রহস্যাবৃত জিয়া হত্যা-৩

পাহাড় থেকে জিয়ার মৃতদেহ ফেলে দিতে তার মন সায় দিলো না
Zia killing logo.jpg৩০মে সকাল ১০ টা। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হয়েছেন এ খবর জনসাধারণ সবেমাত্র জানতে শুরু করেছে। তবু সার্কিট হাউসের আশেপাশে কৌতুহলী জনতা দেখা গেলো না। সকালের দিকে খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার এবং নৌবাহিনীর প্রধান ঘটনাস্থল এক ঝলক দেখে গিয়েছেন মাত্র। 
সারা রাত যেখানে যেভাবে ছিলো সেভাবেই পড়ে আছে মৃতদেহগুলো। কর্নেল মতিউর মেজর মোজাফফরকে বললেন, ‘রাঙ্গামাটির দিকে কোনো এক পাহাড় থেকে জিয়ার মৃতদেহ নিচে ফেলে দেওয়ার জন্য। ইতস্ততঃ করছিলেন মেজর মোজাফফর। কর্নেল মতি বললেন, জিয়াকে কবর দিয়ে আমরা তাকে জাতীয় বীর তৈরি করতে চাই না। সুতরাং যেভাবেই হোক তোমাকে বলছি তাই কর।’ কোনো কথা না বলে বেড়িয়ে গেলেন মেজর মোজাফফর।
সকাল ১০টার পরপরই একটা জিপ ও একটা পিকআপসহ সার্কিট হাউসে পোঁছলেন মেজর মোজাফফর। সকালের আলোয় গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া মৃতদেহগুলো দেখলেন। রক্তে ভেসে আছে
দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখটা। ৮/১০টা মৃতদেহ পড়ে আছে সেখানে। কয়েকজন সিপাহীসহ মোজাফফর সোজা উঠে গেলেন দোতলায়। আধাখোলা দরজার ভিতরে পরে আছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃতদেহ। একটা ম্যাগজিনে থাকা সবগুলিই আঘাত করেছে জিয়ার দেহকে। উপুর হয়ে পড়ে থাকা দেহের পাশে কার্পেট ভিজে কালচে রং ধারণ করছে।
বারান্দার দিকে তাকালেন মেজর মোজাফফর, সেখানে পড়ে আছে আরো দুটো মৃতদেহ। কাছে গিয়ে চিনতে পারলেন। একজন লে. কর্নেল আহসান আর অন্যজন অত্যন্ত কাছের মানুষ ক্যাপ্টেন হাফিজ। বুকের ভিতর কেমন জানি একটু মুচড়ে উঠলো। মনের আবেগ ঝেড়ে ফেললেন তাড়াতাড়ি। সোজা হেঁটে চলে গেলেন প্রেসিডেন্টের ঘরের দিকে।
Zia 22.jpgহাতের কাছে মৃতদেহ জড়ানোর কিছু না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন বিছানার চাদর দিয়েই আপাততঃ কাজ সারতে হবে। দরজার কাছে পড়ে থাকা জিয়ার মৃতদেহকে বাধ্য হয়ে টপকাতে হলো তাকে। ঘরে ঢুকে তাকালেন চারদিকে। খাটের উপর মশারি ফেলা, ডানদিকে একটা সোফা। একটা নীল রঙের টেলিফোন এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে।
বিছানার চাদর টেনে নিলেন মেজর। কয়েকজন সিপাইয়ের সহায়তায় লাশগুলো চাদর দিয়ে জড়িয়ে নিলেন। এরপর সেনাবাহিনীর গ্রাউন্ড সিট দিয়ে মুড়ে দিলেন। দোতলা থেকে ধরাধরি করে লাশগুলো নিচে নামালো সিপাইরা। তোলা হলো পিকআপে। সার্কিট হাউসের গেট দিয়ে জিপ আর পিকআপ বেড়িয়ে গেল রাঙ্গুনিয়ার পথে। লাশ বহনকারী গাড়িগুলো এগিয়ে চলছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে। গত রাতে বৃষ্টিতে ভেজা পাহাড়গুলোর উপরে পড়েছে সকালের রোদ। চলন্ত গাড়িতে বসে সেই দৃশ্যই দেখছিলেন মেজর মোজাফফর। হঠাৎ মনে পড়ে গেল অতীতের দুটি ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানের পর দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া ফারুক-রশিদ দীর্ঘদিন পর্যন্ত ক্যু-এর আশঙ্কায় ব্যস্ত রেখেছিলেন জিয়াউর রহমানকে। ৭৬-এর ২০ এপ্রিল ঢাকা বিমানবন্দরে এসে পোঁছান কর্নেল রশিদ। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ফারুকও সিঙ্গাপুর থেকে এসে চলে যায় সাভারে। সেখানে তার সমর্থিত প্রায় দুই হাজার সৈন্য তাকে অভ্যর্থনা জানায়, কণ্ঠে ছিলো তাদের ‘ফারুক জিন্দাবাদ’ ধ্বনি।
ফারুক ঢাকা আসার দুদিন পর বগুড়া সেনানিবাসে ফারুকের সমর্থক বেঙ্গল ল্যান্সারের সৈনিকরা খবর পাঠায় যে ফারুককে বগুড়া না পঠালে তারা তাদের ট্যাঙ্কবহর নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা দেবে। এর ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই জিয়া ফারুককে বগুড়া যেতে অনুমতি দেন। এদিকে সাভার ক্যান্টনমেন্টের অবস্থারও অবনতি হতে থাকে।
মেজর জেনারেল মঞ্জুর ডেকে পঠালেন মেজর মোজাফফরকে। সাভার ও বগুড়ার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তাকে নিয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছে। জিয়া মোজাফফরকে জিজ্ঞেস করলেন এ অবস্থা কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। মোজাফফর তখন আর্মি হেডকোয়ার্টারে স্টাফ ক্যাপ্টেন। রক্ষীবাহিনীকে কিছুদিন আগেই সেনাবাহিনীতে মার্জ করা হয়েছে। রক্ষীবাহিনীর সিনিয়র অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনীতে এসেছেন মোজাফফর।
Zia 33.jpgসাভারে সেনাবাহিনীতে অবস্থানরত রক্ষীবাহিনীর মনোভাব পর্যবেক্ষণের জন্য জিয়া সঙ্গে সঙ্গে মোজাফফরকে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সে এটাচ করলেন। মোজাফফর সাভারে পোঁছে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর অবস্থান দৃঢ় করেন, যাতে বিদ্রোহী গ্রুপকে প্রতিহত করা যায়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরবর্তীকালে রশিদ ও ডালিমকে গৃহবন্দী করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। অন্যদিকে বগুড়া সেনানিবাসে জিয়ার অনুগত ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ (তৎকালীন কর্নেল) ফারুকের সমর্থক বেঙ্গল ল্যান্সারকে নিরস্ত্র করেন। এদিকে ডালিম-রশিদের দেশ ছাড়ার খবর পেয়ে ফারুকও হতাশ হয়ে পড়লেন। ফারুকের বোন ও পিতাকে হেলিকপ্টারে বগুড়া পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করতে রাজি করানো হয়। ফারুক আত্মসমর্পণ করলে পরে তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং একই সঙ্গে বেঙ্গল ল্যান্সারকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। প্রথম অভ্যুত্থান থেকে বেঁচে যান জিয়াউর রহমান।
এর পরের ঘটনা ১৯৭৭-এর। ২৫ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান কায়রো যান। সেখানে আনোয়ার সাদাত জিয়াকে জানান, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এবং উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করার একটি পরিকল্পনার কথা কায়রোর গোয়েন্দা বিভাগ কোনোভাবে জানতে পেরেছে। আর কদিন পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী অফিসার্স মেস উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। বিদ্রোহী সৈনিকরা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জিয়াকে হত্যা করার জন্য চক্রান্তের বিষয়টিও তিনি জানলেন কায়রো থেকে। 
জিয়া দেশে ফিরে ২৭ সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানে যাননি। ঐ দিনই রেড আর্মি জাপানের একটি ডিসি-৮ বিমান ছিনতাই করে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করলে সেই সুবাদে অফিসার্স মেস উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।
২ অক্টোবর ১৯৭৭। মেজর মোজাফফর তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার। রাত দেড়টার সময় প্রচ- গোলাগুলির আওয়াজে জেগে উঠলেন তিনি। টেলিফোন তুলে যোগাযোগ করলেন ৪৬ ব্রিগ্রেডের আমিনের সঙ্গে। জানতে পারলেন আর্মি সিগনাল ব্যাটেলিয়ন বিদ্রোহ করছে। কুর্মিটোলা এয়ারবেসের সৈনিকরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
একটুও অপেক্ষা না করে এক কোম্পানি ট্রুপস নিয়ে মেজর মোজাফফর পজিশন নিলেন বনানী গেটে। তার নির্দেশে আরেক ট্রুপ ইতিমধ্যেই জিয়ার বাসস্থানে অবস্থানে নিয়েছে।
মেজর মোজাফফরের বিচক্ষণতায় সেবারের মতো রক্ষা পেলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। পরের দিন এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে সশরীরে উপস্থিত হলেন জিয়া অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ধন্যবাদ জানালেন মোজাফফরকে।
লাশবাহী গাড়ির বহর এগিয়ে চলছে। মেজর মোজাফফর ফিরে এলেন বর্তমানে। কর্নেল মতিউরের ‘পাহাড় থেকে লাশ ফেলে দেওয়ার বিষয়টি কেন যেন সায় দিচ্ছিল না মন। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, জিয়াকে স্বাভাবিকভাবেই কবর দেবেন তিনি।
কাপ্তাই রোডে পাথরঘাটা নামে ছোট্ট একটা গ্রাম। এক টুকরো সমতল ভূমির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো খেজুর গাছ। জায়গাটুকু পছন্দ হলো মেজর মোজাফফরের। ভাবলেন খেজুর গাছ দুটো অন্ততঃ কবরের নিশানা জানাবে। ডেকে আনলেন স্থানীয় মাদ্রাসার এক ইমামকে। তাকে জানালেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন সামরিক অফিসার। তাদের তিনি এখানে দাফন করতে চান। যথারীতি জানাজা হলো। একটা বড় কবর খুঁড়ে দাফন করা হলো প্রেসিডেন্ট জিয়াসহ আরো দুজনের লাশ একসঙ্গে।
গাড়ি দুটো আবার ফিরতে শুরু করলো চট্টগ্রামের দিকে। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়তে শুরু করেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন