‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে কে কে
ইয়াহিয়া তোমায় আসামির মতো জবাব দিতেই হবে।’
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে মোকসেদ আলী সাঁই রচিত ও সুরারোপিত গানটি মনে পড়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই। স্বাধীন স্বদেশে বিজয়ের আনন্দ ম্লান হয়ে এসেছিল ছয় মাসের মাথায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে আরও বিধ্বস্ত করার জন্য অস্ত্রের ঝঙ্কার তুলেছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিসহ চরমপন্থিরা। পাকিস্তানি আশা-আকাক্সক্ষার ধারক এ চরমপন্থি ও রাজাকাররা সম্মিলিতভাবে অস্ত্রের ঝঙ্কার তুলেছিল মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে। এরা যুদ্ধের সময় বাঙালি নিধনে মত্ত ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগে। এদের সঙ্গে সংযুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধফেরত একদল উগ্রপন্থি। এরা নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দেশজুড়ে তাণ্ডব চালায়। এদের অপকর্মকাণ্ডে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ভঙ্গুর প্রশাসন গড়ে তোলা ও সচল রাখার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সেতু, কালভার্ট, কল কারখানা মেরামত ও সংস্কার কাজ যখন চলছিল, তখন সেসব আবার ভেঙে ফেলা, এমনকি উড়িয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি সর্বত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। অরাজক পরিস্থিতির ব্যাপকতা ছিল মাত্রাহীন। এদের বিরাট অংশই বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অবিশ্বাসী। পাকিস্তান ও চীনের অনুসারী এবং সাহায্যপ্রাপ্ত ছিল এরা। সামরিক বা গেরিলা প্রশিক্ষণ ছিল এদের অনেকেরই। ক্ষমতার দম্ভে এরা নিজেদের মধ্যেও সহিংস ঘটনা ঘটাত।
স্বাধীনতার পরপরই সন্ত্রাসী তৎপরতা, গুপ্তহত্যা ও সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়ে যায়। গুপ্ত ঘাতকের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং সেই সঙ্গে গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যার সংখ্যাও। থানা ও ফাঁড়ি হামলা করে অস্ত্রসহ মালামাল লুট শুধু নয়, পুলিশও হত্যা করে এরা। শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জ, মহল্লা হয়ে ওঠে নিরাপত্তাহীন ও ভীতিকর স্থান। সরকারদলীয় অনেক সংসদ সদস্যও গুপ্ত ঘাতকদের কারণে এলাকায় যেতে পারত না। কয়েকজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে। এমনকি ঈদের জামাতেও। কল কারখানা লুট, বোমা হামলা চালানো, পাট ও খাদ্য গুদামে আগুন জ্বালানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটায় চরমপন্থিরা। শ্রেণিসংগ্রামের নামে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে খতমের রাজনীতি ব্যাপক মাত্রা পায়। উত্তরবঙ্গের বহু গ্রামের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। বহু নিরীহ সাধারণ মানুষ ‘শ্রেণিশত্রু’ অভিধায় জবাই হয়। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদররা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী থাকায়, তারা এদের সঙ্গে মিশে যায় এবং ক্রমে ধর্মের জিগির তুলতে থাকে। বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতই ছিল এদের মূল লক্ষ্য। আর তা করতে পারা মানে যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি মোচন শুধু নয়, পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গড়ে তোলার পথ সুগম করা। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী চীনের অনুসারী দলগুলো। এরা দলের নামের আগে স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশ সংযুক্ত করেনি। পূর্ব পাকিস্তান, পূর্ববাংলা নামই তারা ১৯৭৮ পর্যন্ত ব্যবহার করেছে এবং তাদের দলের চেয়ারম্যান ছিলেন চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং। এরা চীনের উপনিবেশ গড়তে চেয়েছিল। আর তখন তো চীন-পাকিস্তান এক ও অভিন্ন আত্মার মতো। যে কারণে ১৯৭১ সালে নিক্সন পাকিস্তান ও ইয়াহিয়াকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। চীন ১৯৭৫-এর আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিও দেয়নি। এমনকি জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভেরও বিরোধিতা করেছে। যুদ্ধের সময়ও পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য করে। এদের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগানধারীরাও গণবাহিনী নামে সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তোলে। তাদের কাছেও প্রচুর অস্ত্র ছিল। এসব গ্রুপের পাশে ছিল আরও নানা বাহিনী।
স্বাধীনতার পর গুপ্তহত্যা ও হামলা : স্বাধীনতার পর প্রথম নাশকতামূলক, নৃশংস ও নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঘটে রাজশাহীর বাগমারায়। গোয়ালকান্দির পরিত্যক্ত জমিদারবাড়িতে একই রাতে আটজনকে জবাই করে হত্যা করে মতিন-আলাউদ্দিন-টিপু বিশ্বাসের পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি। ‘শ্রেণিশত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে এদের। কৃষক পরিবারের আবদুর রহমান, রেফাউদ্দিন তুলসী নাপি, কলিমুদ্দিন, আজহার চেয়ারম্যান, বিরু সান্যাল প্রমুখকে খতম করা হয়। সবচেয়ে মর্মান্তিক ছিল স্কুলশিক্ষক আব্বাস মাস্টার ও মোসলেমকে প্রকাশ্য দিবালোকে স্কুলঘরের দরোজার চৌকাঠে শুইয়ে জবাই করে হত্যা। স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় নাশকতামূলক হামলাটি ঘটে ১৯৭২ সালের ২৩ আগস্ট। আক্রমণের লক্ষ্যস্থল ছিল আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়। বিকালে চরমপন্থি সর্বহারা পার্টির লোকেরা হাতবোমা নিক্ষেপ করে। পরদিনের দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছে, কেউ হতাহত না হলেও অফিসের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয় বিস্ফোরণে। এ ঘটনার ২০ দিন পর তৃতীয় হামলাটি ঘটে ১৩ সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সিপিবি ও মোজাফফর ন্যাপের যৌথ সমাবেশে হাতবোমা নিক্ষেপ করা হয়। এতে ২০ জন আহত হন বলে পরদিন দৈনিক আজাদীতে উল্লেখ করা হয়। দুটি হামলাই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা ঘটিয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করা হয় খুলনায়, ২৮ ডিসেম্বের। জেলা আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবু সুফিয়ানসহ দুজন চরমপন্থিদের গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু এ ঘটনায় অত্যন্ত বেদনাক্রান্ত ও মর্মাহত হন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন