গ্রুপ ক্যাপটেন (অবঃ) সাইফুল আজম দুইটি ভিন্ন দেশের বিমান বাহিনীকে এয়ার টু এয়ার কমব্যাটে (Dogfight) পরাস্ত করার এক অনন্য গৌরবের অধিকারী। ১৯৬৫ সালে তরুন ফ্লাইং অফিসার থাকা অবস্থায় তিনি ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি Folland Gnat বিমান ভূপাতিত করেন, যার স্বীকৃতি সরুপ তিনি সিতারা-ই-জুরাত (বাংলাদেশের বীরবিক্রম এর সমতুল্য, পাকিস্তানের তৃতীয় সামরীক বীরত্বের খেতাব) খেতাবে ভূষীত হন। এর দুই বছর পর ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সাইফুল আজম প্রথম পাকিস্তানী হিসেবে ইসরাইলী বিমান ভূপাতিত করার খ্যাতি অর্জন করেন। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মাত্র দুইটি মিশনে তিনি একটি Vatour Bomber, একটি super Mystere এবং একটি Mirage IIIC ভূপাতিত করেন। এর ফলে তার মোট শিকারের সংখ্যা দাড়ায় চারে। অদ্যাবধি তিনি ডগফাইটের ইতিহাসে ইসরাইলী বিমানের সর্বচ্চো শিকারী। তার অসাধারন কৌশল ও সাহসীকতায় মুগ্ধহয়ে জর্ডান ও ইরাক উভয় দেশই তাকে বীর পদক প্রদান করে।
১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি চারটি F-86 Sabre এর ফরমেশনে অংশ নিয়ে ভারতের ভূমীতে আক্রমনের উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করেন। হঠাত্ দুইটি ভারতীয় Folland Gnat (Folland Gnat, F-86 এর চেয়ে Superior) তাদের পথ রোধ করে। ঘটনার জেরে সৃষ্ট ডগফাইটে সাইফুল আজম একটি Folland Gnat গোলাবর্ষন করে ভূপাতিত করেন (পাইলট, ফ্লাইং অফিসার ভি মায়াদেব নিরাপদে Eject করে বেরিয়ে আসলে তাকে যুদ্ধবন্দি করা হয়)। অন্য Folland Gnat টি রনে ভঙ্গ দিয়েছে বুঝতে পারার পর সেটিকে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়।
১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে তত্কালীন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম এবং অপর আরেক জন পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সারওয়ার সাদ কে রাজকীয় জর্ডান বিমান বাহিনীতে প্রেষনে প্রেরন করা হয়। সেখানে তারা রাজকীয় জর্ডান বিমান বাহিনীর Hawker Hunter অপারেট করতেন। তারা সেখানে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ৫ জুন ১৯৬৭ সালে আল মাফরাক থেকে উড্ডয়নের পর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম একটি Mystere IV কে তার দ্বিতীয় শিকারে পরিনত করেন।
এই ঘটনার মাত্র দুই দিন পর, ৭ জুন ১৯৬৭ ইরাকী বিমান বাহিনীতে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে পশ্চিম ইরাকী এয়ার ফিল্ড H-3 এ তিনি অবস্থান করাকালে, ইসরাইলী জঙ্গী জেট এয়ার ফিল্ড H-3 আক্রমন করে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষীতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম ইরাকী Hawker Hunter বিমান নিয়ে উড্ডয়ন করে একটি Mirage III এবং একটি Vautour Bomber ভূপাতিত করেন (Vautour Bomber টির ছোট্ট কিছু ভগ্নাবশেষ সাইফুল আজমের Hunter এ গেথে থাকতে দেখা যায়, যা থেকে তার সহকর্মীরা বুঝতে পারেন বিমানটি ভূপাতিত হওয়ার আগেই তিনি বিধ্বস্ত করেছন)। উল্লেখ্য Mirage III সাইফুল আজেমর Hawker Hunter এর তুলনায় বহুগুনে Superior। এছাড়া Mystere IV ও এয়ার টু এয়ার কমব্যাটের ক্ষেত্রে Hawker Hunter এর চেয়ে Superior। Mirage III, Mystere IV সাইফুল আজেমর Skill, Tactics ও সাহসের কাছে পরাস্ত হয়েছে।
সাইফুল আজম ১৯৪১ সালে পাবনা জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত কোলকাতাতে তার শৈশব কাটান। ১৯৪৭ সালে তার পরিবার পূর্বাঞ্চলে চলে আসে যা মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) অংশে পড়ে। ১৯৫৫ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তাতানে গমন করেন এবং সেখানে তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান এয়ারফোর্স একাডেমী তে যোগদান করেন। ১৯৬০ সালে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে পাইলট অফিসার পদে কমিশন পান।
সাইফুল আজমকে Cessna T-37 বিমান দ্বারা জেট বিমানের প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে F-86 Sabre এর উপর উচ্চতর প্রশিক্ষনের জন্য তাকে এরিজোনিয়ার লিউক এয়ারফোর্স বেজে পঠানো হয়।
১৯৭১ সালে বাঙ্গালী হওয়ায় তাকে পাকিস্তান বিমান বাহিনী Grounded করে। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশের জন্ম হলে তিনি নতুন গঠিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর Director of Flight Safety এবং পরবর্তীতে Director of Operation হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭৭ সালে তিনি উইং কমান্ডার পদে পদোন্নতি পান এবং ঢাকা বিমান বাহিনী ঘাটির বেস কমান্ডার হন।
১৯৮০ সালে সাইফুল আজম বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে গ্রুপ ক্যাপটেন পদে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণ করার পর তিনি দুই টার্মে বেসরকারী বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি Film Development Corporation এর ব্যাবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন। তিনি ১৯৯১-১৯৯৬ সময়ে সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি বর্তমানে নাতাশা ট্রেডিং এজেন্সী, লিঃ (এয়ার ক্রাফট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান) এর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক। তিনি একটি ট্রাভেল এজেন্সীও পরিচালনা করেন।
২০০১ সালে তাকে যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনী বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। তিনি বাইশ জন “Living Eagles” এর একজন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন