তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পেছনে সুসংগঠিত ও স্পষ্ট ভাবাদর্শিক রাজনৈতিক প্রণোদনা ছিল দুর্বল। সেই অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা ও তার সংগঠকদের মৃত্যু কিংবা গ্রেফতারের পরে তার রেশ ধীরে ধীরে মিইয়ে যায়। যদিও ঘটনাবলীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জারি ছিল দীর্ঘদিন। সাতই নভেম্বরের ‘সিপাহি অভ্যুত্থান’-এর ফলাফল ও প্রভাব সেই তুলনায় অনেকাংশেই ভিন্ন। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ যেমন পূর্ববাংলাকে রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে তেমনি ১৯৭৫ সালের সাতই নভেম্বরের পূর্বের ও পরের বাংলাদেশও অনেকাংশে পৃথক দুই রাষ্ট্র। ১৯৭৫ সালের সাতই নভেম্বর তারিখটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাই অনন্য এক দিন। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাবের বিচারে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরেই পঁচাত্তরের সাতই নভেম্বরের গুরুত্ব বাংলাদেশে।
সাতই নভেম্বরের ঘটনাবলীকে বিপ্লব কিংবা প্রতিবিপ্লব কীভাবে চিহ্নিত করা হবে তা নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিতর্ক এখনো চলছে। এইরূপ বিতর্ক বরাবর আবর্তিত হয় কথিত ঘটনাবলী কে ঘটিয়েছে, কারা গুলি ফুটিয়েছে, কারা মারা পড়েছে ইত্যাদির অনুসন্ধানে। তবে এই ঘটনা, বিশেষ করে ঘটনার নায়ক লে. কর্নেল আবু তাহেরের ফাঁসির পর, এই অভ্যুত্থানের মূল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর রাজনৈতিক ও সামরিক কী পরিণতি হলো এবং তাদের সেই পরিণতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকভাবে কীভাবে নিজেকে
গঠন ও পুনর্গঠন করেছে সেটা এতদিন খুব কমই অনুসন্ধানকারীদের মনযোগ পেয়েছে। তাহেরের ফাঁসির পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থান এবং সাধারণভাবে বামপন্থী রাজনীতি ও বিশেষভাবে জাসদের অবক্ষয়ের এই সময়টিতে বাংলাদেশে কেবল যে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র নিজেকে লক্ষণীয়ভাবে পুনর্গঠিত করে নিয়েছে তাই নয় এসময় বিশ্ব পুঁজিবাদের সঙ্গেও পূর্ণাঙ্গ এক যোগসূত্র স্থাপিত হয় নবীন দেশটির। আদর্শিক ও আর্থিক নীতিনির্ধারণী এই মোড় পরিবর্তন তার সমাজ-সংস্কৃতিতেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। বিশাল এক ‘বাজার’ নিয়ে বাংলাদেশ যে আজ বিশ্ব বাজারের অংশীদার হয়ে উঠেছে তার জন্য এককভাবে পঁচাত্তরের সাতই নভেম্বর এবং তার পরবর্তী রাজনৈতিক বিকাশের অসামান্য অবদান রয়েছে বলেই ইতিহাসের এই অধ্যায়টির অনুসন্ধান স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যের জন্য জরুরি এক কর্তব্য ছিল এবং আছে।প্রায় চার দশক আগের উত্তাল অতীতের দিকে যদি আমরা তাকাই তা হলে দেখবো, ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ‘হাতছাড়া’ হয়ে যাওয়ার পরও পিছু হটতে নারাজ ছিল জাসদ এবং লে. কর্নেল তাহের। জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রযন্ত্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পুনর্চেষ্টার নতুন তারিখ নির্ধারিত হয় পঁচাত্তরের ২৩ ও ২৪ নভেম্বর। কিন্তু সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ এসব পরিকল্পনার পুরোটাই জেনে যায়। ১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ‘রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপ’-এর অভিযোগে একে একে মেজর (অব.) এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনুসহ গুরুত্বপূর্ণ জাসদ নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলে গ্রেফতার হন। সর্বশেষ কর্নেল (অব.) আবু তাহেরও গ্রেফতার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল থেকে। সামরিক সরকারের চিরুণী অভিযান সত্ত্বেও দলের মূল নেতা সিরাজুল আলম খান অবশ্য এসময় বিস্ময়করভাবে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন।
*১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বর ট্যাঙ্কের ওপরে উল্লাসরত হাসানুল হক ইনু(লাল বৃত্তে)
কর্নেল তাহেরের গ্রেফতারের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর ভাই, গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর প্রধান আনোয়ার হোসেন এক অভিনব অপারেশন পরিচালনা করেন ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসে। আটক জাসদ-নেতৃবৃন্দের মুক্তি এবং বেতার ও টিভিতে নিজস্ব বক্তব্য প্রচারের উপায় হিসেবে তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী গণবাহিনীর একটি চৌকস দল ঢাকাস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরণের কৌশল নেয় ১৯৭৫-এর ২৬ নভেম্বর। ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি স্কোয়াডের ওপর অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয় যাদের মধ্যে কর্নেল তাহেরের কনিষ্ট দুই ভাই বাহার ও বেলালও যুক্ত ছিলেন। তখন ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস ছিল ধানমন্ডি ২ নং সড়কে। অপারেশনটি ব্যর্থ হয়েছিল, সমর সেনকে প্রাথমিকভাবে জিম্মি করা গেলেও ভারতীয় রক্ষীদের পাল্টা হামলায় গণবাহিনীর চার কমান্ডো নিহত হন।
এই ঘটনা জিয়াউর রহমানকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে জাসদের ওপর দমন অভিযান চালাতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপ্লবী কার্যকলাপে এ ধরনের অপহরণ উদ্যোগের নজির থাকলেও বাংলাদেশে ১৯৭৫-এর ২৬ নভেম্বরের ঘটনাটির কোন ইতিবাচক অর্জন ছিল না। জাসদ নিজেও এই অপারেশনকে ‘আত্মঘাতী’ বিপ্লবী তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করে। সমর সেনকে অপহরণের এই চেষ্টা কূটনীতিকভাবে সরকারকেও বেশ ব্রিবতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রেসিডেন্ট সায়েম ইন্দিরা গান্ধীকে টেলিফোন করেন। বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি প্রতিনিধি দলকেও এ সময় ভারতে পাঠানো হয়। সাত্তার ঐ সময় প্রেসিডেন্ট সায়েমের বিশেষ সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। ভারত সরকার সমর সেনের চিকিৎসায় তাৎক্ষণিকভাবে ছয় জন চিকিৎসকের একটি দলকে ঢাকায় পাঠায় তাদের বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে।
সমর সেনকে অপহরণের ঘটনা জিয়াউর রহমানকে জাসদ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে ঠেলে দেয়। ১৯৭৬ সালের জুন থেকে তাহেরসহ জাসদ নেতৃবৃন্দের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ২১ জুলাই সামরিক আদালতের গোপন বিচার শেষে কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয়। একই সঙ্গে এই সময় জেনারেল জিয়াউর রহমান কারাগারের বাইরে থাকা জাসদ নেতা-কর্মীদের ওপরও নির্মম নিপীড়ন শুরু করেন। ইতিমধ্যে ১৯৭৫-এর ‘৭ নভেম্বর-এর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান’-এর ‘বরপুত্র’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ‘উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক’ হলেও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে ‘সামরিক আইন’ শাসিত দেশে তিনিই ছিলেন মূল ক্ষমতাধর। উল্লেখ্য, তাহেরকে ফাঁসির মাধ্যমে হত্যার প্রতিবাদে জাসদ দেশব্যাপী হরতালসহ বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচীর উদ্যোগ নিয়েছিল সেসময় এবং দলের সংগঠকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন ঐসব কর্মসূচী সফল করার জন্য এবং তাতে অন্তত আটজন কর্মী মারাও গিয়েছিলেন। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থে লিখেছেন, তাহেরকে ফাঁসির প্রতিবাদে লন্ডনসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেও বিক্ষোভ হয়েছিল।
জাসদের জঙ্গী কর্মীদের অনেকেই তখনো ভাবতেন, তারা ‘প্রতিশোধ’ নিতে সক্ষম হবেন। অন্যদিকে, ‘কাদের সিদ্দিকী ও ভারতের সহযোগী হিসেবে জাসদ দেশে সন্ত্রাস চালাচ্ছে’ এই সরকারি প্রচারণা ছিল তখন প্রবল। কাদেরিয়া বাহিনী ময়মনসিংহ সীমান্ত পুরোদস্তুর যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল। ফলে ভারত ও কাদেরিয়া বাহিনীকে জড়িয়ে উত্থাপিত অভিযোগ খন্ডন করতে জাসদ আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলো কারণ দেশজুড়ে ভারত বিরোধী মনোভাব তখন তুঙ্গে। একদিকে আহত প্রতিশোধস্পৃহা, অন্যদিকে ‘আমরা গণতন্ত্রী আমরা অস্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না’ সরকার ও জনগণের কাছে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য দলটি প্রায় সত্যাগ্রহে নেমেছিল তখন।
এইরূপ নমনীয়তা কৌশলগত হলেও তার মধ্যে ‘পরাজিত’ মানসিকতার ছাপও ছিল সুস্পষ্ট। বস্তুত এরপর থেকেই শুরু জাসদ রাজনীতির নতুন কালপর্ব। ১৯৭৪-এ যে দল দেশবাসীর কাছে ‘বিকল্প’ হিসেবে বিবেচিত হতো মাত্র ২-৩ বছর পরই তার বহুমুখী অবক্ষয় শুরু। খোদ জেনারেল জিয়ার সঙ্গে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ আলাপ-আলোচনা শুরু করে নূরে আলম জিকুদের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ। মাহবুবুর রব সাদীসহ অনেকে এই আলোচনার পথ প্রশস্ত করেন। অহিংস রাজনীতিতে আনুগত্য দেখাতে জাসদ গোপনে কিছু ‘টোকেন অস্ত্রসমর্পণ’-এরও আয়োজন করে এ সময়। নেতৃত্বের জঙ্গী ও বৃহৎ অংশ তখনও কারাগারে। গণবাহিনী ভেঙ্গে দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ ও তৎপরবর্তী সময়ে যারা গ্রেফতার হয়েছিল তাঁরা পর্যায়ক্রমে ১৯৭৭ সালের শেষের দিকে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৭ মার্চ পরবর্তী কার্যক্রমের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। বিশেষ করে বাকশাল গঠনের পর আওয়ামী লীগের প্রাইভেট বাহিনী হিসেবে রক্ষীবাহিনীর রোমহর্ষক নির্যাতন এবং হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের কর্মসূচীকে তারা চরম হঠকারি ও রোমান্টিক বলে আখ্যায়িত করেন। নূরে আলম জিকু ও শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে এই প্রচার ব্যাপকভাবে সর্বত্র চালানো হয়। সশস্ত্র পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে দল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বলে তারা অভিযোগ করে মূল নেতৃত্বকে দায়ী করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন