হয়েছিল। স্বাধীনতা ঘোষণাদানকারী কোনো নেতার পক্ষে হরতালের ডাক দেয়া সম্ভব নয়। ঘোষণা দেয়া সংক্রান্ত দাবিটিও তাই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। ঘটনাপ্রবাহে বরং প্রমাণিত হয়েছে, এক পাকিস্তানভিত্তিক সমাধানই ছিল শেখ মুজিবের লক্ষ্য। তার এই ভূমিকার দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে
১. আলোচনার আড়ালে স্বাধীনতামুখী আন্দোলনকে প্রশমিত করা; অথবা
২. সঙ্কটকে আরও জটিল করার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলা। এ দুটির মধ্যে যে ব্যাখ্যাই গ্রহণ করা হোক না কেন, প্রাসঙ্গিক তিনটি তথ্য ও বিষয়কে বিবেচনায় রাখতে হবে
১. শেখ মুজিব স্বাধীনতার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে যাননি বরং যুদ্ধের সূচনা লগ্নেই গ্রেফতার বরণ করেছিলেন;
২. স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি সরকার ও মুক্তিবাহিনী গঠন করে যাননি;
৩. এক পাকিস্তানের জন্য সচেষ্ট ছিলেন বলেই গ্রেফতার বরণ করার প্রাক্কালেও ড. কামাল হোসেনের কাছে তিনি জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানভিত্তিক সমাধানের জন্য চেষ্টার আড়ালে শেখ মুজিব নিয়মতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতা অর্জনের কৌশলও নিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু সে কৌশলের বিষয়টি এখনও প্রমাণিত হয়নি।
তথ্যসূত্র :
১. ড. কামাল হোসেনের বিবরণী, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ ২১০-৭৮; ২. প্রফেসর রেহমান সোবহানের নিবন্ধ, ‘নিগোশিয়েটিং ফর বাংলাদেশ: এ পার্টিসিপ্যান্টস ভিউ’, সাউথ এশিয়ান রিভিউ, জুলাই, ১৯৭১; ৩. জি ডাব্লিউ চৌধুরী, ‘দ্য লাস্ট ডেইজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’, লন্ডন, ১৯৭৪; ৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্রের দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত রিপোর্ট এবং বিভিন্ন বক্তব্য ও বিবৃতি।
দরবার-এ শাহ
-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন