গোলাম মাওলা রনি; সিএমএম কোর্টের পথে কাঁপছিল হাত-পা (পঞ্চম পর্ব)

ডিবির গাড়িতে করে সিএমএম কোর্টে যাওয়ার সময় খুব সতর্কতার সঙ্গে ড্রাইভার তাদের অফিস কম্পাউন্ডের গেট পার হলো। কারণ রাস্তার উল্টো দিকে প্রায় শখানেক সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দৃশ্য ধারণ করার জন্য। পুরো গাড়ির গ্লাসে কালো রংয়ের বিশেষ পেপার লাগানো থাকায় কারো পক্ষেই ভেতরের আরোহীদের দেখা সম্ভব নয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সূর্যের আলো যত তীব্র হবে ততই গ্লাসে কালো রংয়ের ঘনত্ব বাড়তে থাকবে। আমাদের গাড়ি এত দ্রুত এবং এমন কৌশল করে বের হয়ে গেল, উপস্থিত সাংবাদিকরা টেরই পেলেন না, ভেতরের ডিবি অফিসাররা সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে নানারকম রসাত্দক ব্যঙ্গ করতে লাগলেন। আমি সেদিকে খেয়াল না করে আনমনে আমার প্রিয় শহরের রাস্তাঘাট, ফুটপাত, গাড়ি-ঘোড়া এবং মানুষজন দেখতে থাকলাম। এমনিতেই আমার অবসর সময়ে তসবি জপার অভ্যাস। তাই গাড়িতে বসে আনমনে সেই কাজটি করতে থাকলাম। যদিও দুর্বলতায় আমার হাত-পা তখনো কাঁপছিল।গাড়ি রমনা পার্কের সামনে দিয়ে মন্ত্রিপাড়া অতিক্রম করছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কয়েক মাস প্রধানমন্ত্রী এখানকারই একটি বাড়িতে থাকতেন। বাইরে থেকে দেখতে বাড়িটা বেশ সুনসান। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে
গণভবনের চেয়েও এই বাড়িটি ভালো লাগত। ডিবির গাড়িতে বসে আমি যখন নানা কথা ভাবছিলাম ততক্ষণে আমরা নগর ভবনের সামনে গিয়ে পেঁৗছালাম। আমি দৃষ্টিনন্দন ভবনটির দিকে তাকালাম। সেটি তখন তার সৌন্দর্য এবং জৌলুস হারিয়ে ফেলেছিল। পুরো ভবনের বাইরের অংশে শ্যাওলা পড়ে এমন বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল যাতে মনে হচ্ছিল ভবনটি সংস্কার করা না হলে খুব তাড়াতাড়ি সেটি পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হবে। মূলত ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে বিভক্ত করার পর এটির গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। এমপি হিসেবে আমি প্রথম থেকেই ঢাকার এই প্রশাসনিক বিভক্তির প্রচণ্ড বিরোধিতা করে আসছি। প্রথম থেকেই আমি বলে আসছিলাম এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত যা কি না শেষমেশ সরকারের জন্য একটি মরণফাঁদে পরিণত হবে।
নগর ভবন, গোলাপ শাহর মাজার এবং টিঅ্যান্ডটি ভবন পেছনে ফেলে আমরা কোর্ট-কাচারির দিকে এগোচ্ছিলাম। এরই মধ্যে সাংবাদিকরা টের পেয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকটি টেলিভিশনের গাড়ি আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে সমান্তরালভাবে এগোচ্ছিল। গাড়িতে বসা ডিবির কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে বিভিন্ন খিস্তিখেউর আওড়াচ্ছিলেন। আমার তখন বেশ মজাই লাগছিল। এভাবে আমরা কোর্টকাচারিতে পেঁৗছানোর পর দেখলাম বিভিন্ন টেলিভিশন, চারদিকে এলাহি কাণ্ড। অনেক টিভি চ্যানেল অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করার জন্য লাইফ টেলিকাস্টের রিসিভারসহ বিশেষ ধরনের গাড়ি পাঠিয়েছে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কয়েক শ সাংবাদিক জোরেশোরে রনি ভাই, রনি ভাই এদিকে একটু তাকান বলে চিৎকার শুরু করলেন। কোর্টহাজতে ঢোকার পথে তারা আমাদের গাড়িটি চারদিক থেকে ঘেরাও করেন। যেহেতু গাড়িতে কালো রংয়ের টিনশেড গ্লাস ছিল বলে ক্যামেরাম্যানরা শত চেষ্টা করেও আমার একটি পছন্দসই ছবি তুলতে পারছিলেন না। গাড়ির গ্লাসের সঙ্গে ক্যামেরার লেন্স লাগিয়ে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে তারা একের পর এক ছবি তুলতে লাগলেন। কিন্তু পরক্ষণে ক্যামেরার এলসিডিতে যখন দেখলেন কিছুই ওঠেনি তখন তারা আবার হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
সাংবাদিক, আইনজীবী এবং সাধারণ মানুষের সংখ্যাধিক্যের কারণে আমাদের গাড়ি একটুও এগোতে পারছিল না। আমার নির্বাচনী এলাকার নেতা, অফিসের কর্মকর্তা এবং ঢাকা-প্রবাসী হাজার হাজার এলাকাবাসী পুরো কোর্ট-কাচারির রাস্তা ব্লক করে হৈচৈ করছিল। কেউ বা নীরবে দাঁড়িয়ে কান্না করছিল এবং চোখের পানি ফেলছিল। কারও কান্না দেখলে আমারও ভীষণ কান্না পায়। টেলিভিশনে নাটক-সিনেমা দেখতে গিয়ে কোনো আবেগঘন ইস্যু দেখলেই আমার চোখ সজল হয়ে ওঠে। আমার বাচ্চারা তখন নিজেরা নিজেরা মশকরা শুরু করে। তারা বলে ওঠে, এই তোমরা এখন চুপ কর! বাবা এখনই কেঁদে দেবেন। তাড়াতাড়ি রুমাল অথবা টিস্যু আন। শুধু কান্না নয়, হাসির দৃশ্যও আমি দারুণ উপভোগ করি। সামান্য কোনো হাসির ঘটনা ঘটলে আমি খিলখিলিয়ে হাসা শুরু করি। হাসতে হাসতে অনেক সময় আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। একবার থ্রি স্টুজেজ নামক একটি হাসির সিনেমা দেখতে গিয়ে হাসতে হাসতে প্রায় মরতে বসেছিলাম। আজকের ঘটনায় হাসি-কান্নার দৃশ্য একসঙ্গে উপস্থিত হওয়ায় আমি অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম।
সাংবাদিকদের কশরত দেখে যেমন হাসি পাচ্ছিল তেমনি প্রিয়জনদের চোখের পানি আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলছিল। একবার মনে হলো, গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ওদের নির্বিঘ্নে ছবি তুলতে দিই এবং একই সঙ্গে প্রিয়জনদের হাত নেড়ে সান্ত্বনা জানাই। ডিবির কর্মকর্তারা আমায় মনোভাব বোঝালেন। তারা বললেন, স্যার, এ কাজ করা ঠিক হবে না। কয়েক হাজার মানুষ। এদের মধ্যে গাড়ির গ্লাস খুললে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। গাড়ি তিল তিল করে এগোচ্ছিল। এরই মধ্যে দেখলাম আমার সবচেয়ে ছোট ভাইটি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অঝরে কাঁদছে। আমরা সাত ভাই। আমি সবার বড়। আমার ছোট ভাইদের কাছে আমি কেবল ভাই-ই নই, পিতার মতো। বাবা মারা গেছেন বছরতিনেক হলো। এরপর পুরো সংসারের দায় আমায় বহন করতে হয়েছে। সব ভাই লেখাপড়ায় খুবই ভালো। ফলে খুব অল্প পয়সায় তাদের মানুষ করতে পেরেছি আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে। কেবল ছোটটি ছাড়া সবাই বিয়েথা করে সুখে-শান্তিতে আছে। ছোট ভাইটি এমবিএ শেষ বর্ষে। তার চোখের পানি আমার বুকে বন্দুকের গুলির চেয়েও বেশি জোরে আঘাত করল। আমি গ্লাস খুলে ওর দিকে হাত বাড়ালাম। ও শুধু আমার হাত ধরে একাধারে চুমো দিতে থাকল আর তার চোখের পানিতে আমার হাত ভিজে গেল। আমি অন্য হাত দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলাম এবং গাড়ির দরজা বন্ধ করলাম। আরও প্রায় ৩০ মিনিট কশরত করার পর আমাদের গাড়ি কোর্টহাজত এলাকায় প্রবেশ করল। পূর্বপরিকল্পনামতো আমি গাড়িতেই বসে রইলাম। সাংবাদিকরা বিভিন্ন দেয়ালের ওপর কিংবা আশপাশের ভবনে উঠে আমাদের গাড়ির দিকে ক্যামেরা তাক করে বসে রইলেন। আমার আইনজীবীরা ভেতরে ঢুকে ওকালতনামায় আমার স্বাক্ষর নিয়ে গেলেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ছাত্র ছিলাম। ফলে ঢাকা বারে আমার শত শত আইনজীবী বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী কিংবা ছোট ভাই/বড় ভাইরা ছিলেন। বলতে গেলে সবাই সেদিন উপস্থিত ছিলেন। আমি জানতাম আমার জামিনের জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। কিন্তু আমি এও জানতাম যে আমার জামিন হবে না। সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশে আমার জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা আমার জানা ছিল। তাই আমার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল জামিন চাইব না। কিন্তু আইনজীবীদের পীড়াপীড়িতে আমাকে আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হলো। কারণ তারা আমাকে বোঝালেন, যদি জামিন না চাই তাহলে ভবিষ্যতে উচ্চতর আদালতে জামিন চাওয়া যাবে না। এ জন্য আমি তাদের জামিন চাওয়ার জন্য সম্মতি দিলাম।
উকিলরা সব চলে গেলেন। আমি আপনমনে আশপাশের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা আর কাণ্ডকারখানা। আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। এটি ছিল হাজতখানার বাইরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা নিরাপত্তাবলয়। এখানে এসে প্রিজন ভ্যানগুলো থামে। এরপর আসামিদের গাড়ি থেকে নামিয়ে গারদে ঢোকানো হয়। দূর থেকে দেখলাম বেশ বড় ভবন, অনেক গারদ রয়েছে নিচ তলায় এবং ওপর তলায়। একের পর এক প্রিজন ভ্যান আসছে আর হাতকড়া পরা অবস্থায় আসামিদের ঘাড় ধাক্কা দিতে দিতে গারদখানায় ঢোকানো হচ্ছে। অন্যদিকে কোর্টপুলিশ বিভিন্ন আসামির নাম ধরে গারদখানার সামনে ডাকাডাকি করছে। এরপর তাদের বের করে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটু পর কোর্ট থেকে ফেরত এনে পুনরায় গারদে ঢোকানো হচ্ছে। ১০-১৫ মিনিট পরে জেলকোর্ট এবং গারদের বিভিন্ন কাগজে সই-ছাপ্পর মেরে আসামিদের পুনরায় প্রিজন ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হয়তো কাউকে জেলখানায়। আবার কাউকে থানায় কিংবা রিমান্ডের নামে অন্য কোথাও।
আমাদের গাড়ির ড্রাইভারটি বলল গাড়ির জানালা খুলে দেওয়ার জন্য। কারণ গাড়িতে নাকি তেল কম। কাজেই দীর্ঘক্ষণ এসি চালিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আমার সঙ্গে থাকা ইন্সপেক্টরটি শুরু করলেন ড্রাইভারের বাপ-মা তুলে গালাগালি। সে কী ভাষা আর সুরের ঝংকার, না শুনলে তা লিখে বোঝানো যাবে না। আমি শান্তভাবে বললাম, ঠিক আছে। না হয় কিছুক্ষণের জন্য গ্লাস খুলে দিই। গরম লাগলে না হয় বন্ধ করে দেওয়া যাবে। ইন্সপেক্টর রাজি হলেন। যেই না গ্লাস খুলেছি তখনই উপস্থিত পুলিশ ও অন্যান্য উৎসুক আসামি এবং উকিলরা দৌড়ে গাড়ির কাছে এলো। তারা সবাই আমাকে চিনত এবং আমি কেন আজ জেলে যাচ্ছি এসব নিয়ে নানারকম মন্তব্য শুরু করল। প্রায় সবাই সমালোচনা করল খলনায়কদের।
আমি উপস্থিত জনতার কথা শুনছিলাম। কিন্তু কোনো মন্তব্য করতে পারছিলাম না। একে তো শরীর খারাপ অন্যদিকে আসামি অবস্থায় কথা বলা আইনত নিষিদ্ধ। আমি হালকা হাসিমাখা মুখে তাদের সঙ্গে কেবল মাথা নাড়ছিলাম। এমন সময় দেখলাম গেটের কাছে গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল মিয়া এবং আমার এক ভাগ্নে পিন্টু গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে আর চার রক্ষী পুলিশ তাদের ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমার খুব খারাপ লাগছিল। আমি উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুরোধ করলাম আমার দুই আত্দীয়কে একটু ভেতরে ঢোকানোর ব্যবস্থা করার জন্য। তারা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কাজটি করে দিলেন। দুজনই গাড়ির কাছে এসে শুরু করল হাউমাউ করে কান্না। আমি বাধা দিলাম না। তারা অনেকক্ষণ প্রাণভরে কাঁদার পর যখন একটু শান্ত হলো তখন মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলাম। আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর কিছু বাণী শোনালাম এবং যথাসম্ভব নিজেকে সংযত রেখে তাদের চলে যেতে বললাম। কারণ সাংবাদিকদের শত শত ক্যামেরা বিভিন্ন দেয়াল, বাড়ির ছাদ এমনকি জানালার কার্নিশ থেকে আমাদের গাড়ির দিকে তাক করে রাখা ছিল। তারা বিদায় নেওয়ার পর আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। কান্নার পানি শুকানোর জন্য আমি চোখ ঘষতে লাগলাম। ভাবখানা এ রকম যে অন্য প্রিজন ভ্যানের ধোঁয়া লেগে আমার চোখে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ইন্সপেক্টর পুনরায় গাড়ির গ্লাস বন্ধ করে এসি চালিয়ে দিলেন।
কোর্টে তখন আমার মামলা নিয়ে তুমুল সওয়াল-জওয়াব হচ্ছিল। আমার পক্ষে শত শত আইনজীবী। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ ভাড়া করে এনেছে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র উকিল আনিসুল হককে। আনিসুল হকের বাবা নামকরা উকিল ছিলেন। তিনি নিজেও বেশ নাম করেছেন সরকার সমর্থক আইনজীবী হিসেবে। তার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আমার একটু দুর্বলতা ছিল। কারণ বেশ কিছু দিন হলো তার স্ত্রী মারা গেছেন। অন্যদিকে এক বোন বা ভাই সম্ভবত পাগল।
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমার জামিন বাতিল করে জেলহাজতে পাঠানো হবে। কাজেই সিদ্ধান্ত যা হওয়ার তা তো হয়েই আছে। গ্রেফতার হওয়ার আগের দিন আমি সরকারের কয়েক ব্যক্তিকে বললাম, এ মুহূর্তে একজন সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের গ্রেফতার সরকারের জন্য মারাত্দক বুমেরাং হবে। কারণ যে ইস্যু নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত তা হলো শেয়ার মার্কেটের অর্থ লোপাট নিয়ে আমার মন্তব্য। ঘটনাটি মামলা পর্যন্ত গড়াল। এ অবস্থায় সরকারের উচিত ছিল আইনকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দেওয়া। কিন্তু তা না করে নিজেদের এমপিকে জেলে ঢোকানোর অর্থই হলো নির্লজ্জভাবে কারও পক্ষাবলম্বন করা। কে শোনে কার কথা। আমি বললাম, আর তারা শুনলেন এবং ভাবভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন, জানেন তো আমাদের কারোরই করার কিছু নেই। ওহি আসে (নাউজুবিল্লাহ) যেখান থেকে সেখানে যাওয়ার সাধ্য আমাদের কারোরই নেই। এবার আমি ওহি নিয়ে কিছু কথা বলছি। ওহি বলতে আমরা বুঝি মহান আল্লাহর বাণী যা কি না হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আসত। এসব ওহির লিখিত রূপই কোরআন শরিফ। ওহির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো- এটি আসে আসমান বা ঊধর্্বলোক থেকে এবং এটি পরিপূর্ণভাবে নির্ভুল। পৃথিবীর কোনো মানুষের সাধ্য নেই ওহির একটি শব্দ বা বর্ণ পরিবর্তন করার। তাফসিরকারকরা বর্ণনা করেছেন, পুরো কোরআন আল্লাহর তত্ত্বাবধানে লাউহে মাহফুজে লিখিত আকারে রয়েছে। জিবরাইল কেবল আল্লাহর হুকুমে সেখানে রক্ষিত কোরআনের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে রাসূল (সা.)-এর কাছে নিয়ে এসেছেন।
অতি দুর্ভাগ্য আমাদের জন্য যে সরকারের কেউ কেউ উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশকে প্রায়ই ওহির সঙ্গে তুলনা করেন এবং এ কথা বলে তারা বেশ গর্ব অনুভব করেন। যেমন এক সকালে জনৈক মন্ত্রী আমাকে ফোন করে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। সেদিন বাংলাদেশ প্রতিদিনে শিক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম। আমি যথাসম্ভব ধৈর্য, বিনয় ও ভদ্রতাসহকারে মন্ত্রী মহোদয়ের সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। সম্ভবত তিনি অসন্তুষ্ট হলেন। এরপর তিনি বললেন, তুমি মনে করো না যে এ প্রশ্নগুলো আমি তোমাকে নিজে থেকে করেছি। আমি ওহিপ্রাপ্ত হয়েছি... বুঝতেই পারছ। এখন আমার দায়িত্ব ওহির মালিককে বিষয়টি বুঝিয়ে বলা। তিনি ফোন রাখলেন আর আমি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বসলাম।
মানবজাতির বেশ কিছু ইতিহাস আমার জানা আছে। সেখানে অনেক মেধাবী মানুষ একসময় নিজেকে আল্লাহর নবী দাবি করে বসেছিল। তাদের আশপাশের মানুষ সব সময় তাদের সেভাবে বুঝিয়েছে এবং পরিণতিতে সবারই পতন হয়েছে নির্মমভাবে। এ জন্য পৃথিবীর সব মহান শাসক ভিন্নমতের মানুষকে নির্যাতন করতেন না। এমনকি তারা খয়েরখা প্রকৃতির লোকজনের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারীর বিষয়ে কোনো আলোচনা করতেন না। কেউ উপযাচক হয়ে আলোচনা করতে এলেও তারা তা শুনতেন না। বরং উল্টো ভর্ৎসনা করতেন এই বলে যে ওই লোকটি আমাকে যেভাবে সমালোচনা করলে তদ্রূপ তুমিও পারলে আমার সামনে আমার ত্রুটিগুলো বল যদি সাহস থাকে ওই লোকটির মতো। এরপর আমি তোমার মুখে ওই ভিন্নমত পোষণকারীর সমালোচনা শুনব। কোনো কাপুরুষের স্পর্ধা থাকা উচিত নয় বীরের সমালোচনা করার। আব্বাসীয় খলিফা মনসুর, হারুন অর রশিদসহ অনেক রাজা-বাদশা গিয়ে হাজির হয়েছেন ভিন্নমত পোষণকারীর বাড়িতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা আলোচনা করেছেন আর এভাবেই নিজেদের ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছেন।
আমেরিকার পাঠদান পদ্ধতিতে সরকারিভাবে দেশের সব শিশুকে শেখানো হয় ভিন্নমত পোষণ করার জন্য। তাদের মতে, প্রকৃতিতে নিম্নশ্রেণীর প্রাণীরাই দলবদ্ধভাবে ঐকমত্য পোষণ করে। যেমন ভেড়ার পাল। কিন্তু উন্নত প্রাণীরা সব সময় স্বতন্ত্র চিন্তা করে এবং নিজেদের চিন্তা-চেতনা দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে নিয়ত তর্ক-বিতর্ক করার পর একটি উত্তম সমাধানে পেঁৗছে। এসব বিষয় নিয়ে আমি ভাবতাম এবং সব সময় বলতে গেলে শৈশব থেকেই অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা ভাবতাম এবং আলাদা থাকার চেষ্টা করতাম। রাজনীতিতে এসেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু জীবনের অন্যত্র যে ভুল কম হয়েছে। রাজনীতিতে এসে তার মাত্রাটি সীমা অতিক্রম করেছে। আমি সব সময়ই আমার নিয়োগকর্তা এবং মুরুবি্বদের সম্পর্কে উঁচু ধারণা পোষণ করে আসছিলাম। কিন্তু রাজনীতিতে এসে নিয়োগকর্তা বা মুরুবি্বদের সম্পর্কে আমার উঁচু ধারণা বাস্তবসম্মত ছিল না। কারণ এ যুগে খলিফা আল মনসুর কিংবা মহামতি আকবরের মতো কিংবদন্তিরা জন্ম নেন না। ভণ্ডের উচ্ছিষ্ট খেয়ে কেউই তার হৃদয়ে মহত্ত্ব ধারণ করে রাখতে পারবেন না। আমি যখন এসব আবোল-তাবোল ভাবছিলাম তখনই খবর এলো যে কোর্ট আমার জামিন বাতিল করেছেন। এখন গন্তব্য নাজিমউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন