জিয়া - তাহের বিতর্কঃ

কর্নেল তাহেরের সামরিক আদালতে বিচারের বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। অত:এব এ নিয়ে আমার মতো আইন বিষয়ে উম্মি মানুষের কোনো কথা বলা উচিত নয়, সমীচীনও নয়। তবে আমি ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে ওই সময়ের ঘটনা কিভাবে অবলোকন করেছি এবং মোকাবেলা করেছি, সে বিষয়ে কিছু সামান্য অভিজ্ঞতা করজোড়ে আপনাদের সামনে উপস্খাপন করতে চাই। সামান্য অভিজ্ঞতা এ জন্যই বলছি যে, এই মহা ঘটনার সব খুঁটিনাটি বিষয় লিখতে হলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। আর করজোড়ে উপস্খাপনের ব্যাপারে বলব, প্রশ্ন হতে পারে যা আমি আজকে সবার সামনে আনছি তা অতীতে কেন আনিনি। এর জবাবে বলব, সামরিক বাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্খায় এমন বিষয় নিয়ে লেখা আর শরীরের একটি ভালো জায়গা চুলকিয়ে ঘা করা­ একই কথা। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। তাই আমিও এ নিয়ে যা সমীচীন তাই করেছি। বিখ্যাত সাংবাদিক লিফশুলজ বাংলাদেশে এসেছেন এবং মহামান্য হাইকোর্টের ডাকে সাড়া দিয়ে হাইকোর্টে সাক্ষ্যও প্রদান করেছেন। সাংবাদিক লিফশুলজের মহামান্য হাইকোর্টে প্রদত্ত মামলাসংক্রান্ত সাক্ষ্য সংবাদপত্রে পড়েছি এবং নির্মোহভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি­ আজকের বাস্তবতায় তিনি ঘটনার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা তার মতো করে প্রায় একই সুরে জিয়াবিরোধীদের মুখে শুনতে শুনতে অন্তত আমার কান পচে গেছে। জিয়া নিরপরাধ কর্নেল তাহেরকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের প্রহসন করে বিনা বিচারে হত্যা করেছেন প্রভৃতি।


কর্নেল তাহেরের বিচার সামরিক আদালতে অনুষ্ঠান সঠিক ছিল কি ছিল না, সে সম্বìেধ আমি কোনো মন্তব্য করব না। কিন্তু কর্নেল তাহের নিরপরাধ ছিলেন বিষয়টি কতখানি সত্য বা ঠিক, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। সাংবাদিক লিফশুলজকে সবিনয়ে প্রশ্ন করতে চাই­ তিনি যে দেশের মানুষ সে দেশের সেনাবাহিনীতে সে দেশের কোনো কমিউনিস্ট সংগঠন অতিগোপনে সংবিধান বহির্ভূতভাবে সেনাবাহিনীতে সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই জেসিও’র (ওয়ারেন্ট অফিসার) ওপরে অফিসার নাই­ এমন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পিপলস আর্মি গঠনের বাস্তব পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং গ্রহণ করে তা প্রয়োগের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ সংঘটিত করে বিদ্রোহের কারণে বহু অফিসার নির্মমভাবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্খার গুলিতে নিহত হলেও বিপ্লব সংগঠনকারীরা পরাজিত হলে আমেরিকার কোন কোর্টে এবং আমেরিকার কোন আইনে তাদের বিচার হতো? আমার প্রশ্ন­ এ ধরনের সেনাবাহিনীতে বেআইনি বিপ্লব সংগঠনকারীরা কি নিরপরাধ?

আমি সবিনয়ে মি. লিফশুলজকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এই অল্প কিছু দিন আগে আফগানিস্তানে আমেরিকান একজন কমান্ডিং জেনারেল একটি ম্যাগাজিনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে অসম্মানজনক বক্তব্য দেয়ার কারণে ওই জেনারেলকে কংগ্রেসে শুনানির নামে হেনস্তা করা হয় এবং তাকে পদত্যাগের মাধ্যমে চাকরি ছাড়তে হয়। কেন? আমেরিকার মতো চরম ব্যক্তি স্বাধীনতার দেশে ব্যক্তি মতামত প্রকাশের জন্য একজন জেনারেলকে কেন হেনস্তা হতে হয় এবং চাকরিছাড়া করা হয়? প্রতিটি দেশের সেনাবাহিনী প্রায় একই প্রকার মনোভঙ্গি এবং দৃষ্টিভঙ্গির ধারক। সেনাবাহিনীর এই বিশেষ মনোভঙ্গিকে ধারণ করতে হলে সেনাবাহিনীকে জানতে হয়, শিখতে হয়, সমরবিদ হতে হয় এবং সামরিক আইন সম্বìেধ বিশারদ হতে হয়।

আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে চীনের সমরবিদ সানজু ‘দি আর্ট অব ওয়ার’ রচনা করেন। ঘটনাটা ছিল এ রকম : চীনের সম্রাট রাজ পরিষদ নিয়ে উন্মুক্ত মাঠের মঞ্চে আসীন। হাজারো দর্শক। মাঠের মধ্যখানে সম্রাটের বেশ কিছু ‘কনকুবাইন’ (উপপত্নী) সারিবদ্ধভাবে সামরিক কায়দায় দণ্ডায়মান। সানজু কমান্ডার হিসেবে সামনে দাঁড়িয়ে। সানজু কনকুবাইনদের বললেন, আমি যখন ডাইনে ঘুরতে আদেশ দেবো, তখন সবাই একসাথে ডাইনে ঘুরবে। আমি যখন বামে ঘুরতে আদেশ দেবো, তখন সবাই একসাথে বাঁয়ে ঘুরতে হবে। সানজু ডাইনে ঘুরতে আদেশ দিলে সব কনকুবাইন হাসিতে উচ্ছলিত হয়ে ডাইনে ঘুরল না। সানজু বললেন, যদি জেনারেলের আদেশ প্রতিপালিত না হয়, তবে আদেশ সঠিকভাবে প্রদান হয়নি। এবার সানজু উপপত্নীদের বাঁয়ে ঘোরার আদেশ দিলে একইভাবে তারা হেসে উড়িয়ে দিলো।

যখন সানজুর আদেশ তৃতীয়বার প্রতিপালিত হলো না, তখন তিনি বললেন, আদেশ প্রতিপালিত না হওয়ার জন্য আন্ডার কমান্ড দায়ী। সানজু তৎক্ষণাৎ তার কোষের তরবারি উন্মুক্ত করে সবচেয়ে সুন্দর এবং সর্ব ডাইনে দণ্ডায়মান একজন কনকুবাইনের মাথা কেটে ফেললেন। সবাই আতঙ্কিত এবং হতবাক হয়ে ঘটনা অবলোকন করল। এবার যখন সানজু ডাইনে ঘোরার আদেশ করলেন, তখন সারিবদ্ধ সব কনকুবাইন পূর্ণ শৃঙ্খলার সাথে সে আদেশ পালন করল। ইউএস আর্মিতে যেমন বাংলাদেশ আর্মিতেও তেমনি মনের মাধুরী মিশিয়ে কমান্ড দিলে তা প্রতিপালিত হবে না। সামরিক বিষয় যেমন প্রাক্টিক্যাল, তেমনি সামরিক আইনও প্রাক্টিক্যাল। এর প্রয়োগ বাস্তবভাবে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলব : যখন বনি ইসরাইলিরা সিনাই মরুভূমিতে হজরত মুসা আ:-এর নেতৃত্বে উদ্বাস্তু হিসেবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তখন তাদের জন্য প্রাক্টিক্যাল ‘ল’ দাঁতের বদলে দাঁত এবং চোখের বদলে চোখ এমন প্রাক্টিক্যাল আইন প্রয়োগের আদেশ ছিল। কারণ ওই চলমান অবস্খার জন্য মরুভূমিতে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে বিচার করে জেলে দেয়ার বাস্তব অবস্খা ছিল না। তাৎক্ষণিক অপরাধ তাৎক্ষণিক বিচার। সামরিক বিষয় প্রায় এই রকম। একটা বিষয় ভুললে চলবে না, কর্নেল তাহের সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার এবং তিনি ও তার অনুগামীরা মিলে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক সংস্খা নামের কমিউনিস্ট আদর্শের সংবিধানবহির্ভূত অবৈধ গোপন সংগঠন তৈরি করে সামরিক বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল, দেশের সামরিক বাহিনীকে আইনবহির্ভূত অবৈধভাবে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করা। ওই সময়ের অবস্খা বিবেচনায় নিলে চরম বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য এমন কঠোর আইনে বিচার সমীচীন ছিল বলে অন্যরা মনে করেন।

কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে গোপন সংগঠন সৈনিক সংস্খার মাধ্যমে যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চরম বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, তখন আমি ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন পদবির একজন অফিসার হিসেবে একটি পদাতিক কোম্পানির কমান্ড করছিলাম। আমাদের ব্যাটালিয়ন শেরেবাংলা নগর সংসদ ভবনে অবস্খান করছিল। হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম, ইউনিটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। সৈনিকরা নিজ নিজ অস্ত্র হাতে বেরিয়ে এসে আকাশে গুলি ছুড়ছে। আমি সৈনিকদের দিকে এগিয়ে এলে শুনতে পেলাম, সৈনিকরা যে যার মতো বলছে, ‘সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই জেসিও’র ওপরে অফিসার নাই।’ এই অবস্খা দেখে আমি আমার বিশ্বস্ত রানার (ব্যক্তিগত সহকারী) সৈনিককে ডেকে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? সে জানাল, আর্মিতে বিদ্রোহ হয়েছে। এখন থেকে কোনো অফিসার থাকবে না সেনাবাহিনীতে। জেসিওরা (জুনিয়র কমিশন অফিসার) সেনাবাহিনীর কমান্ডার হবেন। এমন সময় কিছু সৈনিক আমার দিকে এগিয়ে এসে উগ্র মূর্তিতে অতি উচ্চৈ:স্বরে বলল, আপনারা বুর্জুয়া সাম্রাজ্যবাদী সামন্ত প্রকৃতির। আমরা নিজেরা সেনাবাহিনী কমান্ড করব। জেসিওরা এখন থেকে সেনাবাহিনীর বড় অফিসার হবেন। সৈনিকরা আমাকে বলল, সিও (কমান্ডিং অফিসার) সাহেব বলে ব্যাটালিয়নে এখন আর কেউ নেই। তার কোনো কমান্ড নেই। আপনি আপনার র‌্যাংক ব্যাজ খুলে ফেলেন। আমি যখন ঘাড়ের র‌্যাংক ব্যাজ খুলছিলাম, তখন আমার কোম্পানির কিছু সৈনিক এসে আমাকে ঘিরে ফেলে বলল, ‘স্যার অবস্খা এখন এমন। আমরা সবাই এখনো এতে যোগ দেই নাই। আপনি আপনার রুমে চলে যান এবং র‌্যাংক ব্যাজ খুলে ফেলেন।’ সৈনিকরা আমাকে আরো বলল, ‘স্যার মনে হচ্ছে যেকোনো সময় আপনাকে মেরে ফেলতে পারে। সব সৈনিক এখনো সৈনিক সংস্খায় যোগ দেয় নাই জানতে পেরে আশান্বিত হলাম।’ আমি তৎক্ষণাৎ কোম্পানি হাবিলদার মেজরকে কোম্পানি কলইন করতে বললাম। আমার ধারণা ছিল, হয়তো আমার কথা মানবে। কিন্তু দেখলাম, বেশির ভাগ সৈনিক কমান্ড মানল না। অল্প যারা ছিল তাদের বললাম তোমরা যা করছ তা ঠিক নয়। এতে সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি আরো বললাম, তোমরা আকাশে গুলি করছ, এতে তো দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। উপস্খিত সৈনিকরা বলল, স্যার সবাই ট্রাক আর ওয়ানইন গাড়ি নিয়ে শহরে চলে গেছে এবং সমানে আকাশে গুলি ছুড়ছে। আমরাও যাচ্ছি বলে সবাই স্খান ত্যাগ করল। আমি ব্যাটালিয়নের প্যারেট অফিসার (যে অফিসার কমিশনপ্রাপ্তির পর প্রথম ব্যাটালিয়নে পোস্টিং হয়) ছিলাম। আমাদের সুবেদার মেজর নজরুল ইসলাম (প্রয়াত) এসে আমাকে জানাল, ‘স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপনাদের বোধ হয় আর বাঁচানো যাবে না। সিও সাহেবের কোনো কমান্ড নাই। কেউ কারো কমান্ড মানছে না। চরম বিশৃঙ্খলা অবস্খা। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অন্য ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা এসে আপনাদের মেরে ফেলতে বলছে।’ আমি সুবেদার মেজরকে বললাম, আপনি সবশেষ পরিস্খিতি জানাবেন। এমন সময় তখন সìধ্যা হয়ে আসছে। আমার কোম্পানির সিনিয়র জেসিও সুবেদার খায়ের পাঁচ-ছয়জন সৈনিক নিয়ে আমার সামনে এসে উগ্রমূর্তি হয়ে উচ্চৈ:স্বরে বলল, ‘আপনারা গাদ্দার।’ এই বলে সে তার এসএমজি (সাব মেশিনগান) কক করে আমাকে গুলি করার জন্য তাক করতেই সুবেদার মেজর নজরুল এসএমজির নল ধরে ফেলে। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, ‘খায়ের খবরদার আমার প্যারেড অফিসার’ এই বলে সুবেদার মেজর নজরুল সুবেদার খায়েরকে গুলি চালাতে বিরত করে সবাইকে নিয়ে স্খান ত্যাগ করল। আমি ওই সময় বলেছিলাম, খায়ের সাহেব আমার বাবা আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, আমি অফিসার হয়েছি। আপনি পারেননি তাতে আমার দোষ কোথায়?

তখন সìধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আমি সম্ভবত ওই সময় পাঁচ নম্বর ব্লকে ছিলাম। আমার রানারকে ডেকে জানতে চাইলাম শেষ পরিস্খিতি কী? সে জানাল, স্যার অনেক অফিসার মারা গেছেন। অন্য ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা বলছে, আপনারাও বাঁচবেন না। আমি চিন্তা করলাম, এভাবে কতক্ষণ বাঁচব জানি না। শেষ চেষ্টা হিসেবে শেষবারের মতো সৈনিকদের সাথে কথা বলতে চাইলাম। আমি রানারকে বললাম, হাবিলদার মেজরকে সংবাদ দাও এবং যারা আছে সবাইকে ফলইন হতে বলো, আমি কথা বলব। কয়েকজন সৈনিকসহ বিভিন্ন র‌্যাংকের সৈনিকরা ফলইন হলে আমি তাদের সামনে গিয়ে বললাম, আমাকে কে মারতে চাও হাত তোল। যখন কেউ হাত তুলল না, তখন আমি বললাম, আমি এখন আমার রুমে চলে যাবো। যে আমাকে মারতে চাও আমার রুমে এসে আমাকে বলবে, আমি অজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে র‌্যাংকসহ ইউফর্ম পরে তৈরি হবো। আমার এসএমজি অথবা পিস্তল দিয়ে সামনে থেকে আমার বুকের বাম দিকে গুলি করবে। আমার মৃত্যু হলে আমাকে ইউনিফর্ম পরা অবস্খায় আমার দেশের বাড়ির পারিবারিক কবরস্খানে গার্ড অব অনার দিয়ে তোমরা দাফন করবে। এই বলে আমি রুমে চলে গেলাম। রাত ১০টা কিংবা ১১টার দিকে মনে হলো কিছু সৈনিক আমার রুমের দিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আমি ধরে নিলাম আমার মৃত্যুর সময় এসে গেছে। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, আমি কোনো প্রকার ভয় কিংবা চিন্তাচ্ছন্ন ছিলাম না। এই অনুভূতি কোনো মানুষের পক্ষে ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শুধু মায়ের কথা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার মা আমার মৃত্যুর সংবাদ শুনে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবে। আমার মৃত্যুর শোক তিনি কিভাবে সইবেন, মনে হচ্ছিল আমার মৃত্যু তো এভাবে হওয়ার কথা নয়। আমি কি অপরাধ করেছি! দেখলাম আমার কোম্পানির হাবিলদার মেজর আরো চার-পাঁচজন সৈনিকসহ আমার রুমে প্রবেশ করে জানাল, ‘স্যার আপনি ঘুমান, আমরা পাহারা দিচ্ছি। আমাদের না মেরে ওরা আপনাকে মারতে পারবে না।’ ওদের কথায় আশার আলো দেখতে পেলাম। মনে হলো, এখনো সবাই ওই সংস্খায় যোগ দেয়নি। পরদিন সকালে ব্যাটালিয়ন সদরে গেলাম। দেখলাম, জিও লে. কর্নেল নওয়াজেশ দুইজন অফিসারসহ বসে আছেন। আমি স্যালুট করতে তিনি খেদোক্তি করে বললেন, আর কিসের স্যালুট? বেঁচে আছি এটাই যথেষ্ট। দেখলাম, কোনো সৈনিক জিওকে স্যালুট করছে না। সবার হাতে অস্ত্র। এই প্রথম উপলব্ধি করলাম, কমান্ড কিভাবে চলে যায়। কমান্ড না থাকলে ব্যাটালিয়ন সৈনিকরা যে কি পরিমাণ ভয়াবহ কিলিং মেশিনে পরিণত হয়, তা প্রত্যক্ষ করলাম প্রথমবারের মতো সে দিন। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, সেনাবাহিনীর কমান্ড এবং শৃঙ্খলা সম্বìেধ ধারণা সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘদিন তাতে না থাকলে সম্যক উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। মনের মাধুরী মিশিয়ে, হিউম্যান রাইটস, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তি অধিকারের মতো বিষয়গুলোকে ধারণ করে সামরিক বিষয়ের বিশ্লেষণ সম্ভব নয়।



ড. কামাল হোসেন তাহেরের বিচার অবৈধ ছিল বলে এমিকাস কিউরি হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘তাহেরের জীবন তো ফিরিয়ে দেয়া যাবে না, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সে ব্যবস্খা করতে হবে।’ (নয়া দিগন্ত ১৭ মার্চ ২০১১)। ড. কামালের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে সংবিধানবহির্ভূতভাবে সেনাবাহিনীতে অবৈধ গোপন সংগঠন সৈনিক সংস্খা গঠনের মাধ্যমে সেনা বিদ্রোহ সংঘটিতকরণে কর্নেল তাহের ও জড়িতরা যদি বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে পার পেয়ে যান, তা হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির নিরসন তো হবেই না, বরং এ দেশে বহু কর্নেল তাহেরের জন্ম হবে, যারা হীন উদ্দেশ্যসাধনের জন্য অবৈধভাবে সেনা বিদ্রোহ সংঘটিত করে দেশ ও জাতিকে বারবার মহাসঙ্কটে নিপতিত করবে। আপনি কি তা-ই চান? তদুপরি বিদ্রোহে নিহত অফিসারদের জীবন ফিরিয়ে দেবে কে?



মহামান্য হাইকোর্টের কাছে সবিনয়ে নিবেদন করতে চাই, ড. কামাল হোসেন ’৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে কৌশলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে কেন আত্মসমর্পণ করে নিজ শ্বশুরবাড়ি পাকিস্তানে চলে যান? জনশ্রুতি আছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস শ্বশুরবাড়িতে জামাই আদরে পার করে বঙ্গবìধুর সাথে দেশে ফিরে আসেন। যুদ্ধের ৯ মাস ড. কামাল পাকিস্তানে কোথায় ছিলেন কেউ জানে বলে মনে হয় না। এর কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন বলে জানা নেই। আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলে তার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইব। এ ধরনের বিতর্কিত ব্যক্তিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের রক্ত ও ঘামে জন্ম নেয়া আমাদের প্রাণপ্রিয় বীর সেনাবাহিনী এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়কদের সম্বìেধ ব্যাখ্যা জানতে মহামান্য হাইকোর্ট যখন এমিকাস কিউরি নিয়োগ করেন, তখন আমার মতো যারা ৯ মাস জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছি, আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।



মহামান্য হাইকোর্ট সাংবাদিক লিফশুলজের বক্তব্য শুনেছেন। মহামান্য হাইকোর্টের কাছে আমার করজোড়ে বিনীত নিবেদন, কর্নেল তাহেরের বিষয়ে বিস্তারিত সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্যক উপলব্ধি করতে এবং সামরিক আইনের মনোবৈজ্ঞানিক বিষয় এবং এর বাস্তবতা, সেনা শৃঙ্খলার সাথে এর আন্ত:সম্পর্ক নির্ণয় এবম্বিধ বিষয়ে অবহিত হতে অবসরপ্রাপ্ত সমরবিদ এবং সামরিক আইনবিদদের বক্তব্য আপনারা শুনুন। আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের ধন। আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক। যুক্তিতর্ক এবং আইনের মারপ্যাঁচে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত এবং এর মহানায়কদের কৌশলে বিতর্কিত করে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর মনোবল এবং শৌর্যবীর্যে আঘাত করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মহামান্য হাইকোর্টের সমীপে শেষ অনুরোধ (ক) সামরিক আদালতে কর্নেল তাহের এবং জড়িতদের বিচার সঠিক না হলে দেশের প্রচলিত আইনে এদের বিচার করে সমুচিত শাস্তির বিধান করুন, যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে কেউ সাহসী না হয়, (খ) ওই সময় সেনাবিদ্রোহের জন্য যারা নিহত হয়েছেন এবং আমার মতো যাদের জীবন মহাসঙ্কটে নিপতিত হয়েছিল, তাদের পক্ষে স্বত:প্রণোদিত হয়ে কর্নেল তাহের এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের মামলা রুজু করতে মহামান্য হাইকোর্টকে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।



লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অব. মেজর জেনারেল ও সাবেক বিডিআর প্রধান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন