জাসদ কাহিনী (শেষ): গুপ্তহত্যা লুট রাহাজানি থামেনি ৭৫ সালেও ; জাফর ওয়াজেদ

চরমপন্থিদের অরাজকতা থেকে জনগণকে তথা দেশকে রক্ষা করার জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরও থেমে থাকেনি গুপ্তহত্যা, লুট, অগি্নসংযোগ। অরাজকতার এই সুযোগে সামরিক বাহিনীর বিপথগামী কতিপয় সদস্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে।জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর প্রথম চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল চরমপন্থি ও শ্রেণিশত্রু খতমকারীদের নেতা সিরাজ শিকদারের পতন। ১ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ শিকদারকে চট্টগ্রামে গ্রেফতার করা হয়। সশস্ত্র লড়াই করে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন সিরাজ শিকদার। গুপ্তহত্যা, রাহাজানি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা, খাদ্য ও পাট গুদামে অগি্নসংযোগ, খাদ্যদ্রব্য বহনকারী পরিবহন ধ্বংস ইত্যাদি সহিংস, নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগ ছিল পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সদস্যদের বিরুদ্ধে। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে পালানোর সময় সিরাজ শিকদার ২ জানুয়ারি নিহত হন। ১৯৭৮-এর ৩ জানুয়ারি সংবাদপত্রে পুলিশের বরাতে উল্লেখ করা হয়, 'নিজের দলের গুপ্ত একটি ঘাঁটি চিনিয়ে দেয়ার জন্যে পুলিশ গাড়িতে করে সাভারের দিকে তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে পালাবার সময় সিরাজ শিকদার পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।' ঘটনাটি তদন্তের জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করে। ৩ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা আইনবলে জরুরি ক্ষমতা বিধি বিধান জারি করা হয়। বিধিতে নাশকতা, সন্ত্রাসী, অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ, চোরাচালানি, কালোবাজারি এবং গুপ্তহত্যার মতো অপরাধের দায়ে দোষীদের প্রাণদণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়। এবং এসব সমাজবিরোধী কাজের দমনে সরকারের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়।৪ জানুয়ারি এক লাখ রেশন কার্ড জালিয়াতির অভিযোগে খাদ্য বিভাগ ও বিজি প্রেসের মোট ৪৪ জনকে গ্রেফতার করা 
হয়। ১১ জানুয়ারি কুমিল্লা সামরিক একাডেমিতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী জেন্টেলম্যান ক্যাডেটদের উদ্দেশে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। বলেন তিনি, 'আর একদল লোক আছে, যারা বিদেশিদের অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চায়। তারা রাতের অন্ধকারে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। একটি লোক কেমন করে যে পয়সার লোভে মাতৃভূমিকে বিক্রি করতে পারে, তা ভাবলে আমরা শিউরে ওঠি। যারা বিদেশের আদর্শ বাংলাদেশে চালু করতে চায়, এ দেশের মাটিতে তাদের স্থান হবে না।'
২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সংবিধান চতুর্থ সংশোধন বিল গৃহীত হওয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী সুদীর্ঘ ভাষণে বঙ্গবন্ধু এই পরিবর্তনের পটভূমি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে দাবি করেন যে, এই পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। দেশে বিরাজমান নৈরাজ্য এবং রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতার প্রসঙ্গ আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু সংসদকে জানান, "দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, আজ আপনার এই এসেম্বলি বা সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। যাঁদেরকে হত্যা করা হয়েছে তারা এই কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির মেম্বার ছিলেন। হত্যা করা হয়েছে গাজী ফজলুর রহমানকে, হত্যা করা হয়েছে নুরুল হককে, হত্যা করা হয়েছে মোতাহার মাস্টারকে। এমনকি, যা কোনোদিন আমাদের দেশে আমরা শুনি নাই যে, নামাজে, পবিত্র ঈদের নামাজে যখন কোনো লোক নামাজ পড়তে যায়, সেই নামাজের সময়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের হত্যা করা হয়েছে, যারা স্বাধীনতার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে যাঁরা সুদীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত এই বাংলাদেশে পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কারানির্যাতন ভোগ করেছেন, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। কোনো একটি রাজনৈতিক দল যাদের আমরা অধিকার দিয়েছিলাম- তাঁরা কোনোদিন এদের কনডেম করেছেন কি না? তারা কনডেম করেন নাই। তারা মুখে বলেছেন যে, তারা অধিকার চান। তারা মিটিং করেছেন, সভা করেছেন, রাজনৈতিক পার্টি গঠন করেছেন। কিন্তু তারা কি করেছেন? আমাদের সংবিধানে অধিকার দেওয়া আছে। ভোটের মাধ্যমে আপনারা সরকার পরিবর্তন করতে পারেন- এই ক্ষমতা আমরা দিয়েছিলাম। বাই-ইলেকশন আমরা তিন মাসের মধ্যে দিয়েছি। জনগণ ভোট না দিলে তার জন্য আমরা দায়ী নই। তখন তারা বলেছিলেন, এই সরকারকে অস্ত্র দিয়ে উৎখাত করতে হবে। মুখে বলেছেন, তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। কিন্তু গোপনে গোপনে তারা অস্ত্র জোগাড় করেছেন এবং সেই অস্ত্র দিয়ে, যাঁদের কাছ থেকে আমরা অস্ত্র নিয়েছি, যাঁরা অস্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন- তাদেরকে হত্যা করেছে ঘরের মধ্যে। আজকে আপনারা জানেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটা একটা 'হট রেড অব ইন্টারন্যাশনাল ক্লিকে পরিণত হয়েছে। এখানে অর্থ আসে, এখানে মানুষকে পয়সা দেওয়া হয়। এখানে তারা বিদেশিদের দালাল হন।... আমাদের রক্ত থাকতে এ দেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার ক্ষমতা কারোর নেই।" জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরই চরমপন্থিদের তৎপরতা কিছুটা হ্রাস পায়। ২৬ জানুয়ারি গ্রেফতার হন মাওবাদী চরমপন্থি নেতা ক্যাপ্টেন আলতাফ। ১৫ ফেব্রুয়ারি খুলনার দৌলতপুরে চরমপন্থিরা ৪টি পাট গুদামে অগি্নসংযোগ করে সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত করে। ১৬ মার্চ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে চরমপন্থিরা বোমাবাজি করে। এতে একজন নিহত ও ১২ জন আহত হন। ২২ মার্চ মাওবাদী চরমপন্থি নেতা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ঈশ্বরদীর আলউদ্দিন আহমদ গ্রেফতার হন।
৩ এপ্রিল সরকার দেশের গুপ্ত সশস্ত্র সমাজবিরোধীদের প্রতি ১৫ দিনের মধ্যে আত্দসমর্পণের জন্য নির্দেশ দেয়। ৫ এপ্রিল কুমিল্লার পানপাড়া খেয়াঘাটে স্টেনগানসহ তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। ১৪ এপ্রিল চরমপন্থিদের কারসাজিতে ক্রিসেন্ট জুটমিলে ভয়াবহ অগি্নকাণ্ড ঘটে এবং এতে বিপুল সম্পদ বিনষ্ট হয়। ২১ এপ্রিল কর্তব্যে অবহেলার দায়ে সরকার মাগুরার লাঙ্গলবাঁধ ফাঁড়ির সব পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
৬ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবনে হাতবোমা নিক্ষেপের ঘটনায় তিন ব্যক্তি নিহত হন। ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স এনেঙ্, কার্জন হল, লাইব্রেরি এলাকায় গণবাহিনী বোমাবাজি করে। ১৫ আগস্ট ঘটালো সেই কলঙ্কজনক অধ্যায়। '৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত এই সময়ে চরমপন্থিরা যা চেয়েছিল, বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতে অরাজকতার সৃষ্টি করেছিল তার সমাপনী ঘটে। চরম অরাজকতা সৃষ্টি করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পাকিস্তানি চিন্তা-চেতনা শুধু নয়, তাদের প্রতিভূরা এরপর দীর্ঘদিন শাসনক্ষমতা দখল করে রাখে। আর চরমপন্থিরা গুপ্তহত্যা থেকে সরে আসে। কেন গুপ্তহত্যা, কেন নিপীড়ন, কেন লুটপাট, অগি্নসংযোগ, কেন মানুষ মানুষকে হত্যা করে শ্রেণির নামে, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, ভাষার নামে, জাতির নামে- সে সব প্রশ্নের জবাব মেলে না অথচ বাংলাদেশ এসব প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়ে দেশে যে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছিল, সময় এখনো ফুরায়নি সেসব ঘটনার ওপর শ্বেতপত্র প্রকাশ করার। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রক্রিয়া এবং দেশকে পাকিস্তানি চেতনায় ফিরিয়ে নিতে যেসব কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়, নতুন প্রজন্মকে তা অবহিত করা রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন