জেনারেল মঞ্জুরের কথায় ৪০জন অফিসার হাত তুলে সমর্থন জানালেন
মেজর মোজাফফর জানালেন, The president has been killed. মেজর জেনারেল মঞ্জুর কথা শুনে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। একটু ধাতস্থ হয়ে মেজর মোজাফফরকে বললেন, ডিভিশনাল স্টাফ অফিসার, বিগ্রেড কমান্ডারসহ সব সামরিক উর্ধ্বতন অফিসার যেন সকাল সাতটার মধ্যে তার দপ্তরে হাজির হয়।
টেলিফোন নামিয়ে তৈরি হয়ে নিলেন মেজর জেনারেল মঞ্জুর। বেসামরিক পোশাক পরে নিজের স্টাফ গাড়িতে উঠে বেড়িয়ে গেলেন বাসা থেকে। ষষ্ঠ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের দপ্তরে এসে থামলো গাড়িটা। তাকে নামতে দেখে এগিয়ে আসলেন ষষ্ঠ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর দোস্ত মোহাম্মদ শিকদার। অবিলম্বে সিগনাল সেন্টারে প্লাটুন মোতায়েন এবং কুমিল্লা থেকে সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য শুভপুর ব্রিজে সৈন্য পাঠাতে বলে আবার গাড়িতে উঠে বসলেন মঞ্জুর। ঝড়ের বেগে ছুটে চললো তার গাড়ি প্রধান ফটকের দিকে।
তৎকালীন বিএমএ কমান্ডেন্ট একজন বিগ্রেডিয়ার এবং বিগ্রেডিয়ার শাহজাহানসহ মোট ৪০ জন সামরিক অফিসার ইতিমধ্যেই পোঁছে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন চট্টগ্রাম ডিভিশনাল কমান্ডার মেজর জেনারেল মঞ্জুরের জন্য। উপস্থিত অফিসারদের সামনে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন মঞ্জুর, ‘কিছু সেনা অফিসার প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করেছে।’ উপস্থিত সবার দৃষ্টি জেনারেলের দিকে। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এ হত্যাকা- ঘটার পেছনে অবশ্যই
উপস্থিত একজন অমুক্তিযোদ্ধা অফিসার উঠে দাঁড়ালেন। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘আমাদের শুধু হাত তুলে এ ঘটনার প্রতি সমর্থন জানালে চলবে না, শপথ নিতে হবে।’ নিজ উদ্যোগেই দপ্তরে রাখা একটা কোরআন শরীফ নিয়ে এলেন তিনি। মেজর জেনারেল মঞ্জুরের সামনে পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিলেন একে একে সবাই।
সকাল আটটার মধ্যে দপ্তরে এসে পোঁছালেন চট্টগ্রামের কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, রাইফেলস্-এর সেক্টর কমান্ডার, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর কমান্ডিং অফিসারসহ বিভিন্ন বেসমারিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ব্রিফিং শুনে একে একে শপথ নিলেন সবাই। বেসামরিক অফিসারদের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন মঞ্জুর।
সকাল ১১টা। সকল ব্রিগেড কমান্ডার এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের নিয়ে বসলেন মেজর জেনারেল মঞ্জুর, তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে। দায়িত্বের মধ্যে ছিলো শুভপুর-সীতাকু--চট্টগ্রাম প্রবেশপথ বন্ধ করা। পতেঙ্গা ফৌজদারহাট-কুমিল্লা সমুদ্রতীরে অবতরণে বাধা দেওয়া, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দর রক্ষা করা এবং সর্বোপরি চট্টগ্রাম সেনানিবাসকে রক্ষা করা। দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তা সঠিকভাবে পালন করতে বললেন মে. জে. মঞ্জুর। ঢাকার দিকে সমর সম্ভার নিয়ে অনেকের এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও মঞ্জুর ভিন্নমত পোষণ করলেন। তিনি সোজাসুজি বলে দিলেন, ‘আমাদের এখন ডিফেন্সিভ প্লান ফলো করতে হবে।’ সেই অনুযায়ী চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার জন্য অগ্রসর হলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক অফিসাররা।
৬৯ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর খালেদকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিভিন্ন ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য এবং তাদের অবস্থান পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে জানানোর দায়িত্বে রইলেন মেজর মোজাফফর।
একজন ব্রিগেডিয়ারকে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন জেনারেল মঞ্জুর। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আপনার তো নেগোসিয়েশন করার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। যেমন করছিলেন মেজর ফারুক-রশিদের ক্যু-এর সময়। সুতরাং ঢাকার সঙ্গে নেগোসিয়েশনের ব্যাপারটা আপনাকে দিয়েই সবচেয়ে ভালো হবে বলে মনে করি।’ নির্দেশ দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন মে. জে. মঞ্জুর।
এর মাঝে কন্ট্রোল রুম থেকে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন ঐ ব্রিগেডিয়ার। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ বিদ্রোহী দলকে আত্মসমর্পণ করার জন্য প্রস্তাব দিলেন। কথা দিলেন আত্মসমর্পণের পর ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের পরিবারসহ বিশেষ বিমানযোগে বিদেশ প্রেরণ করবেন। শুধু তাই নয় আগামী ছয় মাসের মধ্যে তাদের আবার দেশে ফিরিয়ে আনার নিশ্চয়তা দিলেন তিনি।
আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাশে বসে থাকা কর্নেল মতিউর উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ঝট করে টেনে নিলেন রিসিভার। চেচিয়ে বললেন, ‘আমাদের সারেন্ডার করার প্রশ্নই আসে না। সারেন্ডার যদি করতেই হয় করবেন আপনারা, আমরা না।’ জেনারেল এরশাদকে স্পষ্ট কথা জানিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন কর্নেল মতি।
ঢাকা রেডিও থেকে তখন বিদ্রোহী সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ ঘোষণা করা শুরু হয়ে গেছে। এরশাদের দেওয়া আত্মসমর্পণের কথা জানানো হলো মে. জে. মঞ্জুরকে। এরশাদ তার সঙ্গে কথা বলতে চান জেনে তা প্রত্যাখ্যান করলেন মঞ্জুর। তার মনে পড়ে গেল এই মে মাসেরই ২৮ তারিখের একটি ঘটনা।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার চট্টগ্রামে আসার সব প্রস্তুতি তখন সম্পন্ন হয়েছে। মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগেই হেলিকপ্টার নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পোঁছালেন লে. জে. এরশাদ। মঞ্জুরকে জানালেন প্রেসিডেন্ট তাকে অতিসত্ব¡র ঢাকায় স্টাফ কলেজে যোগদান করতে বলেছেন। সেই সঙ্গে মঞ্জুরের হাতে ধরিয়ে দিলেন তার বদলির আদেশনামা। ১৫ দিন আগের স্বাক্ষর করা বদলির আদেশ হাতে পেয়ে মঞ্জুর ক্ষুব্ধ হলেন। এরশাদ ও তার সঙ্গীরা যে তার বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র করছে সে খবর তিনি আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলেন। সে কারণে লে. জে. এরশাদকে হেলিপ্যাডে রিসিভ পর্যন্ত করতে যাননি তিনি।
মে. জে. মঞ্জুরের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ঢাকা ফিরে গেলেন এরশাদ। ফিরেই প্রেসিডেন্ট জিয়াকে মঞ্জুরের ক্ষোভের কথা জানালেন। শুধু এটুকুতেই থেমে রইলেন না, প্রেসিডেন্টের উর্ধ্বতন স্টাফ অফিসারকে দিয়ে টেলিফোনে মঞ্জুরকে জানিয়ে দিলেন, প্রেসিডেন্ট চান না যে, আগামীকাল মঞ্জুর তাকে রিসিভ করতে আসুক। কথাটা শুনে আশ্চর্য হয়ে এরশাদের কাছে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য টেলিফোন করলেন মে. জে. মঞ্জুর। এরশাদ জানালেন কথাটা মিথ্যা নয়। আসলেই প্রেসিডেন্ট এ রকম বলেছেন। পরের দিন প্রেসিডেন্টকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে গেলেন না মঞ্জুর। তার বদলে ব্রিগেডিয়ার মহসিন গেলেন প্রেসিডেন্টকে রিসিভ করতে। প্রেসিডেন্ট জিয়া এয়ারপোর্টে মঞ্জুরকে না দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিগেডিয়ার মহসিনকে জিজ্ঞেস করলেন, Where is Manzur? উত্তরের অপেক্ষা না করে রাগতস্বরে বলে উঠলেন, What does he think he is! সন্ধ্যায় লে. জে. মঞ্জুর সস্ত্রীক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন সার্কিট হাউসে। কথা কাটাকাটি হলো প্রচুর। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে স্যাক করার কথাও বললেন। জিয়ার সঙ্গে সেটাই ছিলো তার শেষ সাক্ষাৎ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন