রহস্যাবৃত জিয়া হত্যা-৪

মঞ্জুর হত্যার বিচার হওয়া উচিত
Zia killing logo.jpgমেজর মোজাফফর চট্টগ্রামের সেনাবিদ্রোহের সময় খুব কাছ থেকে দেখেছেন ঘটনা। মেজর জেনারেল মঞ্জুর ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে ছিলেন। একাত্তরে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে যোগ দেন। রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত করা হলে সেখান থেকে সেনাবাহিনীতে গৃহীত হন। পরবর্তীকালে মেজর পদে উত্তীর্ণ হন। জিয়া হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিনি মামলার একজন আসামী ছিলেন। কিন্তু তিনি বিদেশ চলে যেতে সক্ষম হন এবং বিদেশে আছেন। সম্প্রতি তার সাক্ষাতকার গ্রহন করা হলে তিনি তার ভাষ্য এভাবে বলেন:
চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম না। তবে চিটাগাং-এর অন্য সব সেনা অফিসার এবং সদস্যদের মতই আমাকেও জড়িয়ে পড়তে হয়। আর সে কারণেই অনেক কিছু সচক্ষে দেখার সুযোগ হয়ে যায়। 
অনেক দিন থেকেই সামরিক বাহিনীর ভিতরে অসন্তোষ দেখা দিতে শুরু করেছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা সংঘাত থেকেই অসন্তোষের প্রধান কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই সামরিক বাহিনীর ভেতর দলাদলি ছিল। 
জিয়াউর রহমান ক্ষমতার আসার পরই মুক্তিযুদ্ধের অতীত থেকে সরে যেতে শুরু করলেন। দ্রুত
সম্পর্ক গড়ে তুললেন পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সঙ্গে। জামাত নেতা গোলাম আজমকে দেশে আসার অনুমতি দিলেন। শাহ আজিজকে বানালেন প্রধানমন্ত্রী। প্রশাসনের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার বিরোধীরা পুর্নবাসিত হতে শুরু করলেন। খোলামেলা রাজনীতির কথা বলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাত ইসলামীকে জনসমক্ষে আসার সুযোগ দেওয়া হল। তারা আবার সরাসরি রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করলো। শুধু তাই নয়, সামরিক বাহিনীর ভেতরে থাকা অমুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান ফেরত সামরিক অফিসাররা তার খুব কাছের লোক হয়ে দাঁড়াল। আর সুবিধাবাদি অমুক্তিযোদ্ধারা জিয়ার এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের হীনস্বার্থ হাসিল করে চলছিল।
zia bd05_01a.jpgঅন্যদিকে শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিদেশে চাকরী দিলেন। সেটা না করে খুনিদের বিচার করতে পারতেন জিয়া। তাতে তার ভাবমুর্তি কমতো না বরং বাড়তো। আমার তো মনে হয় এর কারণেই বিদ্রোহের আগ্রহ সৃষ্টি হয় অনেকের মনে। সাহসী হয়ে উঠেন তারা। আর ফারুক রশীদের বিষয়টিও ক্রমে ক্রমে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের দূরে ঠেলে দিচ্ছিল জিয়ার কাছ থেকে। সামরিক বাহিনীর ভেতরে অমুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের প্রতি কিছুটা পক্ষপাতিত্ব স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযোদ্ধা পক্ষকে হতাশ করছিল। এর একটা পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা উপলবদ্ধি করতে শুরু করেছিলেন অনেকেই। প্রয়োজনবোধে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনাও মুক্তিযোদ্ধা পক্ষের অনেকের মাথায় ঠাঁই পেতে শুরু করে।
অমুক্তিযোদ্ধা পক্ষ চুপ করে বসে ছিল না। তারাও মনেপ্রাণে চাচ্ছিল সামরিক অভ্যুত্থান ঘটুক। কৌশলে তারা মুক্তিযোদ্ধা পক্ষকে উষ্কানি দিতে শুরু করেছিল, যাতে মুক্তিযোদ্ধা পক্ষই অভ্যুত্থান ঘটায়। সম্ভবত সে কারণেই মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের বদলি করে নির্দিষ্ট সেনানিবাসগুলোতে সমবেত করতে অদৃশ্যভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। যাতে এক জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা থাকলে অভ্যুত্থান ঘটানো সুবিধা হয় এবং অভ্যুত্থানের দায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযুক্ত করা যায়।
অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের দুর্নীতি ধীরে ধীরে তুঙ্গে উঠছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়া সব জেনেও চুপ করে ছিলেন। দুর্নীতি চরম পর্যায় উঠার শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধা পক্ষ অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের দুর্নীতি ব্যাখ্যা করে একটা তালিকা পর্যন্ত প্রস্তুত করে। চরম দুর্নীতির কারণে জেনারেল এরশাদের নাম তালিকার শীর্ষে স্থান করে নেয়। অথচ এই তালিকার ব্যাপারে কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। তখনই এরশাদ এর দুর্নীতি ও অসৎ চরিত্রের কথা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। সব জেনেও জিয়া তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। অথচ জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদই বিএনপি সরকারকে দিয়ে বিচার করেছে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অভ্যুত্থানে জড়িত ব্যক্তিদের। ফাঁসি দিয়েছে তাদের। বিএনপি সরকারের ঘারে বন্দুক রেখে সমস্ত কাজ করিয়ে নিয়ে যখন পথ পরিষ্কার হয়ে গেছে, ঠিক তখনই জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে বসেছেন নিরাপরাধের মুখোশ পরে। এরশাদ সামরিক বাহিনীর ভেতরে কতো যে ষড়যন্ত্র করেছে, তাতো পরে সবাই জেনেছে এবং প্রমাণও হয়ে গেছে। কিন্তু জিয়া জেনারেল এরশাদের ষড়যন্ত্রের কথাকে বিশ্বাস করেন নি। 
এদিকে মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের দেয়া তালিকার বিপরীতে অমুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা যখন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের তালিকা তৈরী করে জিয়াকে দিলেন, তখন তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেন। এই ঘটনা আবারও ক্ষোভের জন্ম দিল মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের মনে।
Zia_Khaleda_Indira.jpgএটা লক্ষ্য করা যায় যে, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৬ সাল থেকে যতগুলো সেনা বিদ্রোহ ঢাকা আর বগুড়ায় ঘটেছে, তার জন্য মুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধা পক্ষ উভয়েই দায়ী হলেও শাস্তি পেয়েছে শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই। নিহত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা। জিয়ার আমলে শুধু ১৯৭৭-এর অভ্যুত্থানেই বিদ্রোহের অভিযোগে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সৈনিককে মুত্যুদ- দেয়া হয়। সামরিক বাহিনীর মাঝে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর জিয়া কর্তৃক জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণে। সেখানে তিনি বলেন, ‘দেশের সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি সংকটময় মুহূর্তে আমি আমার বক্তব্য আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতার জন্য পেশ করতে চাই।’ 
আর একটি ঘটনার কথা বলি, চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহের দিন পনের আগে জেনারেল মঞ্জুর সামরিক বাহিনীর ভেতরে থাকা ক্ষোভ এবং এর আশু প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াকে একটা পনেরো পৃষ্ঠার চিঠি লিখলেন। পৌঁছানের জন্য তৎকালীন জিয়ার পিএস কর্নেল মাহফুজকে দিয়েছিলেন চিঠিটা। রাষ্ট্রপতি জিয়ার কাছে পৌঁছানোর আগেই ‘ঞযরং রং হড়ঃ ুড়ঁৎ লড়ন’ বলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা চিঠিটা হাতিয়ে নেন। এর পরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যায়, এই চিঠি জিয়ার কাছে আদৌ পৌঁছায় নি। তাহলে হয়তো পরবর্তী ঘটনা এমন হতো না। শুধু তাই নয়, সেনাবিদ্রোহের তিন মাস পর কর্নেল মাহফুজকে অভ্যুত্থানের দায়ে জড়িয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। চিঠির বিষয়টি জানতেন বলেই মাহফুজকে পৃথিবীতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা। 
অভ্যুত্থানের দায়ে অভিযুক্ত জেনারেল মঞ্জুরের বিচার না করে কেন তাকে হত্যা করা হলো- সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন আমার তো মনে হয় একটু খেয়াল করলেই বোঝা সম্ভব, মঞ্জুর হত্যার পেছনে কাদের হাত ছিল এবং শেষ পর্যন্ত এতে কারা লাভবান হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন এরশাদ এবং তার সহযোগিরা। আমি মনে করি, মঞ্জুর হত্যার বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। বিচার হলে চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে পরবে বলেই হয়তো এর ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন