"মানবতার ডাক" জীবন বাঁচানো সাহসী যোদ্ধারা


রক্তের সম্পর্ক নেই। নেই কোনো আত্মীয়তার বন্ধন। এমনকি প্রতিবেশীও নন। তাতে কী। মানবিকতার টানেই ধ্বংসস্তূপে নেমে গেলেন একেকজন সাহসী যোদ্ধা। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই মৃত্যুপুরীর ফাঁকফোকর থেকে বের করে আনলেন জীবিত শত শত মানুষ। আনলেন শত শত মৃতদেহও। এদের কারও ছিল না কোনো প্রশিক্ষণ। এরপরও সেনা, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে দিনভর তাদের ক্লান্তিহীন লড়াই। ধ্বংসস্তূপে ভাই খুঁজতে এসেছেন বোনকে, বাবা খুঁজতে এসেছেন সন্তানকে; আবার সন্তান
খুঁজছেন বাবাকে। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে যারা পেশা আর আবেগ নিয়ে উদ্ধার কাজ করছেন, মৃত্যুপুরীতে আটকেপড়া সবাই যেন তাদের স্বজন। প্রাণের স্পন্দন পাওয়া গেলেই সুড়ঙ্গ আর উপ-সুড়ঙ্গ হয়ে বের করে আনেন 
একেকজনকে। আর কাউকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলেই অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে চোখ। রানা প্লাজা ধসের পর সেনা, ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে হাজারো সাধারণ মানুষ জীবন বাজি রেখে যেভাবে উদ্ধারে অংশ নেন, সেটা আবারও মনে করে দিয়েছে 'মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য'। 


ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে স্ট্রেচারে করে বের করে আনা হলো ক্লান্ত এক উদ্ধারকর্মীকে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত, তবে পরাজিত নন। একপাশে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো। নাকের নিচে দেওয়া হলো অক্সিজেনের নল। কাঁপা কাঁপা হাতে নল সরিয়ে দিলেন। তাকে যে বিশ্রাম নিলে চলবে না। ক্লান্তির কাছে হার মানলে চলবে না। আবার যে যুদ্ধে যেতে হবে! চিৎকার করে বললেন, 'আমার হেলমেট কই? আমি আবার যামু।'
এই 'মহাবীরের' নাম মো. শামসুদ্দিন। পেশাদার উদ্ধারকারী নন তিনি। রাজধানীর মিরপুরের একটি গার্মেন্টের সাধারণ শ্রমিক। শামসুদ্দিনের মতো এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন হাজারো সাধারণ মানুষ।


সিলেট ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ম্যানেজার শামসুল আলম। দেশ-বিদেশ থেকে উদ্ধার তৎপরতার ওপর একাধিক ট্রেনিং নিয়েছেন। সাভারে রানা প্লাজা ধসের পরপরই শামসুলসহ ছয়জন বিশেষজ্ঞ 'ফায়ারম্যানের' ডাক পড়ে। বৃহস্পতিবার ভোররাতেই রানার প্লাজার ধ্বংসস্তূপে এসে পেঁৗছেন তারা। এরপর ক্লান্তিহীনভাবে চলে তাদের টিমের উদ্ধার কাজ। রোববার দুপুরে দোতলায় একটি দুর্গম সুড়ঙ্গে কাজ করছিলেন তারা। এর ফাঁকেই শামসুলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, আমাদের টিমের সদস্যরা ৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে। প্রথম দিনেই উদ্ধার করেছি ২৭ জন। জীবন বাজি রেখে কাজ করাই আমাদের পেশা। তবে যারা এ ধরনের বড় কোনো ট্র্যাজেডির পর উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন, তারা পেশা ছাড়াও দায়িত্ববোধের বিষয়টি মাথায় রাখেন। একেকজন জীবিত মানুষ উদ্ধারের পর মনে হয়, এটাই হয়তো জীবনের শ্রেষ্ঠ কোনো অর্জন। কারও 'পুনর্জন্মে' নিজের কিছুটা হলেও ভূমিকা থাকল! অনেক ঝুঁকি নিয়ে প্রাণ খুঁজে বেড়ানো যেন একটা নেশা। এর আগেও সাভারে স্পেকট্রাম ট্র্যাজেডিসহ অনেক দুর্ঘটনায় উদ্ধার করার অভিজ্ঞতা রয়েছে শামসুল আলমের। ওই অভিজ্ঞতা এখানে কাজে লাগাচ্ছেন। 


প্লো কমপোজিট লিমিটেডের নিটিং ইনচার্জ মানিক সরদার। রানা প্লাজা ধসের পর সামাজিক দায়িত্ববোধের কারণে শুরু থেকেই উদ্ধার কাজে অংশ নেন। ধ্বংসস্তূপের ভেতর সুড়ঙ্গের মধ্যে কাজ করার ফাঁকে শনিবার দুপুরে কথা হয় মানিকের সঙ্গে। তিনি জানান, সাতজনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। সঙ্গে ২৩টি মৃতদেহও উদ্ধার করেছেন। লাশের ওপর দাঁড়িয়ে হলেও জীবিত শ্রমিকদের উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। মানবতার তাগিদেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে প্রথম থেকে হাজারো সাধারণ মানুষ দিনভর উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা এখানে আটকা পড়েছেন, তারাও তো আমাদের ভাই-বোনের মতো। তাদের জন্য কিছু করতে পেরে খুব আনন্দ লাগছে। 
রানা প্লাজার পাশের ভবন আরএস টাওয়ারের ভেতর থেকে সুড়ঙ্গ তৈরি করে একটি মরদেহ বের করতে ব্যস্ত কয়েকজন উদ্ধারকর্মী। তাদের মধ্যে ছিলেন সেনাসদস্য শরীফ সেলিম। উদ্ধার কাজের ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, ১০-১২ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই একেকজনকে উদ্ধার করেছেন। রানা প্লাজা ধসের পর থেকে সেনাবাহিনীর শত শত সদস্য দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম আর ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নেন। অতীতের যে কোনো দুর্যোগের মতো এবারও তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন।


রাজু নামের ১৪ বছর বয়সী ছেলেটি পেশায় মুদি দোকানদার। সাভারে রানা প্লাজাসংলগ্ন এলাকায় তার বাড়ি। বুধবার সকালে ভবনটি ধসে যাওয়ার পর থেকেই অন্যদের সঙ্গে উদ্ধার কাজে যোগ দেয়। টানা চার দিন সেখানে রয়েছে। অসম সাহসী এ ছেলেটি শনিবার দুপুর ২টায় ধসেপড়া ভবনের ছাদে করা সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিল জীবিত মানুষ উদ্ধারের আশায়। কিন্তু ভেতরের আলো-বাতাসহীন দমবন্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাইরে বেরিয়ে আসার পর তার জীবন বাঁচাতে অক্সিজেন দিতে হয়েছে। একটু সুস্থ হয়ে সে আবারও অংশ নিয়েছে উদ্ধার কাজে।


গার্মেন্টকর্মী ইমরান এসেছেন গাজীপুরের বক্তারপুর এলাকা থেকে। ভবনধসের খবর পেয়ে ওই দিন বিকেলেই ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কাজে যোগ দেন। নিজ পেশার সহকর্মীদের বাঁচানোর ইচ্ছা থেকেই এখানে আসেন তিনি। উদ্ধার কাজের প্রথম দিনই তিনি ২৫ জন জীবিত মানুষ উদ্ধারে অন্যদের সঙ্গে ছিলেন।
মাওনা চৌরাস্তার বাসিন্দা নোমান উইভিং টেক্সটাইলস মিলে কর্মরত শাহ আলম প্রথম দিন থেকেই নিরলসভাবে উদ্ধার কাজে অংশ নিচ্ছেন। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ধসেপড়া ভবনের ছাদের সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। তিনি জানান, ক্ষীণকণ্ঠের আর্তচিৎকার শুনে তিনতলার একটি বাথরুমে নারীসহ বেশ কয়েকজন মানুষ জীবিত রয়েছেন বলে জানতে পারেন। আর লাশ কতগুলো দেখেছেন, তার হিসাব নেই।


গণজাগরণ মঞ্চের ফিল্ড হাসপাতালের কর্মী নদী পেশায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স। তিনিও আছেন প্রথম দিন বিকেল থেকে। তিনি জানান, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে তাদের টিমে আছেন ৫০ জনের মতো। যারা পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করছেন। উদ্ধার কাজে সহযোগিতা ও আহতদের মেডিকেল সেবা দিচ্ছেন তারা। জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধ, খাবার, পানি ও সরঞ্জাম সরবরাহও করছেন তারা। ৪০ জন জীবিত মানুষ উদ্ধারে সহযোগিতা করেছে এ টিমটি।
স্থানীয় মাদরাজ তুল হুদা শাহি মাদ্রাসার শিক্ষক মোবারক খানও আছেন প্রথম দিন থেকেই। শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৬৯ জন জীবিত মানুষ উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করেছেন। এর মধ্যে বুধবার রাত ২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ভবনের পেছন দিক থেকে উদ্ধার করেছেন ৫২ জন। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টায় উদ্ধার করা দুই নারী শ্রমিক ভেতরের অন্ধকার পরিবেশে ভয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। উদ্ধারের সময় নারী দু'জন উল্টো তাকেই কামড়ে দিয়েছে বারবার। তবে মুক্তা নামের এক জীবিত শ্রমিক পায়ে হেঁটে ও হাসতে হাসতে বের হয়ে আসে, যেটি তার সারাজীবন মনে থাকবে বলে জানান মোবারক।
সাভারের আড়পাড়ার বাসিন্দা রানা পেশায় ইলেকট্রিক মেকানিক। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনিও ঘটনার দিন সকাল থেকেই উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। দুপুর কিংবা বিকেলে বাসায় ফিরে গোসল ও খাওয়া-দাওয়ার সময়টুকু বাদে ২৪ ঘণ্টাই সেখানে থেকে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করে আসছেন।


স্থানীয় মঞ্চকর্মী ইয়াছিন শামীম জানান, শুক্রবার রাত পর্যন্ত ভারী স্লাবের নিচে আটকেপড়া সুরুজ নামের একজন জীবিত ছিলেন। তাকে খাবার ও পানি দেওয়া হয়েছে। তবে ভারী স্লাবের কারণে তাকে উদ্ধার করা যায়নি। তার সামনে পড়ে থাকা দুটি মৃতদেহ ডিঙিয়ে তার কাছে পেঁৗছানো সম্ভব হয়নি। তবে শনিবার সকাল থেকে সুজনের আর সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি।
এশিয়া প্যাসিফিক ইন্ডাস্ট্রিজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার রাশেদুজ্জামান আছেন বৃহস্পতিবার থেকে। শুক্রবার ধসেপড়া ভবনের পেছন দিয়ে নয়তলা ভবনের ওপর দিক থেকে তিনতলা পর্যন্ত নামতে পেরেছিলেন। তিনি জানান, ভেতরে প্রচুর গরম। তিনি তিনটি মৃতদেহ দেখলেও কোনো জীবিত মানুষ পাননি।
স্থানীয় মামুন কোম্পানির সুপারভাইজার পদে কর্মরত রঞ্জুও আছেন প্রথম দিন থেকে। তিনি অন্যদের নিয়ে ৩০ জন জীবিত মানুষ উদ্ধারে সক্ষম হন। মো. সাদেক জানান, তার বাড়ি রানা প্লাজার ঠিক পেছনে। ঘটনার দিন সকাল থেকে আছেন উদ্ধার কাজে। ৩০ কদমের মধ্যে বাড়ি। তবু একটি বারের জন্য যাননি। পানি, কলা রুটি খেয়ে দিন পার করেছেন।
শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে রানা প্লাজার সামনের সড়কে নারী উদ্ধারকর্মী সৈয়দা জুবায়েরা জাবীনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ভবনধসের দিন বিকেল থেকেই তারা উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির যুব ইউনিটের ১৪০ জনের একটি টিম উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে। এ ইউনিটে পুরুষের পাশাপাশি ১৬ জন নারী উদ্ধারকর্মী রয়েছেন। প্রতিদিন তিন ইউনিটে ভাগ হয়ে তারা উদ্ধার কাজ করছেন।
জাবীন জানান, এ পর্যন্ত তিনি ওপর থেকে ভবনের তিনতলা পর্যন্ত গিয়েছেন। আহত অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন। পাশাপাশি আটকেপড়া জীবিতদের সুড়ঙ্গ দিয়ে খাবার, পানি, স্যালাইন, ওষুধ ও অক্সিজেন সরবরাহ করেছেন। কথাও বলেছেন অনেকের সঙ্গে। এ সময় আটকেপড়া জীবিতদের আর্তনাদ শুনে নিজেও অশ্রুসজল হয়েছেন।
তিনি বলেন, উদ্ধার কাজ করতে গিয়ে কয়েকবার ঝুঁকির মধ্যেও পড়েছেন। তার পরও আটকেপড়া মানুষদের একটু সহায়তা করতে পেরে খুশি তিনি। আরও বেশি প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মী অংশ নিলে আটকেপড়া অনেক মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন এই উদ্ধারকর্মী। 
আরেক উদ্ধারকর্মী মিথি জানান, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির যুব ইউনিটের অধীনে ঘটনার দিন থেকে তারা কাজ করছেন। পুরুষ উদ্ধারকর্মীরা তাদের সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছেন। আটকেপড়া মানুষদের জন্য কষ্ট হয়। তবে তাদের বিপদে একটু সহায়তা করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করেন তিনি। উদ্ধার কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকবেন বলেও জানান এ দুই নারী উদ্ধারকর্মী। একজন মানুষকেও জীবিত কিংবা মৃত রেখে যেতে চান না তারা।
রানা প্লাজা থেকে ঢাকার দিকে আসার পথে প্রায় এক হাজার মিটার দূরে ক্যাম্প স্থাপন করেছেন তারা। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির যুব ইউনিট এ ক্যাম্প পরিচালনা করছে। এ টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মিজানুর রহমান হিরণ। তিনি সমকালকে জানান, হতাহতদের চিকিৎসায় তারা মেডিকেল টিম, উদ্ধারকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করেছেন। উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সেবা অব্যাহত থাকবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন