সংসদ অধিবেশন; সংসদের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবনা

রেহানা আক্তার রানুর যে বক্তব্যকে কেন্দ্র করে গতকাল জাতীয় সংসদ অধিবেশ উত্তপ্ত ও দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হয় ওই বক্তব্যের প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো:
মাননীয় স্পিকার, দিন বদলের কথা বলে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সরকারের তিন বছর শেষ। হানিমুন পিরিয়ডও অনেক আগেই শেষ হয়েছে। অনেকে বলেন নৌকার তলা নাকি ফুটো হয়ে গেছে।

আজ জিনিসপত্রের এত দাম, মানুষ সহ্য করতে পারছে না। আজ সারাদেশে ক্ষুধার্ত মানুষের কণ্ঠ ধ্বনিত হচ্ছে। এ কেমন দিন বদলের শুরু হলো পালা, পেটে বড় ক্ষুধার জ্বালা, আমাদের দাবি—কবে তোরা যাবি, যা দূর হ’ শালা। 
মাননীয় স্পিকার, আজ শেয়ারবাজার হয়েছে মানুষের মরণের বাজার। শেয়ারবাজারের টাকা লুট করে আমেরিকা, কানাডা, লন্ডনে পাচার করা হয়েছে। আজ পুঁজি হারিয়ে মানুষ আত্মহত্যা করছে। মাননীয় হুইপ কিছুক্ষণ আগে বক্তব্যে বলেছেন, উনারা অনেক বিদ্যুত্ দিয়েছেন। এত বিদ্যুত্ গেল কোথায় মাননীয় স্পিকার। শিল্প কলকারখানা বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুত্ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার। ফেনী নদী আমাদের নদী। এটা আন্তর্জাতিক নদী নয়। আজ পাম্প বসিয়ে ভারত সেখান থেকে জোর করে পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার নির্বিকার কোনো প্রতিবাদ করছে না। এভাবে চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে ওই অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। মাননীয় স্পিকার, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে ভাষণ দিয়েছেন সে ভাষণে এসব সমস্যা সমাধানের কোনো কথাই তিনি উল্লেখ করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা লিখে দিয়েছেন, উনি তোতা পাখির মতো বুলি আওড়িয়েছেন। সেটি বাস্তবতা বিবর্জিত, বস্তাপচা গল্প। বাংলাদেশে যা ঘটছে তার কোনো প্রতিফলন এ ভাষণে নেই। তাই আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ দিতে পারছি না বলে দুঃখিত। 
মাননীয় স্পিকার, কিছুক্ষণ আগে হুইপ সাহেব বক্তব্যে বলেছেন, জামায়াতের কথায় নাকি বিএনপি চলে। এটি অসত্য। বিএনপি চলে বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে। আমি উনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই—১৯৯১ সালে আপনাদের নেত্রী গোলাম আযমের পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলেন। আর ছিয়ানব্বই সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আপনারা এক সঙ্গে আন্দোলন করেছেন। (এ সময় তুমুল হৈচৈ শুরু করেন সরকারদলীয় সদস্যরা।) এর মধ্যেই রানু বলেন, জামায়াত যখন আপনাদের সঙ্গে যায় তখন হয় সঙ্গী, যখন আমাদের সঙ্গে আসে তখন হয় জঙ্গি। মাননীয় স্পিকার, কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। কথা বলতে এসেছি। এতদিন তারা এক তরফা বলেছে। আমরা আসিনি। আজকে কথা বলার সুযোগ না দিলে আমরা ওয়াকআউট করতে বাধ্য হব। (তুমুল উত্তেজনা, বিএনপির শাম্মি আক্তার ও আওয়ামী লীগের ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী মুখোমুখি। কয়েকজন তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন।)
স্পিকার : যার যার আসনে আপনারা বসুন। 
রানু : এখানে আমরা কথা বলার জন্য এসেছি। কথা আমরা বলবই মাননীয় স্পিকার। 
মাননীয় স্পিকার, কাল নাগিনীর কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। ডায়নির কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। আইনের শাসনের পরিবর্তে চলছে জংলি শাসন। দানবের শাসন চলছে। আইন-আদালত প্রধানমন্ত্রীর ভ্যানেটি ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমরা দানবের শাসন নয়, মানবের শাসন চাই। মাননীয় স্পিকার, আদালতকে দিয়ে এ সরকার তার সব অপকর্ম জায়েজ করতে চায়। বিচারপতি খায়রুল হক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের টাকা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের রায় দিয়েছেন। বর্তমানে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কত টাকা নিয়ে রায় দিচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায়। বিচারকের চেয়ারে বসে উনি যে সব মন্তব্য করেন তা শুনলে মনে হয় উনি একজন বিকারগ্রস্ত পাগল। কোনো পাগল দিয়ে তো আদালত চলতে পারে না মাননীয় স্পিকার। মাননীয় স্পিকার, আইনজীবীরা বলেন, উনাকে নাকি মাঝে মাঝে ভূতে ধরে। ওই আদালতে বসে উনি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কী কী অপকর্ম করেন তা আমরা জানি। আমি আইনমন্ত্রীকে আহ্বান জানাচ্ছি এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য। মাননীয় স্পিকার, শেখ মুজিব রক্ষীবাহিনী দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যা করেছিল। আর তার কন্যা ছাত্রলীগের গুণ্ডাদের গায়ে পুলিশের পোশাক পরিয়ে পুলিশ লীগ দিয়ে আজ বিএনপি নেতাদের হত্যা করছে। লক্ষ্মীপুরে রুবেল, কাশেমকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা বলতে চাই, রুবেল-কাশেমকে হত্যা করে আপনি বিএনপিকে ধ্বংস করতে পারবেন না। কারণ এক রুবেলের রক্ত থেকে বিএনপিতে লাখ লাখ রুবেল জন্ম নেবে মাননীয় স্পিকার।
মাননীয় স্পিকার, একের পর এক লাশ পড়ছে, আর আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্লজ্জের মতো বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক আছে। টেলিভিশনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভেটকি হাসি দেখলে মানুষ ভয়ে টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। উনি বললেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেফতার করবেন। ৪৮ ঘণ্টা কবে শেষ হবে মাননীয় স্পিকার? পুলিশ বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার করতে পারে, বিএনপির এমপিদের পেটাতে পারে। কিন্তু সাগর রুনির হত্যাকারীদের ধরতে পারে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজে সাগর-রুনির হত্যাকারীদের আঁচলের তলে আশ্রয় দিয়েছেন। এ ঘটনা প্রমাণ করে প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসীদের লালন করেন, খুনিদের লালন করেন। তিনি সন্ত্রাসীদের গডফাদার। মাননীয় স্পিকার, আমাদের প্রিয় নেতা তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার আমাদের প্রিয় নেতা। তারেক রহমানের নাম শুনলেই উনাদের গায়ে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যায়। উনারা মৃগি রোগীর মতো খিচুনি দিয়ে ওঠেন। মাননীয় স্পিকার, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক। তার বিরুদ্ধে সরকার ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করেছে। (সরকারি দলের সদস্যদের হৈহৈ ও চিত্কার )
মাননীয় স্পিকার, বিএনপির নেতৃত্বের ক্ষেত্রে শহীদ জিয়া ও খালেদা জিয়ার পর কে—প্রশ্ন করা হলে সবাই এক বাক্যে বলবেন—তারেক রহমান। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনার পর কে প্রশ্ন করা হলে উত্তর দেয়া সম্ভব নয় বলেই তারেক রহমানের ব্যাপারে সরকারের এত গাত্রদাহ। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বানোয়াট অর্থ পাচার মামলায় ভুয়া অভিযোগ প্রমাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডেবরা না থেবরা নামের এক বুড়ি সাদা চামড়ার শয়তান মহিলা ভাড়া করে আনা হয়েছে। (এ সময় স্পিকার বলেন, শয়তান ও বুড়ি শব্দ দু’টি এক্সপাঞ্জ করা হলো।) মাননীয় স্পিকার, সরকারের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ আজ স্লোগান দিচ্ছে চশমা পরা বুবুজান, নৌকা লইয়া ভারত যান। অথচ প্রধানমন্ত্রী আমাদের নেত্রীকে পাকিস্তান যেতে বলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে দুই নেত্রীকে বিদেশ পাঠাতে চাইলে শেখ হাসিনা চলে গিয়েছিলেন। অথচ আমাদের নেত্রী বলেছেন—এ দেশ আমার ঠিকানা, বিদেশে আমার কেউ নেই। আমি এদেশ ছেড়ে যাব না।
মাননীয় স্পিকার, ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা আইএসআইর কাছে থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার নিয়েছিলেন। এ নিয়ে তখন ভারত অসন্তুষ্টও হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে উনি মইন ইউ আহমদের কোলে বসেছেন। শুধু মইন নয়, আরও কোথায় কোথায় বসেছেন এদেশের মানুষ জানে। উনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় মদ পান করে মাতলামি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। জয় এখন আমেরিকায় কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করছে। তার বাবাতো ব্যবসায়ী ছিলেন না। কোথায় পেয়েছে এত টাকা তার বিচার একদিন হবে। মাননীয় স্পিকার, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মানুষ বলে-তার জন্মের সময় মুখে মধু দেয়া হয়নি। একটি গান আছে তুতু তু তুতু তারা-মর্জিনার মা মার্কা মারা। এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে বলছে-তুতু তু তুতু তারা, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মুখ মার্কা মারা। মাননীয় স্পিকার, ভারতীয় বিএসএফ আমার ভাইকে লুঙ্গি খুলে পেটানোর পরও এক মন্ত্রী বলেন সবকিছু ঠিক আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে চাই-যেভাবে ভারতের দালালি করছেন কিছু দিন পর ভারতীয় মহিলা পুলিশ আপনাকে এবং আইন প্রতিমন্ত্রীকে লুঙ্গি খুলে পেটালে কী বলবেন। আইন প্রতিমন্ত্রী কথা বললে মুখ থেকে নর্দমার গন্ধ বের হয়। জনরোষে মুখে এসব মন্ত্রী কাপড় ছাড়াই দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হবে। মাননীয় স্পিকার, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন তারা। এটা দিবাস্বপ্ন। এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। আর বিএনপি ছাড়া কোনো নির্বাচন এদেশের মানুষ হতে দেবে না। যতই আমাদের নির্যাতন করেন, আমরা ভয় পাই না। আমরা শহীদ জিয়ার সূর্যসৈনিক। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী কোনো ষড়যন্ত্রই আমরা সফল হতে দেব না। দাদা বাবু, কাকা বাবুদের দিয়ে এদেশকে নতজানু করে রাখতে পারবে না। রানুর বক্তব্য চলাকালেই মাইক বন্ধ হয়ে যায়। স্পিকার বলেন, মাননীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্যে অসংসদীয় কিছু থাকলে তা এক্সপাঞ্জ করা হবে। পরে স্পিকার মাগরিবের নামাজের বিরতি ঘোষণা করলে উত্তাপ থামে। 



*****************************************************************************
গত ১৮ মার্চের সংসদ অধিবেশন যারা দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’ কথাটার অর্থ বুঝতে পেরেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশেষ করে বিএনপির এমপি রেহানা আক্তার রানু। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে এতদিন যথেচ্ছভাবে চালিয়ে এসেছেন আওয়ামী মহাজোটের মন্ত্রী-এমপিরা। সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করাসহ যা ইচ্ছা তা তো করেছেনই, বলেছেনও তারা সীমা ছাড়িয়েই। বিরোধী দলকে তুলাধোনা করার ব্যাপারে তাদের কেউ কেউ অসংসদীয়, এমনকি অশ্লীল বাক্যের ব্যবহারেও দ্বিধাহীন থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও পিছিয়ে থাকেননি। প্রাসঙ্গিকতা থাকুক না থাকুক বহুবার তিনি বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ধরে টানাটানি করেছেন। তার দুই ছেলেকে নিয়ে ব্যঙ্গ-তামাশা করেছেন। সব মিলিয়েই নবম জাতীয় সংসদকে তারা আওয়ামী সংসদে পরিণত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটার শুরু হয়েছে গত ১৮ মার্চ। ২০১১ সালের ১৫ মার্চের পর প্রথমবারের মতো অধিবেশনে যোগ দিয়েই সেদিন বিরোধী দল আলোড়ন তুলেছে। একটি একটি করে প্রসঙ্গ টেনে এনে কষে জবাব দিয়েছেন বিরোধী দলের এমপিরা। 
বিএনপির এমপি রেহানা আক্তার রানু তো রীতিমত মাতিয়েই তুলেছিলেন। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, পাকিস্তান ও ভারতের চরম উত্তেজনাপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচও সেদিন পাত্তা পায়নি। খেলা বাদ দিয়ে দর্শকরা সবাই টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন এমপি রানুর বক্তৃতা শুনতে। বলেছেনও তিনি যথেষ্ট জোরালো ভাষাতেই। শেয়ারবাজারের লুণ্ঠন থেকে ওয়াশিংটন, লন্ডন ও কানাডায় হাজার কোটির অংকে ডলার পাচার, গ্যাস ও বিদ্যুত্ সঙ্কট এবং পণ্যমূল্য পর্যন্ত কোনোকিছুই বাদ যায়নি। উচ্চ আদালতকে আওয়ামীকরণের অভিযোগও তিনি তথ্য-প্রমাণ দিয়েই তুলে ধরেছেন। সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের যে প্রতিক্রিয়া ক্ষমতাসীনরা ব্যক্ত করেছেন তার জবাবেও মন্ত্রীদের লুঙ্গিসংশ্লিষ্ট উদাহরণ সহযোগে দারুণ শুনিয়েছেন তিনি। প্রতিটি সমস্যা প্রসঙ্গে কঠোর সমালোচনা করেছেন সরকারের। দু’একটি বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের মনে জ্বালাও ধরিয়েছেন এমপি রানু। যেমন বলেছেন, ১৯৯১-এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের পায়ে ধরে সালাম করেছিলেন। তখন জামায়াতের কোনো দোষ ছিল না। জামায়াত যখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকে তখন ‘সঙ্গী’ হয় আর বিএনপির সঙ্গে গেলে একই জামায়াত হয়ে যায় ‘জঙ্গি’! একজন চাকরিজীবীর ছেলে হয়েও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় কীভাবে শত শত কোটি ডলারের মালিক হয়েছেন সে প্রশ্ন যেমন তুলেছেন, তেমনি আবার এ তথ্যও ফাঁস করে দিয়েছেন যে, জয় যুক্তরাষ্ট্রে একাধিকবার অপরাধ করে গ্রেফতার হয়েছেন এবং বিভিন্ন মেয়াদে জেল খেটেছেন। 
বিএনপির এই এমপি তাই বলে স্বাচ্ছন্দ্যে বক্তৃতা করতে পারেননি। আওয়ামী লীগের এমপিরা তাকে প্রতিটি কথার পিঠেই বাধা দিয়েছেন। এদের মধ্যে বাপ্পি নামের এক মহিলা এমপি বার বার ‘চুপ’ বলে ধমক দিয়েছেন। এর আবার যুত্সই জবাব দিয়েছেন বিএনপির এমপি শাম্মী। তিনি বাপ্পিকেই উল্টো চুপ থাকতে বলেছিলেন। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হয়েছিল। পরে উভয় দলের কয়েকজন সিনিয়র এমপির হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারেনি। এদিকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এমপি রানুর বক্তব্যে নাকি তথাকথিত ‘অশালীন’ কিছু শব্দ বা কথা ছিল। কিন্তু জনগণের সচেতন অংশ বলেছেন, এমপি রানু আসলে ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’ প্রবাদটিকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কারণ, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এমন দু’চারজন রয়েছেন যাদের আক্রমণাত্মক বক্তব্যের জবাবে এ ধরনের পাল্টা আক্রমণ চালানো ছাড়া উপায় থাকে না। তারা ভদ্র ভাষায় যেমন বলেন না, তেমনি বোঝেনও না ভদ্র ভাষার কথা। এখানে একটি বিশেষ তথ্য স্মরণ করা দরকার। আওয়ামী লীগের লোকজন এমপি রানুর বিরুদ্ধে ‘অশালীন’ ভাষা ও শব্দে ‘খিস্তিখেউড়’ করার অভিযোগে পাড়া মাতাতে চাইলেও মাননীয় স্পিকার কিন্তু তার মাত্র দুটি শব্দকে ‘অসংসদীয়’ হিসেবে চিহ্নিত করে এক্সপাঞ্জ করেছেন। শব্দ দুটি ছিল ‘বুড়ি’ এবং ‘শয়তান’। এ দুটি শব্দ তিনি কাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন সেটা একটি প্রশ্ন বটে তবে এমপি রানুর সম্পূর্ণ বক্তৃতাকে ‘অশালীন’ বা ‘খিস্তিখেউড়’ বলার সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীনরা ক্ষিপ্ত হলেও এমপি রানু বরং সাধারণ মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কারণ, যতই অপপ্রচার চালানো হোক না কেন, তার দুটি শব্দ ছাড়া তার পুরো বক্তৃতাই ছিল সংসদীয় রীতি অনুযায়ী যথাযথ। 
এমপি রানুর অনেক কথা নিয়েই জোর আলোচনা চলছে। আলোচিত হচ্ছে বিশেষ করে সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রসঙ্গ। বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারেও এমপি রানু কোনো মহাদোষ করে ফেলেননি। কারণ, জয় কার ছেলে বা মেয়ের জামাই সেটা বড় কথা নয়। বিদেশে তার প্রধান পরিচয়, তিনি পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা। সে অর্থে বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীই অপরাধ করে যুক্তরাষ্ট্রে জেল খেটেছেন। এ ভারি লজ্জার কথাই বটে। এমপি রানুও সে কথাটাই বলেছেন। ফলে রাজনৈতিক অর্থে কোনো দোষই করেননি তিনি। এমপি রানু বরং দিন-তারিখ ধরে ধরে উল্লেখ করেছেন, কবে ঢাকায়, টেক্সাসে এবং ভার্জিনিয়ায় জয় কোন অপরাধে গ্রেফতার হয়ে কতদিন জেল খেটেছেন। কথাগুলো মানুষের মনে ধরেছে এজন্য যে, অন্যরা তো বটেই, এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বেগম খালেদা জিয়ার ছেলেদের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই মানিলন্ডারিংসহ কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করার অভিযোগ তুলে চলেছেন। ব্যঙ্গ করে শোনাচ্ছেন, বেগম জিয়ার ছেলেরা নাকি মানিলন্ডারিং-এ ‘গ্র্যাজুয়েশন’ করেছেন! বলা হচ্ছে, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিন বছরেও যেহেতু কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেননি সেহেতু প্রধানমন্ত্রীর উচিত অবিলম্বে খান্ত দেয়া। না হলে জয়কে ধরে টানাটানি আরও বাড়তেই থাকবে। আর জয়ের সমস্যা হলো, তিনি যে গ্রেফতার হয়েছেন এবং জেল খেটেছেন সে তো প্রমাণিত সত্য! এ সংক্রান্ত রেকর্ডও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
অন্যদিকে এমপি রানুকে তুলাধোনো করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দু-একজন যে ভাষা ব্যবহার করেছেন সেগুলোই কিন্তু উল্টো খিস্তিখেউড় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলে বসেছেন, এমপি রানু নাকি এমন ভাষায় বলেছেন যে, সে ভাষা নাকি নিষিদ্ধ পল্লীতেও চলে না! নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দাদের প্রতিও জবরই মহব্বত দেখিয়েছেন দীপু মনি। বলেছেন, কথাটা বললেও এর মাধ্যমে নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দাদের তিনি ‘অবমাননা’ করতে চান না। প্রশ্ন উঠেছে, ওগুলো যে নিষিদ্ধ পল্লীরই ভাষা সে কথাই বা দীপু মনি জানলেন কী করে? এ ব্যাপারে পরদিন, ১৯ জানুয়ারি দুর্দান্ত কিছু কথা শুনিয়েছেন বিএনপির আরেক এমপি আসিফা অশরাফি পাপিয়া। তিনি বলেছেন, নিষিদ্ধ পল্লীর ভাষা কেবল তাদেরই জানার কথা যারা নিষিদ্ধ পল্লীতে বসবাস করে কিংবা নিষিদ্ধ পল্লীতে যাদের যাতায়াত রয়েছে। কথাটার মধ্য দিয়ে এমপি পাপিয়া সরাসরি দীপু মনিকেই পাকড়াও করেছেন। তার ইঙ্গিতে ও উদ্দেশ্যে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। এখানে লক্ষণীয় ছিল দীপু মনির তথা ক্ষমতাসীনদের মনোভাব। সংসদে কেমন ভাষায় কথা বলা উচিত—এ বিষয়ে ‘জ্ঞান’ দিতে গিয়ে দীপু মনি নিজেই উল্টো ‘ফাউল’ করে বসেছেন। না তিনি নিষিদ্ধ পল্লীর উদাহরণ টেনে আনেন, না তাকে সরাসরি ‘বোল্ড আউট’ হতে হয়! পর্যবেক্ষকরা অবশ্য দীপু মনির মতো সংসদে মাত্র সেদিন আগতদের খুব একটা দোষ দেয়ার পক্ষে নন। কারণ, এই শিক্ষা তারা তাদের নেত্রীর কাছ থেকে পেয়েছেন। সংসদের বাইরে তো বটেই, সংসদের ভেতরেও বিভিন্ন সময়ে শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছেলেদের নিয়ে এমন অনেক ব্যঙ্গ-তামাশাই করেছেন, যেগুলোর দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য বিএনপির রানুর মতো অন্তত ডজনখানেক এমপি দরকার। 
এভাবেই হঠাত্ সেদিন জমে উঠেছিল জাতীয় সংসদের অধিবেশন। উত্তেজনা ছিল পরদিন ১৯ মার্চও। বিএনপির দুই এমপি রানু ও পাপিয়া অন্তত একটি কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন। কথাটা হলো, ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। অন্য একটি কথাও হাড়ে হাড়ে টের পেতে হয়েছে ক্ষমতাসীনদের। ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’ বলে দেশে যে প্রবাদটি রয়েছে তার অর্থ তাদের বুঝিয়ে দেয়া হবে। এ ব্যাপারে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও জানান দিয়েছেন। ২০ মার্চ একঘণ্টা ৫৩ মিনিটের দীর্ঘ ভাষণে তিনি আওয়ামী লীগের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। প্রকাশিত বিভিন্ন খবর ও তথ্যের উল্লেখ করে তিনি প্রমাণ করেছেন, আওয়ামী লীগ আসলেও একটি সন্ত্রাসী দল। দলটি ক্ষমতায় থাকার সময় তো বটেই, বিরোধী দলে থাকার সময়ও হত্যা-সন্ত্রাসকেই কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। বেগম জিয়া তাই বলে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেননি, উস্কানিও দেননি। তিনি বরং সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন, সরকার যদি দেশ ও জাতির স্বার্থে কোনো ভূমিকা পালনের উদ্যোগ নেয়। 
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছেন, হাজার ধুলেও কয়লার আসলেই ময়লা যায় না। এমন মন্তব্যের কারণ, প্রধানমন্ত্রী সাধারণত কম যান না বরং আগ বাড়িয়ে পা বাড়িয়ে থাকেন। সেদিনও তিনি যথেষ্টই শুনিয়েছেন। এসবের মধ্যে তার দুঃখ করাটা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার ছেলে-মেয়েদের সম্পর্কে ‘অসত্য ও আজেবাজে মন্তব্য’ এবং একজন এমপির ‘অশালীন ও অশোভন বক্তব্য’ ছিল এই দুঃখের কারণ। সংসদ সদস্য হিসেবে জাতির কাছে দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি তিনি নিজের এবং বোন রেহানার ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা ও বিভিন্ন ডিগ্রির ফিরিস্তি দিয়েছেন। এদের মধ্যে কে হার্ভার্ড থেকে মাস্টার্স করেছেন, কে আবার ডাবল মাস্টার্স করেছেন—সেসব তথ্যও শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু জানাননি, চাকরিজীবীর সন্তান হয়েও কীভাবে বিদেশে লেখাপড়া করেছেন তাদের সন্তানরা। কারণ, শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া সারা জীবন সরকারি চাকরি করেছেন, অন্যদিকে শেখ রেহানার স্বামী শফিক সিদ্দিকী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাছাড়া বহু বছর ধরে তিনি অসুস্থ রয়েছেন। অর্থাত্ দৃশ্যমান কোনো আয় নেই তার। তা সত্ত্বেও এই দু’জনের সন্তানরা হার্ভার্ড এবং অক্সফোর্ডের মতো ‘বিশ্ববিখ্যাত’ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার—এমনকি ‘ডাবল মাস্টার্স’ করার মতো বিপুল অর্থ পেলেন কোথায় এ ধরনের কোনো প্রশ্নেরও উত্তর ছিল না প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। বলাবাহুল্য, কথাগুলো তিনি কাকে শুনিয়েছেন এবং এর মধ্য দিয়ে ঠিক কার সন্তানদের সঙ্গে নিজেদের সন্তানদের তুলনা করেছেন তা বুঝতে সাধারণ মানুষেরও অসুবিধা হয়নি। অন্য একটি প্রসঙ্গেও রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ১৯৯১ সালে চাইলে তারাও নাকি জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারতেন। কিন্তু তাদের কাছে নাকি ক্ষমতায় যাওয়াটাই ‘বড় কথা’ ছিল না! কথাগুলোর জবাব রয়েছে বিএনপির দুই এমপি রানু ও পাপিয়ার বক্তৃতার মধ্যে। সমর্থনের জন্য কারা জামায়াতের নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলেন, কারা রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থনের জন্য জামায়াতের সঙ্গে দেনদরবার করেছিলেন এসব বিষয়ে সংবাদপত্রেও প্রচুর সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী বললেই এসব তথ্য ‘অসত্য ও আজেবাজে’ হয়ে যাবে না। 
প্রসঙ্গক্রমে এখানে কিছু ইঙ্গিতও দিয়ে রাখা দরকার। এমপি রানু ও পাপিয়াকে শুধু নয়, বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকেও ‘চুপ-চুপ’ ও ‘ধর-ধর’ বলে বাধাগ্রস্ত করেছেন আওয়ামী এমপিরা। খালেদা জিয়ার সুলিখিত ভাষণটি ঠাসা ছিল প্রকাশিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য ও পরিসংখ্যানে। কিন্তু এত লেখাপড়া করনেওয়ালাদের মা-খালা ও মামা-চাচাদের মুখেও ‘থিসিস’ বা ‘অভিসন্দর্ভ’ ধরনের শব্দ শোনা যায়নি। তারা বলেছেন, খালেদা জিয়া নাকি কাউকে দিয়ে ‘উপন্যাস’ লিখিয়ে এনেছেন এবং সেটাই পড়ে শুনিয়েছেন! ‘নিষিদ্ধ পল্লী’ ও ‘উপন্যাস’ জাতীয় কথা শোনানোর পাশাপাশি নেতিবাচক ও অভদ্রজনোচিত আচরণ এবং প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতেও বর্তমান সংসদের সম্ভাবনা সম্পর্কে যে কোনো ধারণা করা যেতেই পারে। তা সত্ত্বেও অপেক্ষা করা এবং দেখা দরকার, আওয়ামী লীগ ও তার জোটের সঙ্গীরা গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসবেন, নাকি বারবার তারা এমপি রানু ও পাপিয়ার ঠ্যালার সামনেই পড়তে থাকবেন!

লেখক : শাহ আহমদ রেজা, সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন