জাসদ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড চলছে রাজনীতিতে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী এ দলকে নিয়ে হঠাৎ বিতর্ক জমে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আর বিতর্কের সূত্রপাত সরকারি দল থেকেই। দীর্ঘ ৪৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত দলটির জন্ম আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সাহসী নেতাদের সমন্বয়ে। শুরু থেকেই জাসদ ছিল এ দেশের রাজনীতিতে পরম বিস্ময়। রহস্যঘেরা। ধূমকেতুর মতো সামাজিক বিপ্লব ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান আর তারুণ্যের তেজি নেতৃত্বের টানে জাসদে শুরুতে দলে দলে ছুটে এসেছিল অগণিত তরুণ। কিন্তু দিন শেষে সবাই হয়েছে বিপ্লবের নামে বিভ্রান্ত, আর সংগ্রামের নামে বিপর্যস্ত, হতাশ। নেতাদের ভ্রান্তি, লক্ষ্যহীনতা আর হঠকারিতার চরম মূল্য দিতে হয়েছে জাসদের কর্মী-সমর্থকদের। কালের বিচারে বেরিয়ে এসেছে- জাসদের বিপ্লব ছিল আসলে বিপ্লবের ভ্রান্তিবিলাস।
সম্মেলনের প্রধান অতিথি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেষ পর্যন্ত পল্টনের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু গেলেন না। তিনি যোগ দেন রেসকোর্সের সম্মেলনে। সম্মেলনের উদ্বোধন করে তিনি বললেন, গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শেষে ছাত্রলীগ কর্মীদের মাঝে স্লোগান ওঠে- ‘এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ, ত্যাগ কর সব বাদ কায়েম কর মুজিববাদ।’ একই সময়ে পল্টনের সম্মেলনে আ স ম আবদুর রব বললেন, ‘গণতন্ত্র দিয়ে সমাজতন্ত্র হবে না। মার্কসবাদই হচ্ছে মুক্তির মতবাদ।’ কর্মীদের মাঝে স্লোগান ওঠে- ‘সামাজিক বিপ্লবের পথ ধর, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম কর।’ সেদিন পল্টন ময়দানে বক্তাদের বক্তব্যে ছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জের সুর। সম্মেলনে শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে সভাপতি ও আ ফ ম মাহবুবুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। আর এ চ্যালেঞ্জেরই রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে চার মাস পর। ৩১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। জন্মের শুরুতে জাসদের দর্শন ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, সামাজিক বিপ্লব, শোষণহীন সমাজ ও মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা। দর্শন হিসেবে এসব কালের সেরা দর্শন। কিন্তু বাস্তব একটু ভিন্নতর। যে স্লোগান নিয়ে জাসদের প্রতিষ্ঠা, বাস্তবে তার লেশমাত্র আদর্শ তাদের কাজের মাঝে তখন ছিল না। শুরু থেকেই জাসদের নেপথ্য নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। স্বাধীনতার আগে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্লু আই। কর্মীরা তাকে ডাকতেন দাদা। দাদার ইচ্ছায় দলের সভাপতি হন মেজর (অব.) এম এ জলিল এবং সাধারণ সম্পাদক হন আ স ম আবদুর রব। রবের গ্রহণযোগ্যতা সে সময় সামাজিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী তরুণদের মাঝে যথেষ্টই ছিল। কিন্তু মেজর জলিলের ব্যাপারে প্রশ্ন তখনো ছিল, এখনো আছে। মেজর জলিল জীবনের শুরু থেকে জাসদে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত কখনো সমাজতান্ত্রিক মতে বিশ্বাসী ছিলেন না। কারও কারও মতে, জলিলের মধ্যে বরাবর একটা সামন্তবাদী চিন্তাধারা ছিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি বুর্জোয়া চিন্তাধারায় বেড়ে ওঠেন। সিরাজুল আলম খান সভাপতি না হয়ে জলিলকে কেন জাসদের সভাপতি করা হলো- সেই রহস্যের জট এখনো খোলেনি। মুক্তিযুদ্ধে মেজর জলিল একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলে তিনি চমক সৃষ্টি করেন। ব্যাপক পরিচিতিও লাভ করেন। এ কারণেই হয়তো তাকে সভাপতি করা। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত জাসদের সাংগঠনিক ভূমিকা ছিল অভিনব তবে দুর্বোধ্য। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সাংগঠনিক প্রভাব বিস্তারের চেয়ে জাসদ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংঘাতমূলক ভূমিকায় বেশি সক্রিয় ছিল। ফলে জনগণের সামনে জাসদের রূপ ধরা পড়ে ভিন্নভাবে। ব্যাপারটা এমনভাবে দেখা দেয়, যেন শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়ের চেয়ে ক্ষমতা দখলই ছিল জাসদের প্রধান টার্গেট। বিপ্লবের স্বপ্নে আচ্ছন্ন জাসদ বেশ কিছু ভ্রান্ত কর্মসূচি হাতে নেয়, যেগুলোয় ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় লিপ্ত বুর্জোয়া দলের চরিত্রই প্রকাশ পায়। সিরাজুল আলম খানের চে’গুয়েভারা হওয়ার স্বপ্ন দলকে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়। আর এ বিভ্রান্তির প্রাথমিক পর্যায় হলো, ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও। বুর্জোয়া সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতিতে একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে গোটা সমাজের চেহারা পরিবর্তন কখনো সম্ভব নয়। অথচ এটা জাসদ নেতারা উপলব্ধি করতে চাননি বা পারেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের জের হিসেবে হতাহত হলেন দলের বিপুলসংখ্যক কর্মী। আর গ্রেফতার হন সিনিয়র নেতারা। এ ঘটনার পর জাসদ আরও অভিনব রাজনীতিতে নামে। গঠন করে গণবাহিনী। গণবাহিনী গঠনের কারণ হিসেবে বলা হয়, যেহেতু ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, সেহেতু বলপ্রয়োগ করেই তাদের উচ্ছেদ করতে হবে। মার্কসীয় এ ব্যাখ্যার আলোকে গণবাহিনী গঠন করা হলেও মার্কসীয় মতবাদকে পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করেনি জাসদ। মহামতি মার্কস বলেছেন, ‘পুরাতন সমাজব্যবস্থার গর্ভে নতুন সমাজ রূপ লাভ করার পরই দরকার বলপ্রয়োগ। এর আগে নয়।’ ’৭৪ ও ’৭৫ সালের বলপ্রয়োগের মতো কোনো পরিস্থিতির জন্ম হয়নি। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় না, সঠিক বিপ্লবী ভাবধারা থেকে জাসদ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল? আর জাসদ গণঅভ্যুত্থানের যে চেষ্টায় লিপ্ত ছিল, সে পরিস্থিতিও তখন ছিল না। লেনিনের মতে, ‘অভ্যুত্থান কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কোনো দলের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। সমাজের ক্রান্তিলগ্নে যখন পরিবর্তনকামী মানুষ তাদের অগ্রণী বাহিনীর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ হবে তখনই অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি পেকে উঠবে।’ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাসদ গণঅভ্যুত্থানের যে চেষ্টা চালায় তাও বাস্তবানুগ ছিল না। বিপ্লবের পর্যাপ্ত উপাদান ও অনুকূল পরিস্থিতি তখন ছিল না। তবে ’৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এ উপমহাদেশে প্রথম সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সম্পর্কে পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টি নেতা কমরেড ফরহাদ বলেছিলেন, ‘জাসদ এ ধরনের উদ্যোগ নেবে জানলে আমরাও সহযোগিতার হাত বাড়াতাম।’ এখানে আরেকটি রহস্য ছিল বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে সিরাজুল আলম খান এক দিনের জন্যও আটক হননি। শুধু তাই নয়, ১৫ আগস্ট তিনি ছিলেন ভারতে। এর আগে তার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই তিনি ঢাকা ছেড়েছিলেন। সিরাজুল আলম খান এ নিয়েও কখনো মুখ খোলেননি। জাসদ তৈরিতে ভারতের ভূমিকা ছিল বলে যে গুজব ছিল তা নিয়েও আজ পর্যন্ত কেউ কোনো কিছু স্পষ্ট করেননি। তাদের ভারতীয় হাইকমিশন ঘেরাও কর্মসূচি নিয়েও রহস্য ও হঠকারিতা ছিল। ’৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর জলিল, রব, কর্নেল (অব.) তাহেরসহ গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তির জন্য জাসদ ভারতীয় দূতাবাসে কমান্ডো হামলা চালায়। তাদের টার্গেট ছিল হাইকমিশনারকে হাইজ্যাক করে দাবি আদায় করা। কিন্তু হাইকমিশনের নিরাপত্তারক্ষীরা সে হামলা তছনছ করে দেন। পাল্টা প্রতিরোধে ঝরে পড়ে জাসদের কয়েক কর্মীর প্রাণ। আটক হন অনেকে। সেই হামলাকারীদের একজন এখন আওয়ামী লীগের এমপি। শুধু হঠকারী কর্মসূচি নয়, দলে অভ্যন্তরীণ বিরোধও ছিল সেই শুরু থেকেই। সিরাজুল আলম খান রহস্যময় নেতা হিসেবে ঐক্য ধরে রাখেন। কিন্তু বিপর্যয় শুরু জিয়াউর রহমানের আমলে। ৭ নভেম্বরের ব্যর্থতায় ফাঁসি হয় কর্নেল তাহেরের। এর মাঝে ১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট সরকার ঘোষিত পিপিআরের অধীনে জাসদ রাজনৈতিক অনুমোদন লাভ করে। একই বছর দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক গণবাহিনী বাতিল করা হয়। গণবাহিনী বাতিল, অ্যাকশনধর্মী তৎপরতা হ্রাস জিয়ার পদক্ষেপকে পরোক্ষ সমর্থন বলে প্রশ্নের সৃষ্টি করে। ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে কলহ-বিবাদের মধ্যেও জাসদ কিছুটা সক্রিয় ছিল। নেতাদের জেলে রেখে দলের একটি অংশ ’৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু আ স ম রব কারাগার থেকে নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভও ব্যক্ত করেছিলেন। নির্বাচনে জাসদ ৯টি আসন পায়। ’৭৯ সালের শেষ দিকে দলে রাজনৈতিক বিরোধ চরমে। ’৮০ সালে জাসদ নেতারা দাদার ইঙ্গিতে ১৮ দফার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থনই বিপর্যয় বাধে। তা ছাড়া অস্পষ্ট পেটি বুর্জোয়া চিন্তাচেতনা তৎকালীন ছাত্র-যুব নেতৃত্বের কাছে রহস্যময় ঠেকে; যার পরিপ্রেক্ষিতে জাসদের যুব নেতৃত্ব প্রকাশ্য প্রতিবাদ জানায়। এ ঘটনার জের হিসেবে ’৮০ সালের ১৪ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতির ঝড় বয়ে যায়।’৮০ সালের সেই পরিস্থিতি নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আ স ম রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে তারা দুজন দুজনের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ করেন। এর কিছু দিন পর ৭ নভেম্বর জাসদ থেকে বেরিয়ে আসা নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ’-এর জন্ম হয়। এ ভাঙনে জাসদ রাজনীতির ভিত কেঁপে ওঠে। ভাঙন সম্পর্কে পরবর্তীতে সাপ্তাহিক ‘ঢাকা’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘জাসদ ভাঙার কারণটা ছিল রাজনৈতিক। গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের নামে বুর্জোয়া তোষণকারী একটা ভুল রাজনীতি অনুসরণ করেছিল তারা। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বললেও পরিচালিকা শক্তি শ্রমিক শ্রেণির পার্টির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়েছিল। আমাদের প্রথম সফলতা আমরা একটা ভুল রাজনীতি বর্জন করে সঠিক রাজনীতি অনুশীলনের চেষ্টা করছি।’জাসদ ভেঙে বাসদ গঠিত হওয়ার পর বাসদেও নেতৃত্বের বিরোধ দেখা দেয়। ’৮৩ সালের ৫ নভেম্বর দলের এক বৈঠকে খালেকুজ্জামান ভূইয়াকে পার্টির আহ্বায়কের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আ ফ ম মাহবুবুল হককে নতুন আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। খালেকুজ্জামান ভূইয়া আলাদা আরেকটি বাসদের নেতৃত্ব দেন। ভাঙন সম্পর্কে বাসদের সাম্যবাদ গ্রন্থে বলা হয়, ‘খালেকুজ্জামান, মবিনুল হায়দার চৌধুরী বিশ্বাস করেন SUCI (Socielist unity centre of India) নেতা শিব দাস ঘোষ এ যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সঠিক ধারণার বাহক। বাস্তব হলো দুই বাসদের মধ্যে টিকে আছেন খালেকুজ্জামান সমর্থকরা। ১৯৮০ সালের পর জাসদে শান্তি ছিল না। বিভক্তির পর দলে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করেন হাসানুল হক ইনু, কাজী আরেফ আহমেদ, শরিফ নুরুল আম্বিয়া ও মার্শাল মণি। আর সে সময় আ স ম রব, মেজর (অব.) এম এ জলিল, শাজাহান সিরাজদের প্রভাব কমতে থাকে। আর জাসদের ওপর রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খানের প্রভাব প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে মেজর (অব.) জলিল রাজনীতি ছেড়ে আদম ব্যবসায় নামেন। আদম ব্যবসায় কিছু উন্নতি করার পর যোগ দেন হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে। সেখান থেকে বেরিয়ে আলাদাভাবে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামে সাইনবোর্ড-সর্বস্ব মৌলবাদী একটি দল গঠন করেন। একই সময় আ স ম আবদুর রব মাগুর মাছের খামার শুরু করেন। শাজাহান সিরাজ বাকি থাকবেন কেন! তিনিও ব্যবসা-বাণিজ্যের সন্ধানে নামেন। এভাবে কিছু দিন কেটে যায়। তারপর আবার রব ও শাজাহান সিরাজ রাজনীতিতে সক্রিয় হন। যথারীতি রবের পেছনে এসে দাঁড়ান সিরাজুল আলম খান। এক পর্যায়ে নেতৃত্ব নিয়ে রবের সঙ্গে ইনুর বিরোধ বাধে। রব আলাদা অবস্থান নেন। সিরাজুল আলম খান সমর্থন দেন আ স ম রবকে। রব ’৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনে গঠিত সংসদে বিরোধী দলের নেতা হন। এর আগে দলটি ভেঙে তৈরি হয় তিন জাসদ হয়- জাসদ রব, জাসদ সিরাজ, জাসদ ইনু। কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। ’৮৬ সালের নির্বাচনে ইনু ‘নির্বাচনে গেল যারা জাতীয় বেইমান তারা’ স্লোগান দিয়ে ১৫ দল থেকে বেরিয়ে আসেন। শাজাহান সিরাজ যান নির্বাচনে। এ ভাঙনে লাভবান হন হাসানুল হক ইনু। কারণ কাজী আরেফ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মার্শাল মণিসহ দলের মূল অংশ তার পক্ষে আসে। এমনকি শিরীন আখতার, ডা. মুশতাক হোসেন, নাজমুল হক প্রধানসহ ছাত্রলীগ আরেফ ও ইনুর প্রতি আস্থা রেখে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখে। পরে ডাকসু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐকমত্যে সুলতান মনসুরের সঙ্গে মুশতাক জিএস হন। এদিকে শাজাহান সিরাজের জাসদ ’৮৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে আরেক দফা ভাঙনের শিকার হয়। এবারের ভাঙনের জন্যও শাজাহান সিরাজকে দায়ী করা হয়। কারণ, শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়। অন্যদিকে, মীর্জা সুলতান রাজা আলাদা জাসদ গঠন করেন। তার নেতৃত্বাধীন জাসদ মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে এরপর আরেকবার ভাঙে। জাসদের ভাঙাগড়া নিয়ে আশির দশকে অনেক লেখালেখি হয়েছিল। বিশিষ্ট লেখক আহমদ ছফা সাপ্তাহিক ‘উত্তরণ’-এ ‘জাসদের রাজনীতি একটি সেন্টিমেন্টাল মূল্যায়ন’ শীর্ষক নিবন্ধে দলীয় রাজনৈতিক ব্যর্থতা, হঠকারিতা ও সুবিধাবাদী নীতির জন্য মূল তিনজন নেতাকে দায়ী করেন। তিনি লেখেন, বহু তরুণের সম্ভাবনাময় জীবন ও রক্তের বিনিময়ে এই স্বনামখ্যাত ‘বিপ্লবী’ নেতারা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে একাধিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন। বিপ্লব ছেড়ে কেউ কেউ সরকারের দালালিতে নিজেদের নিয়োজিত রাখছেন। আহমদ ছফা জাসদ রাজনীতির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সংযোগ ও সহমর্মিতার কথা উল্লেখ করে বলেন, আজকাল অনেক বুদ্ধিজীবী কথায় কথায় জাসদের সমালোচনা করেন। অথচ একালে তারাই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে জাসদ কর্মীদের রাজনৈতিক তালিম দিতে এগিয়ে যেতেন। আমি যখন জাসদের সমালোচনা করি তখন মনে হয় আমার নিজের বুকে ছুরি চালাচ্ছি। এ ব্যর্থতা ও ভণ্ডামির জন্য তিন নেতা আ স ম আবদুর রব, মেজর (অব.) জলিল ও সিরাজুল আলম খানকে যদি খুন করতে পারতামতাহলে নিজের এ অনুতাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতাম।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন