রহস্যাবৃত জিয়া হত্যা-১

Zia killing logo.jpg[১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হন। এ হত্যাকান্ড সংক্রান্ত তথ্য আজো অনেকখানি গোপণীয়তার আবরণে ঢাকা। বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহিত এবং অনুসন্ধানে প্রাপ্ত জানা-অজানা বহু তথ্যের সমাবেশে সাড়া জাগানো এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেন প্রোবনিউজ-এর প্রধান সম্পাদক ইরতিজা নাসিম আলী। যা ১৯৯৪ সালের মে মাসে আট কিস্তিতে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল মতিউর রহমান সম্পাদিত দৈনিক ভোরের কাগজে। আগ্রহী পাঠকদের জন্য আলোচিত এই প্রতিবেদনটি ধারাবাহিকভাবে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।]


এক.
ziamusueam -1.jpgবৃষ্টিভেজা রাতের হত্যাকান্ড: পুরো অপারেশন সময় নিলো মাত্র ৯ মিনিট 
১৯৮১ সালের ২৯ ও ৩০ মে’র রাতের সন্ধিক্ষণ। প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল চারদিক। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পেছন দিক দিয়ে সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে একটা সাদা টয়োটা গাড়ি আর দুটো আর্মি পিকআপ বেড়িয়ে এলো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে। পাবলিক স্কুল রোড হয়ে যাত্রা করলো কালুরঘাট ব্রিজের দিকে। জি-১ হিলট্র্যাক্টস অপারেশন ডিভিশনের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান, ৩৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুবুর রহমান, মেজর খালেদসহ আরো কয়েকজন সেনাবাহিনীর অফিসার গাড়ির আরোহী।
ঘড়ির কাঁটা দুটো ছুলো। কালুরঘাট ব্রিজের সামনে এসে থামলো গাড়ির বহর। মেজর ফজলুল হক,
সুবেদার জাফর চৌধুরী এবং নায়েক সুবেদার সোলায়মানের অধীনে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি প্লাটুন বান্দরবান এসে অপেক্ষা করছিলো আগে থেকেই।
গাড়ি থেকে নেমে সঙ্গে নিয়ে আসা ৩টি হ্যান্ডলাঞ্চার, ১১টি এসএমজি এবং ৩টি গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল প্রস্তুত করে ফেলছিলো সেনা অফিসাররা। প্রস্তুতি পর্ব সমাপ্ত হলে রওনা হওয়ার আগে কর্নেল মাহবুব সবাইকে ডাকলেন অপারেশন পরিচালনা ব্রিফ করার জন্য। অপারেশন পথ ও পদ্ধতি অবশ্য আগেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল দিলওয়ারের বাসায় বসে নির্ধারণ করা হয়েছিলো। তবুও কারো যেন একটুও দ্বিধা না থাকে সে কারণেই ব্রিফ করলেন মাহবুব। বৃষ্টিতে সবাই ভিজছে। এই মে মাসের রাতেও কাঁপুনি এসেছে সবার শরীরে। ঝড়ো বাতাস আর উত্তেজনা মিশে অস্থিরতা বাড়িয়ে দিয়েছে সবার। ব্রিফিং শেষে বান্দরবান থেকে আসা প্লাটুন দুটি কালুরঘাটেই থাকবে বলে মনস্ত করলেন সবাই। মেজর খালেদ কর্নেল মাহবুবের সাদা টয়োটা গাড়িসহ অন্য গাড়িগুলোকে ব্রিজের অন্য পাড়ে পার্ক করে রাখতে বললেন।
Zia khal khonon.jpgরাত তিনটা বেজে তিরিশ। তিনটি পিকআপে উঠে বসলেন মোট ১৬ জন অফিসার। গাড়ি এগিয়ে চললো চট্টগ্রামের দিকে। তিনটি পিকআপের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তিনটি গ্রুপকে। প্রথম গ্রুপে রয়েছেন লে. ক. মাহবুব, লে. ক. ফজলে হুসেইন, মেজর খালেদসহ মোট ৬জন। দ্বিতীয় গ্রুপে ৬ জনকে নিয়ে ভাগ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন লে. ক. মতিউর, মেজর মমিনুল হক প্রমুখ। তৃতীয়টি মেজর ফজলুল হক, মেজর গিয়াসউদ্দিনসহ চারজন।
গাড়ির আরোহী সকলের মুখে চিন্তার ছাপ। সকাল থেকে এলাকার উপর নজর রাখছিলেন দুজন অফিসার। একজনের অবস্থান চিটাগং ক্লাব, অন্যজনের স্টেডিয়ামের কাছে একটা উঁচু বিল্ডিংয়ে। সিভিল ড্রেসে দুজন সারাদিন নজর রেখেছেন সার্কিট হাউসের উপর। বায়নোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখছেন কারা আসছে, যাচ্ছে। ইনফরমেশন পাঠিয়েছেন মাঝে মাঝেই মূল গ্রুপের কাছে। চারদিকে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। একজন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার জন্য যতোটুকু ব্যবস্থা গ্রহণ করার দরকার তার কমতি নেই। তাদের পাঠানো খবরা-খবর ভাবিয়ে তুলেছে পিকআপে বসে থাকা অফিসারদের। ভোর চারটের কিছু পরপরই শহরে ঢুকে পড়লো গাড়ি তিনটি। সারা চট্টগ্রাম শহর ঘুমিয়ে আছে। ফাঁকা রাস্তাগুলোতে বৃষ্টির পানি জমছে। চট্টগ্রাম ক্লাবকে বাঁয়ে রেখে প্রথম পিকআপ দুটি দেওয়ানহাট ব্রিজ ঘুরে সিএন্ডবি রোড হয়ে সার্কিট হাউসের দিকে এগিয়ে যায়। তৃতীয় গ্রুপের উপর নির্দেশ আছে আলমাস সিনেমা হলের সামনে অপেক্ষা করার।
সার্কিট হাউসের সামনের গেটটা বন্ধ। জানালাগুলো অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে। বৃষ্টির আমেজ মাখা ভোরে সবাই ঘুমিয়ে রয়েছেন। শুধু বারান্দা আর কার পোর্চ-এর লাইটগুলো জ্বলে রয়েছে। পিকআপ দুটো এগিয়ে আসলো মূল ফটকের দিকে। প্রথম গ্রুপের দায়িত্বে রয়েছে গুলিবর্ষণ করতে করতে সার্কিট হাউসের দোতলায় উঠে নির্দিষ্ট ঘরগুলোতে হামলা চালানোর। দ্বিতীয় গ্রুপটি সার্কিট হাউসের গ্রাউন্ড সিকিওর করবে। আলমাস সিনেমা হলের কাছে থাকা তৃতীয় গ্রুপটি সার্কিট হাউস থেকে কেউ পালাচ্ছে কিনা তার উপর নজর রাখবে।
গেটে ধাক্কা দিয়ে পিকআপ দুটো সোজা সার্কিট হাউসের মাঠে ঢুকে পড়লো। প্রথম পিকআপ রকেট লাঞ্চারের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার রকেট নিক্ষেপ করলেন। প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠলো সার্কিট হাউস। গার্ডরা চমকে উঠে আঁকরে ধরলো তাদের অস্ত্র। এসএমজি দিয়ে এক নাগারে গুলি করতে করতে দোতলার দিকে এগিয়ে গেল প্রথম দলটি। কি হচ্ছে বুঝে উঠবার আগেই সিড়িঁর নিচে থাকা গার্ড রেজিমেন্ট ও পুলিশের ৮/১০ জন দেহ ঝাঝরা হয়ে লুটিয়ে পড়লো সেখানেই। হতবিহ্বল অপর পক্ষ থেকে গুলির উত্তর আসলো সামান্যই।
পেছনে থাকা দ্বিতীয় গ্রুপটিও গুলি বর্ষণ শুরু করেছে তখন। সিড়িঁ মাড়িয়ে প্রথম গ্রুপটির অফিসাররা উঠে গেলেন দোতলায়। সার্কিট হাউসের যে ঘরে প্রেসিডেন্ট জিয়ার থাকার কথা ছিলো সে ঘরে তিনি ছিলে না। গোলাগুলির আওয়াজে সিড়িঁর ডান দিকের রুমটার দরজা ফাঁক করে বাইরে কি হচ্ছে দেখার চেষ্টা করলেন জিয়া। বিদ্রোহী অফিসারদের নজর পরলো জিয়ার উপর। গর্জে উলো হাতের আগ্নেয়াস্ত্র। মেঝেতে লুটিয়ে পরলেন তিনি। পুরো অপারেশনে সময় নিলো মাত্র নয় মিনিট।
গুলিতে আহত লে. ক. ফজলে হোসেন ও জামিলকে নিয়ে ভোর সাড়ে চারটির দিকে প্রথম পিকআপটি রওনা হয়ে যায় কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটালের দিকে। দ্বিতীয়টিতে মেজর খালেদ ও ক্যাপ্টেন সাত্তার ও লে. রফিককে নিয়ে লে. মাহবুব সোজা রওনা দিলেন আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশনের দিকে। সেখানে থাকা পুলিশ সেন্ট্রিদের নিরস্ত্র করে গ্রহণ করেন রেডিও স্টেশনের নিয়ন্ত্রণভার। আলমাস সিনেমা হলের সামনে অবস্থানরত তৃতীয় দলটি বান্দরবান রওনা হয়ে যায়। 
৩০মে ভোর সাড়ে চারটার কিছু পরে ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠলো টেলিফোন। রিসিভার তুললেন মেজর জেনারেল মঞ্জুর। অন্য প্রান্ত থেকে শোনা গেল মেজর মোজাফফরের কণ্ঠ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন