জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি -মহিউদ্দিন আহমদ (নির্বাচিত অংশবিশেষ)

বাংলাদেশে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সংঘটিত প্রধান প্রধান ঘটনাগুলো আজও থেকে গেছে অনুদঘাটিত ও অপ্রকাশিত। যারা ইতিহাস লেখেন তারা হয় সুবিধাভোগী, নয়তো ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ। ফলে বিকৃতির বেড়াজালে ঘুরপাক খাচ্ছে ইতিহাস। নতুন প্রজন্ম হচ্ছে বিভ্রান্ত। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মহিউদ্দিন আহমদের ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ গ্রন্থটি। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন।
Mujib mar 12Zia mar 12জাসদ একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঝড় তুলেছিল। ইতিহাসের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সময়ের অন্তরঙ্গ বর্ণনা পাওয়া যাবে এ বইয়ে। জানা যাবে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর উথালপাতাল রাজনীতির বিস্তার, পচাত্তরের হত্যাকান্ড, অভ্যুত্থান- পাল্টা অভ্যুত্থান, জাসদের জন্ম, পথচলা ও স্বপ্ন ভঙ্গের কথা। ইতিহাসের একটি অজানা পর্ব এই প্রথমবারে মত নির্মোহভাবে তুলে ধরেছেন মহিউদ্দীন আহমদ। তিনি নিজেও একসময় জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ের চুম্বক অংশ পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো:
পটভূমি
১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে উপদলীয় কোন্দল স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সভাপতির পদে কে এম ওবায়দুর রহমানের মনোনয়ন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। সাধারণ সম্পাদক পদে শাহ মোয়াজ্জেমের পছন্দের লোক ছিলেন সিরাজুল আলম খান। অন্যদিকে শেখ মনির সমর্থণ ছিল ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর প্রতি। শেখ মনি ছিলেন শেখ মুজিবের বোনের ছেলে। তিনি একজন পরিশ্রমী ছাত্রনেতা ছিলেন বটে, তবে মুজিব পরিবারের সদস্য হওয়ায় তাঁর একটা অতিরিক্ত সুবিধা ছিল। কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোরেশীর সমর্থক বেশি থাকলেও কাউন্সিলরদের মধ্যে সিরাজুল অলম খান
খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। শেষমেশ তিনিই (সিরাজ) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শেখ ফজলুল হক মনি এবং সিরাজুল আলম খানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছিল, যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী (পৃষ্ঠা-১৮)।
Serajul alam Khan mar 12সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের ভেতরে একটা গোপন সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার সূচনা করেন। ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে তিনি আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে নিয়ে ছোট একটা সেল বা চক্র তৈরি করেন। রাজ্জাক ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় কমিটির সহ-সম্পাদক। কাজী আরেফ ছিলেন ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সভাপতি। এই সেলের তাত্ত্বিক ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তাঁরা বিপ্লবী রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন ছিলেন। আঙ্গুল কেটে রক্ত ছুঁয়ে তাঁরা শপথ নেন, যতদিন পূর্ব বাংলা স্বাধীন না হবে, ততদিন তারা ব্যক্তিগত সুখ- সুবিধার পেছনে ছুটবেন না, এমন কি বিয়েও করবেন না। ... সেলটির নাম দেওয়া হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। (পৃষ্ঠা-১৯)
আগরতলা মামলা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের ব্যাপারে অবহিত হন। তিনি উৎসাহবোধ করেন, কিন্তু বিষয়টা নিয়ে হইচই করতে নিষেধ করেন। (পৃষ্ঠা-২৪)
ছাত্রলীগের ভেতরে যে মেরুকরণ ঘটছিল, তার একটা বিস্ফোরণ হয় ১০৭০ সালের আগষ্ট মাসে। ঢাকার ৪২ নং বলাকা বিল্ডিংয়ের ছাত্রলীগের অফিসে তখন কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিতসভা চলছিল। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সিরাজপন্থীদের মুখপাত্র ছিলেন স্বপন কুমার চৌধুরী। ২১ আগস্ট রাতে সভা চলার সময় তিনি ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটা প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন। এ নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা ও বিতন্ডা হয়। স্বপন ভোটাভোটির দাবি জানান। কেন্দ্রীয় কমিটির ৪৫ জনের মধ্যে ৩৬ জনই ছিলেন প্রস্তাবের পক্ষে। সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী অবস্থা বেগতিক দেখে সভা মুলতবী করে দেন। তখন সবাই মিলে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাসায় যান। শেখ মুজিব সব শুনে বিব্রতবোধ করেন। ...ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদিউল আলম বললেন, ‘আমরা মেজরিটি ভোটে প্রস্তাব পাশ করেছি।’ উত্তেজিত তরুণ-তুর্কিদের শান্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে শেখ মুজিব বললেন, ‘স্বাধনিতা চাস, ভাল। কিন্তু রেজুলেশন নিয়ে তো স্বাধীনতা হয় না। গ্রামে যা, কাজ কর।’ এ সময় রফিকুল ইসলাম জোরে শ্লোগান দিয়ে উঠলেন, ‘কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। রফিকের শ্লোগান শুনে শেখ মুজিব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘খবরদার, এ শ্লোগান দেবা না, এটা কমিউনিস্টদের শ্লোগান।’ ছাত্রলীগের আরেক সহ-সম্পাদক চিশতি হেলালুর রহমান শেখ মুজিবের মুখের সামনে হাতের বুড়ো আঙ্গুল উচিঁয়ে বললেন, ‘আপনি শ্রেণী সংগ্রামের কী বুঝেন?’ শেখ মুজিব হতভম্ব হয়ে যান। এই প্রজন্মকে তিনি চেনেন না। শেষে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোরা এখন যা। সিরাজের সঙ্গে আমার কথা হবে।’(পৃষ্ঠা- ৩২)
মনি-সিরাজ- রাজ্জাক- তোফায়েল- এই চার যুবনেতা বসে ছিলেন না। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথ তলায় ব্যানার্জি নামের এক ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়। তার মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের দেখা হয়। চার যুবনেতা ‘বাংলদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)’- এর প্রশিক্ষণের জন্য সম্পদ ও অবকাঠামোগত সুযোগ খুঁজছিলেন। উবানও খুঁজছিলেন এমন একটি যুবশক্তি। (পৃষ্ঠা-৪৬+৪৭) ...চার যুবনেতা নিজেদের নতুন নামকরণ করলেন। তাঁরা নতুন নামেই অনেক জায়গায় নিজেদের পরিচয় দিতেন। নামগুলো সংক্ষেপে ছিল মনোজ (মনি), সারোজ (সিরাজ), রাজু (রাজ্জাক) ও তপন (তোফায়েল)। বিএলএফ (মুজিব বাহিনী)-এর চার আঞ্চলিক অধিনায়ককে লে. জেনারেলের মর্যাদা ও প্রটোকল দেওয়া হয়েছিল। প্রশিক্ষণার্থী বাছাই করা হতো মূলত ছাত্রলীগের সদস্যদের মধ্য থেকে। ... মোট কতজন প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন, তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। উবানের হিসাব মতে, সংখ্যাটি ছিল ১০ হাজার। প্রকৃত সংখ্যাটি ছিল সাত হাজার। ... প্রশিক্ষণার্থীদের বেইস ক্যাম্পে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি খরচ মেটানোর জন্য ৭৬ লাখ টাকার একটা বাজেট তৈরি করে উবানের হাতে দেওয়া হয়। বরাদ্দ হয়েছিল ৭০ লাখের কিছু বেশি। কয়েক কিস্তিতে টাকাটা দেওয়া হয়। (পৃষ্ঠা- ৪৯)
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ কথাবার্তার মাঝে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে বলেন, ‘আমার দেশ থেকে আপনার সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনতে হবে।’ শেখ মুজিব এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এত সহজভাবে তুলতে পারেন, ভাবতেও পারেননি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। তাঁর অপ্রস্তুত অবস্থার সুযোগে নিয়ে শেখ মুজিব নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আদেশই যথেষ্ট।’ অস্বস্থিকর অবস্থা কাটাতে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে রাজি হতে হয় এবং (তিনি) জেনারেল মানেকশকে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের দিনক্ষণ নির্ধারণের নির্দেশ দেন (হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর স্মৃতিচারণ থেকে উদ্ধৃতি)। পৃষ্ঠা-৫৭।
উত্থান
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পন করার আহবান জানালেন। কিন্তু তাঁর আহবানে বিশেষ কোন কাজ হলো না। অনেকেই তখন প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করছেন। বাড়ি-গাড়ি-দোকান- অফিস দখল চলছে। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের উপর অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। এ নিয়ে তাজউদ্দীনের সঙ্গে মুজিববাহিনীর নতুন করে তিক্ততা শুরু হয়। শেখ ফজলুল হক মনি ব্যাপারটা নিয়ে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে রীতিমত প্রচারে নামলেন। জেনারেল উবান তখন ঢাকায়। তাঁর বর্ননায় বিষয়টি এভাবে উঠে এসেছে:
Jalil Taher mar 12‘‘তিনি (মনি) আমার কাছে অভিযোগ করলেন যে, তাজউদ্দীন যে পলিসি নিয়েছেন তা, মনির মতে, ক্ষমতায় থাকার জন্য ও বামপন্থী বাহিনীসমূহ গড়ে তোলার জন্য। ... অস্ত্র সংক্রান্ত এই প্রশ্নে শ্রী ডি পি ধর ও মনির মধ্যে অত্যন্ত কড়া বাক্যবিনিময়ের আমি ছিলাম একজন সাক্ষী। মনি শ্রী ধরকে বলেছিলেন, শেখ মুজিব ঢাকায় না পৌছাঁনো পর্যন্ত তাঁরা অস্ত্র জমা দেবেন না এবং তেমন প্রয়োজন হলে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবেন। এই সময় মনি যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। শ্রী ধর যে মুষড়ে পড়েছিলৈন তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। মনি পরে আমাকে বলেছিলেন, তিনি নিশ্চিত যে শ্রী ধর তাঁর দেশের সবচে বড় শত্রু। পরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে এর প্রভাব পড়েছিল। এটা খুবই জানা কথা যে, শেখ মুজিব ক্ষমতা নেওয়ার পর তাঁর সরকারের কাছে শ্রী ধর একজন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হয়ে পড়েছিলেন। একপর্যায়ে বাংলাদেশ তাঁকে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল । শ্রী মতি গান্ধী ব্যাপারটা মিটমাট করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কারণ, তিনি বাংলাদেশের জন্য যা করেছিলেন, তার জন্য শেখ মুজিব তার কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন।’’ (পৃষ্ঠা-৬২)
১৯৭২ সালের জানুয়ারির কোন এক সময় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের নেতাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের একটি বৈঠক হয়। সিরাজুল ইসলাম খান ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে একটি ১৫ দফা কর্মসূচির খসড়া দিয়েছিলেন শেখ মুজিবকে। নতুন রাষ্ট্রটি কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিৎ, এই কর্মসূচিতে তিনি তা উল্লেখ করেছিলেন।
গণভবনের সবুজ চত্বরে এক সন্ধ্যায় সিরাজুল আলম খানের কাঁধে হাত রেখে শেখ মুজিব অনেকক্ষণ হেঁটেছিলেন। একপর্যায়ে বলেই ফেললেন, ‘পারলাম নারে সিরাজ।’ আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা এর (কর্মসূচি) বিরোধীতা করেছিলেন।
তাজউদ্দীনের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। তিনি লক্ষ্য করলেন, তাজউদ্দীন ক্রমেই কোনঠাসা হয়ে পড়ছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীনের ভূমিকা ও পরবর্তী সময়ে তাঁর নেপথ্যে চলে যাওয়ার ব্যাপারে সিরাজুল আলম খানের পর্যবেক্ষণ ছিল এরকম:
‘বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ের নেতা হলেন তাজউদ্দীন। জামায়াতে ইসলামি হলো পাকিস্তানী ফোর্স আর আওয়ামী লীগ ছিল এন্টি লিবারেশন ফোর্স। আওয়ামী লীগ তো ছয় দফা থেকে এক ইঞ্চিও আগে বাড়তে চায়নি। এদের সত্যিকার চেহারা জানতে পারলে মানুষ এদের থুথু দেবে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তাজউদ্দীনের নাম আসা উচিৎ এক নম্বরে। অথচ তিনিউ হলেন এর প্রথম ক্যাজুয়ালটি।’ (পৃষ্ঠা- ৬৯-৭১)
বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের দুই নেতা সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাকের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগের একাংশের মধ্যে ‘অতিবাম’ প্রবণতা লক্ষ করে করে রাজ্জাক উদ্বিগ্ন হন। ... ‘লাল সালাম’ স্লোগানে তার ঘোর আপত্তি ছিল।
... একাত্তর সালের অক্টোবরে বিএলএফ-এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সিরাজুল আলম খান প্রথম ‘মুজিববাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। রাজ্জাক এটা সমর্থন করেন। ১৬ ডিসেম্বরের পরই ছাত্রলীগের মধ্যে ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ- মুজিববাদ মুজিববাদ’ - এই স্লোগান চালু হয়ে যায়। কয়েকদিন যেতে না যেতেই সিরাজপন্থীরা এই স্লোগান বন্ধ করে দেয়। তবে বাহাত্তরের জানুয়ারিতেই জাতীয় শ্রমিক লীগের ব্যানারে ‘লাল বাহিনী’ তৈরির ঘোষণা দেওয়া হয়। (পৃষ্ঠা-৭৩)
...সিরাজুল আলম খান তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে নতুন দল করা নিয়ে বিস্তর আালোচনা করেন। মুজিববাহিনীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের টানাপোড়েন থাকা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের সখ্য ছিল। শেখ মুজিব তাদের দুজনের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করতেন। আওয়ামী লীগের অন্য সিনিয়র নেতাদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ছিলেন মুজিবের খুবই অনুগত। জাতীয় নেতা হওয়ার মত গুনাবলী তাঁদের ছিল না। দলের আরেক সিনিয়র নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছিলেন অত্যন্ত ধীর-স্থির ও বুদ্ধিমান। শেখ মুজিবের সঙ্গে একমাত্র তাঁরই ‘তুই-তুমি’ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের অনেক বিষয়ে এবং কাজে শেখ মুজিব তাঁকে সম্পৃক্ত করতে ভরসা পেতেন না।
মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করার সময় তাজউদ্দীনের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর বিরোধ হলেও মূল দ্বন্দ্বটা ছিল শেখ মনির সঙ্গে। শেখ মনি তাজউদ্দীনকে মনে করতেন কমিউনিস্টদের চর। শেখ মুজিব ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসার পর মনি তাজউদ্দেিনর বিরুদ্ধে মুজিবের কান ভারী করেছিলেন। এ নিয়ে তাজউদ্দীনের মনঃকষ্ট ছিল, যদিও প্রকাশ্যে তিনি কখনো মুজিবের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সরকারি পদে থাকলে দলের নেতৃত্বে থাকা যায় না। সে জন্য তাজউদ্দীনকে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিতে হয়। শেখ মুজিব কিন্তু সভাপতির পদ ছাড়লেন না। সিরাজুল আলম খানের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেননি। মনি নিজেও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু দলের অনেক নেতাকর্মী তাকে অপছন্দ করতেন (পৃষ্ঠা-৮৩ ও ৮৪)।
সিরাজুল আলম খান তাজউদ্দেিনর পেছনে লেগে ছিলেন তাঁকে নতুন দলে টানার জন্য। ৩০ অক্টোবর সিরাজুল আলম খান ও আসম রবকে তার বাসায় ‘চা-নাসতা খাওয়ার দাওয়াত’ দেন তাজউদ্দীন। ...মন্ত্রীপাড়ায় তাজউদ্দীনের বাসায় সারা রাত আলাপ-আলোচনা করেন। একপর্যায়ে তাজউদ্দীন রীতিমত ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আওয়ামী লীগে তিনি ইতিমধ্যে যথেষ্ট কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। অথচ এই বৃত্তের বাইরে যাওয়ার মতো সহস তাঁর ছিল না। বললেন, বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে এখন আর তার কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। তবে তিনি কথা দেন, নতুন দল গড়তে সিরাজুল আলম খানদের তিনি যতদূর সম্ভব সহায়তা দেবেন। ।
বাহাত্তরের ৩১ অক্টোবর সকালে এক সভায় ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ নামে নতুন একটা রাজনৈতিক দল গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। (পৃষ্ঠা-৮৬ ও ৮৭)
বিস্তার
নির্বাচনের দিন সকালে একটা ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণ ইনস্টিটিউিটের ভোট কেন্দ্রে ভোট দিয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম মাহবুবুল হক ও গণকন্ঠের নির্বাহী সম্পাদক আফতাবউদ্দীন কলাভবনের একতলার বারান্দায় রেলিংয়ের ওপর বসেছিলেন। বেলা ১১টা হবে। শেখ কামাল কয়েকজন সহযোগীসহ তাঁদের জোর করে একটা গাড়িতে ওঠান। গাড়িতে তাদের চোখ বেঁধে ফেলা হয়। পরে তাদের একটা বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সারাদিন সেখানে তাদের আটকে রাখা হয়। তাদের শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। আফতাব পরে বলেছিলেন, তাদের আবাহনী ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রাত নটার দিকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। শর্ত ছিল এসব কথা পত্রিকায় লেখা যাবে না। (পৃষ্ঠা- ৯৮)
আওয়ামী লীগ ২৯২ টি আসনে জয়লাভ করে। ...একজন মার্কিন কূটনীতিকের পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘তেয়াত্তরের মার্চ মাসের নির্বাচন হলো শেষ যাত্রার শুরু। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতেছিল বিপুলভাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা ভোট নিয়ে ছেলেখেলা করেছে এবং জালিয়াতি থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখতে পারেনি।’(পৃষ্ঠা- ১০০)
তেয়াত্তরের আগস্টে ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। রাত ৮টার দিকে লেলিন-গামার (ছাত্রইউনিয়ন ও মুজিববাদী ছাত্রলীগ সমর্থিত প্রার্থী) সমর্থকেরা ভোট গননার কেন্দ্রগুলোতে হামলা করে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যায়। তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এক হল থেকে অন্য হলে যায়। প্রতিপক্ষ দলের ছাত্ররা এবং ভোট গননার কাজে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা আতঙ্কিত হয়ে যে যেদিকে পারেন পালিয়ে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সেটা ছিল একটা কলঙ্কজনক দিন। (পৃষ্ঠা-১০৬)
১৭ মার্চ পল্টনে জাসদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ... সভা শেষ হতে না হতেই এক বিশাল মিছিল মিন্টো রোডের দিকে রওনা হয়। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন জলিল ও রব। মিছিল গিয়ে থামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাড়ির সামনে। স্লোগান চলতে থাকে। কয়েক ট্রাকবোঝাই পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সদস্য এসে উপস্থিত হন। হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়- তিনজন নিহত ও ১৮জন আহত হয়েছেন। জাসদ দাবি করে, অন্তত ৫০জন নিহত হয়েছেন। মাঈনুদ্দিন খান বাদলের বাবা আহমদুল্লাহ খান ছিলেন পুলিশের ঢাকার তেজগাঁও অঞ্চলের ডিএসপি। বাদল পরে তাঁর কাছে শুনেছিলেন, ৪০-৫০টি লাশ রক্ষীবাহিনী ট্রাকে করে নিয়ে গেছে। (পৃষ্ঠা-১১১)
১৭ মার্চের মিছিল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও নিয়ে জাসদের মধ্যে অনেক বিতর্ক হয়। বিতর্কের প্রথম প্রশ্ন ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাড়ি কেন ঘেরাও করতে হবে, গণভবন নয় কেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, প্রথম গুলি কারা ছুড়েছে?...এটা ছিল দলকে আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার একটি অংশ। পরিকল্পনাটি সফল হয়। এ প্রসঙ্গে জাসদের জাতীয় কমিটির কৃষি সম্পাদক হাবিবুল্লাহ চৌধরীর ভাষ্য: ‘মমতাজ (হাবিবুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী ও জাসদ নেত্রী) আমারে কইছিল, গুলি প্রথমে আমাদের লোকেরাই করেছে।... প্রথমে শুনলাম, গুলি করছে হাবিবুল হক খান বেনু। পরে জানলাম, এইডা হাসানুল হক ইনুর কাম। সিরাজুল আলম খানরে জিগাইলাম, পোলাপান সব মইরা যাইতেছে, কী ছাতার বিপ্লব করেন। সে জবাব দেয় না। প্রশ্ন করলেই সাইড কাইট্টা যায়। ভলিউম ঘাইট্টা খালি তত্ত্ব ঝাড়ে।’ (পৃষ্ঠা- ১১৩)
বিদ্রোহ
শেখ মুজিব তার পরিবারের কিছু সদস্যকে নিয়ে বিপাকে ছিলেন। বিশেষ করে ফজলুল হক মনি ও শেখ কামালের কিছু কিছু কাজের ফলে তারা শুধু নিজেরাই বিতর্কিত হননি , এর দায় নিতে হয়েছে শেখ মুজিবকে। শেখ কামাল অতি উৎসাহে অনেক কিছুই বলতেন বা করতেন, যার জন্য শেখ মুজিবকে যথেষ্ট বিব্রত হতে হতো। ... চুয়াত্তরের ৩ জুন সর্বহারা পার্টি পরপর ২দিন হরতাল ঘোষণা করেছিল। ... শেখ কামাল এই হরতালকে ব্যক্তিগতভাবে নিলেন। ২ জুন রাতে দলবল নিয়ে একটা মাইক্রোবাসে চেপে সর্বহারা ধরতে বের হলেন। তারা সশস্ত্র ছিলেন। মাঝরাতে এরকম একটা মাইক্রোবাস দ্রুতগতিতে যেতে দেখে পুলিশের সন্দেহ হল। ...পুলিশের গাড়ি থেকে মাইক্রোবাসে গুলি করা হয়। কামাল গুলিতে গুরুতর আহত হন।
বেলা ১১টায় পুলিশের আইজি আব্দুর রহিম এনএসআইয়ের প্রধান মেসবাহউদ্দীনকে নিয়ে শেখ মুজিবের বাসায় যান। ঘটনার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান। শেখ মুজিব রহিমকে বলেছিলেন, ‘এতে দুঃখ প্রকাশের কী আছে? সে যদি মারাও যেত তাহলেও আমার দুঃখ হতো না। কে তাকে মাঝরাতে দুস্কৃতকারী ধরতে যেতে বলেছে। আমি তো তাকে হাসপাতালে দেখতেও যাইনি? (পৃষ্ঠা- ৯৮)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের একটা বিশেষ সম্পর্ক ছিল, যা শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। ঢাকায় সিরাজ যে জায়গায় থাকতেন, সেখানে আসা-যাওয়ার পথে জাসদের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু তাঁর বাসায় কখনো পুলিশ যায়নি। এ ব্যাপারে শেখ মুজিবের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল। তিনি সিরাজকে বলেছিলেন, ‘তোর এখন এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়।’
কয়েকদিন পর শেখ মুজিব সিরাজুল আলম খানকে ডেকে পাঠান। অনেক দিন পর গুরু-শিষ্যের দেখা হলো। দুজন-দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। শেখ মুজিব অনুযোগ করে বললেন, ‘সিরাজ তুই সবাইকে নিয়ে চলে গেলি?’ তিনি সিরাজকে বললেন, তিনি একটা জাতীয় দল গঠন করতে চান। এত দলের দরকার নেই। সিরাজ বললেন, ‘এতে তার সম্মতি নেই।’ মুজিব বললেন, ‘সবাইকে নিয়ে একটা দল করতে চাই। জলিল ও রবকে তুই আমার দলে দে।’ (পৃষ্ঠা-১৫৭)
অভ’্যত্থান
মেজর নূর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। পরে তিনি সর্বহারা পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। সিরাজ সিকদারের নিহত হওয়ার ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। ১৫ আগষ্টের কয়েকদিন পর সর্বহারা পার্টির কয়েকজন নেতা কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পাশের একটা বাসায় সন্ধ্যাবেলা বৈঠক করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন, আকা ফজলুল হক ও মহসীন আলী। তাঁরা নূর ও ডালিমকে ডেকে পাঠান। নূর একাই এসেছিলেন। শেখ মুজিবের পরিবারের সবাইকে হত্যা করার বিষয়ে জানতে চাইলে নূর বলেন, ‘ওরা আমার নেতাকে খুন করেছে, আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি।’ নূরের উদ্ধত আচরণ এবং নৃশংসতার পরিচয় পেয়ে জিয়াউদ্দিন ক্ষুব্ধ হন।
শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাতের জন্য তাহেরের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। শেখ মুজিবের প্রতি তার ক্ষোভ ছিল অপরিসীম। তাহের মনে করতেন, ‘মুজিব সরকার সেনাবাহিনীর উন্নয়নে চরম অবহেলা দেখিয়েছে এবং রক্ষী বাহিনীর মত একটা কুখ্যাত আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেছে। তিনি সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
তাহের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেন নি। তবে ওইদিনই অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাহের মেজর রশীদের অনুরোধে সকাল নটায় ঢাকা বেতারকেন্দ্রে যান। তার পরামর্শে ডালিমরা সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানকে বেতার ভবনে নিয়ে আসেন অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ্যে বিবৃতি দেওয়ার জন্য।
দুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি আঁচ করতে। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ‘ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে এ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখনতো সেখানে মাজার হবে। উচিৎ ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলা দেওয়া।’
শেখ মুজিবের কাল্ট তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভ’মিকা রেখেছিলেন সিরাজুল আলম খান। মুজিব তাকে একরকম ব্ল্যাংক চেক দিয়েছিলেন। এককথায় সিরাজ ছিলেন শেখ মুজিবের সবচেয়ে ‘আস্থাভাজন শিষ্য’। এটাই ছিল সিরাজুল আলম খানের ক্ষমতার ভিত্তি। দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় দুজনই দুর্বল হয়ে পড়েন। মুজিব নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে সিরাজ দুঃখ পেয়েছিলেন সন্দেহ নেই। তবে তিনি মনে করতেন, এটা ছিল অনিবার্য। শেখ মুজিব নিজেই এই পরিণতি ডেকে এনেছিলেন।
জিয়াউর রহমান ও খালেদ মোশাররফের মধ্যে যে ক্ষমতার লড়াই, তার সূত্রপাত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ই। ৩ নভেম্বর থেকে সেনানিবাসগুলোতে খালেদ ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে যারা প্রচার করেছিলেন, তারা ছিলেন জিয়ার লোক। তাদের মধ্যে প্রধান ভ’মিকা ছিল কর্নেল তাহেরের।
জিয়াকে নিয়ে তাহের যে জুয়া খেলেছিলেন, তার মূল্য যে শুধু তিনি দিয়েছেন, তা নয়। মূল্য দিতে হয়েছে পুরো দলকে। জাসদের হাজার হাজার কর্মীকে। (পৃষ্ঠা- ১৯০-২২৩)
তাহেরের স্মৃতি রক্ষার্থে তৈরি করা হয়েছিল তাহের সংসদ। নেপথ্যে থেকে এই সংসদ পরিচালনা করতেন তার ছোটভাই আনোয়ার হোসেন। এ ব্যাপারে সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আহমদ শরীফের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। ১৯৯৭ সালের ২০ জুলাই অধ্যাপক শরীফ তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘...কয়েক বছর তাহের সংসদের সভাপতি ছিলাম। তাহেরের ভাই মহা-উদ্যোগী ও উদ্যমী ডক্টর আনোয়ার হোসেন একাধারে উচ্চাশী ক্ষমতালিপ্সু, সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী, আবার গোঁয়ারও। তিনি হঠাৎ আওয়ামী লীগের সমর্থক হয়ে উঠলেন। ফলে আমি তাহের সংসদ ছেড়ে দিলাম।’’ (পৃষ্ঠা-২৬১)
শেষ কথা
একাত্তরের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ নতুন রাষ্ট্রের হাল ধরলো এবং মনে করল দেশটা কেবল তাদের। আওয়ামী লীগের সমালোচনা মানে দেশদ্রোহ, ষড়যন্ত্র। মুসলিম লীগের বানানো জুতায় আওয়ামীগ পা রাখল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল। জন্ম নিল জাসদ।
... জাসদ রাজনীতির জমিতে চাষ দিয়েছে, বীজ বুনেছে, মই দিয়েছে, কিন্তু ফসল তুলতে পারেনি। ফসল চলে গেছে অন্যের ঘরে। এটাকেই অনেকে জাসদের ব্যর্থতার উদাহরণ বলে মনে করেন। .... তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এতো প্রাণ যে ঝরে গেল, তার কি কোন প্রয়োজন ছিল? নাকি এটা ছিল অনিবার্য? হয়তো একদিন এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যবে। আর কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো কোনদিনই পাওয়া যাবে না। #
PROBE

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন