সেদিন থেকে শুরু এরশাদের ষড়যন্ত্র
৩০ মে ১৯৮১, ঢাকা সেনানিবাসের উচ্চপদস্থ সকলেই ঘুমিয়ে আছেন আরাম করে। শনিবারে সাত সকালে অফিসে যাওয়ার তেমন তাড়া নেই। নিয়ম অনুযায়ী মাসের শেষ শুক্রবার রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ চলে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে। সে জন্য শনিবার অফিস শুরু হয় দেরিতে। ৯টার দিকে গেলেই চলে। ক্রিং ক্রিং বেজে উঠেলো টেলিফোন। ঘুমের মধ্যেই জেনারেল মইন শুনতে পেলেন রিংয়ের শব্দ। তাকালেন সাইড টেবিলে রাখা টইম পিসটার দিকে। ভোর ছটা বেজে গেছে। দ্রুত টেনে নিলেন রিসিভারটা। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললেন, হ্যালো। অন্য প্রান্ত থেকে কথা বলে উঠলেন জেনারেল এরশাদ। `What are you doing' - বললেন এরশাদ। গলাটা যেন একটু উত্তেজিত মনে হলো তার! উত্তরের অপেক্ষা না করেই এরশাদ আবার বললেন, Come to the office immediately. It’s urgent. বলার ভঙ্গিটাতেই বুঝে গেলেন জেনারেল খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। সম্মতি জানিয়ে
নামিয়ে রাখলেন টেলিফোন। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন অফিসের দিকে।
নামিয়ে রাখলেন টেলিফোন। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন অফিসের দিকে।
সোজা এগিয়ে চলছে গাড়িটা ঢাকা আর্মি হেডকোয়াটারের দিকে। কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব
জেনারেল এরশাদ বসে আছেন। তখনো আর কেউ পৌঁছায়নি। একবার দৃষ্টি বুলিয়ে এরশাদ বলেন, President has been assassinated. কিছুটা অবাক হয়ে চাইলেন জেনারেল। ঘুম ভেঙে সাতসকালে এ কথা শুনতে হবে বুঝতে পারেন নি। চাইলেন এরশাদের দিকে। এর মধ্যে আরো দু‘একজন এসে পড়েছেন। `Is it confirm that he has been killed! অবিশ্বাস ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন এরশাদকে। কিছুটা অস্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিলেন, `Yes that is confirmed.'
এদিকে জেনারেল নুরুদ্দিন সিজিএস (চীফ অফ জেনারেল স্টাফ) তখন তার অফিস থেকে একনাগাড়ে যোগাযোগ করে চলেছেন বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট ও গ্যারিসনের অবস্থা জানতে। কোন অবস্থায় কি ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটাও বলছেন।
এরশাদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘What do we do now’. একটু ভেবে উত্তর দিলেন, ‘Let us follow the book' অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট এ সময় দেশের শাসনভার গ্রহণ করবেন- তাকালেন এরশাদের দিকে। বোঝা গেলো এরশাদ এ রকম জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু তিনি তো অসুস্থ। তিনি তো এখন সিএমএইচ-এর বেডে শুয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক দেখালো তাকে। ভাইস প্রেসিডেন্ট সাত্তার কি ম্যানেজ করতে পারবেন। He is too old, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিটা এরশাদ ঘুরিয়ে আনলেন সবার মুখের দিকে। সবাই কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। ঠিক হলো সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিবের মতামত নেওয়া হবে। ডাকা হলো তৎকালীন কেবিনেট সেক্রেটারী কেরামত আলীকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই, সিইনসির অফিসে এসে পৌঁছলেন কেরামত আলী। সংবিধান অনুযায়ীও ভাইস প্রেসিডেন্টই দায়িত্ব পাবেন, এই পরামর্শ দিলেন তিনি জেনারেল এরশাদকে।
কেমন যেন একটু উত্তেজিত হয়ে বসে আছেন জে. এরশাদ। হাত দুটো টেবিলের ওপরে রাখা। অনেক কথাই মনে হচ্ছে তার । তিনি একাধিকবার বলছেন, এই বৃদ্ধকে অর্থাৎ সাত্তারকে দিয়ে কি হবে? বার বার একই প্রশ্ন করছেন সবাইকে, আমাদের এখন কি করা উচিত। অন্যান্য সেনানিবাসের খবরও সঠিকভাবে তখনো জানা যায়নি। জেনারেল মঞ্জুরের নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম। এর মধ্যেই সকাল ৮টা বেজে গেছে। পাশে রাখা টেলিফোনটা তুলে নিলেন। ফোন করলেন সিএমএইচ-এর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। ভাইস প্রেসিডেন্ট সাত্তারের অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলেন এরশাদ। অপর প্রান্ত থেকে জানানো হলো, তিনি এখন সুস্থই আছেন। দায়িত্ব নিতে পারবেন। তারপর কেরামত আলীকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন সিএমএইচ-এ। সাত্তার সাহেব তখনো বিছানায় শুয়ে। ঘরে ঢুকলেন জেনারেল এরশাদ। সঙ্গে কেরামত আলী। আস্তে আস্তে জানালেন জিয়া হত্যার কথা। খুব নার্ভাস মনে হচ্ছিল সাত্তার সাহেবকে তখন। একটু অপেক্ষা করে তাকে নিয়ে বঙ্গভবনে আসলেন জেনারেল এরশাদ। ভাইস প্রেসিডেন্টের দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটা ভাষণ রেকর্ড করে রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হলো। দেশবাসী রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যার খবরে স্তম্ভিত হয়ে পড়লো।
ঢাকা সেনানিবাসে মিটিংয়ের পর মিটিং চলেছে সারাদিন। যোগাযোগ চলেছে অন্যান্য সেনানিবাসের সঙ্গে। সেখানকার পরিস্থিতি ওপর নজর রাখা হচ্ছে। দেশ জুড়ে, ঢাকা শহর জুড়ে জিয়া হত্যার আলোচনা চলছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। যোগাযোগ করা হয়েছে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সঙ্গে। জেনারেল মঞ্জুর স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ঢাকা থেকে সেনাদল যদি চট্টগ্রামের দিকে মুভ করে তবে পরিস্থিতি আরো অবনতি ঘটবে। এরশাদ উত্তেজিত। কখন কোথায় কি ঘটে যায়। তার মনে পড়ে গেলো জিয়া হত্যার দু-তিনমাস আগের একটি ঘটনার কথা। কক্সবাজারে ‘আয়রন শিল্ড’ নামে এক বিমান ল্যান্ডিং মহড়ার দিন একটা বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছিল চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসাররা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর আঘাত হানার ইচ্ছা ছিল তাদের। মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের উপর বেশ কিছুটা বিমাতাসুলভ আচরণ থেকে উদ্ভব ঘটেছিল এই বিদ্রোহের। কিন্তু সে পরিকল্পনা পরে আর বাস্তবায়ন করার চেষ্টা নেওয়া হয়নি।
সব ঘটনাই ভেসে চলছিল জেনারেল এরশাদের চোখের সামনে। তার মনে পড়লো এক সময় রাষ্ট্রপতি জিয়া ও জেনারেল মঞ্জুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু ৭৭-এর সেনাবিদ্রোহের পর জিয়া ভুল বুঝলেন জেনারেল মঞ্জুরকে। ডাকযোগে ট্রান্সফার অর্ডার পাঠিয়ে মঞ্জুরকে সরিয়ে দিলেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে। জিয়া যে এমন একটা কাজ করবেন ভাবতে পারেননি মঞ্জুর। অত্যন্ত দুঃখ পেলেন তিনি। একই সময়ে মীর শওকত আলীকে বদলি করা হলো যশোরে। দীর্ঘদিন ধরে মঞ্জুরই ছিলেন জিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত অফিসার। ঢাকা ছাড়ার পর ফাঁকা মাঠ পেলেন জেনারেল এরশাদ। জিয়াকে ঘিরে রইলো অমুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা। অনেক সূত্র থেকে এরশাদের দুর্নীতি এবং অন্য কুকীর্তির খবরও ইতিমধ্যে পৌঁছাতে শুরু করলো প্রেসিডেন্টের কানে। কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করে চললেন। জিয়ার মনে হতে লাগলো সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে জেনারেল এরশাদই তার জন্য কম বিপজ্জনক। সে ব্যস্ত থাকবে অর্থ আর নারী নিয়ে।
এদিকে জেনারেল মঞ্জুরও দিনে দিনে অস্থির হয়ে উঠছিলেন দেশের সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে। জেনারেল মঞ্জুর এতো ব্রিলিয়ান্ট অফিসার হয়ে কেন চট্টগ্রামে ক্যু করতে গেলেন, ভাবছিলেন ঢাকার জেনারেলরা বাইরে ক্যু করে যে টিকে থাকা যাবে না, এটা মঞ্জুরের মাথায় যে কেন এলোনা বুঝতে পারছিলেন না কেউ।
জানা যায়, ঘটনা ছিল আসলে অন্যরকম। সার্কিট হাউসের অপারেশনের আগে পরিকল্পনা তৈরির সময় বাছাই করা হয়েছিল ২৪জন সেনা অফিসারকে। তাদের মধ্যে ১২জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সার্কিট হাউস অপারেশনে। অবশিষ্ট ১২ জনের ওপর দায়িত্ব থাকে চট্টগ্রামের রেডিও-টেলিভিশন দখল করা। আরো ঠিক করা হয়েছিল এর মধ্যেই কিছু অফিসার ঢাকায় এসে যোগ দেবেন ঢাকা সেনানিবাসের কিছু বিদ্রোহী অফিসারের সঙ্গে। আগে থেকেই সেনাবাহিনীর ভেতরে বিভিন্নরকম ক্ষোভের কারণে তারা নিজেরাও বিদ্রোহের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে সার্কিট হাউস অপারেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত ১২জনের গ্রুপটি জানায়, নিñিদ্র নিরাপত্তার কারণে সার্কিট হাউসে অপারেশন সম্ভব নয়। পিছিয়ে আসার উপায় আর না থাকায় পরবর্তী ১২ জনের গ্রুপটিকে বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয় সার্কিট হাউস অপারেশনের। ঢাকা সেনানিবাসে যোগাযোগের পরিকল্পনাটি বাদ দিতে হয় অনেকটা বাধ্য হয়েই।
চট্টগ্রাম বিদ্রোহের পর জেনারেল মঞ্জুর নিহত হলে স্বস্তি ফিরে এলো জেনারেল এরশাদের মনে। এর সঙ্গে পথের কাঁটা সরে যাওয়ায় খুশি হলেন তিনি। এরপর শুরু হলো তার নতুন খেলা। পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হতে শুরু করলেন তিনি। শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল হওয়া সত্বেও প্রেসিডেন্ট করা হলো সাত্তার সাহেবকে। জিয়ার মৃত্যুর সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে `Office of profit' হোল্ড করছিলেন সাত্তার। এ অবস্থায় থাকলে নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জেনারেল এরশাদ সংবিধান পরিবর্তনের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ক্ষমতায় আসার চরম ইচ্ছাটা মনের মাঝে প্রবল থাকলেও দেশের পরিস্থিতি, জিয়ার প্রতি জনগণের অনুভূতি প্রভৃতি কারণে পিছিয়ে গেলেন তিনি। খেলা শুরু হলো বিএনপির ভেতরে। অনেকের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বিএনপিকে দিয়ে সংবিধান পরিবর্তন করালেন প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনের মাধ্যমে সাত্তার সাহেবকে বানালেন প্রেসিডেন্ট। এ জন্য তিনি প্রকাশ্যে সাক্ষাৎকার দিয়ে সাত্তারকে সমর্থন করলেন। এরপর শুরু করলেন পুরোনো চাল। বিএনপির ভেতরে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করলেন। অমুক্তিযোদ্ধা শাহ আজিজ, হুদা, মতিনের নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ওপর প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতি পরায়ণ বলে বাতিল করলেন মন্ত্রিপরিষদ। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও তিন বাহিনীর প্রধানের সমন্বয়ে জাতীয় সিকিউরিটি কাউন্সিল গঠনের চেষ্টা চালালেও সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান পদে বসালেন নিজস্ব লোক এবং তাদের দিয়ে সামরিক শাসন জারির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চললেন ধীরে ধীরে। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের বিচার হলো, ফাঁসি দেওয়া হলো। সবই তিনি করালেন বিএনপি সরকারের ঘারে বন্দুক রেখে। আর ভেতর থেকে বিএনপি সরকারকে ব্যর্থ বলে প্রমাণ করলেন, নতুন নতুন দাবি জানালেন আর্মির হয়ে। সবাই ভাবতে শুরু করলো এ সরকারকে দিয়ে কিছু হবে না। ইতিমধ্যে সাক্ষাৎকার দেওয়া শুরু করলেন জেনারেল এরশাদ বিভিন্ন পত্রপত্রিকার। দেশ শাসনে সেনাবাহিনীর ভূমিকার দাবি তুললেন। অবশেষে সব কাজ পরিকল্পনামাফিক শেষ হলে বসলেন তার কোর্সমেটদের নিয়ে। প্রেসিডেন্ট সাত্তার তার বিরুদ্ধে জেনারেল এরশাদের তৎপরতার কথা জানতে পেরেছিলেন। আবারো একটি সামরিক শাসন এড়াতে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে প্রেসিডেন্ট সাত্তার ১৯৮২ সালের ২২ মার্চ জেনারেল এরশাদকে অবসর দিয়ে ৯ম ডিভিশনের জিওসি জেনারেল শামসুজ্জামানকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করে এক আদেশপত্রে সই করলেন। এরশাদ প্রেসিডেন্টের এ সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলেন তার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মাধ্যমে, যিনি তখন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে য্ক্তু ছিলেন। এরশাদ দ্রুত পদক্ষেপ নিলেন এবং ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করলেন। তারপর থেকে শুরু হলো বাংলাদেশে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির আরেক অধ্যায়। (শেষ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন