দুঃস্বপ্নের স্মৃতিচারণা কখনোই সুখকর ব্যাপার নয়। তারপরও প্রতিবছর এই সময়ে আমার মন ১৯৮১ সালের ৩০ মের সেই আতঙ্কজনক সকালে চলে যায়, স্থান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস। সেই সকালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আততায়ীর হাতে নিহত হন। শতাব্দীর প্রাচীন ভবনটির অংশবিশেষ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, তিনজন নিরীহ মানুষও নিহত হয়। স্থানীয় সেনানিবাস থেকে আসা একদল উর্দিধারী মানুষ এদের সবাইকে হত্যা করেছিল। আমি যখন ভোরবেলা ঘটনাস্থলে পৌঁছাই, তখন সেখানে ভুতুড়ে নীরবতা বিরাজ করছিল। মনে হচ্ছিল, ঘণ্টা খানেক আগেই সেখানে রীতিমতো যুদ্ধ হয়েছে। সার্কিট হাউসের বারান্দা এবং ওপরের ব্যালকনির একটি অংশ ভাঙা অবস্থায় পড়ে ছিল। দুজন উর্দিধারী মানুষের নিথর দেহ সিঁড়িতে পড়ে ছিল—একটি ছিল পুলিশের, আরেকটি ছিল সেনাসদস্যের দেহ। কিন্তু সবচেয়ে বিপর্যয়কর ও মর্ম বিদীর্ণ করা ব্যাপার ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বুলেটবিদ্ধ দেহ। যে স্যুটে তিনি ছিলেন, তার খানিক দূরেই পড়ে ছিল তাঁর নিথর দেহটি। সেই দৃশ্যটি আমাকে বহুকাল তাড়িয়ে বেরিয়েছে, এমনকি এখনো তা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য ছিল। দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটির ডাকে যেখানে পুরো সেনাবাহিনী মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে প্রস্তুত ছিল, সেই রাষ্ট্রপতি কিনা তাঁর নিজের এক লোকের হাতে এভাবে খুন হলেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে খুন করার এই অভিযান সম্ভবত এক ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। এ কথা বলছি কারণ, সেদিন
আমি ভোররাত তিনটার দিকে সম্ভবত প্রথম গুলির শব্দ শুনেছিলাম। আমার বাংলো থেকে সার্কিট হাউসের দূরত্ব ছিল মাত্র এক মাইলের মতো। পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে এক ঘণ্টা পর আমাকে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতিকে খুন করা হয়েছে। আমি সার্কিট হাউসে পৌঁছার এক ঘণ্টা আগেই খুনিরা সেই স্থান ত্যাগ করেছিল। অভিযানটি খুব সুপরিকল্পিত ছিল, তার লক্ষ্যও ছিল একটি। কিন্তু পরবর্তীকালে যে খবর বেরোয়, তা ছিল আরও অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও দুর্বোধ্য।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে খুব অল্পসংখ্যক মানুষের এক প্রতিনিধিদল ছিল, তাঁদের সবাই রাতে সার্কিট হাউসেই ছিলেন। রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছাড়া এই দলে ছিলেন বিএনপির মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, উপদেষ্টা ড. আমিনা রহমান ও আরও একজন প্রতিমন্ত্রী। খুনিরা সেখানে ঢোকার পর তাঁরা নাকি খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমরা সার্কিট হাউসে পৌঁছার পর তাঁরা একে একে বের হয়ে আসেন, বিহ্বল চিত্তে তাঁরা ভয়ে কাঁপছিলেন। সেখানে যে লোকটা সবচেয়ে শান্ত ছিলেন, তাঁর সামরিক ইউনিফর্মও ছিল একদম পরিপাটি, লে. কর্নেল মাহফুজ, রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত সচিব। আমাদের দেখে বেরিয়ে আসার সময় তিনি বেতার ফোনে কথা বলছিলেন। তিনি খুব শান্ত গলায় আমাদের জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ হেলিকপ্টারে রওনা হয়েছেন। তাঁর মেজাজের প্রশান্তি দেখে মনে হচ্ছিল না যে সেখানে কোনো বিপর্যয় ঘটেছে। তাঁর ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আছে; একদল বিপথগামী ঘাতকের হাতে রাষ্ট্রপতি খুন হয়েছেন।
যে মানুষদের জিয়াউর রহমান নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের হাতেই যে তিনি খুন হবেন, সেটা দুর্ঘটনা নয়। আবার একদল ক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্তের কারণে তিনি খুন হয়েছেন, ব্যাপারটা তেমনও নয়। কয়েক বছর ধরে তাঁকে খুন করার এই পরিকল্পনা হয়েছে। দেশ ও আমাদের মতো দলের বাইরের মানুষদের জন্য এটা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, খুনের প্রকৃত সত্য কখনোই বেরোবে না, অথচ কুশীলবেরা এটা নিয়ে কুশলতার সঙ্গে কত না নাটক করবেন। এর সঙ্গে আরও কিছু যোগ করতে হবে। এই খুনের পর আরও অনেক অস্বাভাবিক ও পরিণাম-অজানা ঘটনা ঘটেছে, এগুলো দেখে আমরা হতবুদ্ধি হয়ে গেছি; যার রেশ এখনো আছে।
সেদিন সকালে লে. কর্নেল মাহফুজের রহস্যময় আচরণের পাশাপাশি প্রথম লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে সেনা অনুপস্থিতি। মাহফুজ দাবি করেন, সেনাপ্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘটনার তিন ঘণ্টা পর পর্যন্ত রেডিও বা অন্য কোনো মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত ঘোষণা আসেনি। আমাদের তরফ থেকে সকালের দিকে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ফোনে ঘটনাটি জানাই। এরপর চট্টগ্রামের সঙ্গে বাইরের টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত তা বহাল থাকে। হেলিকপ্টার আসেনি, ঢাকা থেকেও কেউ আসেনি।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার খুনের প্রথম ঘোষণাটি আসে চট্টগ্রাম বেতার থেকে, একজন অজ্ঞাত সেনা কর্মকর্তা এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের সরকারকে হটিয়ে ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’ ক্ষমতা দখল করেছে। ছয় ঘণ্টা পার হওয়ার আগে সরকারের তরফ থেকেও অভিযোগ খণ্ডন করা হয়নি। তখন উপরাষ্ট্রপতি এক রেডিও ভাষণে তথাকথিত অভ্যুত্থানের নিন্দা জানান, আর এসব কিছুর দায় চাপান চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুরের কাঁধে। আর এই তথাকথিত অভ্যুত্থানই বা চট্টগ্রামে কীভাবে ব্যর্থ হলো? এক ডজন সেনা চট্টগ্রাম টেলিফোন ভবন এবং আরেক দল টিভি ও রেডিও ভবন দখল করে নেয়। একজন সেনাও শহরে প্যারেড করেনি, আবার ‘বিদ্রোহী সেনাদল’ যানবাহন চলাচল বন্ধ করার চেষ্টা করেনি। দেশে কী ঘটেছে, তা নিয়ে পুরো শহরে আতঙ্ক বিরাজ করছিল, পুরো শহরই তখন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল।
এর পরবর্তী অপরিণামদর্শী ঘটনা ছিল মেজর জেনারেল মঞ্জুরের আচরণ, বিদ্রোহের অনুমিত নেতা। তিনি আমাকে (জেলা প্রশাসক) ও বিভাগীয় কমিশনারকে সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে নিজেকে তথাকথিত বিপ্লবী কাউন্সিলের মুখপাত্র হিসেবে পেশ করেন। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, এই বিপ্লবী কাউন্সিলে কে কে আছেন, তখন তিনি সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অস্বাভাবিক ব্যাপার হচ্ছে, তাঁর কথা শুনে মনে হচ্ছিল তিনি মুখস্থ স্ক্রিপ্ট অনুসারে কথা বলছেন (সরকারকে একদম ধুয়ে দিয়ে তিনি ঢাকার সঙ্গে অসহযোগিতার কথা বলেছিলেন, যতক্ষণ না সরকার বিপ্লবী কাউন্সিলের দাবি মেনে না নেয়)। মঞ্জুর সাধারণত শান্ত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন, তাঁর কথায় কর্তৃত্ব ছিল। কিন্তু পরবর্তী দিন সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁর সুর ভিন্ন শোনাল। নরম মনে হচ্ছিল তাঁকে, তাঁর আচরণ ছিল নিয়ন্ত্রিত। মঞ্জুরের মধ্যে কে ভর করেছিল?
একই দিন (৩১ মে) মেজর জেনারেল মঞ্জুর কর্মকর্তাদের সঙ্গে শলাপরামর্শের জন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কেন্দ্রে যান, তিনি ঢাকার সঙ্গে বিরামহীনভাবে কথা চালাতে থাকেন। আমরা এটাও জানি না, ও-প্রান্তে কে ছিলেন। তবে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, তিনি লে. জেনারেল শওকতের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কিন্তু আমার সূত্র আমাকে জানিয়েছে, সেই বৈঠকে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের পরবর্তীকালে জিয়ার খুনের সঙ্গে জড়ানো হয়েছিল, এমনকি তাঁদের অনেকেই মঞ্জুরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যও দিয়েছেন। আমার কাছে ব্যাপারটা বক্রাঘাত মনে হয় এ কারণে যে সেনানিবাসে মঞ্জুরের সঙ্গে আমাদের বৈঠকে শতাধিক কর্মকর্তা ছিলেন, যাঁরা তাঁর সঙ্গে বৈঠকের জন্য আমাদের আগেই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে কেউ বলেননি কে কাকে সমর্থন করছেন।
দুঃখজনকভাবে জিয়া হত্যার তিন সপ্তাহ পর বিচারকের খাসকামরায় অনুষ্ঠিত কোর্ট মার্শালে বিদ্রোহের কথিত নেতার ভাষ্য পাওয়া যায়নি, এই বিচারে ১৩ জন কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। আমরা কখনোই প্রকৃত ঘটনা জানব না। এই খুনের পরিকল্পনা কারা করেছিলেন, তাঁদের চিনতে পারব না। সত্য চিরকালই রহস্যাবৃত হয়ে থাকবে। আক্ষেপের ব্যাপার হচ্ছে, এটা নজির হিসেবে থেকে যাবে, আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকেও তা তাড়িয়ে বেড়াবে।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: ১৯৭৮-৮১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন। অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ (ইউপিএল, ২০০৯) গ্রন্থের লেখক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন