রহস্যাবৃত জিয়া হত্যা-৬

সামনে পথ বন্ধ, ধরা পড়তেই হবে

Zia killing logo.jpg১৯৮১ সালের ১ জুন। রাত আড়াইটা। জে. মঞ্জুরকে বহনকারী জীপটি একটানে সেনানিবাস থেকে বের হয়ে চলতে লাগলো হাটহাজারীর দিকে। অন্ধকার রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জীপ। জেনারেল মঞ্জুর হঠাৎ করে গাড়ি থামাতে বললেন। রাজি হলেন না মেজর মোজাফফর। ‘আমাদের আর একটু এগিয়ে গিয়ে থামা উচিত’-বললেন তিনি। মোজাফফরের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন মঞ্জুর। গাড়ি এগিয়ে যেতে থাকলো।
বেশ খানিকটা চলার পর হাটহাজারীর প্রায় কাছকাছি এলে গাড়ি থামাতে বললেন মেজর মোজাফফর। রাস্তার বাম দিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো জীপ। জে. মঞ্জুর গাড়িটাকে একটু আড়ালে পার্ক করতে বললেন। রাস্তায় নেমে এলেন তিনজন।
মনটাকে কেন যেন শান্ত করতে পারছেন না জেনারেল। বার বার তাকাচ্ছেন চট্টগ্রামের দিকে। তার পরিবারসহ আরো যাদের আসার কথা, কারোরই দেখা পাচ্ছেন না তিনি। মুখে বার বার বলছেন, এখনো আসছে না কেন ওরা। এগিয়ে এসে মেজর মোজাফফর বললেন, ‘স্যার জীবনে তো অনেক
স্যাকরিফাইস করেছেন, আরেকবার না হয় স্যাকরিফাইস করেন। আপনার ফ্যামিলিকে আল্লাহরPresident_Ziaur_Rahman_Bangladesh.jpg কাছে সপে দিন। ইনশাল্লাহ কোনো অসুবিধা হবে না।’ যেভাবে জেনারেল তাকিয়ে ছিলেন রাস্তার দিকে, সেভাবেই তাকিয়ে রইলেন; তবে বোঝা গেলো কথাটা তার কানে গিয়েছে। অনেকটা স্বগত সংলাপের মতো বললেন, ‘নো নো আইন ক্যান নট মুভ উইদাইট রানা (তার স্ত্রী)।’
হুস করে বেরিয়ে গেলো স্টাফ কারটা। অন্ধকারে বোধহয় জেনারেলকে দেখতে পায়নি ড্রাইভার। জেনারেল বুঝতে পারলেন তারই স্টাফ কারটা এগিয়ে গেল হাটাহাজারীর দিকে। ‘কুইক’ বললেন জেনারেল। একলাফে সবাই উঠে বসলো জীপে। স্পিডোমিটারের কাঁটাটা লাফিয়ে উঠলো। ‘জোর চালাও’, ড্রাইভারকে বললেন জেনারেল, ‘ওদেরকে ধরতেই হবে।’
সামনেই দেখা গেলো স্টাফ কারটাকে। জীপ পাশাপাশি নিয়ে আসতেই লক্ষ্য করলো কারের আরোহীরা। থেমে পড়লো রাস্তার পাশ ঘেঁষে। জীপ থেকে নেমে আসলেন জেনারেল, মেজর মোজাফফর এবং মেজর রেজা। গাড়ির ভেতর উঁকি দিলেন সবাই। ভেতরে বসে আছেন মিসেস মঞ্জুর, মিসেস দিলওয়ার ও তাদের ছেলেমেয়েরা।
গাড়ি দুটো রওনা দিলো এক সঙ্গে। বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেলো রাস্তার ওপর আরেকটা জীপ দাঁড়িয়ে আছে। স্টাফ কার আর জীপ থেমে যেতেই থেমে থাকা জীপ থেকে নেমে আসলেন একে একে লে কর্নেল মতিউর, লে. কর্নেল মাহবুব আর ক্যাপ্টেন মুনির।
‘আর সবাই কোথায়’ জেনারেল জিজ্ঞেস করলেন। লে. কর্নেল মতি উত্তর দিলেন, ‘সম্ভবত পেছনে স্যার।’ দুটো গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়লো সবার মুখে। রাস্তা থেকে একটু পাশে সরে গেলেন সবাই। এগিয়ে আসছে গাড়ি দুটো। রাস্তার পাশে রাখা গাড়িগুলো বোধ হয় ওদেরও চোখে পড়লো। গতি একটু কমিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসলো পিকআপ আর একটা জীপ। কাছে আসতেই মেজর খালেদকে দেখা গেলো। এদেরকে দেখে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন মেজর খালেদ আর মেজর ইয়াজদানী। আঙ্গুল দিয়ে পিকআপের পেছন দিকটা দেখালেন। সেখানে আধশোয়া অবস্থায় আহত দুই অফিসার লে. কর্নেল ফজলে হোসেন আর ক্যাপ্টেন জামিল। সার্কিট হাউস অপারেশনের দিন যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে ছিলেন।
লে. কর্নেল দিলওয়ারকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন মিসেস দিলওয়ার। বার বার বলতে লাগলেন, ‘ওকে আপনারা কেন নিয়ে এলেন না।’ এগিয়ে এলেন
Zia 1.jpgজেনালের মঞ্জুর। সান্ত¦¦Íনা দিলেন মিসেস দিলওয়ারকে। ‘মঞ্জুর, আমি বরং দিলওয়ার ভাবীকে ছেলে-মেয়েসহ আর আহতদের নিয়ে ফিরে যাই’- বললেন মিসেস মঞ্জুর। ‘ইমপসিবল’ অনেকটা চেচিয়ে বললেন লে. কর্নেল মতি। ‘এতদূর এগিয়ে এসে আমাদের অফিসারদের বৌ বাচ্চাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না; - মতি তাকালেন জেনারেলের মুখের দিকে। জেনারেলসহ সবাই তাকে সম্মতি দিলেন। জেনারেল এগিয়ে গেলেন তার জীপের দিকে। ড্রাইভারের কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুমি আর স্টাফ কারের ড্রাইভার ফিরে যাও। অবাক বিস্ময়ে তাকালো ড্রাইভার। কেমন যেন ঝাঁপসা দেখা যাচ্ছে জেনারেলের মুখ। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে গাড়ি থেকে নেমে সেলুট করলো ড্রাইভার। স্টাফ কার নিয়ে ড্রাইভার দুজন গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে গেলো চট্টগ্রামের দিকে।

তিনটা গাড়ি রওনা দিলো আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে। প্রথম গাড়ি চালাচ্ছেন লে. কর্নেল মতি। লে. কর্নেল
মাহবুব, মেজার মোজাফফর, ক্যাপ্টেন মনি আর জেনারেলের ব্যাটম্যান গাড়িতে বসে। দ্বিতীয়টিতে মেজর গিয়াস, মেজর রেজা, আর জেনারেলের তিন ছেলেমেয়ে, গাড়ি চালাচ্ছেন জেনারেল মঞ্জুর স্বয়ং। তৃতীয়টি ড্রাইভ করছেন মেজর ইয়াজদানী। মিসেস মঞ্জুর ও ছেলেমেয়েসহ মিসেস দিলওয়ার তার আরোহী। আহত দুই অফিসার ফজলে হোসেন আর জামিলকে নিয়ে পিকআপ চালাচ্ছেন মেজর খালেদ।
রওনা হওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল কর্নেল মতির জীপটা পাইলট কার হিসেবে অন্ততঃ পাঁচ মিনিট এগিয়ে থাকবে অন্য গাড়িগুলো থেকে, যাতে রাস্তায় কোনো বাঁধা পেলে পেছনের গাড়িগুলো সতর্ক হতে পারে। ভোর হওয়ার আগেই লে. কর্নেল মতি, মেজর মোজাফফর, লে. কর্নেল মাহবুব আর ক্যাপ্টেন মনিরকে
নিয়ে পাইলট কারটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে সবার। সাঁ সাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছে জীপটি। লে. কর্নেল মতির পা দেবে বসেছে এক্সেলেটরে। ভোর হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। রাজবাড়ী নদীর বেইলি ব্রিজটা পার হতেই চোখে পড়লো কনভয়টা। তিনটা আর্মি ট্রাক এগিয়ে যাচ্ছে সারি বেধে। পেছনের ট্রাকটা দেখলেই বোঝা যায় সেনাভর্তি ট্রাকগুলোতে। ওভারটেক করার জন্য হর্ন দিলেন মতি। প্রথম ট্রাকটা রাস্তা ছেড়ে দিলো। দ্বিতীয়টিও ওভারটেক করলেন মতি।

রাতে গোপন সংবাদ পেয়ে বেরিয়ে পড়েছেন মেজর মান্নান, সঙ্গে সেনাভর্তি তিনটি আর্মি ট্রাক। বিদ্রোহী অফিসাররা কোন পথে যাবে, আগেই জেনে গেছেন এসকেপ রুট পরিকল্পনার সময় মিটিঙে থাকা এক অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারের কাছ থেকে। পেছনে হর্ন শুনে বাইরে তাকালেন মেজর মান্নান। জীপটা তখন পাশ কাটাচ্ছে। একবার মাত্র চোখাচোখি হলো কর্নেল মাহবুবের সঙ্গে। প্রচ- জোরে বেরিয়ে গেলো জীপটা পাশ দিয়ে। মেজর মান্নানও গতি বাড়ালেন ট্রাকের।
বুঝে গেলেন কর্নেল মতি, পালানো ছাড়া গতি নেই। অসম্ভব হালকা হয়ে গেছে স্টিয়ারিং, মনে হচ্ছে জীপের চাকা মাটিতে লেগে নেই। মেজর মোজাফফর আরPRESIDENT ZIA (20).jpg কর্নেল মাহবুব মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। সবার হাত চলে গেছে স্টেনাগানের কাছে। আচমকা ঠিক করে ফেললেন সবাই ক্যাপ্টেন মুনিরকে গাড়ি থেকে জাম্প করে ডাইভার্ট করতে হবে পেছনে আসা জেনারেল মঞ্জুরের কনভয়কে। প্রথম গুলিটা আসলো ট্রাক থেকে। বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে গেলো জীপের পাশ দিয়ে। জাম্প, মুনির জাম্প চেঁচিয়ে বললেন মোজাফফর। কিন্তু অসম্ভব দ্রুত গতিতে চলা জীপ থেকে লাফ দিতে পারলেন না মুনির।
বাঁক ঘুরতে গিয়ে জীপটা ধাক্কা খেলো একটা টিলার সঙ্গে। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামলেন চারজনই। ছুটলেন, উঁচু-নিচু পথ বেয়ে। সেনাভর্তি ট্রাক তিনটা থেমে গেলো রাস্তার উপরে। অস্ত্র হাতে নেমে এলো সেনারা। মেজর মান্নানসহ শুয়ে পড়লো সবাই ট্রাকের নিচে। ‘ফায়ার’ হুকুম দিলেন মেজর মান্নান। বৃষ্টির মতো গুলি বেরিয়ে যেতে লাগলো দৌড়াতে থাকা সেনা অফিসারদের দিকে। 
এগোচ্ছেন মেজর মোজাফফর। পেছন থেকে ছুটে আসছে গুলি। হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগলো। হুমরি খেয়ে পড়ে গেলেন মোজাফফর। অনুভব করলেন পিঠের দিকে শিরশির করে নামছে রক্ত। বুঝলেন গুলি লেগেছে তার পিঠে। গড়িয়ে চলে গেলেন একটা ঝোঁপের আড়ালে।
অবিশ্রান্তভাবে ছুটে আসছে গুলি পেছন থেকে। কর্নেল মতি আর মাহবুব এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলেন না মোজাফফর আর মুনিরকে। থমকে দাঁড়ালেন দুজন, সামনে পথ বন্ধ। এবার ধরা পড়তেই হবে। ঝোঁপের ভেতর থেকে ওদের দুজনকে দেখলেন মোজাফফর। অসহায়ের মতো দাড়িয়ে রয়েছে। কর্নেল মতি বুঝে ফেললেন এখন কি করতে হবে। শুট মি চেঁচিয়ে বললেন কর্নেল মতি মাহবুবকে। কর্নেল মাহবুব বুঝতে পারলেন না প্রথমে মতি কি বলছে। শুট মি মাহবুব, শুট মি। এতোক্ষণে বুঝলেন মাহবুব, মতি কি বলতে চাইছে।
ঠিক একসঙ্গেই গুলি বেরুলো দুজনের দুটি স্টেনগান থেকে। দাঁড়িয়ে থাকলেন কয়েক সেকেন্ড। ধপ করে মাটিতে পড়লো দুটি দেহ। কর্নেল মতিউর আর কর্নেল মাহবুব, এক সঙ্গেই চলে গেলেন পরপারে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন