রহস্যাবৃত জিয়া হত্যা-৭

সেনানিবাসে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় জেনারেল মঞ্জুরকে
এগিয়ে যাচ্ছিল জেনারেল মঞ্জুরের কনভয়টা। সমানের দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ আসতেই ব্রেক করলো গাড়িগুলো। জেনারেল তাঁকালেন মেজর রেজার দিকে। বুঝতে অসুবিধা হলো না কি বলতে চান তিনি। গাড়ি থেকে নেমে সোজা উঠে গেলেন মেজর রেজা একটা টিলার উপরে। যেদিক থেকে গুলির শব্দ আসছে সেদিকে তাকিয়ে অবস্থা দেখলেন রাস্তার উপর কারা জানি দৌড়াদৌড়ি করছে। স্যার, আমাদের বোধহয় সামনে আর এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। নিচে নেমে রেজা জানালেন জেনারেলকে।
বুঝে গেলেন জেনারেল মঞ্জুর সামনে আর এগুনো যাবে না। গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বললেন সবাইকে। ঘুরে গেলো গাড়িগুলোর মুখ। কিন্তু স্টার্ট নিলো না জেনারেলের জীপটা। কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন তিনি। আর দুটো গাড়িতে ভাগাভাগি
করে উঠে বসলেন সবাই। পিকআপ আর জীপটা এগিয়ে চললো চট্টগ্রামের দিকে।
zia 5-6-14 1.jpgঅনেকক্ষণ উপুড় হয়ে পড়েছিলেন মেজর মোজাফফর। ঝোপের আড়াল থেকে দেখেছেন, কর্নেল মতি আর মাহবুব একে অপরকে গুলি করে মৃত্যুবরণ করেছেন। বুঝলেন এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা উচিত হবে না। ঝোপের আড়ালে আড়ালে ক্রল করতে শুরু করলেন। এগিয়ে গেলেন অনেকদূর। পিঠে দুটো গুলি নিয়ে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে ত্রল করতে তবুও ‘বাঁচতে হবে’ একথা ভেবে এগিয়ে যেতে থাকলেন। এরপর একুশটা দিন মেজর মোজাফফর আশ্রয় নিয়েছিলেন অপরিচিত এক উপজাতীয়ের বাসায়। বেশ কয়েকদিন প্রচ- জ্বরে বেহুশ হয়েছিলেন। ঢাকা বেতার থেকে তখন জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে আড়াই লাখ টাকার ঘোষণা চলছে তার নামে। খবরের কাগজেও ছবি ছাপা হচ্ছে তার। বুঝলেন মোজাফফর একটু কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। ঢাকায় সম্পূর্ণ অপরিচিত এক উপজাতীয় ছেলেকে দিয়ে চিঠি পাঠালেন সেনা দপ্তরে। চিঠিতে লেখা ছিল রেডিওর ঘোষণা বন্ধ না হলে তিনি আত্মসমর্পণ করতে পারছেন না। কারণ, আড়াই লাখ টাকার লোভে রাস্তাঘাটে যে কেউ খুন করতে পারে তাকে। ভাগ্যক্রমে সেই উপজাতীয় ছেলেটি চিঠিটা পৌঁছালে রেডিওর ঘোষণা বন্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলের পথঘাট চেনা ছিল মেজর মোজাফফরের। আর অপেক্ষা না করে সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরার সাবরুম এলাকা দিয়ে চলে যান ভারতের আগরতলায়।
zia 5-6-14 2.jpgচট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে চলেছে জেনারেল মঞ্জুরের জীপ আর পিকআপটা। হাত তুললেন জেনারেল। থেমে গেলো গাড়ি দুটো। ‘গাড়ি এখানে ছেড়ে দিয়ে আমাদের হাটতে হবে’ বললেন জেনারেল। আহত অফিসার ফজলে হোসেন আর জামিলকে স্টেচারে বহন করার নির্দেশ দিলেন তিনি।
অসম্ভব, স্টেচারে শোয়া অবস্থাতেই বলে উঠলেন ফজলে হোসেন, আমাদের বহন করতে গিয়ে আপনারা ধরা পড়তে পারেন না। জেনারেল কিছু একটা বলতে গেলেন কিন্তু তার আগেই বলে উঠলেন কর্নেল ফজলে হোসেন, ‘স্যার আমার পরিচিত একটা কাঠের দোকান রয়েছে সামনে। অনেক কাঠ কিনেছি ওখান থেকে। আমাকে ওরা চেনে। আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আমাদের জন্য প্লিজ আপনাদের বিপদ ডেকে আনবেন না।’ চোখ দুটো ভিজে গেলো মিসেস মঞ্জুরের, বললেন, ফজলে ভাই, আপনাদের ফেলে আমরা যাবো না। ভাবী, আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন না। আপনারা চলে যান ভাবী, চলে যান। প্রায় ককিয়ে উঠলেন কর্নেল ফজলে হোসেন। এগিয়ে এলেন জেনারেল আহত দুজনের হাতে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বিদায় জানালেন। কথা হলো, মেজর খালেদ আর মেজর ইয়াজদানী গাড়ি এবং ওদের রেখে জেনারেলের সঙ্গে যোগ দেবেন পাশের গ্রামে। হুশ করে বেরিয়ে গেলো গাড়ি দুটো কর্নেল ফজলে হোসেন আর ক্যাপ্টেন জামিলকে নিয়ে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন জেনারেল। কিন্তু ফিরে এলো না খালেদ আর ইয়াজদানী। সবাই বসে ঠিক করে ফেললেন আর অপেক্ষা না করে রওনা হতে হবে হায়াকোয়ার পথে। গাইড ঠিক করা হলো পথ চিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পর পর গাইড বদল করা হলো পথে। তৃতীয় গাইডটি ওঁদের নিয়ে গেল একটা চা বাগানে।
zia 5-6-14 4.jpgঅবুঝ শিশু দুটো কাঁদতে শুরু করেছে খিদের জ্বালায়। সবাই ক্ষুধা-তৃষ্ণার কাতর। কিন্তু কিছুুতেই কান্না থামানো যাচ্ছে না জেনারেলের ছোট ছেলে আর কর্নেল দিলওয়ারের ছোট মেয়ের। গাইডকে ডেকে জেনারেল টাকা দিয়ে পাঠালেন মুড়ি আর কলা আনতে। অল্প কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলো গাইড। চোখে মুখে উত্তেজনার চিহ্ন। জেনারেল ওর দিকে তাকাতেই বলে উঠলো, তাড়াতাড়ি চা বাগানের ভেতর দিয়ে আমাদের চলে যেতে হবে। একটা মিলিটারির গাড়ি দেখেছে সে, তাতে দুজনকে চোখ বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে। উঠে পড়লেন সবাই। চা বাগানের ভেতর দিয়ে চলে গেলেন অনেক দূর। ক্লান্ত শরীর টেনে হিচঁরে হাজির হলেন সবাই চা বাগানের এক কুলীর বাড়িতে। ঠিক হলো রাতের অন্ধকারে রওনা হবেন সবাই।
মিসেস মঞ্জুর, মিসেস দিলওয়ার ও ছেলেমেয়েসহ খাওয়া শেষ করলে খেতে বসলেন জেনারেল আর মেজর গিয়াস। টেনশনে কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করছিলেন মেজর রেজা। না খেয়ে বসে রইলেন বারান্দায়। ঘেউ ঘেউ করে উঠলো কুকুরগুলো। চমকে উঠলেন মেজর রেজা। কুকুর ডাকছে কেন, রেজা ঘর থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন জেনারেল। জানি না স্যার, উত্তর দিলেন রেজা। কুইক ভেতরে ঢুকে পড় সবাই, নির্দেশ দিলেন জেনারেল। বাচ্চাদের নিয়ে ঘরে ঢোকে পড়লেন রেজা। কুকুরগুলো একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে। দরজার পাল্লাটা একটু ফাঁক করলেন রেজা, দূরে অবছা কয়েকজন মানুষের অস্তিত্ব টের পেলেন তিনি।
‘তোমরা পালাও মঞ্জুর, আমি ওদের দেরি করাবো ফিসফিস করে বললেন মিসেস মঞ্জুর।’ ‘না, আমি পালাবো না’, বললেন জেনারেল। ‘রেজা, তুমি আর গিয়াস চলে যাও’, রেজার দিকে তাকালেন তিনি। মেজর রেজা গেলেন না। অনেক কষ্টে মেজর গিয়াসকে রাজি করানো গেলো। তিনি বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। 
অনেকটা ডুব সাঁতার দিয়ে খালের উপর ঢেকে থাকা ঝোপটার নিচে ভেসে উঠলেন রেজা। ঝাঁকুনি দিয়ে পানি ঝরালেন স্টেনগানের। জেনারেল নির্দেশ দিয়েছেন যা কিছুই ঘটুক না কেন গুলি যেন না ছোটে রেজার স্টেনগান থেকে। খালের উপরের ঝোপটায় অনেকটা জোর করেই লুকিয়েছেন জেনারেলকে। অনেকগুলো হুইসেলের শব্দ শুনলেন রেজা। স্পষ্ট শুনলেন জেনারেল মঞ্জুরের কণ্ঠ, তোমরা এগোবে না। আমি নিজেই আসছি।
অনেকক্ষণ চুপচাপ। ঝোপ থেকে খালের পার বেয়ে মাথা তুললেন রেজা। জেনারেল ছেলেমেয়ে নিয়ে গাছের কাছে বসে সিগারেট খাচ্ছেন নির্বিকার চিত্তে। সামনে স্টেনগান নিয়ে পুলিশের একজন হাবিলদার আর কয়েকজন পুলিশ। মেজর রেজাকে প্রথম দেখলো জেনারেল মঞ্জুরের মেয়ে নিতু। বলে উঠলো, ‘পাপা রেজা আঙ্কেল।’ মেজর রেজা ততোক্ষণে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
প্রশ্নভরা দৃষ্টি নিয়ে রেজার দিকে তাকালেন জেনারেল। বললেন 'Why have you surrendered Reza?' সোজাসুজি উত্তর দিলেন রেজা, আপনার মতো একজন জেনারেলের মৃত্যুর কাছে আমার মতো একজন মেজরের মৃত্যু কিছুই না। I want to die with you sir,  অবাক বিস্ময়ে হাত রাখলেন জেনারেল রেজার কাঁধে, চোখ দুটো তার ঝাপসা হয়ে এলো।
zia 5-6-14 3.jpgহাটহাজারী থানার সামনে ভিড় উপচে পড়ছে। রেডিও শুনে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে সবার মনে। জেনারেল মঞ্জুরকে তারা এক নজর দেখতে চায়। একটা খালি রিকশার উপরে উঠে থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার থানার সামনে ভিড় না বাড়িয়ে চলে যেতে বলছেন সবাইকে।
টিনের ছাউনি দেওয়া পুলিশের অয়্যারলেস রুমের বাঁশের তৈরি খাটের উপর বসে আছেন স্বপরিবারে জেনারেল ও দিলওয়ারের পরিবার। মেজর রেজাও বসে আছেন একপাশে। চোখে সানগ্লাস, একটার পর আরেকটা সিগারেট টেনে চলেছেন জেনারেল মঞ্জুর।
ক্যাপ্টেন এমদাদকে নিয়ে সেনাবাহিনীর একটা গাড়ি ঢুকলো থানায়। সবাই তখন পুলিশের ট্রাকে বসে আছেন। এমদাদ এগিয়ে এসে সবাইকে ট্রাক থেকে নেমে সেনাবাহিনীর গাড়িতে উঠতে অনুরোধ জানালেন। নামলো না কেউ। ক্যাপ্টেন এমদাদ কি যেন বললেন সঙ্গে আসা সৈনিকদের। একজন সুবেদার কয়েকজন সেনিকসহ এগিয়ে গেলেন জেনারেলের দিকে। ‘নেমে আসেন’, অত্যন্ত কর্কশ শোনালো সুবেদারের গলা। ‘আমি পুলিশের সঙ্গে যেতে চাই’ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন তাকে জেনারেল। একটু সময় না দিয়ে কথা বলার সময় তোলা জেনারেলের হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে ট্রাক থেকে নামিয়ে ফেললো সুবেদার। ঝটপট পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো হাত আর চোখ। ঐ অবস্থাতেই সেনাবাহিনীর ট্রাকের পিছন দিকটাতে তুলে ফেললো তারা জেনারেলকে। পুরো বন্দীদের টেনে হিচঁড়ে নামিয়ে তোলা হলো সেনাবাহিনীর ট্রাকটাতে। চোখ বাঁধা অবস্থায়ও টের পেলেন জেনারেল মঞ্জুর অনেকগুলো গাড়ি একসঙ্গে চলছে চট্টগ্রামের দিকে। সেনাবাহিনীর হাতে মঞ্জুরকে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত সরাসরি এসেছিল ঢাকা থেকে।
তারপরের ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। বিভিন্নভাবে ধরা পড়লেন বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত অফিসাররা। কেউ কেউ আত্মসমর্পণ করলেন। খালেদ দু’তিন মাস পালিয়ে থেকে রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে ভারত-নেপাল হয়ে চলে যান ব্যাংকক। সেখানে ১৯৯০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মেজর মোজাফফর আগরতলা থেকে চলে যান বিদেশে। কারাগারে বসেই বন্দীরা জানতে পারেন ধরা পড়ার দিন ঢাকার নির্দেশে সেনানিবাসে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলি করে হত্যা করা হয় মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে। চট্টগ্রামের সেনাবাহিনীর কবরস্থানে মেজর জেনারেল মঞ্জুর, লে. ক. মতি এবং লে. ক. মাহবুবের কবর রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন