আয়েশা ফয়েজের আত্মজীবনী "জীবন যে রকম"




বাচ্চার নাম রাখা হলো কাজল। কাজলের জন্মের খবর জানিয়ে তার বাবাকে টেলিগ্রাম করা হলো পরদিন ভোরে। তার তখন খুব কাজের চাপ। আসতে পারল না। অন্যেরা এল।
আমার নানি এসে কাজলকে মানুষ করার কাজে লেগে গেলেন। প্রথমে নানা রকম গাছগাছালির পাতা ছেঁচে রস, মধু আর এক টুকরা লোহা তার সাথে গরম করে সেই তরলটুকু খাইয়ে দিলেন। তারপর
খানিকটা শর্ষের তেল নিজে ঘানি থেকে ভেঙে এনেছেন। বিদঘুটে সেই জিনিস খেয়ে কাজলের সে কী চিৎকার! আমি বাচ্চা মানুষ করা নিয়ে কত বই পড়ে রেখেছি, কোথাও তো এসব দেখিনি! কাজলের চিৎকার দেখে বুকটা ভেঙে যাবার অবস্থা। এক সময় না পেরে বলেই ফেললাম, নানিজান, এসব খাওয়ানো ঠিক না।
নানি চোখ কপালে তুলে বললেন, কেন?
বাচ্চা কষ্ট পায়।
শুনে নানির সে কী হাসি! চিৎকার করে বললেন, তোমরা শুনে যাও, আমার নাতনি কী বলে! আমি নাতির ঘরে পুতি দেখছি, আর আমি নাকি বাচ্চা মানুষ করতে জানি না!
শুনে সবার সে কী হাসাহাসি! আমি আর কী করি, মুখ ভার করে সরে গেলাম। শুধু যে কাজলের ওপর অত্যাচার, তা-ই না; আমার উপরেও অত্যাচার। ঠাণ্ডা পানি খেতে পারব না, গরম পানি খেতে হবে। তাও একদিন দু'দিন নয়, পুরো চলি্লশ দিন। সাথে আতপ চালের নরম ভাত, ঘি আর আলু সেদ্ধ আদা দিয়ে মেখে। রাতের খাওয়া সেরে নিতে হতো সন্ধ্যার আগে; কবুতর, না হয় মুরগির বাচ্চা আলাদা করে রান্না করা হতো আমার জন্যে। রাতে শুধু দুধ। তার ওপর ছিল সেঁকা। আমার জন্যে সেঁক, কাজলের জন্যে সেঁক। কাজলের নাভি পড়ার আগে এক রকম সেঁক; নাভি পড়ার পর আবার অন্য রকম সেঁক।
কাজলের বয়স যখন নয় দিন, তখন নাপিত এল তার মাথা কামানোর জন্য। মায়ের পেট থেকে যে চুল নিয়ে আসে, সেটি নাকি নাপাক; মাথায় রাখা টিক না। নাপিত এলে তাকে পান খেতে দেয়া হলো। নাপিত নতুন ধুতি পরে পান খেয়ে মুখ লাল করে চুল কামাতে বসে। তার সাথে সবার রসিকতার সম্পর্ক, ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে ক্ষুর চালিয়ে কাজলের মাথা ন্যাড়া করার সময় তার কোচ খুলে তাতে রাজ্যের জিনিস বেঁধে দেয়া হয়েছে। সে আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। তাই দেখে সবাই হেসে গড়াগড়ি! কাজ শেষ হলে নাপিতকে ডালা ভরা চাল, পান- সুপারি আর একটা রুপার টাকা দিয়ে বিদেয় করা হলো। তখন আমি কাজলকে নিয়ে ঘর থেকে বের হবার অনুমতি পেলাম। সবাই মিলে আমাকে সাজিয়েছে; কাজলকে সাজিয়েছে আরও বেশি। আমি যাচ্ছি আর আমার সামনে ধানের খই ছিটিয়ে দিচ্ছে সবাই। রাতে আরও হৈ চৈ। ঘটা করে খাওয়া-দাওয়া করে সকাল সকাল শুয়ে পড়তে হলো। ঘরে দোয়া-কালাম লিখে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। আজ রাত ১২টায় ফেরেশতারা কাজলের ভাগ্য লিখতে আসবে। ভুল করে আবার যদি ভূত-প্রেত এসে পড়ে, তখন? আমার শাশুড়ির দেখাদেখি এখানেও তৈরি হয়েছে ভূতের ঝাড়ূ। সেটাও ঝুলছে এক কোনায়। ভূত-প্রেতের সাধ্যি কি ভেতরে ঢোকে!
রাত বারোটায় আমি জেগে আছি। কপালে ভাগ্য লিখছে ফেরেশতারা। আহা, ভালো কিছু যেন লিখে দেয় আমার সোনার কপালে!


শামসুর রহমান
কাজলের বাবা বাচ্চা দেখতে আসার সুযোগ পেল এক মাস পর। তার খুব মেয়ের শখ ছিল। আমার ছোটভাই নজরুল তখন সিলেটে থেকে পড়াশোনা করত। তাকে বলে রেখেছিল দেশ থেকে টেলিগ্রাম এলে অফিসে নিয়ে যেতে। যদি ছেলে হয় সে পাবে দশ টাকা, সাথে রংমহলে একটা সিনেমা। যদি মেয়ে হয় তাহলে পাবে বিশ টাকা আর রংমহলে দুইটা সিনেমা!
কাজলের বাবা মোহনগঞ্জে পেঁৗছাল রাতের ট্রেনে। সবাই স্টেশনে হাজির। বাড়ির বৌ-ঝিরাও সবাই জেগে নতুন বাবা তার বাচ্চাকে দেখে কী করে দেখবে। সবার ধারণা ছিল হয়তো একটু লজ্জা পাবে, মুখ ফুটে বেশি কিছু বলবে না। কিন্তু কিসের লজ্জা। বাড়ি পেঁৗছেই আমার মাকে বলল, আম্মা, কোথায় বাচ্চা দেখান তাড়াতাড়ি।
আমার নানি সাবধানে কাজলকে তার হাতে তুলে দিলেন, অবাক হয়ে খানিকক্ষণ দেখে তাকে বুকে চেপে ধরে তার সে কি আদর!
দেখে আমার নানির সে কি হাসি!
নানি তার পরদিন বাড়ি চলে গেলেন। দুদিন পর খবর পেলাম কলেরা হয়ে আমার ছোট মামা আর নানি মারা গেছেন।
সে রাতে অবশ্যি বাড়িতে আনন্দ আর হৈ চৈ। জামাইকে ঘিরে সবাই বসে আছে, গল্প-গুজব হচ্ছে। ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় রাত শেষ হবার অবস্থা। আমার সাথে যখন প্রথম নিরিবিলি দেখা হলো, প্রথমেই বলল, কাজলের ভাগ্য গণনা করে ফেলেছি!
কী ভাবে করলে?
বইপত্র কিনে পড়াশোনা করেছিলাম।
কী আছে ভাগ্যে?
অনেক বিখ্যাত হবে তোমার ছেলে! জান রানী এলিজাবেথের ছেলে আর তোমার ছেলের জন্ম একই দিনে, একই লগ্নে?
আমি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসলাম, কোথায় রানী এলিজাবেথ আর কোথায় আমি!
কাজলের বাবা গম্ভীর হয়ে বলল, রানীর ছেলে বিখ্যাত হবে বাবা-মায়ের নামে, আর আমার ছেলে বিখ্যাত হবে তার নিজের যোগ্যতায়! তুমি দেখে নিও।
তখন তার কথা বেশি গুরুত্ব দিয়ে নিইনি। সব বাবা-মাই তো ভাবে তার ছেলে অনেক বড় হবে, সেটা আর বিচিত্র কি? কিন্তু তার বলার ধরনটি ছিল অন্য রকম, কেমন জানি বিশ্বাস নিয়ে বলত। আজ সত্যিই তার ছেলে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাশিল্পী হয়ে পরিচিত, দুঃখ সেই মানুষ সেটি দেখে যেতে পারল না।
কাজলের বাবার ছুটি ছিল অল্প কয়দিনের, সে চলে গেল দুদিন পরেই। আমি সিলেট ফিরে গেলাম যখন কাজলের বয়স আড়াই মাস তখন। যাবার সময় কয়দিন শ্বশুরবাড়ি থেকে গেলাম, সেখানে আবার সেই একই রকম আনন্দ-উৎসব! আমার এক চাচাশ্বশুর কাজলকে দেখে বললেন, বলেছিলাম না ছেলে হবে? এই বংশে বার সিঁড়ি প্রথম সন্তান ছেলে।
শাশুড়ি বললেন, বউমা, তুমি ছেলের মুখের দিকে বেশি তাকাবে না। নজর লেগে যাবে তাহলে। বাবা-মায়ের নজর কিন্তু সবচেয়ে বেশি লাগে। ফয়জুর রহমানকেও না করবে। সে তো কোনো কথা শোনে না, দুই পাতা বই পড়ে মনে করে দুনিয়ার সব কিছু জেনে গেছে।
আমার বাবা আর শ্বশুর আমাকে সিলেট পেঁৗছে দিলেন। দুজনের খুব খাতির ছিল। কোনো সুযোগ পেলেই একসাথে বের হয়ে পড়তেন! বাড়ি ফিরে যাবার আগে দুজনে অনেক চিন্তাভাবনা করে কাজলের ভালো নাম রাখলেন শামসুর রহমান।
তারা চলে যাবার পরপরই কাজলের বাবা কী ভেবে তার নাম পাল্টে রেখে ফেলল হুমায়ূন আহমেদ। ভাগ্যিস রেখেছিল তা না হলে সমকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ কবি এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাশিল্পীকে আলাদা করতে হতো একটি মাত্র আকার দিয়ে! একজন হতেন কবি শামসুর রাহমান, আরেকজন হতো কথাশিল্পী শামসুর রহমান!
আমার শাশুড়ি অবশ্যি কখনোই হুমায়ূন নামটাকে গ্রহণ করেননি। শেষদিন পর্যন্ত আমাকে ডেকে গেছেন শামসুর মা!

ইকবাল
আমার মেজো ছেলের জন্ম হয় সিলেটের মীরাবাজারে। ডিসেম্বর মাসের এক ভোরে, সকাল ৬টা সাড়ে বাইশ মিনিটে। কাজলের বাবার ডায়রিতে এই নিখুঁত সময়টি লেখা ছিল, কীভাবে এই নিখুঁত সময়টি বের করেছে আমার জানা নেই।
এর আগে দুই সন্তানই হয়েছে বাবার বাড়িতে, অসংখ্য লোক ছিল আশপাশে। এবার নিজেদের লোক নেই, বন্ধুবান্ধব এবং কাদম্বিনী নার্স। সেই নার্স জন্মের পর তাকে ধুয়েমুছে তার বাবার হাতে তুলে দিল, বাবা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল তার ছেলের দিকে।
ছেলে জন্মালে আজান দিতে হয় (মেয়ে হলে কেন নয়?) তাই তার চাচা আজীজ বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আজান দিল। আজান শুনে বুঝতে কারো বাকি নেই, ছুটে এলো সবাই। বাচ্চাকে দেখে কারো আর আশ মেটে না, ধবধবে গায়ের রং, বড় বড় হাঁসের ডিমের মতো চোখ, নাদুস-নুদুস চেহারা।
খরব পেয়ে আমার বাবা এলেন, শ্বশুর এলেন। দুজনেই নাতিকে দেখে মহা খুশি। শ্বশুর বললেন, আমি বুঝেছিলাম তোমার ছেলে হয়েছে, তোমার শাশুড়ি স্বপ্নে দেখেছে আকাশে মস্ত এক চাঁদ উঠেছে, তখন বুঝেছি তোমার নিশ্চয়ই একটা ছেলে হয়েছে।
শ্বশুর যাবার আগে আবার আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, মনে আছে তো আমি খোদার কাছে ধন চাই নাই, শুধু জন চেয়েছি। এই দেখ খোদা জন দিছে। দোয়া করি এরা মানুষ হোক।
আজীজ বাচ্চাদের খুব আদর করত। সে অনেক ভাবনাচিন্তা করে ছেলের নাম রাখল ইকবাল আহমেদ। বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ, মেজো ছেলে ইকবাল আহমেদ, কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। বেশ কিছুদিন কেটে গেছে তখন হঠাৎ কাজলের বাবা নিউমারোলজিতে ঝুঁকে পড়ল। কাগজে আঁকিবুঁকি করে, হিসাবপত্র করে বলল, না, নাম ঠিক হয় নাই। নাম পাল্টাতে হবে।
আমি বেঁকে বসলাম, ইকবাল নামটা আমার পছন্দ, কিছুতেই পাল্টাতে দেব না।
অনেক হিসাবপত্র করে সে নামটা ইকবাল আহমেদ থেকে পাল্টে করে দিল জাফর ইকবাল। আমি ডাকি ইকবাল।
বড় দুজন জন্ম থেকে দুরন্ত, সে তুলনায় ইকবাল খুবই শান্ত। আমার ধারণা ছিল দুজন চালাক-চতুর বাচ্চার পর সে হয়তো একটু বোকাই বের হয়েছে। কথাবার্তা বিশেষ বলে না। বড় দুজনকে যখন জোর করে পড়াতে বসাই সে কাছে চুপ করে বসে থেকে দেখে। একদিন দেখি সে নিজেও বই নিয়ে বসেছে, ভাবলাম ছেলেমানুষি শখ, পড়ার ভান করবে। হঠাৎ দেখি পড়ার ভান নয়, সত্যিই পড়ে যাচ্ছে। তাকে তখনো কোনো অক্ষরজ্ঞান দেয়া হয়নি। নিজে নিজে পড়া শিখে গেছে। বুঝলাম ছেলেটা চুপচাপ হতে পারে, তবে বোকা নয়!
একবার কৌতূহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি রে, তুই কথা বলিস না কেন?
চার বছরের বাচ্চা গম্ভীর হয়ে বলল, বেশি কথা বলে কী লাভ?
শুনে তার আব্বার সে কি হাসি!
কাজল ছেলেবেলা দুষ্টুমি করে কাটিয়ে একটু বড় হয়ে পড়ায় মন দিয়েছে। ইকবাল ছেলেবেলা থেকেই মনোযোগী। পড়াশোনায় ভালো, সারাজীবনই বৃত্তি পেয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পর সর্বস্ব হারিয়ে আবার যখন নতুন করে জীবন শুরু করেছি সে তখন আমার কাছ থেকে একটি পয়সাও নেয়নি। প্রাইভেট টিউশনি করেছে, খবরের কাগজে কার্টুন এঁকেছে, টেলিভিশনে বিজ্ঞানের ওপর অনুষ্ঠান করেছে। এমএসসি পাস করার পরের দিন সে আমেরিকা চলে গেল পিএইচডি করতে, তার প্লেনের ভাড়াটাও আমাকে দিতে হয়নি, তার ছেলেবেলার বন্ধু জোগাড় করে দিয়েছে।

শাহীন
আমার তৃতীয় ছেলের জন্মের পরপরই আমরা সিলেট ছেড়ে চলে যাই দিনাজপুরের এক প্রান্তে, জগদল নামে একটা নির্জন জায়গায়। মানুষজন নেই, চারদিকে আমবাগান, তার মাঝে বিশাল এক প্রাচীন জমিদার বাড়ি, সেখানে থাকি। বাসায় একজন পুরনো বাসিন্দা রয়ে গেছে, জমিদারের এক সম্ভ্রান্ত কুকুর। প্লেটে করে না দেয়া পর্যন্ত সে কিছু খেত না, এ ধরনের বড়লোকি হাবভাব থাকলেও কুকুরটি ছিল ভালো। আমার সবচেয়ে ছোট ছেলেটার প্রাণ বাঁচানোর জন্য সেটা একবার একটা সাপকে কামড়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সাপের কামড়ে মুখে ঘা হয়ে পাগল হয়ে যাবার জন্য এই সম্ভ্রান্ত কুকুরটিকে গুলি করে মারা হয়েছিল।
ছোট ছেলের নাম রাখা হলো শাহীন। তখন বিজ্ঞানী কুদরতে খোদা পাঠশালা থেকে পার্টেক্স্ বের করে অনেক নাম করেছেন, কাজলের বাবা তার নামানুসারে শাহীনের ভালো নাম রাখল কুদরতে খোদা। দীর্ঘদিন পর ছেলেমেয়ে বড় হয়ে নামটি নিয়ে আপত্তি করল, যার নাম রাখা হয়েছে তিনি নমস্য ব্যক্তি কিন্তু তার নামটি প্রাচীনকালের, এ যুগে হাল ফ্যাশনের নাম দরকার। শাহীন যখন ক্লাস ফোরে পড়ে তখন তার নাম আবার পাল্টানো হলো, এবারে নাম ইবনে ফয়েজ মুহম্মদ আহসান হাবীব, যার অর্থ ফয়েজের পুত্র আহসান হাবীব। কাজলের আব্বার মাথায় তখন ইবনে ফয়েজ শব্দ দুটি ঘুরছে, অন্যদের নামের আগেও সেটা জুড়ে দিতে চাইছিল, কিন্তু তখন তারা বেশি বড় হয়ে গেছে তাই রাজি হলো না! শাহীনের নাম তো দীর্ঘদিন ছিল ইবনে ফয়েজ মুহম্মদ আহসান হাবীব। ঠিক বলতে পারব না কোনো এক সময়ে সে ইবনে ফয়েজ ছেড়ে ফেলে নিজেই তার নাম সংক্ষিপ্ত করে আহসান হাবীব করে ফেলেছে!
আমার এই ছেলেটি অন্যদের থেকে বেশি কষ্ট করেছে। স্বাধীনতার পর অভিভাবকহীন সংসারে নিজে খুঁজে খুঁজে স্কুল বের করে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। প্রচণ্ড অনিশ্চয়তার মাঝে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়েছে, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন তুলেছে, বাজার করেছে_এর মাঝে আবার পড়াশোনা করে মানুষ হয়েছে! ছোট ছেলে হলে তাদের অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। একটা উদাহরণ দিই।
আমরা তখন বাবর রোডে থাকি, দিন-দুপুরে একটা চোর ধরা পড়েছে। চোর ধরা পড়লে তাকে শক্ত মার দেয়া হয়। নিচে বেঁধে তাকে অমানুষিকভাবে পেটানো হচ্ছে। আমাদের নিচের তালায় একজন মেজর থাকতেন, তিনি খানিকক্ষণ পিটিয়ে এসে আমাকে বললেন, বুঝলেন খালাম্মা, সকালে ডেইলি দুইটা করে ডিম খাই, আমি পর্যন্ত কাবু করতে পারলাম না, টায়ার্ড হয়ে গেলাম!
অসহনীয় দৃশ্য! আমি ছুটে গিয়ে অনেক বলে সবাইকে থামালাম, চোর চুরি করে থাকলে তাকে থানায় দিতে হবে, নিজেরা কেন এত অমানুষের মতো তাকে মারধর করবেন? আমার কথায় শেষ পর্যন্ত সবাই থামল। এখন চোরকে থানায় দিতে হবে।
থানায় ফোন করা হলো। কিন্তু পুলিশ বড় বড় সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাদের এ ছিঁচকে চোর নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। বলল থানায় নিয়ে আসতে।
থানায় নিয়ে যাবার কথা শুনে একজন একজন করে সবাই কেটে পড়ল, কাজেই ভার পড়ল আহসানের ওপর। ছোট ছেলে হবার এই হচ্ছে যন্ত্রণা!
চোরকে পিটিয়ে রক্তারক্তি করে ফেলেছে। থানায় নেয়ার আগে তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। আহসান তাকে নিয়ে রওনা দিল হাসপাতালে। একটা রিকশা ডেকে থামানো হলো, চোর উদাস গলায় বলল, রিকশা? ভাই, আমি তো স্কুটার ছাড়া যাতায়াত করি না!
আহসান তো চোরের মর্যাদার হানি করতে পারে না, তাকে স্কুটারে করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছিল আমি জানি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থানা পর্যন্ত পেঁৗছে দিতে পেরেছিল কিনা আমার জানা নেই।
আহসানও তার অন্য ভাইবোনের মতো ছবি আঁকতে পারে। আর্ট কলেজে পড়েনি, কিন্তু ঘরে বসে ছবি আঁকতে আঁকতেই বেশ ছবি আঁকা শিখে গেছে। আজকাল সে চমৎকার কার্টুন আঁকে, এমনিতে উন্মাদ পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক। ব্যাংকের ভালো চাকরি পেয়েছিল, করতে রাজি হলো না। দশটা-পাঁচটা গৎবাঁধা জীবন তার ভালো লাগে না!


আয়েশা ফয়েজের 'জীবন যে রকম' ২০০৮ গ্রন্থ থেকে



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন